#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_৭
#Saji_Afroz
.
.
পৌষীকে নিয়ে মাথা থেকে চিন্তা ফেলে ফেবুতে প্রবেশ করলো উষ্ণ । ডানা কাটা পরীর আইডিতে একটি কবিতা আপলোড হয়েছে—-
ক্লান্ত যখন মন তোমার কাঁধে মাথা,
মন চাইছে চাঁদ দেখবো,
নেই তো কোনো বাঁধা।
তবুও মনকে প্রশ্ন করি কোথায় আমার তুমি।
সত্যি বলতে তোমার খোঁজ,
পাইনি এখনও আমি।
.
কবিতাটি পড়ে উষ্ণ ইনবক্স করলো আইডিতে –
কি খবর পরী ম্যাডামের?
– উষ্ণ মাহমুদ কাউকে নিজ থেকে মেসেজ করে! জানা ছিলোনা ।
-আপনি আমাকে কতোটুকুই বা চিনেন?
-যতোটা চিনলে একজন মানুষের সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যায় ।
.
মেসেজটি পেয়ে চমকে উঠলো উষ্ণ । আজ এই কথাটি তাকে পৌষীও বলেছে ।
পৌষীর চিন্তা মাথা থেকে ফেলার জন্যই পরীর সাথে চ্যাটে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেয়েছে । কিন্তু পরীর আচরণেই পৌষীর কথা আবারো মনে পড়লো তার ।
উষ্ণের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে পৌষী লিখলো-
আজ মিয়াজ সাহেবের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তোমাকে কালো জ্যাকেট-টায় অনেক মানিয়েছে ।
.
আবারো যেনো ধাক্কা খেলো উষ্ণ । এই মেয়ে কিভাবে জানলো? সে আজ কালো জ্যাকেট পরে মিয়াজ শেখের বাড়িতে গিয়েছে ।
উষ্ণ লিখলো-
কে আপনি?
-তোমার খুব চেনা কেউ ।
-ভণিতা না করে বললেই পারেন!
-ভণিতা করতেই ভালো লাগছে ।
.
উষ্ণের মেজাজ খারাপ হচ্ছে । কি ঘটছে তার সাথে বুঝে উঠতে পারছেনা সে ৷ পৌষীকেও তার আপন মনে হয়েছে আর এই পরী কেউ । দুজনের সন্ধান না পাওয়া অব্দি যেনো শান্তি পাবেনা সে ।
ঠিক তখনি তার অস্থিরতা কাটার মতো একটি রিপ্লাই পেলো সে-
দেখা করবে আমার সাথে?
.
উষ্ণ কিছু না ভেবেই রিপ্লাই দিলো-
হ্যাঁ । কখন, কোথায়?
-এতো আগ্রহ?
-আপনি যদি এটাও মজা করেন, তবে ঠিক করছেন না ।
-আমি মোটেও মজা করছিনা ।
-তবে বলুন কখন দেখা করবেন?
-কালই ।
.
পৌষী একটি রেস্টুরেন্টের নাম পাঠালো উষ্ণকে ।
এই রেস্টুরেন্টটির সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে উষ্ণের । অনেক দিন হলো, এখানে যাওয়া হয়না তার । পরীর কথামতো সে কি যাবে? যাওয়া কি উচিত?
.
পৌষী মেসেজ দিলো-
ঠিক সময়ে চলে আসবেন । আমি অপেক্ষা করবো কিন্তু! শুভ রাত্রি ।
.
.
খুব ভোরেই ঘুম ভাঙলো পৌষীর ।
আজ উষ্ণের সাথে তার দেখা হবে । দুজনে আলাদাভাবে সময় কাটাবে । এখন থেকেই মনের মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে ।
তবে উষ্ণ কি আসবে?
এই নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তাও তার মনে বিরাজ করছে ।
সব মিলিয়ে অস্থির লাগছে তার । অস্থিরতা কাটানোর জন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা প্রয়োজন । এই ভেবে এগিয়ে গেলো সে রান্নাঘরের দিকে ।
.
বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলো ফাহাদ । এমন সময় পৌষীর ডাক কানে আসতেই চোখ মেললো সে ।
সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে আছে পৌষী । ওড়ানাটা কোমরের সাথে প্যাচিয়ে রেখেছে । চুলগুলো কাটা দিয়ে বাধা থাকলেও এলোমেলো লাগছে । এমন অগোছালো পৌষীকে যেনো দেখতে অনেকখানিই ভালো লাগছে তার কাছে ।
নিজের দিকে ফাহাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পৌষী বললো-
এমন ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে কি দেখছেন! উঠে পড়ুন । সকাল সাতটে বাজে । আজ পিঠে বানিয়েছি কয়েকরকমের ।
.
পিঠের কথা শুনে বসে পড়লো ফাহাদ । এই শীতে পিঠে খাওয়ার মজায় আলাদা । পিঠের কথা শুনেই যেনো তার জিভে পানি চলে এলো ।
পৌষী বললো-
আমি টেবিলে পরিবেশন করছি । আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন ।
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে আসলো ফাহাদ । টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো হরেকরকমের পিঠে ।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে ফাহাদ বললো-
আজ কি উপলক্ষে এতো আয়োজন?
-অস্থিরতা কমাতে ।
-বুঝলাম না?
-এতো কিছু না বুঝলেও চলবে । খেয়ে নিন । অফিসের সময় হয়ে আসছে আপনার ।
.
চুপচাপ খেতে থাকলো দুজনে । নীরবতা ভেঙে ফাহাদ বললো-
দারুণ হয়েছে ।
-ধন্যবাদ ।
-ভাবছি আজ অফিসে যাবোনা ।
.
কথাটি শুনেই কাশতে শুরু করলো পৌষী । ফাহাদ তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি সব খেয়ে ফেললো সে ।
ফাহাদ বললো-
ঠিক আছো তুমি?
.
বিড়বিড়িয়ে পৌষী বললো-
আপনি না গেলে ঠিক থাকবোনা ।
-সরি?
-কিছুনা । অফিসে কেনো যাবেন না?
-তুমি সারাদিন একা থাকো । চলো কোথাও ঘুরতে যাই আজ ।
.
ফাহাদের কথা শুনে রাগ হচ্ছে পৌষীর ।
নিজের রাগ সংযত করে পৌষী বললো-
আসলে আজ এতো পিঠে বানালাম তাই ক্লান্ত লাগছে । তাছাড়া আমার কবিতাও লিখতে হবে ।
-কিন্তু…
-আজ না । অন্যদিন ।
-ওকে তুমি যাই বলো । তবে আমি তৈরী হয়ে নিই অফিসের জন্য ।
-হু ।
.
ফাহাদ অফিসে যাচ্ছে শুনে পৌষী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো । আজ তার উষ্ণের কাছে যেতেই হবে ।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো পৌষী । আজ সে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে । উষ্ণের পছন্দের রঙের মাঝে এটি একটি ।
উষ্ণ কি এই শাড়িতে তাকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকাবে? নাকি চিন্তিত হবে এই ভেবে, তার পছন্দের রঙের কথা সে কি করে জানলো?
এসব ভেবেই দুষ্টু একটা হাসি দিলো পৌষী ।
.
বেশকিছুক্ষণ হয়ে যাচ্ছে উষ্ণ গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্ট টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।
তার পুরো শরীর যেনো কাপুনি দিয়ে উঠছে ।
এতোদিন সে এই রেস্টুরেন্টটির দিকে ফিরেও তাকায়নি । আজ কি করে এখানে প্রবেশ করবে সে!
সম্ভব নয় তার পক্ষে । গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো উষ্ণ । ঠিক তখনি একটি রঙিন কাগজ উড়ে এসে, তার কারের উপরে পড়লো ।
কাগজটি ফেললো না উষ্ণ । হাতে নিয়ে কাগজের লেখাগুলো চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকলো সে————————————————
আমি আলো তুমি চাঁদ
তুমি আমার জোসনা রাত।
আমি ভোর তুমি পাখি
তাইতো তোমায় যত্নে রাখি। আমি সূর্য তুমি রোদ
কখনও কোরোনা প্রতিরোধ।
কিছু স্বপ্ন কিছু আশা
এই নিয়ে ভালোবাসা।
কি উষ্ণ? মনে আছে এই কবিতার কথা? আমার আনাড়ি হাতের প্রথম লেখা কবিতা ছিলো এটি। যেটি তোমাকেও দেখিয়েছিলাম। দেখে তুমি হেসেছিলে। বলেছিলে এতোটাও খারাপ না!
.
লেখাটি দেখে চমকে উঠলো উষ্ণ । কি হচ্ছে তার সাথে! কি করে সম্ভব এটি!আবারো সেই একই হাতের লেখা!
গাড়িতে উঠলোনা উষ্ণ । এই হাতের লেখা কার সে দেখতে চায় । পরীকে দেখতে চায় সে । কে এই ডানা কাটা পরী!
ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো উষ্ণ রেস্টুরেন্টের দিকে ।
ভেতরে এসেই চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো চারদিকে । হঠাৎ পৌষীর দিকে চোখ পড়লো তার ।
হালকা সবুজ রঙের শাড়িতে পৌষীকে অপসরীর চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর লাগছেনা ।
কয়েকমুহুর্তের জন্য থমকে গেলেও চোখ সরিয়ে নিলো উষ্ণ। ঘুরে দাঁড়ালো সে । সে এখানে এসেছে পরীর সাথে দেখা করতে । এটা ভুলে গেলে চলবেনা । কেনো সে বিবাহিতা মেয়েটিকে দেখে থমকে যাবে? এটা অনুচিত ।
উষ্ণকে দেখতে পেলো পৌষী ।
চেঁচিয়ে বললো-
উষ্ণ মাহমুদ?
.
উষ্ণ চেয়েছে পৌষী যেনো তাকে না দেখে । কিন্তু পৌষীর ডাকে আর নিজেকে লুকালো না সে । পেছনে ফিরতেই পৌষী ইশারা করলো কাছে আসতে ।
উষ্ণ আসতেই পৌষী বসতে বললো তাকে ।
সৌজন্যতার খাতিরে উষ্ণ বসে বললো-
আমি আসলে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি ।
-সে না আসা পর্যন্ত আমার সাথে গল্প করতে পারো ।
-কাল অনেক করেছি ।
-তাই বলে আজ করা যাবেনা?
-তা নয় ।
-তবে?
-ছাড়ো । তুমি এখানে?
-আমিও কারো সাথে দেখা করতে এসেছি ।
-কার সাথে?
– উষ্ণ মাহমুদের সাথে।
.
পৌষীর কথা শুনে হেসে ফেললো উষ্ণ । পৌষীও হাসলো ।
.
বেশকিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেলেও পরীর দেখা পেলোনা উষ্ণ ।
ফোন বের করে মেসেজ দিলো সে –
আপনি বলেছিলেন অপেক্ষা করবেন, কিন্তু আমিই অপেক্ষা করে আছি ।
.
উষ্ণকে মোবাইল নিতে দেখে পৌষীও ফেবুতে ঢুকলো । উষ্ণের মেসেজের রিপ্লাই দিলো-
আমিই তোমার আগে এসেছি । ব্লু কালারের টি শার্টে দারুণ মানিয়েছে তোমাকে ।
.
মেসেজটি পেয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো উষ্ণ । বেশ কয়েকজনের হাতেই সে ফোন দেখতে পেলো ।
উষ্ণ লিখলো-
এভাবে লুকোচুরি করাটা কি ঠিক হচ্ছে? প্লিজ দেখা দিন ।
.
উষ্ণের উদ্দেশ্যে পৌষী বললো-
লুকোচুরি খেলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার । তাই দেখা করার কথা আমিই বলেছি ।
.
পৌষীর মুখে কথাটি শুনে উষ্ণের আর বুঝতে বাকি রইলোনা, সে যার খোঁজে এসেছে মেয়েটি সেই ।
অবাক হয়ে উষ্ণ বললো-
পৌষীই পরী?
-হু ।
-পরিচয় লুকোনোর কারণ?
-তুমি এমনিতেও আমাকে চিনতে না । কালই আমাদের দেখা হয় । সেই হিসেবে আমি পরিচয় লুকাইনি । এই যে দেখা দিলাম! আগে দেখা দিলেও তুমি কি আমায় চিনতে?
-তা হয়তো চিনতাম না । তবে পরিচয় দেয়ার পরেও মনেহচ্ছে, যে পরিচয়টা তুমি আমায় দিচ্ছো সে পরিচয়ে আমি তোমাকে চিনিনা । আমি তোমাকে আগে থেকেই চিনি । এমনটা মনেহচ্ছে আমার! এর কারণ তোমার জানা আছে নিশ্চয়?
.
পৌষী হাসলো ।
একটু আগে পাওয়া কাগজটি পৌষীকে দেখিয়ে উষ্ণ বললো-
এই কবিতাটি কোথায় পেয়েছো?
-লেখাটা আমার মতোই । কিন্তু এটি আমার লেখা নয় ।
-আমি এটি এখানে পেয়েছি । এখানে যেহেতু পেয়েছি তোমার লেখা হওয়াই স্বাভাবিক ।
-তোমার কাছে তো আমার লেখার মতোই লেখা কবিতা রয়েছে ।
-তুমি কিভাবে জানলে?
-তুমিই দেখিয়েছো ।
.
পৌষীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে উষ্ণ । পৌষীও তাকালো ।
এভাবে বেশকিছুক্ষণ দুজন দুজনের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকার পর হেসে ফেললো পৌষী ।
হাসতে হাসতেই বললো-
আমাকে কি সুন্দর লাগছে দেখতে? এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ?
-হালকা সবুজ রঙ…
-তোমার পছন্দের রঙের মাঝে একটি ।
-আমি এসব কখনো প্রকাশ করিনি । আমার খুব আপনজন ছাড়া পারসোনাল বিষয়ে কোনো ফ্যানের জানার কথা নয় ।
-আমি হয়তো তোমার আপনজনদের মাঝেই একজন ।
.
কথাটি বলে আবারো হাসতে থাকলো পৌষী ।
ডানা কাটা পরীর আইডি পৌষীর, এটা জানতে পেরেও উষ্ণ যেনো শান্তি পেলোনা । মনেহচ্ছে এখনো অনেককিছুই তার অজানা । পৌষীর কাছাকাছি থেকে তাকে আবিষ্কার করতে চায় উষ্ণ । কেননা পৌষী তার কাছে রহস্যময়ী!
.
.
অফিসে বিশেষ কোনো কাজ না থাকার কারণে বাসার পথে রওনা হলো ফাহাদ ।
মাঝপথে জ্যামে আটকে গেলো সে । হঠাৎ তার চোখ পড়লো রেস্টুরেন্টের সামনে । সিঁড়ি বেয়ে একইসাথে নামছে পৌষী ও উষ্ণ ।
ফাহাদ আরেকটু ভালোভাবেই লক্ষ্য করতেই বুঝলো, সে ভুল দেখেনি । তার মানে উষ্ণের সাথে দেখা করার জন্যই মিথ্যে বলেছে পৌষী! কেনো এমন করছে পৌষী? কি সম্পর্কে উষ্ণ মাহমুদের সাথে তার? আজ পৌষীকে এর জবাব দিতেই হবে ।
.
চলবে
.
বি:দ্র- ।