মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি পর্ব ২১

#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ২১
৫২।
“কী হলো মারছিস কেন আমাকে! আরে আহ! ব্যথা পাচ্ছি ভাই আমার। আজ অসুস্থ বলে তার ফায়দা নিচ্ছিস মৃণ্ময়?”

আরিজ ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠে হাপাতে হাপাতে কথাগুলো আওড়াচ্ছে, তবুও তার মুক্তি হয় না বন্ধুর মারের হাত থেকে। সকালে ঘুম থেকে উঠার ঘণ্টা খাণেক বাদেই দরজায় কেউ নক দেয় কেউ। সেই শব্দেই ঘুম ভেঙে যায় পক্ষীরও, একপলক আরিজের দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়া করে মাথায় কাপড় দিতে দিতে দরজা খুলতে যায়।

দরজা খুলেই মৃণ্ময়কে দেখে সে কিছুটা অবাক হয়। যুবক হাসিমুখে আমতা আমতা করে বলে উঠে,

“আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। কেমন আছেন? আসলে আমি আরিজকে দেখতে এসেছিলাম, একটু প্রাইভাসি লাগতো আর কী… আপনি না চাইলে সমস্যা নাই।”

“না, না, সমস্যা নেই। আপনার বন্ধু, কালকে আপনার জন্য এত বড় বিপদ কেটে গেল, আর আমি কিনা আপনাকে মানা করবো! আপনি যেয়ে বসুন, আমি চা-নাস্তা নিয়ে আসছি।”

পক্ষী কিচেনের পথে চলতে শুরু করতেই মৃণ্ময় এক স্বস্তির শ্বাস ফেলে বেডরুমে ঢুকে ধপ করে দরজা আটকে দেয়। আরিজ আওয়াজ শুনে খাণিক অবাকই হয়। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে মৃণ্ময়কে দেখেই হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠে মুখশ্রী।

“আরে মৃণ্ময়, তুই…? এত সকালে? ”

কিন্তু বন্ধুর কী এসব শুনার ইচ্ছে বা আগ্রহ আছে! সে হনহন করে কাছে এসে মারতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বর্তমানে দুজনেই ঘামিয়ে উঠেছে। মৃণ্ময় বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,

“শালা, তুই কী ভেবে এসব করতে গেলি! একবারও আন্টি, আঙ্কেল বা ভাই-ভাবির কথা মনে পড়লো না? আর ঐ ছোট্ট মেয়েটা জানিস কাল আমার সামনে কান্না আটকাতে চেয়েও না পারতে কেঁদে দিয়েছে। মেয়েটাকে এমনিতেই হবু বর মরায় কথা শুনতে সমাজের, তুই মরলে তো গলায় দড়ি দেওয়া লাগবে!”

এই কথা শুনে আরিজ কিছুটা গম্ভীর হয়, দুজনের মাঝে বেশ কয়েক মুহূর্তের নিরবতা বিরাজমান থাকে। যা ভাঙিয়ে আরিজ অপরাধবোধ যুক্ত গলায় বলে,

“সরি দোস্ত, আমি এত ডিপ্রেস হয়ে গিয়েছিলাম না গতকাল, আই ওয়াজেন্ট ফাইন্ডিং এনি ওয়ে টু গেট আউট অফ দিস মেস। আমি প্রিয়াকে কোন মুখে বলি আমি পক্ষীকে মেনে নিয়েছি, এমনেই ও আমাকে দেখা হলেই বলে তোমার জায়গা আমি হলে কখনোই বিয়ে করতাম না বাবা-মা যতোই জবরদস্তি করুক, এটা শুনলে ও আরও মানবে আমি ইচ্ছে করেই… আমি বেইমান হয়ে যাবো ওর কাছে, সেটাও নাহয় মেনে নিলাম, কিন্তু যদি কোনো ভুল পথ বেছে নেয় তখন আমি কী করবো! ও সেদিনও বলেছে আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।”

এমন সব আবেগী কথা শুনেও ভাবুক হয় না মৃণ্ময়। বেডের পাশের টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে সে খুবই শান্ত গলায় বলে,

“সবাইও বলে বাঁচতে পারবো না, দিনশেষে যখন ভাগ্যরেখা আর পরিস্থিতির দরুণ আলাদা হয়, তখন গুটি কয়েক ছাড়া সবাই ভাগ্য মেনে নিজের মতো ভালো থাকতে শিখে যায়। এর মানে এই নয় তাদের সম্পর্ক মিথ্যে ছিল, এর মানে শুধু তাদের সম্পর্কতে সর্বশক্তিমানের সম্মতিটা ছিল না। আচ্ছা, তুই বল পক্ষীর সাথে যদি তোর বিয়ে না হতো, তুই কি কখনো প্রিয়াকে ছেড়ে আর কারো কথা মাথায়ও আনতি?”

আরিজ শুধালো,

“না, মেয়েটাকে ভালোবাসতাম কিনা জানি না তবে তার ইন্দ্রজালে আটকে ছিলাম ঠিকই, এক সময় খুব করে চাইতাম নিজের করে পেতে। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে পছন্দও বদলেছে। বল তো কী, একসাথে থাকতে থাকতে কুকুরেরর প্রতিও মায়া জমে যায়, সেখানে পক্ষী এক জলজ্যান্ত মানুষ। ওর মাঝে না নিজের ছেলেবেলা দেখি, ওর মাঝে কেমন একটা শীতলতা বিরাজমান, যার ছোঁয়ায় অতীতের সব জ্বালাপোড়ায় মলম লেগে যায়।”

“ঠিক, এটাই বুঝাতে চাইছি আমি। প্রিয়া যা মানার মানুক, তুই তো জানিস তুই ধোঁকা দিসনি, সবটাই ভাগ্যের লিখন। যে পর্যন্ত ও তোর জায়গায় থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝতে পারবে, ও কেন শুধু, কেউই পারবে না। আমিও তোর পরিস্থিতিটায় পড়েছিলাম বলেই বুঝতে পারছি, নাহলে হয়তো আমিও… দেখ, তুই ওর কাছে বেইমান প্রমাণিত হওয়ার ভয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করছিস, ও যত দ্রুত সত্য জানবে, তত তাড়াতাড়ি জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে, তা তোকে ঘৃণা করেই হোক, ভালোবেসেই হোক, ভুলে যেয়েই হোক। আর যতটুকু ওর নিজের ক্ষতি করার কথা, বিয়ের রাতেও তো বিষ কিনেছিল, কিন্তু খেয়েছিল? প্রিয়া কোনো অবলা বা গাঁধা না তোর মতো। ও লড়তে জানে, ভালো থাকতে জানে, ও এই অমানবিক আর অপমানজনক কাজ কখনোই করবে না।”

কথাগুলো শুনে বন্ধুকে একটু ভাবুক হতেই দেখলো যুবক। মৃদু হেসে ভাবে,

“কাজ হচ্ছে তাহলে ঔষধে।”

একটু গলা খাঁকারি দিয়ে আরিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একই ভাব-ভঙ্গিমায় নেয় কিছু কথা বলার উদ্দেশ্যে। অতঃপর বলতে লাগে,

“আত্মহানি এতোও সহজ কাজ নয়, কারণ বড় সাহস লাগে তাতে। তবে এই সাহস সাহসিকতা নয় বোকামির পরিচয়, মৃত্যুর পর সারাসময় জাহান্নামের আগুনে দাহ হওয়ার সাহস যে তাই। এটার ক্ষমতা খুব মানুষই রাখে, আর তাদের চাইতে বড় বোকা দুনিয়াতে আর দুটো নেই।”

আরিজ একটু হেসেই দেয়, কথাগুলো যে তাকে খোঁচা দিয়েই বলা তা যে তার বুঝতে বাকি নেই। সে রসিকতার সুর ধরেই বলে,

“এত না ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে সোজাসোজি বললেই হয় আমাকে গাঁধা, বোকা, গবেট ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু মনে রাখিস, আমি যা তুইও না। আফটার অল উই আর ফ্রেন্ডস!”

মৃণ্ময়ও একই রেশ ধরে।

“না, আমি তোর মতো সোজাসিধা জিনিসকে এত জটিল বানিয়ে ফেলিনি। বরং, সোজাসাপ্টা সব ক্লিয়ার করে সবাইকে বলেছিলাম। আর আমি বলতে চাচ্ছি না, তুই গাঁধা, বলদ, গবেটই।”

কথাটা বলতেই দরজার দিক থেকে খিলখিলিয়ে হাসার শব্দ পায়, দুই বন্ধু সেদিকে তাকিয়ে দেখে পক্ষী হাসছে। ওড়না চুল সহ সাড়া শরীর ঢাকা, আর হাতে ওড়না নিয়ে মুখ ঢেকে আছে, এই মুক্ত ঝরা হাসিতে তার উন্মুক্ত চঞ্চলা চোখ দুটোও যেন হাসছে, এমনটাই লাগছে আরিজের।

এর মাঝেই মৃণ্ময় বলে উঠে,

“আরে আপনি ভাবি…? আসেন, আসেন, বসেন আপনার স্বামীর সাথে। আমি এখন উঠি, আবার অফিসে যেতে হবে।”

পক্ষী নাকোচ করে উঠে,

“না, না, ভাইয়া সে কী করে হয়! নাস্তাটা তো করে যান।”

“অন্য একদিন করবো, নিশ্চিত।”

“না, না, তা মানছি না। আপনাকে কিছু না কিছু খেয়ে যেতেই হবে।”

আরিজও সায় জানালো পক্ষীর কথায়,

“আরে এত করে বলছে, খেয়ে যা! এত ভাব দেখাচ্ছিস কেন, বল তো!”

“আচ্ছা, এত করে যখন ভাবি বলছে তাহলে চাটা তো খাওয়াই যায়। কী বলেন ভাবি!”

পক্ষী ট্রলি থেকে চায়ের কাপ উঠিয়ে দেয়। অতঃপর বেশি খাণিকটা সময় আড্ডা মেরে মৃণ্ময় তাদের বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করে অফিসের উদ্দেশ্যে।

যাওয়ার আগে সে শুধু একটা কথাই বলে যায়,

“আমার কথাগুলো ভেবেছিস ভালো কথা, সে অনুযায়ী কাজ করার সাহস রাখিস।”

যুবতি এমন কথার মাথামুণ্ডু না বুঝতে পারলেও আরিজ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। মৃণ্ময় চলে যেতেই পক্ষী আস্তে আস্তে আরিজকে উঠিয়ে বসায়। তারপর নিজ হাতে যেই এক চামচ স্যুপ ঠোঁটের সম্মুখে ধরেছে তখনই আরিজ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। পক্ষী ভাবে সে গতকালের ঘটনার জন্য তার উপর রাগ হয়ে আছে।

তাই তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,

“বন্ধুদের বিদ্রূপ শুনে এখন আমার হাতে খেতেও লজ্জা লাগছে। চিন্তা করবেন না, খুব তাড়াতাড়িই চলে যাবো। বলে না, যার কেউ নেই, গোটা দুনিয়াটাই তার হয়ে দাঁড়ায়।”

আরিজের বেজায় রাগ হয় এমন বক্তব্যে,তাই রাগের সহিতই বলে,

“এই মেয়ে, এত বেশি কথা কেন বলো? মেয়েরা আসলেই এক লাইন শুনে আর দুই লাইন বেশিই বুঝে, অবশ্যই উল্টাই বুঝে। এখন বলো আমাকে যে খাওয়াচ্ছো, নিজে খেয়েছো?”

এবার যুবতীর মাঝে আমতা আমতা ভাব দেখা যায়।

“না, মানে পরে খাবো আর কী…”

“কোনো বাহানা না, এই চামচ তুমি মুখে দাও। নাকি আমার প্লেট থেকে খেতে ঘিন লাগে?”

পক্ষী কোনো উত্তর না দিয়েই খাবার মুখে দেয়। আরিজ তা দেখে মুচকি হেসে দেয়।

“এই না হলো কাজ!”

তারপর হঠাৎ করেই নিজের দুই ক্ষত-বিক্ষত হাত দ্বারা পক্ষীর মুখশ্রী ধরে বলতে শুরু করে,

“ইশ! শ্যামলা চেহারাটা কেমন কাঁদতে কাঁদতে লাল বানিয়ে ফেলেছে, আরও কালো লাগছে দেখতে। একদম কৃষ্ণবর্ণা মায়াবতীর মতো। চুলগুলো কী আঁচড়াওনি! কিন্তু এলোমেলো চুলে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। বাহ! এই কয়েকদিনে দেখি ভালোই লম্বা হয়েছে! আর তুমি ফ্রেশ হয়েছো? হওনি তো…? তবে যাও ফ্রেশ হয়ে এসো একসাথেই ব্রেকফাস্ট শেষ করি।”

পক্ষী জবাবে বলবে কী সে এমন সব কথা আরিজের মুখে শুনে বিস্মিত হয়ে গিয়েছে। তার মনে হচ্ছে এ যেন এক স্বপ্ন! যে ছেলে কয়েকদিন আগেই এ মুখে হতো না, আবার কাল এত কথা শুনলো তার জন্য, হঠাৎ তার এমন কথা কারোরই কাম্য নয়। ভাবে,

“আজ কী অকাম্য সব ঘটনা হচ্ছে আমার সাথে নাকি মিথ্যে স্বপ্ন দেখছি শুধু? কিন্তু এসব কী ঠিক! আরিজ তো প্রিয়া…”

তার ভাবনার ঘোর কাটে আরিজের পুনরায় তাড়া দেওয়ায়। হচকচিয়ে উঠে “হুম, যাচ্ছি” বলেই আরিজের নিকট থেকে হাড়তাড় করে প্রস্থান করে সে।

৫৩।
পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে প্রিয়া নিজের বাসা ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি উঠেছে। এর মধ্যে সে একবারও সুযোগ পায়নি আরিজের সাথে যোগাযোগ করার, কারণ তার মা এই বাড়িতে আসার সময় ফোন আনতে দেয়নি, আবার আসার পর তার এক মুহূর্তও একা কাটেনি। সারাদিন ননদের সাথে আড্ডায় আর মাহদির সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়ায়। আজও তাই হচ্ছে,

“এই শুনেন, আপনার এসব কাপড় বিছানার উপর বা এখানে-সেখানে রাখবেন না। আপনার কী সেন্স নেই যে রুমে একটা সহজ-সরল মেয়েও থাকে!”

নিজের মনের সব রাগ জাহির করে থামলো প্রিয়া। মাহদি কনফিউজ হওয়ার ভান করে শুধালো,

“না, না, তোমার কোনো ভুল হচ্ছে এই ঘরে আমি ব্যতীত কোনো সহজ-সরল মেয়ে থাকে, একটা পেত্নি থাকে।”

“এই, এই, কী বললেন আপনি আমাকে! আমি পেত্নি! পেত্নি!”

“লুক হু’স সেয়িং! আমি একবারও তোমার নাম নিয়ে কিছু বলেছি? বরং, তুমিই বারবার চেঁচিয়ে বলছো যে আমি পেত্নি, আমি পেত্নি।”

প্রিয়া রেগেমেগে কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল। এই ছেলের সাথে তর্ক করা আর পাথরকে গালি দেওয়া একই বিষয় মানে, কোনো লাভ নেই। তাই সে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বললো,

” সে যাই হোক আপনার এসব যেখানে, সেখানে ফেলে রাখবেন না। আপনি একা থাকেন না রুমে আর রুমটা আপনার একারও না, আমারও।”

মাহদি এতক্ষণ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে করতে কথা বলছিল। এবার ল্যাপট কোল থেকে সরিয়ে একটানে প্রিয়াকে কোলে বসিয়ে তরুণীর কপালে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে উত্তর দেয়,

“আমিও তো তোমারই, তাই না বলো প্রিয়ানু? যেহেতু আমিই তোমার তাহলে আমার কাপড়চোপড়ও তোমার, আর আমার প্রতি তোমার একটা দায়িত্বও তো আছে, তাই না? তাহলে এখন আমার আন্ডারগার্মেন্টস জায়গা মতো রেখে আসো। আসলে সকালে আমি কালার চুজ করার কনফিউশনে… যাকগে তুমি এখন ঠিকঠাক করে রেখে দাও তো প্রিয়ানু!”

ঘটনার আকস্মিকতায় প্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই কোনো এক ঘোরেই সে অস্ফুটভাবে “হু” বলে উঠে। মাহদি হেসে দিয়ে একটু জোরেই বলে,

“এবার একটু বরের কোল থেকে উঠেন। আমার পা তো ভেঙে গেল।”

কথাটা শুনে ভাবনার সুতো কাটতেই প্রিয়া তাড়াহুড়ো করে কোল থেকে উঠে যেতে নেয়। কিন্তু বলে না, তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের। আর হলোও তাই কোল থেকে সরে আসবে তো দূরের কথা আরও বরং স্লিপ খেয়ে গলা জড়িয়ে কোলে বসতে হলো তার ব্যালেন্স রাখতে।

লজ্জাভাব নিয়ে চোখ তুলে মাহদির দিকে তাকাতেই দেখে যুবক মুখে বড়সড় হাসি নিয়ে বসে আছে, যেন সে এমন ঘটনায় বেশ ভালো, গর্বিত বোধ করছে। প্রিয়ার যেন রাগ উঠে গেল এই ভেবে যে ছেলেটা নির্ঘাত তার উপরই হাসছে।

কিছু না বলেই মুখটা বিকৃত করে মাহদির পোশাকটা নিয়ে আলমারি খুলে ভিতরে ছুড়ে মারলো। একঝলক অগ্নিদৃষ্টিতে মাহদিকে দেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে, আর মাহদি সে তো হুহা করে হাসতে ব্যস্ত।

___

কেটে গিয়েছে আরও তিন-চার দিন প্রিয়া ও মাহদির মাঝে এখনো টম এন্ড জেরির সম্পর্ক, মাঝেমাঝে টুকটাক প্রেমময় মুহূর্তেরও রচনা হয়, সবটাই মাহদির একক আগ্রহেই। তবে প্রিয়ার হৃদয়ে ধীরেধীরে আরিজের নামটি আবছা হতে শুরু করেছে, সে নিজের অজান্তেই এই নতুন জীবনের সাথে, মাহদির সাথে এতোটা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আরিজকে মনে করার সুযোগই পায় না দুয়েক মুহূর্ত ছাড়া। আগে যাও রাত্রিটা তার আরিজময় হতো, আজকাল তাতেও ভাঁটা পড়েছে, কারণ মাহদি যে তাকে জড়িয়ে ধরে শোয়া শুরু করেছে, তাই সারাটা রাত তার মাহদিময় ভাবনা নিয়েই কেটেই যায়।

বর্তমানে প্রিয়া রান্নাঘরে শ্বাশুরিকে রান্নার কাজে সাহায্য করছে, আজ তার পরিবার আসবে যে তার সাথে দেখা করতে। প্রিয়ার রান্নাবান্নার হাত তেমন কাঁচা নাহলেও, এসব বাঙালি ভারি খাবার মানে মুরগির রোস্ট, ডিমের কোরমা, গরুর মাংস ভুনা, সবজি পোলাও এসব সে পারে না। মোটামোটি কাজ করতে যেয়ে চরম আগ্রহে ভুলও করে ফেলছে সে।

তারপর ভয়ে ভয়ে শ্বাশুরি মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি না রেগে আরও সাহস দিয়ে বলছে,

“ভুল দিয়েই তো মানুষ শিখে, মামনি। তুমি যে ইচ্ছে রাখো শিখার, চেষ্টা করছো বারবার ভুল করেও, সেটাই অনেক।”

নারীটির ধৈর্য্য দেখে প্রিয়া মনে মনে বেশ খুশি হচ্ছে। অবশ্য এই বাড়ির সবাই খুব হাস্যরসিক স্বভাবের, শ্বশুর যদিও একটু রাগি, তবে সেই রাগটা কখনোই প্রিয়ার জন্য প্রযোজ্য নয়।

রান্না করে ঘেমে নেয়ে বেডরুমে ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে ফ্যান ছেড়ে শাড়ির আঁচল গা থেকে ফেল দেয়। ওদিকে বারান্দা থেকে বের হতে হতে সে দৃশ্য দেখে মাহদি নিজেই বিস্মিত হয়ে যায়। সাথে সাথেই বারান্দার দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে উঠে,

“এই মেয়ে ঘরে কেউ আছে নাকি না দেখেই… জামা ঠিক করো, আমি ওয়াশরুমে যাবো।”

প্রিয়া অবস্থা তো লজ্জায় আরও মন্দ। ফর্সা মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি আঁচল তুলে নত মাথায় নিচু গলায় বলে,

“জি, আসুন।”

মাহদি বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“বাঘিনীকে রাগলে যতোটা মারাত্মক লাগে, লজ্জা পেয়ে লাল টুকটুকে হলে ততোটাই হৃদয়হরণী লাগে। তবে এখানে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই কারণ তার সর্বস্বই আমার অধিকার, শুধু আমার। সেটাও ঐ সর্বশক্তিমান আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার।”

প্রিয়াকে এ কথাগুলোই যেন ছুঁয়ে দিয়েছে, লজ্জাবতী লতিকা যেমন স্পর্শে নুয়ে পড়ে, তেমনই লজ্জায় নুয়ে পড়ছে প্রিয়া অদ্ভুত শিহরণে। ভাবে,

“সংসারটা কী তবে মেনেই নিয়েছি আমি!”

এ প্রশ্নের উত্তর তার নিকট আছে কিংবা নেই, অথবা জেনেও অজানার ভান। তবুও সে এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে চায় না, বরং বর্তমানটাকে উপভোগ করতে চায়।

দুপুরের দিকে প্রয়ার পরিবার বাড়িতে আসে। মাকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে, যদিও তার মাকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস, তবুও সে বেশ মনে করেছে মাকে।

‘বিয়ের পর মাকে একটু বেশিই মনে পড়ে প্রতিটি নারীর। এমন কী যে নারী মাকে কোনোদিন দেখেওনি জীবিত অবস্থায় কিংবা যে জানেও না তার মাকে, তারও মনে পড়ে। এটাই হয়তো নারীদের প্রকৃতি।’

আঞ্জুমান শেখ মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

“কেমন আছিস?”

“ভালো, আম্মু তোমরা…?”

“আমরাও ভালো ছিলাম।”

মাহদির মা বলে উঠেন,

“যাও প্রিয়া, মাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। কতদিন পর দেখা, কত কথা থাকবে পেটে, তাই না? আজ যখন পেয়েছো সব বলো!”

প্রিয়া সায় জানিয়ে মাকে নিয়ে ঘরে যায়। তাদের নানা কথোপকথনের মাঝেই প্রিয়া ফোন চেয়ে বসে। আঞ্জুমান শেখ ফোনটা প্রিয়ার হাতে দিতে দিতে বলেন,

“আমার ভয় ছিল তুই সম্পর্কটাকে মেনে নিসনি, ফোনটা হাতে পেয়েই হয়তো সম্পর্কটা ভাঙার কোনো চেষ্টা… তবে আজ দিচ্ছি, আমাদের মেয়ে আমাদের মানটা নষ্ট হতে দিবে না সেই ভরসায়। তুই যখন বিনাকারণে এই সংসারের বাহিরে পা ফেলবি, তখন তোর বাবা-মায়ের শিক্ষার উপর প্রশ্ন উঠবে, লোকে লোকে অপমান করবে। আমি আশা করি তুই এসব চাস না। আর বিশ্বাস কর আমরা তোর খারাপ চাইনি, মাহদির মতো ছেলে হয় না। তোকে ভালো রাখবে, আগলে রাখবে আমাদের অনুপস্থিতিতে। এখন আমার মরতেও কোনো দুঃখ নেই।”

যুবতী শুধালো,

“মা কী বলছো এসব!”

“ভুল কী আর বলছি! মানুষ কী আর অমর জীব! আমি তোকে এক সাথী দিয়ে যেতে পারলেই আমার শেষ দায়িত্ব ও স্বপ্নও, তা আজ শেষ।”

___

কেটে গিয়েছে আরও দুয়েক দিন। প্রিয়া মায়ের কথা খুব করে ভেবেছে। শেষ পর্যন্ত সে যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জানাতেই অপেক্ষা করছে আরিজের।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here