মারিয়া,পর্ব:১৭

“মারিয়া”
পর্ব:- ১৭
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
~~~~~~~~~~~~~~~

দু’দিন পর,
রাফির বাহিরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। এখন অবধি সে রিমিকে ডিভোর্স পেপার দেখায়নি। সে শুধু এই দু’দিন রিমিকে একটু বুঝার চেষ্টা করেছে। আসলেই এতগুলো বছর কি রিমির মনে রাফির প্রতি একবিন্দু ভালোবাসা জন্মায়নি? তার কাছে এতই সস্তা আর ঠুনকো ছিল রাফি?
মারিয়ার যেদিন হুঁশ ফিরে, সেদিনই ওকে দেখে রাফি আর রিমি নিজেদের বাসায় চলে যায়। তাদের মধ্যে কোনো কথা হলো না। এমনকি এক বিছানায় একসাথে ঘুমায়‌ওনি। রাফি ভালো করেই বুঝলো, রিমির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। শুধুমাত্র না পারতে সে রাফির সাথে এক ছাদের নিচে। সারারাত রাফির আর ঘুম হলো না। নির্ঘুম একটা রাত নিমিষেই নিজের মতো চলে গেল…

সকালে যখন রিমি ফ্রেশ হতে বেডরুমে আসে। তখন রাফি ঘুমে বেঘোর! উপুড় হয়ে ওয়ালেট হাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ওয়ালেটের দিকে তাকাতেই রিমির ছবি স্পষ্ট হয়…..

আর দাঁড়ায় না রিমি। চুপচাপ ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ওর বুকের ভিতর ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে! ও কাকে বুঝাবে যে কত বড়ো ভুল সে করেছে! স্বার্থপর সে, স্বার্থপর!

কান্নায় ভেঙে পড়ে রিমি। এখন চাইলেও কিছু ঠিক করা যাবে না। চাইলেও সে রাফিকে বুঝাতে পারবে না যে, সে রাফির সাথে কত বড়ো অন্যায় করেছে, রাফির কাছে সে মাফ চাইতে তৎপর!
মুখে হাত চেপে নিঃশব্দে কাঁদে রিমি। শব্দ হলে রাফি জেগে যাবে। সে রাফির সামনে আর দাঁড়াতে চায় না…কোন মুখেই বা দাঁড়াবে?

•••••

“শান্ত, তুমি কিছু খাবে?”
ইয়াসিরের কথায় সোজা হয়ে বসে শান্ত। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে না করে দেয়। ইয়াসির লক্ষ করে, সে অমনোযোগী! শান্তর পাশে বসে বলল,
“কী নিয়ে চিন্তা করছ?”
শান্ত স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“ভাইয়া, বুবুর চিকিৎসায় যে এত টাকা খরচ হচ্ছে। এগুলো কীভাবে দিতে হবে?”
ইয়াসির ফিক করে হেসে দেয়। একটু আরাম করে বসে সে,
“এতে এত চিন্তার কী আছে? তোমার আপুর এই কেস সিবিআইয়ের হাতে। যা খরচ ওরা দিবে।”
শান্তর চোখ চিকচিক করে। এই দু’দিন সে বোনের ব্যাপারে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। এবার সুযোগ পেয়ে বলল,
“বুবুকে কি ওরা অনেক টর্চার করেছে?”
ইয়াসির চুপ হয়ে যায়। শান্তর কথায় যেমন করে হাসছিল, মুহূর্তেই সে হাসি উবে যায়। শান্তর দিকে তাকায় সে। বলল,
“তোমার বুবু সুস্থ হোক। এরপর তার মুখেই শুনো।”
শান্ত মাথা নাড়ায়। খানিকবাদে আবার বলল,
“কাল যে অফিসারগুলো আসছিল। ওরা কি আবার আসবে?”
“হুঁ। কাল তো ডাক্তাররা কথা বলার পারমিশন দেয়নি। মাত্র তো তার হুঁশ ফিরেছে। আরেকটু অ্যাবল হোক সে। এরপরই তুমি সব জানতে পারবে।”

কিছুমুহূর্ত দু’জনেই চুপ। এবার ইয়াসির বলল,
“তোমার বাসায় কেউ নেই? তুমি যে একা আসছ?”
“আমাদের বাবা নেই, মারা গেছেন। আর মা নেই।”
নির্লিপ্তকণ্ঠে শান্ত জবাব দেয়। ইয়াসির ওহ্ বলে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু হুট করে তার মনে পড়লো,
মারিয়া তো তাকে এসব বলেনি। মারিয়া আর শান্তর কথায় সে কোনো মিল খুঁজে পায় না। শান্তকে জিজ্ঞেস করবে ভেবেও সে আর কিছু বলল না। এই ঝামেলা যাক, তখন জানা যাবে!

•••••

সিবিআইয়ের চারজন অফিসার এসেছিল কাল। মারিয়ার মাত্র জ্ঞান ফিরেছে, শরীরের দুর্বলতা কাটেনি। অবশের মতো পড়ে আছে সে। তাই আর তাদেরকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে তারা ইয়াসিরকে এটা জানিয়েছে যে, মর্গানের বাড়ির পিছনের ইয়ার্ডে দু’টো না, পাঁচটা লাশ পাওয়া গেছে। কংকালসার সব। এগুলো এখনও ফরেনসিক ল্যাবে। কাজ চলছে।

পরবর্তীতে আপডেট জানানো হবে ইয়াসিরকে, বলে তারা চলে যায়।

•••••

একা বাসায় সুরাইয়া বেগমের দম ঘুঁটছে। অথচ এই ক’দিন সে দিব্যি ছেলে আর মেয়ের কথা না ভেবে নিজের শরীর বিলিয়েছে। শান্ত যাওয়ার পর একটা ফোন অবধি করেনি। বরং তিনি ফোন দিলেও সে বারবার কেটে দিচ্ছে। মেয়ের কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, কই আছে মেয়েটা, কিছুই তিনি জানেন না। বাসায় বসে থেকে তার দম বন্ধ লাগছে। ওদিকে ক্লায়েন্টরা ফোন দিচ্ছে। কেউ ইমার্য্যানসি চায়, কেউ দুঘণ্টা পর। কাউকেই তিনি হ্যাঁ বলতে পারছেন না।

অন্ধকার ঘর। ঘরের দরজা জানালা লাগানো, পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে রাখা। খাটের সাথে লেগে বসে আছেন সুরাইয়া বেগম। তিনি অন্ধকার জগতে মোহাচ্ছন্ন! শত চেষ্টায়ও তিনি নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। তার অবশিষ্ট কিছুই নেই… না আছে স্বামী, না সন্তান, না বেঁচে থাকার কোনো শান্তির জায়গা!
মনে মনে সুরাইয়া বেগম অনেক বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। ফ্লোর থেকে ছুরিটা উঠিয়ে কচ করে বাঁ হাতের কব্জিতে চালিয়ে দিলেন, নির্দ্বিধায়!
আরও একবার পচ দিলেন। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে গরম রক্ত স্রোতের মতো গড়িয়ে পড়ছে… তিনি তো এটাই চাইছিলেন। একটা সময় হেলে পড়লেন তিনি। ফ্লোর রক্তে ভিজে একাকার!

•••••

বিকেলের ভেতরেই ফরেনসিক ল্যাব থেকে রিপোর্ট চলে আসে। দারোয়ান ও তার স্ত্রী স্বীকার করেছিল, এখানে মর্গানের ওয়াইফ ও তার মেয়ের লাশও ছিল। ডিএনএর মাধ্যমে ওটাও ক্লিয়ার হয়।

সিবিআইয়ের কাছে এরকম একটা কেস যাবে, তারা ভাবতেও পারেনি। দিনদিন মানুষ কতটা হিংস্র হচ্ছে, তাদের অত্যাচারের মাত্রা কী পরিমাণের বেড়ে চলছে!

মর্গানকে দ্রুতই আদালতে পেশ করা হয়। কোর্ট থেকে তার ফাঁসির রায় শুনানো হয়। সিবিআই মারিয়ার মুখ থেকে ওর সাথে হওয়া নির্যাতনের আদ্যোপান্ত শুনে। সেগুলো নোট করে আদালতে পেশ করেই কোর্ট থেকে মর্গানের উপর করা নজরদারির হুকুম দেওয়া হয়। সাথে সিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হয়, মারিয়া নামের মেয়েটির সুস্থ হতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে!

*****
শান্ত যখন এসব শুনছিল, ওর মনে শুধু একটাই প্রশ্ন থেকে যায়, বুবুকে মায়ের ব্যাপারে কীভাবে বলবে সে? কিন্তু না বলেও কি পার পাওয়া যাবে?
সে আর মারিয়াকে কিছু বলল না। সুযোগ হোক, সব বলা যাবে!

রাতে মারিয়ার কেবিনে শান্তই রয়ে যায়। ইয়াসির সবকিছু দেখেশুনে শান্তকে বলল,
“তুমি থাকতে পারবে?”
“হুঁ। আপনি চলে যান।”
ইয়াসির আর আপত্তি করলো না। কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে বাসায়ও গেল না। করিডোরে বসে থাকে।

মারিয়ার কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা। সে ঠিক করে কথা বলতে পারে না এখনও। শান্ত আর ধৈর্য ধরতে পারে না। হড়বড় করে মারিয়াকে সব বলে দেয়। শেষে বুবু কষ্ট পেয়েছে বলে হয়তো চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রেখেছে ভাবে, কিন্তু সে ভুল প্রমাণিত হয়। মারিয়াকে যখন ধাক্কা দিয়েও শান্ত কোনো সাড়া পায়নি, জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে সে। কেবিনের বাহির থেকে ইয়াসির ছুটে আসে। মারিয়াকে বেহুঁশ দেখে সে ইমারজেন্সি ডাক্তার ডেকে আনে। মারিয়া টলারেট করতে পারেনি। শি গট আ স্ট্রোক!
শান্ত সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ইয়াসির বারবার তাকে জিজ্ঞেস করে, কী এমন হয়েছে যে মারিয়ার এই অবস্থা? বলবে না ভেবেও শান্ত বাধ্য হয়। মারিয়ার স্ট্রোকের নিউজ শুনে সাথে সাথে হেড কোয়ার্টার থেকে ক’জন পুলিশ আসে। শান্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তারা সব শুনে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পুলিশ ফোর্সের একটা টিম ঢাকায় যাবে। হুট করে দু’টো মানুষের মাথার উপর ছায়া সরে গেলে হয় না। মারিয়ার মা যদি ওষুধ না খাইয়ে তার স্বামীকে মেরে ফেলে, এটাও একটা ক্রাইম! তাকে ধরতেই হবে।

*****
পুলিশ টিম ঢাকায় পৌঁছেই মারিয়াদের ফ্ল্যাটে যায়। সেখানের আশেপাশের লোক থেকে জানে, মহিলার চরিত্র ভালো ছিল না। ক’দিন আগে সুইসাইড করে। পরে ফ্ল্যাট থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরুলে পুলিশকে ডাকা হয়। তারাই এসে লাশ নিয়ে যায়। আর কিছু তারা বলতে পারে না। সিবিআই টিম এবার সরাসরি থানায় যায়। গিয়েই বুঝতে পারে, সুইসাইড কেস আর দু’দিন পর লাশ বের করায় তারা কোনো তাড়াহুড়ো করছে না। কেসের প্রতি কোনো দায়িত্বশীলতা নেই তাদের!

নিজের থেকে সিবিআই তাদের হাতে কেস হ্যান্ডেল করে। তাদের সন্দেহ, সুদূর ঢাকা থেকে একটা মেয়ে সামান্য চাকরির জন্য অন্য শহরে যায়। এর সম্পর্কে কি তার পরিবার জানতো না? আর সুইসাইডের কারণ কী!

“চলবে”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here