মারিয়া,পর্ব:১৮

“মারিয়া”
পর্ব:- ১৮
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
~~~~~~~~~~~~~~~

মারিয়াদের আদ্যোপান্ত জেনে সিবিআইয়ের অফিসারগণ তিনদিনের দিন ঢাকা ছাড়েন। সব ইনফরমেশন নিয়ে তারা হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসেন। মর্গানের সাথে সুরাইয়া বেগমের কোনো না কোনোভাবে যোগসূত্র ছিল। আর সিবিআই যেটা সন্দেহ করে, সুরাইয়া বেগমের ইচ্ছেতেই তার মেয়ে মারিয়া মর্গানের বাড়িতে উঠে।

“রায় শুনানোর পর নতুন করে তথ্য বের হচ্ছে। এখন একমাত্র মারিয়ার হাতেই সব, শেষ সাক্ষী সে! আর এই মুহূর্তে শি গট আ স্ট্রোক! ডেম ইট!” একজন অফিসারের তেজী কণ্ঠ শোনা গেল। পাশ থেকে অন্য একজন বললেন,
“ইউ আর রাইট রায়ান! কিন্তু মারিয়া নামের মেয়েটার এই মুহূর্তে স্ট্রোক আসার কারণ কী? নিশ্চয়ই এমন কিছু সে শুনেছে… ওর ছোটো ভাই ছিল না লাস্টবার?”
“ইয়াহ”
“তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে?”
“সে নাকি কিছু বলতে চাইছে না। আর ভয়ে আছে খুব!”
“ওহো… ইয়াসির?”
অফিসার রায়ান আর কিছু বললেন না। সুযোগ পেয়ে পিছন থেকে আরেকজন বললেন,
“ইয়াসির কে কি সন্দেহ করা যায় না?”
কথাটা শুনে রায়ানসহ বাকি দু’জন অফিসারও চমকে গেলেন। রায়ান এই প্রসঙ্গের বিরোধিতা করেন। বললেন,
“ইয়াসির আর তার বন্ধুরাই তো মারিয়ার পাশে ছিল। ওরা কীভাবে?”
“কেন হতে পারে না?”
রায়ানকে কিছুটা ইতস্তত বোধ করতে দেখা যায়। সে কেন যেন এটা মানতে পারছে না। বলল,
“সন্দেহ থেকে কেউই দূরে নয়। তবুও আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ইয়াসির ছেলেটা মারিয়াকে ভালোবাসে। সে এরকমটা করবে না!”
“তাহলে ওর বন্ধুদের মাঝে কেউ?”
“জানি না… হতে পারে!”

~~~

মারিয়ার অবস্থার উপর তার ডিসচার্জ ডিপেন্ড করছে। শান্তকে কোনো অবস্থাতেই সামলে রাখা যাচ্ছে না। সে বারবার বিড়বিড় করে বলছে,
“আমি বুবুকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি ওকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
ইয়াসির একা হাতে সবদিক সামলাতে হাঁপিয়ে উঠছে। তার নিজের অফিস, কাজ, আবার হাসপাতালে এসে থাকাটা, হাঁপিয়ে উঠছে সে। কিন্তু শান্তকে এভাবে একাও রাখা যায় না। বাধ্য হয়ে সে শান্তকে জোর করে বাসায় নিয়ে যায়। তাকে সামলে বলল,
“ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তোমার বুবু সুস্থ হবে। দুয়া করো।”

ফ্রেশ হয়ে এসে শান্ত লম্বা ঘুম দিলো। ক’দিনের ধকল হয়তো এই ঘুমেই কাটবে!

~~~

ডাক্তাররা আশা হারিয়ে ফেললেও ইয়াসির মনে জোর রাখে। স্ট্রোকের পরও যখন মারিয়ার হুশ আসছিল না, সবাই চাচ্ছিল একটা মিরাক্যাল ঘটতে। কোনো যাদু ঘটে যাক, আর মারিয়া চোখ খুলুক।

রাত ন’টার দিকে ইয়াসির আর শান্ত রুমে প্রবেশ করে। শান্ত মারিয়ার বেডের পাশের টুলেই ধুপ করে বসে পড়ে। ক’দিন ধরে সে বুবুর অপেক্ষায়। একটু কথা বলুক বুবু!
ইয়াসির দূর থেকে ভাইবোনকে দেখে। শান্তকে দেখে তার রাফির কথা মনে হয়। রাফি বন্ধু হয়েও সবসময় তার ভাইয়ের জায়গায় ছিল! অথচ এই মুহূর্তে সে রাফিকে কোনো সাহায্যও করতে পারল না।

শান্ত যখন মারিয়ার সাথে কথা বলছিল, হুট করেই সে টের পায় মারিয়া ধীরে ধীরে চোখ খুলছে। চিল্লিয়ে উঠে সে। পিছন থেকে ইয়াসির এগিয়ে আসে। মারিয়ার জ্ঞান ফিরতে দেখে সে ডাক্তার ডেকে আনে। সত্যিই তবে মীরাক্যালটা ঘটলো!

ডাক্তাররা এবার খুব স্ট্রিকটলি সব মেইনটেইন করেন। মারিয়ার এভাবে হুঁশ আসাটা পুরো সিবিআই টিমের কাছে অনেককিছু। এবার আর কোনো গাফিলতি করা যাবে না!

~~~

সিবিআই টিমের সন্দেহ দূর হয়। রিমি নামের যে মেয়েটা ছিল, সে নিজে থেকে এসেই দোষ স্বীকার করে। মারিয়া পালিয়ে আসার পর সেই মর্গানকে মারিয়ার খোঁজ দেয়। তাকেও অ্যারেস্ট করা হয়। রাফির কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়! রিমি যবে শেষবার তার কাছে এসেছিল, ঐদিন রাতে-

“রাফি, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”
রাফি অন্যপাশে ঘুরে দাঁড়ায়। রিমির দিকে না তাকিয়েই বলল,
“কাজ করছি। তুমি বলো।”
রিমি রাফির দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে রইলো। জোর করে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“আমাকে মাফ করে দিয়ো। আমি নিজের কাছেই ছোটো হয়ে গেছি এখন। তোমার সামনে দাঁড়ানোর সাহস অবধি নেই আমার। তবুও বলছি, আমাকে মাফ করে দিয়ো। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের চিন্তা করেছি…”
“হুঁ”
“রাফি? আমি এর থেকেও জঘন্য একটা পাপ করেছি। যেটা কেউ জানে না। একদিন জানতে পারবে। কিন্তু প্লিজ আমায় মাফ করে দিয়ো। আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম…”
রাফি জিজ্ঞেস করতে চায়, কী পাপ? করলো না আর। রিমিকে ওর মতো থাকতে দিয়ে সে চলে যায়।

সিবিআই টিমের কেস শেষ হয়। সব দায়-ঝামেলা শেষ তাদের। কেস নিয়ে আর কোনো প্রেসার নেই। মূল ঘটনা ছিল-
“অনলাইন জব সেক্টর নামের একটা পেইজে যখন মারিয়া জবের অ্যাপ্লাই করে, সেটা সাথে সাথে কনফার্ম হয়ে যায়। সে মুহূর্তে মারিয়ার বাবা হাসপাতালে ভর্তি। কার এক্সিডেন্ট এ তিনি তার পা হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত টাকার দরকার হওয়ায় মারিয়া জব খুঁজতে থাকে। ঘটনাচক্রে মারিয়ার যোগাযোগ হয় মর্গানের সাথে। মারিয়ার যেন কোনোরূপ সন্দেহ না হয়, তিনি দাড়োয়ানের স্ত্রীকে দিয়ে বাড়ির মালকিনের মতো কথা বলায়। আর বাকি কাহিনী সবটুকু ক্লিয়ার! মারিয়া অপরিচিত এক শহরে মর্গানের মতো এক বিকৃত মস্তিষ্কের লোকের হাতে পড়ে, যে তার ওয়াইফ আর স্ত্রীকে মেরে রক্ত সংগ্রহ করতেও দ্বিধা করেনি!”

~~~

দেড় মাস কেটে যায়।
মারিয়া এখন পুরোপুরি সুস্থ। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ দেওয়ার পর শান্ত ভেজা কণ্ঠে বলছিল,
“বুবু কই যাব আমরা? আব্বু আম্মু কেউ নাই!”
ভাইকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে মারিয়া। কপালে চুমু এঁকে বলল,
“আগে ঢাকায় ফিরি। এরপর দেখা যাবে। আমি আছি তো?”
শান্ত মাথা দোলায়।

“তো মারিয়া, চলে যাবে?”
“জি… আপনাকে ধন্যবাদ ইয়াসির। আমার অনেক দেখাশোনা করেছেন। আমি সবসময় আপনার কাছে ঋণী থাকব।”
ইয়াসির মুচকি হাসে, নিষ্প্রাণ সে হাসি। বলল,
“এখানে আর আসবে না?”
“দেখা যাক। যদি কখনও এই শহরকে অনেক মনে পড়ে, তাহলে আসা হবে।”
ইয়াসির হাসে। ওদেরকে সময় দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

“ইয়াসির?”
“হুঁ, বল।”
“বললি না কেন ওকে?”
“এমনই…”
“তোর মাথা নষ্ট? বলে দিলেই পারতি?”
“ইচ্ছে করেনি।”
রাফি বিরক্তির সাথে তাকিয়ে রইলো। অসহ্যকর একটা ছেলে! সবসময় নিজের মর্জিতে চলে। রাফি ভাবে, একটা কাজ করলে কেমন হয়? মারিয়াকে ইশারা দিক সে? ভাগ্যে থাকলে কিছু জুটতেও পারে? তার ভালোবাসা তো আর পূর্ণতা পেল না। বন্ধুরটা পাক!

~~~

ঢাকাগামী বাসে উঠে ব্যাগ ঠিকমতো রেখে ইয়াসির নেমে আসে। পিছু পিছু মারিয়াও নেমে আসলো। ইয়াসির অবাক হয়ে বলল,
“কিছু লাগলে বলো, এনে দেই। তোমার নানার দরকার কী? একটু সাবধানে হাঁটাচলা করো।”
“হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা চিরকুট বের করে মারিয়া। সাথে বলল,
“বাস ছাড়তে দেরি আছে। আমি বলতে চাইছিলাম, আপনার প্রেমিকার জিনিসগুলো আমি সুন্দর করে রেখে এসেছি। চাইলে এটাও রাখতে পারেন।”
ইয়াসির চিরকুট খুলে। কাগজে নাম্বার লেখা। মারিয়া আবার বলল,
“আমাদের তো ঢাকাতেই সব। নয়তো থেকেই যেতাম। এই শহর আমার খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে আছে একেবারেই থেকে যাওয়ার! পৌঁছে আপনাকে ফোন দিব।”
ইয়াসির বোকা বনে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদিকে বাস ছেড়ে দিচ্ছে দেখে মারিয়া দ্রুত উঠে যায়। ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিদায় জানায় সে।

রাফি কিছুদূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। ইয়াসিরকে কাছে আসতে দেখেই দু’পাটি দাঁত বের করে বলল,
“কী দোস্ত? কেমন আছিস?”
ইয়াসির মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“তুই না বাইরে যাস? এখনও দেশে পড়ে আছিস কেন?”
বাইকে উঠতে উঠতে রাফি বলল,
“ভাবছি দোস্তর বিয়েটা খেয়েই যাই। অন্তত কারও সুখ দেখে গেলাম?”

~~~

দু’বছর পর,
আমেরিকায় রাফির এখন সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটে। এখানের কোর্স কমপ্লিট করে ডিউটি জয়েন করেছিল সে। এরপর থেকে আর পিছনের কালো স্মৃতিগুলো তাকে অন্ধকারে ঢেকে দিতে পারেনি। হাসপাতাল, রুগী, হাসপাতাল করেই তার দিন কেটে যায়।

তিনদিন ধরে মারিয়া আর ইয়াসির তাকে ফোন দিচ্ছে, মেইল করছে, কোনো খবর নেই রাফির। আজকে একটু ফ্রী হলো সে। ইয়াসিরকে ফিরতি কল দিতেই সাথে সাথে রিসিভ হয়,
“রাফি ভাই, তুমি আসলেই ভুলে গেলে আমাদের!”
রাফি হো হো করে হেসে উঠলো।
“এত সহজে কি আর ভুলা যায় মারিয়া? সরি ফর লেট রিপ্লাই। এখন বলো, কেমন চলছে?”

এরপর টুকটাক কথা চলে। খানিকপর ইয়াসিরের গম্ভীর কণ্ঠ শুনা গেল,
“রাফি, এদিকে হুট করে মেয়েদের গুম হওয়া শুরু হয়েছে। ঠিক দু’দিন পরপর নাকি একটা করে মেয়ে হারাচ্ছে। মিসিং ডায়েরি লেখার পরও কোনো খবর নেই।”
রাফি চমকে উঠে।
“মানে?”
“হুঁ”
মারিয়া ইয়াসিরের পিঠে হালকা বাড়ি দিয়ে বলল,
“অযথা একটা মানুষকে ভয় দেখানো। রাফি ভাই, এইগুলো কিছুই হচ্ছে না! অযথা কথা!”
রাফি ঈষৎ রাগ দেখায় ইয়াসিরের উপর। ইয়াসির বলল,
“এটা হচ্ছে তিনদিন পর ফোন দেওয়ার শাস্তি।”
তিনজনেই সমস্বরে হেসে উঠে।
~~~

মাঝরাত।
নিস্তব্ধ শহর।
নিয়ন আলোর বাতি জ্বলছে দূর অবধি। মর্গান ভিলা রেস্ট্রিক্টেড। সিবিআইয়ের তরফ থেকে এ বাড়ি কেনাবেচা বন্ধ করা হয়েছে।
হুট করেই বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডের বাতি জ্বলে উঠে। আবছা হলুদ বাতি। ডিপ থেকে কেউ রক্তের ব্যাগ বের করছে। তার এখন রক্ত প্রয়োজন!

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here