#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ১৯
৪৯।
প্রায় একহাত দূরত্ব রেখে তার সাথে একই বেঞ্চে বসে আছে যুবক। একবার আশেপাশে দেখে নিলো সে। না, পার্কের সবাই প্রেমিকার গা ঘেঁষে বসে তাদের উষ্ণতা নিতে ব্যস্ত। অথচ, পাশের পুরুষটি তার নিকাব থেকে শুধুমাত্র মুক্ত থাকা চোখ দুটো দেখতে ব্যস্ত। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো লোকটার মুখশ্রীর দিকে। উজ্জ্বল শ্যামা গড়নে ঘন পাপড়িযুক্ত দুটো আঁখি, তীক্ষ্ম নাক, চিকন হালকা গোলাপি ঠোঁটজোড়া, যেন এক রাজপুত্র।
আনমনেই ভাবলো,
“এই রাজপুত্রের কি মানায় আমার সাথে?”
মনের প্রশ্ন ঠোঁট অবধি এসে পড়লো তার। আকুতিভরা নয়নে প্রশ্ন করে উঠলো যুবককে,
“একটা প্রশ্ন করার ছিল… আমি তো তোমার সুযোগ্য বোধহয় না, তবুও কেন এত ভালোবাসো? আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা কি তোমার মতো ছেলের মানায়?”
“কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখেছো, তার পানে তাকিয়ে হাজার হাজার বছর কাটিয়ে ফেলা যায়, তবুও যেন অক্লান্তকর্ম। কী সৌন্দর্য তার! কী মায়াময় দেখতে! এতোটা মায়াময় কোনো ফুল গাছ থাকাকালীন দেখতে হয়? হয়তো না, অথচ গাছ থেকে ছিঁড়লেই ফুলের রূপ যেন ক্রমে ক্রমে কমে। অথচ বেলি ফুল গাছ দেখো, এদের গাছে থাকাকালীন রূপ তেমন না, অথচ সে পূর্বে যতোটা স্নিগ্ধ, মনরোম গাছ থেকে হাতে নামালে তার চাইতেও রূপ উপচে পড়ে দর্শকের কাছে। গাছে থাকার সময় টুকুই হলো যৌবন, ফুল হলো মানব-মানবী। তুমি আমার কাছে যৌবনের অপরূপা কৃষ্ণচূড়া নয়। বরং, সেই বেলি যে যৌবন পেরিয়ে গেলেও আমার নিকট স্নিগ্ধ, আকর্ষণ না থাকলেও আমার নিকট পবিত্রতাময় প্রেমের এক আস্ত সিন্ধুক। ”
পক্ষী অবাক নয়নে দেখে এই উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের পুরুষটিকে। এই পুরুষটির তথা প্রথমের ভালোবাসা বা অনুভূতির মাঝে সে বিন্দু পরিমাণও অপবিত্রতা খুঁজে পায় না, তার ভালোবাসাই যেন স্নিগ্ধ।
“কী গো সখী, কী এতো ভাবছো?”
প্রেমিকাকে গম্ভীর দেখে ভ্রজোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করে উঠে প্রথম। তাতেই পক্ষীর ভাবনার ঘোর ভাঙে। চমকিত গলায় উত্তর দেয়,
“না, না, কিছুই ভাবছি না। এমনেই আর কী…”
আলতো হেসে কথার বিপরীতে প্রথম বলে উঠে,
“ওহ। কিন্তু জানো আমি আজ বেজায় খুশি। আজ প্রথমবার তুমি আমার সাথে অধিকারবোধ নিয়ে কথা বলেছো। কী যে ভালো লাগছে না! খুব তাড়াতাড়িই আব্বা-আম্মাকে পাঠাবো তোমাদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আর অপেক্ষা করা সম্ভব না সখী এই অধমের পক্ষে। বড্ড বেশি ভয় হয় বুঝলে, বুকের মাঝটায় চিনচিন করে।”
যুবতী কিছুটা বিস্মিতই হয় শেষের বাক্য শুনে। অবাক গলায় বলে উঠে,
“ভয় হওয়ার কারণ কী? কথাটা বুঝলাম না।”
“আমাকে ভালোবাসো? একবার বলবে ঐ প্রেমময় শব্দ তিনটি? বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি?”
পক্ষী হতবিহ্বল হয়ে গেল, সে নিজেও জানে না এই প্রশ্নের উত্তর। প্রথমকে তার ভালো লাগে, তবে ভালোবাসা…? ভালোবাসার ব্যাখ্যাই সে জানে না, সে শুধু জানে এই পুরুষ তাকে নিজের সবটা দিয়ে হলেও ভালো রাখবে, সম্মান দিবে। যা তার জীবনের অনস্বীকার্য প্রয়োজন।
তাকে আমতা আমতা করতে দেখে আলতো হাসে প্রথম, তবে এ হাসিতে কোনো উৎফুল্লতা নেই, আছে শুধু মলিনতা। নিরলস মুখে সে বলে উঠে,
“থাক, আর অস্বস্তি বোধ করা লাগবে না। আমি শুধু তোমায় আমার ভয়ের কারণটা দেখালাম বুঝেছো। আমার কোথায় যেন মনে হয় তুমি আমাকে ভালোবাসো না, আমি শুধুই তোমার শ্রদ্ধার পাত্র। তবে আমার বিশ্বাস একদফা বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালোবেসে ফেলবে, তোমার মনেও অধিপত্ব হবে আমার। তাই আমি খুব তাড়াতাড়িই তোমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসতে চাই সখী।”
বর্তমান,
অতীত ভাবতে ভাবতে নয়নযুগল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে। সে বহুকাল ধরেই নিজেত রূপ ও রংয়ের জন্য কথা শুনছে, তাই অনেকটা সয়ে গেছে। কিন্তু আজ আরিজকে তার জন্য কথা শুনতে হয়েছে বিষয়টা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছে না। এসব শুনেই অতীত ভেবে উঠেছিল সে
আবার অন্য এক খোলাসা হয়েছে তার জীবনের। সে জানতে পেরেছে, তার বর্তমান তারই প্রিয়জনের অতীত, তার স্বামী তারই প্রিয়জনের প্রাক্তন, তার নামহীন সম্পর্কের সাথে জুড়ে আছে তারই প্রিয়জনের ভালোবাসাময় সম্পর্কের পতন।
চাপা কান্নায় নিমজ্জিত হয়ে সে আনমনেই অস্ফুটভাবে বলে উঠে,
“জীবনে কি দুঃখের কমতি ছিল যে এখন নব নব কষ্টগুলো এসে জুড়ে যাচ্ছে? সবকিছু মেনে নিলেও এ কী করে মেনে নেই! যে মানুষটা আমাকে ঢাকায় এনে নতুন জীবন দিয়েছে তার জীবন ধ্বংসের অপরাধী কিনা আমি হলাম!”
কয়েক ঘণ্টা পূর্বে,
পক্ষী ও আরিজ আরিজের বন্ধু-বান্ধবের গেট টুগেদারে অংশগ্রহণ করতে এসেছে। সেখানে এসে সবার সাথে পরিচিতই হচ্ছিলো কিন্তু হুট করেই যে এত ঝামেলা হয়ে যাবে কেউ বুঝতেই পারেনি।
পক্ষী আসার পর থেকেই খেয়াল করছিল কয়েকজন কেমন তাকে ও আরিজকে বাঁকা চোখে দেখছে, মনে মনে একটু শঙ্কিতও হয় বটে। আরিজও বিষয়টা খেয়াল করলে তেমন আমলে নেয় না। এমন সময় একজন যুবক এসে বলেই উঠে,
“আরিজ, তোর থেকে এটা আশা করিনি। ভাগ্যিস, গতকাল আশেপাশের মানুষ মানে সোসাইটির আন্টি আর আম্মুর থেকে জেনেছি নাহলে তো আমাদের জানতেই দিতি না। আমি বুঝি না তুই কীভাবে প্রিয়াকে রেখে অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলতে পারিস?”
‘প্রিয়া’ নাম শুনে প্রথমে পক্ষী বিস্মিত হলেও পরে ভাবে একই নামের অন্যকেউ। সেই যুবককে সায় জানিয়ে আরেকজনও বলে উঠে,
“হ্যাঁ, প্রিয়া মেয়েটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে তুই কি করে পারলি…? আর এটা তোর বউ, যার জন্য প্রিয়াকে ছাড়লি?”
পক্ষীকে ইঙ্গিত করে লোকটি বলে উঠে। পক্ষী ভয়ে আরিজের হাত খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
“এই মেয়ের জন্য প্রিয়াকে ছাড়লি কী দেখে ভাই? দেখতে সুন্দর হলেও বুঝতাম, কিন্তু এই মেয়ে তো প্রিয়ার ধারের কাছেও না। তার উপর তোর বুক অবধিও আসে না। এমন মেয়ে তোর মতো ছেলেরে কেমনে পটালো? ”
আরিজের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় এমন কথা শুনে। সে দৃঢ়ভাবে বলে উঠে,
“দেখ, যা বলার আমাকে বল। পক্ষীকে কিছু বলবি না।”
একজন আরিজের থেকে কিছুটা ছোটো বয়সের নারীও বলে উঠে,
“কেন ভাইয়া আপনার জ্বলে তাকে বললে? আর আমার বান্ধুবীর সাথে এত বছর প্রেম করে তার জন্য একটুও কষ্ট বোধ হয় না!”
থেমে নারীটি পক্ষীর দিকে তাকায় দু-চারটা মন্দ বচন শুনানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু পক্ষীর চেহারা খেয়াল করতেই থমকে যায়। হতবাক হয়ে বলে,
“এই মেয়ে তুমি প্রিয়ার বোন না? ছিঃ ছিঃ কেমন মেয়ে তুমি যে নিজের বোনের ভালোবাসাকে কেড়ে নিলে! তোমার জন্য প্রিয়া কত কিছুই না করলো, আর তুমি…!”
পক্ষী যেন এ কথা শুনে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেল, সে এতক্ষণ মাথা নত করে থাকায় নারীটিকে দেখতে পায়নি। এই কথা শুনে মাথা তুলতেই মনে পড়ে এটা যে প্রিয়ার বান্ধুবী।
আরিজ পুনরায় সবাইকে থামিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“তোরা কিছু জানিস না। শুধুশুধু এভাবে কথা বলবি না, বিশেষ করে পক্ষীকে নিয়ে না-ই।”
“কেন বলবে না? এই মেয়েই তো তোকে ফাঁসিয়েছে নাহলে প্রিয়ার মতো রেখে কেউ এর মতো মেয়েকে… তা কীভাবে ফাঁসিয়েছিলে বলো তো? আর এতোই যখন বিয়ের কীট উঠেছিল মাথায় তাহলে নিজের বোনের ভালোবাসা বাদে অন্য ছেলে ফাঁসালেই পারতে! নিশ্চিত টাকা দেখে ফাঁসিয়ে ছিলে, তাই না? তোমাদের মতো মেয়েরা তো টাকা দেখলে বিছানায়…”
লোকটা আরও কিছু বলবে তার আগেই আরিজ ঘুষি মেরে বসে। সাথে সাথেই মারামারি লেগে যায় দুইজনের মাঝে, বাকিরা তাদের থামিয়ে দূরে সরাতে লাগে। পক্ষী অপরাধবোধ, ভয়, কষ্ট সবকিছুর সংমিশ্রণে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাকিরা দুজনকে থামাতেই আরিজ একঝলক সবাইকে শক্ত চোখে দেখে পক্ষীর হাত ধরে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি ফিরার সারা পথে, অর্থাৎ গাড়িতে তাদের মাঝে চলে নিস্তব্ধ নীরবতা। পক্ষীকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আরিজ কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। আর পক্ষী মনের দুঃখে দৌড়ে বেডরুমে চলে এসে অশ্রু ঝরাতে থাকে।
অপরদিকে আরিজ এসেছে নাইট ক্লাবে, তার হৃদয়মহলে চলছে বিতৃষ্ণার খেলা। আনমনেই ভাবছে,
“হ্যাঁ, আমি অপরাধী। কিছু না করেই অপরাধী, সবার অপরাধী। আমার জন্য পক্ষীকেও এত মন্দ কথা শুনতে হলো। আমি প্রিয়া আর পক্ষীর জীবনে একটা অভিশাপ বৈকি কিছুই না। ”
পরক্ষণেই নানা কুচিন্তা হানা দেয় তার মস্তিষ্কে।
“আচ্ছা, আমার মৃত্যুতে কি এসব কিছুর অন্ত হবে? অন্ত হবে পক্ষী আর প্রিয়ার জীবনের অন্ধকারচ্ছন্ন রাত? পক্ষী কি কাঁদবে আমার মৃত্যুতে? না, তার কাঁদার তো কারণ নেই। সে কি আর আমাকে চায়! সবার তো বরং সুখ মুক্তি পেয়ে। তবে আমার মরণই শ্রেয়।”
৪৯।
“আমরা যা করলাম, ঠিক করলাম তো পলকের মা?”
বিষণ্ণ গলায় বলে উঠেন প্রিয়ার বাবা জয়নাল দেওয়ান। আঞ্জুমান শেখ স্বামীর ঔষধ বের করছিলেন, স্বামীর প্রশ্ন কাজ থামিয়ে দেন। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলতে শুরু করেন,
“এছাড়া কোনো উপায় ছিল? আমার মেয়ের কোন ভবিষ্যতটা তুমি করে রেখেছো, যে সে আশায় এভাবে ফেলিয়ে রাখবো? তোমার বাপের সব সম্পত্তি দিয়েছো ছেলের নামে লিখে, আর আমার মেয়ে…? সবসময় ছেলেই আমাদের দেখবে, বোনকে দেখবে; ছাতার মাথা দেখে! আমার মেয়েটাকে বাড়ি ছাড়া করলো তোমার ছেলে, আবার তার বউ আর শ্বাশুরি যখন তখন খাওয়া-পড়ার খোঁটা দেয়। আর আশা করি করবো কিনা আমার মেয়ের বিপদ-আপদে এ আসবে এগিয়ে!”
নিজের মনের সব রাগ জাহির করে শান্ত হন তিনি। তারপর শান্ত গলায় বলেন,
“তোমার শরীরের এতো মন্দ অবস্থা, আমি তো এমনিতেই মাইগ্রেইন, ডায়বেটিস, প্রেশারের রোগে শেষ। আমাদের কিছু হয়ে গেলে আমার মেয়েটার কি হবে! ওর কোনো সমস্যা হলে কার কাছে আসবে? যতো যাই বলি পৃথিবীতে নরনারী বা কোনো মানুষই পরিবার-পরিজনদের ছাড়া চলতে পারে না, সামান্য জ্বর হলেও খেয়াল রাখার জন্য একজন লাগে। তাই আমার মনে হয়েছে আমরা সুস্থ থাকতে আমার মেয়েকে একজন সঙ্গী আর পরিবার দেওয়া প্রয়োজন, আমি দিয়েছি। মন্দ হলে হোক! কারণ আমি তো জানি আমি ছেলে জন্ম দিলেও পুরুষ জন্ম দেইনি, এই কাপুরুষের ভরসায় তো আমার মেয়েকে আর রেখে যেতে পারি না।”
গোপণে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়নাল দেওয়ান। তার এই একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত যে কত ক্ষতিকর, তা এই বৃদ্ধ বয়সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। যদি নিজের সম্বল টুকু না লিখে দিতেন তবুও একটা গতি থাকতো হাতে, আজ তাও নেই। অবশ্য গ্রামের ভিটেমাটিটা পড়ে আছে, তাও এক ভাঙা একচালা ঘর।
বউয়ের তাচ্ছিল্য শুনে এবং ছেলের প্রতি রাগ ও অভিমান নিয়ে মনে মনে এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
তেজি গলায় বললেন,
“ঠিকই বলেছো আমি আসলে জীবনে কোনো সিদ্ধান্ত ভালো নেইনি। কত অহংকার করতাম ছেলে সন্তানের বাপ হয়েছিলাম বলে! অথচ, দুই মেয়ের বাপ হয়েও আজমলের অত অশান্তি নেই যত আমার! তবে আজ আমি এক ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আশা করি তুমি স্ত্রী হিসেবে আমার সাথেই থাকবে তাতে। আর একমাস পরই আমরা গ্রামে চলে যাবো, এই টাউনে আর থাকবো না। ঐ কাপুরুষের থেকে কোনো সাহায্যও নিবো না। আমার পেনশনেই আমাদের বেশ চলে যাবে।”
আঞ্জুমান আঁচলে চোখ ঢেকে কেঁদে ফেলেন। ক্ষীণ গলায় বলেন,
“যাবো না কেন? অবশ্যই যাবো।”
এদিকে বাবা-মায়ের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছে পালক। ছেলে হয়েও আজ সমাজের নিয়ম ভঙ্গ করে নোনাজল বিসর্জন দিচ্ছে সে শোকে। সে কখন এতোটা মন্দ হয়ে উঠেছিল ছেলে হিসেবে, ভাই হিসেবে বুঝতেও পারেনি।
বাবা-মায়ের অহংকার নয়, আজ তাদের কষ্ট ও অশান্তির কারণ সে ভাবতেই কান্না বেরিয়ে আসছে। বারবার কানে বাজছে বাবা-মায়ের কথোপকথন, বিশেষ করে তাদের মুখ থেকে পলকের জন্য উচ্চারিত ‘কাপুরুষ’ শব্দটি।
কিছু একটা ভেবেই চোখের জল মুছে শক্ত হয়ে উঠে সে। বিড়বিড় করে বলে,
“আমি তোমাদের অহংকার হয়ে উঠবো বাবা-মা, তাও অতি শিঘ্রই।”
অতঃপর হনহন করে ঘরে যেয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার যে খুব কঠিন কিছু কার্যাদি সম্পূর্ণ করতে হবে, আর তার জন্য মস্তিষ্কের সতেজ ও ভালো থাকা খুব প্রয়োজন।
নিপু এসে স্বামীকে এত তাড়াতাড়ি শুয়ে থাকতে দেখে প্রথমে একটু ভাবুক হলেও তা কেটে যায় তার আনন্দের অনুভূতিতে। আজ যে ভীষণ খুশি পক্ষী এ বাড়ি থেকে নিজের সব অধিকার তুলে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ায়। অবশ্য অধিকার ছেড়ে গিয়েছিল বহু আগেই, তবুও তা একবারের জন্য কিনা তাতে সন্দেহ ছিল এই বিষধর নারীর।
“শেষ পর্যন্ত এই আপদটাকে বিদায় করতে পারলাম একবারের জন্য। এখন ঐ দুই বুড়ো-বুড়িকে আমার সংসার থেকে বের করতে পারলেই হলো!”
আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠে সে। কিন্তু কথায় তো আছে, যত হাসি তত কান্না। কে জানে, তার জন্যেও অপেক্ষা করছে তেমন কিছু, শুধু সময়টা পেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা…
আপন আনন্দে ভেসে শুয়ে পড়ে সে বিছানায়, ধীরেধীরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। ওদিকে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আপন ভাবনায় ব্যস্ত, তাদের চোখে আজ নিদ্রা নেই। কারণ তাদের যে বহুদূর যাত্রা করতে হবে চেনা জায়গা ছেড়ে। এ যে কী এক কষ্ট!
৪৯।
ঢাকা শহর থেকে অনেকটাই অকৃত্রিম জীবন গ্রাম বাংলার বাসিন্দাদের, সতেজ ও সুন্দরও বটে। সব থেকে সুন্দর মুহূর্ত হলো ঘুম সকাল হওয়ার সময়টা, যেখানে ঢাকার যান্ত্রিক জীবনযাপনে ঘুম ভাঙে কাকের বিরক্তিকর ‘কা কা’ শব্দে, এখানে ঘুম ভাঙায় কোকিল, দোয়েল, টুনটুনি, চড়ুই পাখিদের কলরবে। কী মনরোমই না সেই দৃশ্য, সেই অনুভূতি!
একই অনুভূতিতে ঘুম ভাঙে প্রিয়ার। সে প্রতিদিনের মতোই চোখ মেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে, সেই সাথে মনে পড়ে যায় গতকালের কথা। চমকে উঠে বিছানার অপরপাশে তাকায় সে। না, কেউ নেই সেখানে। অতঃপর সারা ঘরে চোখ বুলায়, কিন্তু কোথাও কোনো মানুষের চিহ্নও পায় না।
আনমনেই ভাবে,
“তার মানে কি সব স্বপ্ন ছিল?”
চলবে…
এখন থেকে বড় বড় পর্ব দিয়ে গল্প শেষ করবো 😒