#মুহূর্তে
পর্ব-১৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
বিছানার এক কোণে বসে আছে এক কন্যা বধূ সেজে। তার চারপাশে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে। গান বাজনা চলছে বাহিরে। অথচ তার চেহেরায় উদাসীনতার ছাপ। ঠোঁটের কোণে নেই কোনো হাসির ঝলক। কেবল নিথর হয়ে রুমের এক কোণায় বসে আছে সে। তার কাজিনরা হাজারো গল্পে মেতে ছিলো। তারা ভাবছে কবিতা বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিবে এ-কারণে তার মন খারাপ। অথচ সে বুকের ভেতর কত বড় পাথর রেখে আজ বউ সেজেছে তার ধারণা কারও নেই। যার সাথে সে তার কষ্ট ভাগ করবে এমনও কেউ নেই। আর দুইজন কাছের মানুষ তাহিরা এবং অনু, তাদেরও আসতে দেয় নি কবির। কবিরের মতে তাদের সায় পেয়েই কবিতা তীর্থের সাথে সম্পর্ক করেছে। এমনকি তাহিরাকে বাড়ির দরজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কবির। অথচ তাহিরাকেও এই বাড়ির মেয়ে বলা হতো একসময়।
বর আসার খবর শুনে সবাই দৌড়ে যায় রুম থেকে। কিন্তু কবিতা এক ইঞ্চিও নড়ে। সেখানেই বসে রয় নিথর পাথরের মতো। কিছু সময় পর রুমে প্রবেশ করে কবিতার মা-বাবা। মা কবিতার গলায় একটি স্বর্ণের হার পরিয়ে দিয়ে বলে, “তোর বাবার পক্ষ থেকে উপহার এইটা। তোর জন্য অনেক আগে কিনে রেখেছিলো।”
কবিতা তখনও কিছু বলে না।
মা আবারও বলে, “তুই আজও মুখ ফুলিয়ে আছিস? দেখ তোর ভাই খারাপ কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না তোর জন্য। কবির তোকে অনেক আদর করে।”
“হ্যাঁ, তাইতো আমাকে বিক্রি করতে চাইছে।” কবিতার কথা শুনে রাগ উঠে যায় তার মা’য়ের, “এইসব কী আজেবাজে কথা বলছিস তুই? আমারই দোষ, আমি আদর দিয়ে তোর মুখ বড় করেছি। তাই আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে। ভুলেও মেহমানদের সামনে বাজে কিছু বলবি না।”
কবিতা শীতল দৃষ্টিতে তাকায় মা’য়ের দিকে। প্রশ্ন করে, “জয়ের বাবা এই বিয়ের পরিবর্তে তোমার বড় ছেলেকে প্রমোশনের ওয়াদা করে নি?”
কথাটা শুনতেই মা’য়ের মুখের রঙ উড়ে যায়। আঁতকে উঠে কবিতার বাবা, “কবিরের মা কবিতা কী বলছে এইসব? এই কথাটা কী সত্যি?”
“মানে শুধু আত্নীয় হিসেবে বলেছে সাহায্য করবে। বিয়ের পরিবর্তে না।”
কবিতা উঠে দাঁড়ায়। তার গলার হারটা খুলে তার বাবার হাতে দিয়ে বলে, “তোমার কিছু বলার দরকার নেই বাবা। আজ পর্যন্ত যেমন সব কিছুতে রোবটের মতো চুপ থেকে দেখেছ আজও তাই করো। হয়তো শুনতে খারাপ লাগবে বাবা কিন্তু তুমি টাকা দিয়ে আমাদের বড় করা ছাড়া কিছুই করো নি আমার জন্য। আমি তো ছোট থেকে তোমার ভালোবাসাও পেলাম না। আমি হওয়ার পূর্বেই তুমি বিদেশ চলে গেলে। তুমি যখন ফিরে এলে তখন আমি অনেক খুশি ছিলাম কিন্তু পরে যেয়ে মনে হল তুমি থাকাটা এবং না থাকাটা একই। কখনো অনুভব হয় নি তুমি আমার কাছে। তুমি ছোট থেকে ভুল সঠিক কোনো কিছুতে কথা বলো না। এমনকি যখন আমাকে শর্ত দিয়ে বিয়ে করানো হচ্ছিল তখন তুমি কিছু বলতে পারলে না, যখন আমাকে তোমার ছেলে মেরেছিল তখনও কিছু বললে না, যখন আমাকে এমন ছেলের সাথে বিয়ের ঘোষণা করা হল যে চরিত্রহীন তখন কিছু বলো নি। আজ তোমার মুখে প্রতিবাদের সুর মানায় না।”
মা কবিতাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন, “নিজের বাবার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“সত্য কথা কটুই হয়। যেমন তোমাকে বলছি তুমি তোমার বড় ছেলের ভালোবাসায় অন্ধ। একটা কথা বলো, আমাকে কী পেলে লালন-পালন করেছিলে ছেলের প্রমোশনের জন্য বিক্রি করার জন্য?”
“বেয়াদব মেয়ে।” সজোরে চড় মারে মা কবিতার গালে। আরও কয়টা মারতে নিলেই তার বাবা এসে ধরে নেয় তাকে। মা ক্রোধের সুরে বলে, “তোর মত মেয়েকে জন্ম দেওয়া ভুল হয়েছে আমার। বেয়াদবি ছাড়া কিছু শিখে নি। সারাক্ষণ মুখের উপর উওর দেয়। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছিস, মেয়েদের মুখের উপর কথা বলা মানায় না। তোর ওই ছেলের সাথে প্রেম করার আগে পরিণাম মাথায় আসে নাই? আরে সব ওর নাটক ওই ছেলের সাথে বিয়ে করতে পারে নি বলে। ওর আফসোসও নেই যে ওই ছেলে ওর বড় ভাইয়ের জন্য হাত তুলেছে।”
“হ্যাঁ এই নিয়েই তো তোমার মা, ছেলের জেদ। এর পরিবর্তে নিজের মেয়ের জীবন নষ্ট করে দেও কার কি? তীর্থকে হারানোর যত কষ্ট আমার হৃদয়ে ছিলো তা শতগুণ গতরাতে বেড়ে গেল। যখন আমি আমার আপন বড় ভাইকে ফোনে কথা বলতে শুনলাম, যে আমার এই বিয়ের পরিবর্তে উনি প্রমোশন পাচ্ছে। বাহ! মা, আমি তোমাদের উপর এই কারণে রাগ না যে তোমরা আমাকে তীর্থের সাথে বিয়ে দেও নি। তোমরা আমার পরিবার। আমার জীবনের জন্য ভালো খারাপ তোমরা বুঝো। কিন্তু তা বুঝেও কেবল নিজের স্বার্থের জন্য তোমরা আমার জীবন নষ্ট করছ। আমি জানি ভাইয়া তার অপমানের প্রতিশোধ এবং তার লাভের জন্য আমাকে জয়ের মতো এক নেশাখোর এবং মেয়েবাজ ছেলের সাথে বিয়ের বন্ধনে বাঁধছে। কিন্তু আমি বিয়েটা করব।” শক্ত হয়ে বলে কবিতা। তার দৃষ্টি স্থির। অথচ সে চোখে জমে আছে জল। হঠাৎ-ই তার গাল বেয়ে জল পড়তে থাকে। কিছু তার দৃষ্টি নম্র হয় না। সে কঠিন গলায় বলে, “এই বিয়ের সাথে এই পরিবারের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। আজকের পর থেকে আমি তোমাদের নিজের চেহেরাও দেখাব না। ভেবে নিও তোমাদের মেয়ে মরে গেছে।”
কথাটায় বড়সড় ধাক্কা লাগে কবিতার মা’য়ের। সে শিউরে ওঠে কথাটা শুনে। অস্থির হয়ে তার স্বামীকে বলে, “এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে। কী বলছে এইসব? তুমি শুনছ ও কী বলছে?”
এতক্ষণে রুমে ঢুকে আবির। আবিরকে দেখে তার মা ছুটে যেয়ে তার হাত ধরে বলে, “আবির দেখ মেয়েটা জেদের চোটে যা তা বলছে। ও না’কি আমাদের জন্য মরে গেছে। এইসব কোনো কথা? কোন মেয়ে এইসব বলে?”
“যে মেয়েকে তোমার ছেলে প্রতিশোধের জন্য অশিষ্ট ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছে।” আবির নির্দ্বিধায় বলল। কবিতা মা অবাক হয়ে চাইলেন তার ছেলের দিকে, “তুইও? তুই তো কখনো এমন ছিলি না।”
“দেখে আসো তোমার ঘরের হবু জামাই সম্ভবত গতরাতে নেশা করেছে। বরকে এমন অবস্থায় দেখায় তোমাদের কতটা সুনাম হচ্ছে তাও শুনে এসো। যাও।”
কথাটা শুনতেই কবিতার বাবা দ্রুত যায় হলরুমের দিকে।
মা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবিরের দিকে। তারপর দ্রুত চলে যায়।
আবির কবিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে বলে, “আমি আমার বন্ধুদের দিয়ে তীর্থ ও তার বন্ধুদের জেল থেকে ছাড়িয়ে প্রথমে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছি ব্যান্ডেজের জন্য। তীর্থের হাতও ভেঙে গেছে, প্লাস্টার করা হয়েছে। অনেক মারা হয়েছে না’কি তাদের। তারপর তাদের বাসে উঠানো হলো। ধ্রুব ও তাহিরা তাদের সাথে আছে। তাহিরা অনেক আসতে চেয়েছিলো ভাইয়া অনেক বাজে ব্যবহার করে তাকে তাড়িয়ে দেয়।”
“ভাইয়া তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?”
“কারণ তোর সাথে চোখ মিলানোর সাহস আমার নেই। বড় ভাই হিসেবে তোকে রক্ষা করাটা আমার দায়িত্ব ছিলো কিন্তু আমি….” কবিতা আবিরের কথা কেটে বলল, “তুমি যথেষ্ট করেছ ভাইয়া। আমি জানি। এই ঘরে কেবল তুমিই আমার পাশে দাঁড়িয়েছ। কবির ভাইয়ার বিরুদ্ধে জীবনে প্রথমবার, তাও আমার জন্য। কিন্তু তোমারও হাতে কিছু নেই। ভাইয়া আমি প্লিজ একবার তীর্থের সাথে কথা বলব।”
আবির তাড়াহুড়ো করে তার ফোনটা বের করে কবিতাকে দিলো।
“আমি কখনো ভাবতেও পারি নি কবির ভাইয়া রাগে কবিতার জীবন নষ্ট করে দিবে।” তাহিরা বলল। তাহিরার পাশেই বসা ছিলো ধ্রুব। তার কন্ঠ রাগান্বিত, “ওই ব্যাটা যখন তোমার অপমান করেছে মন চাইছিলো ওর আমের খোঁসার মতো নাকটা ঘুষি মেরে ভেঙে দেই। তুমি কিছু করতে দিলে না।”
তাহিরা, ধ্রুব, তীর্থ ও তার বন্ধুরা বাসে বসে আছে। ঢাকার জন্য রওনা দিচ্ছে তারা। তীর্থ ও লিমনের পিছনের সিটেই বসেছে তাহিরা ও ধ্রুব। তাদের দুইজনের কথোপকথন স্পষ্ট শুনতে পারছিলো তীর্থ। এমনিতেই সে কষ্টে ভুগছে। এর উপর দুইজনের কথোপকথন শুনে বেদনা আরও বাড়ছিলো তার। সে জানালার বাহিরে তাকাল। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। আজ সকালেই তাদের ছাড়া হয়েছে জেল থেকে। তীর্থ সেখান থেকে সবার আগে গেল কবিতার বাসায়। সেখানে বিয়ে হচ্ছে না। কোথাও হচ্ছে তা কেউ বলছেও না। কেউ জানে না। পাগলের মতো কিছুক্ষণ খুঁজলো কবিতাকে লাভ হলো না। এত বড় জায়গায় কাউকে খোঁজা সম্ভব না। তারপর ধ্রুব তাকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল ব্যান্ডেজ করাতে। সে আজ জানলো কবিতা তার জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। এই কথাটা জানার পর থেকে তার বুকের পীড়ন আরও বাড়লো।
পিছনের সিট থেকে ফোনের রিংটোনের শব্দ পাওয়া গেল। তারপর পাওয়া গেল তাহিরের কণ্ঠ, “হ্যালো আবির ভাইয়া, বলো। বিয়ে কী আসলেই হয়ে গেছে?”
তীর্থ চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নিলো। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে তার। কবিতার বিয়েটা আসলেই হয়ে গেছে? কবিতা আসলে অন্যকারো হয়ে গেছে?
তাহিরার কন্ঠ আবারও শোনা গেল, “কবিতা… কবিতা তুই! কেমন আছিস তুই?”
চমকে উঠে তীর্থ। চোখ দিয়ে স্তব্ধ হয়ে রয় মুহূর্তের জন্য। তারপর জলদি করে উঠে তাহিরার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “কবিতা… ”
ওপাশ থেকে কবিতার কান্নাভেজা কন্ঠ পেল তীর্থ, “তীর্থ তুমি কী বেশি ব্যাথা পেয়েছ? ভাইয়া বলল তোমার ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। তোমার না’কি হাতও ভেঙে গেছে। বেশি ব্যাথা করছে তোমার?”
“হুম, তবে এইটা ভেবে যে আমার কারণে আজ তুমি অন্যকারো হয়ে যাচ্ছ। আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।”
কবিতার কান্নার শব্দ বাড়লো। সে বলে, “তুমি নিজের খেয়াল রেখো তীর্থ। শুনো ভুলেও পাল্টাবে না। আগের মতো কোনো খারাপ জিনিসে জড়াবে না। তুমি আমার থেকে ভালো কাওকে পেয়ে যাবে। চিন্তা করো না।”
“কিন্তু আমার যে কেবল তোমাকেই চাই।”
“আমাদের ভাগ্যে নেই।”
“তুমি আমার কাছে এসে পড় কবিতা। তোমার ভাই আমার সাথে কি করবে আমার কিছু আসে যায় না। তুমি কেবল হ্যাঁ বলেছিলে কারণ তোমার ভাই তোমাকে হুমকি দিয়েছে যদি তুমি বিয়ের জন্য হ্যাঁ না বলো তাহলে আমাকে বড় কোনো কেইসে ফাঁসিয়ে দিবে। আমার এতে কিছু আসে যায় না। আর আমি এখন জেল থেকেও বাহিরে। তুমি আমার কাছে এসে পড়ো।”
“না, তীর্থ এ হয় না।”
“কেন না?”
“কারণ এখন কেবল তোমার আমার বিষয় না। আমি এই মুহূর্তে পালিয়ে যেয়ে আমার বাবা মা’য়ের সম্মানের বিসর্জন দিতে পারব না।”
কিছু সময় চুপ রইলো তীর্থ। তারপর বলল, “আর আমাদের ভালোবাসার? তুমি আমাদের ভালোবাসার বিসর্জন দিতে পারবে?”
“আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাব। ভালোবাসা অর্থই তো মিলন নয়, তাই না? ভালোবাসা তো অনুভূতি, কাছে থেকে হোক অথবা দূরে থেকে হোক ভালোবাসা যায়। ভালোবাসার জন্য তোমাকে আমার পেতেই হবে এমনটা নয়।”
তীর্থ অনুভব করলো তার চোখ ভিজে আসছে। এক ফোঁটা জল তার গাল গড়িয়ে পড়লো। সে কী কাঁদছে? গালে হাত ছুঁইয়ে দেখে তীর্থ। এক বয়স শেষে তার মনে হয় না সে কেঁদেছে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। কবিতা ফোনের ওপাশ থেকে বলল, “তীর্থ আমায় ওয়াদা করো, যদি কখনো কোনো মেয়ে তোমায় খুব ভালোবাসে তাহলে আমার জন্য তুমি নিজের মনের দরজা বন্ধ করে রাখবে না। তাকে আপন করে নিবে। ওয়াদা করো।”
তীর্থ ওয়াদা করে না। প্রশ্ন করে , “কবিতা তোমার বিয়ে কখন?”
“জানি না। বর পক্ষ না’কি এসেছে। ডাক দিবে।” মৃদুস্বরে বলে কবিতা।”
“কবিতা তোমার স্বামীকে বলবে, ও যদি কখনো তোমাকে এক বিন্দুও কষ্ট দেয় তাহলে আমি তার খুন করে ফেলব।কেউ তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না।” তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও তীর্থ আবদারের সুরে বলে, “অন্যকারো স্ত্রী হবার পুর্বে একবার ভালোবাসি বলো না।”
কিছুসময় কোনো কথাই বলে না কবিতা। তারপর সে কাঁপানো গলায় বলে, “ভালোবাসি তীর্থ, খুব ভালোবাসি।”
.
.
পাঁচ বছর পর,
(২০১৮)
বড় একটি কক্ষে একজন পুরুষ প্রবেশ করতেই আশেপাশের সবাই দাঁড়িয়ে যায়। তার হেঁটে সময় যতটা মানুষের পাশ কাটিয়ে যায় সবাই তাকে সম্মানের সাথে ‘গুড মর্নিং’ জানায়।
“তীর্থ স্যার, আজ সাড়ে এগারোটায় মিটিং আছে কিন্তু ধ্রুব স্যার আসে নি এখনো।” তীর্থের পাশে দাঁড়ানো একটি অল্পবয়সী ছেলে কথাটি বলে। তীর্থ শীতল দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। কিছু না বলে নিজের কেবিনের দিকে রওনা দেয়। ছেলেটিও তার পিছু নেয়।
তীর্থ চেয়ারে বসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, “ধ্রুব আসে নি তুমি এই কথা আমাকে কেন জানাচ্ছ? ওর সাথে যোগাযোগ করাটা তো তোমার দায়িত্ব তাই না?”
ছেলেটার নাম রাহাত। সে ভয়ে এক ঢোক গিলল। প্রায় তিন বছর ধরে সে তীর্থের সাথে কাজ করছে অথচ এখনো তার থেকে বাঘের মতো ভয় পায় সে। সে আমতা-আমতা করে বলল, “স্যার উনি কল ধরছে না। কন্টেক্ট ফাইনাল করার জন্য আপনাদের দুইজনে স্বাক্ষর লাগবে।”
তীর্থ বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকায় রাহাতের দিকে। তারপর ফোনটা বের করে ধ্রুবকে কল করার জন্য। চার বছর হলো এই ব্যবসা শুরু করেছে সে এবং ধ্রুব অংশীদার হিসেবে। আজ তাদের ব্যবসা সফল। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের কারখানায় তৈরি করা পোশাক ও গহনার দোকান আছে। তাদের কাজের চাপ বাড়লো কিন্তু ধ্রুবর মধ্যে সে অলসতা ভাবটা আজও কমলো না।
ধ্রুব ঘুমাচ্ছিলো। ঘুমের মধ্যেই কারও নরম হাতের স্পর্শ পায় সে। সে হাতটা ধরে কাছে টনে বুকে জড়িয়ে ধরে। তাহিরা বিরক্তি নিয়ে বলে, “উফফ তুই ঘুম থেকে কী উঠবি না।”
“এমন করিস কেন? ঘুমাতে দে না।”
“সকাল এগারোটা বাজে। নবাবেরাও এতক্ষণ ঘুমায় না মনে হয়। তীর্থ কল দিয়েছে তোর না’কি মিটিং আছে সাড়ে এগারোটায়। আমি অফিসের কাজ ছেড়ে তোকে উঠাতে এসেছি। জলদি উঠ।”
ধ্রুব তাহিরার হাত ধরে থাকে একটানে কাছে নিয়ে আসে। তার দিকে তাকিয়ে ঘুম মেশানো মুগ্ধ কন্ঠে বলে, “ঘুম থেকে উঠতেই একটি রূপসীকে নিজের বাহুডোরে পেলে কার অফিসে যেতে মন চাইবে?”
“তো মহারাজ আপনার কী করবার ইচ্ছা?”
ধ্রুব তাহিরার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার ইচ্ছা তো আগামী মাস থেকে পূরণ হবে। আগামী মাসে বিয়ের পর থেকে তোকে নিজের থেকে দূরই করব না। জাহান্নামে যাক ব্যবসা বাণিজ্য। আমি তো সারাক্ষণ কেবল তোকে আদর করব।”
তাহিরা ধ্রুবকে দূরে সরাতে চাইলো। ধ্রুবও ন্যাছোড়বান্দা। সে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে। বলে, “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না অবশেষে আমাদের বিয়ে হবে। আজ তোর বিয়ের শাড়ি কিনতে যাই চল।”
“দুইটা না কিনলাম। একটা অনুষ্ঠানে কয়টা শাড়ি পড়ব আমি?”
“এইজন্যই তো বললাম হলুদ, মেহেদী, বিয়ে, বৌভাত সব করি কিন্তু তুই একটা অনুষ্ঠানের বেশি তো করবিই না।”
“আমি তো কোর্ট ম্যারেজই করতাম। তুই জেদ করায় একটায় মানলাম। আমার কাছে এই অনুষ্ঠানগুলো বিরক্তকর লাগে। আচ্ছা এইসব কথা তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে, উঠে এইবার যা অফিসে।”
আলতো করে তাহিরার মুখে এসে লাগা চুলগুলো সরিয়ে ধ্রুব বলে, “আরেকটু দেখে নেই তোকে।”
“অর্ধেক দিনই তো দেখিস। আর কত দেখবি?”
“তোকে প্রতিমুহূর্ত দেখলেও কম লাগে। না দেখলে মন ভালো লাগে না, তোকে দেখলেও চোখের তৃষ্ণা মিটে না।”
#মুহূর্তে
পর্ব-১৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তোকে প্রতিমুহূর্ত দেখলেও কম লাগে। না দেখলে মন ভালো লাগে না, তোকে দেখলেও চোখের তৃষ্ণা মিটে না।”
তাহিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকায় ধ্রুবর দিকে। তার ঠোঁটের কোণে এঁকে উঠে এক মন ভোলানো হাসি। ধ্রুবর কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো সে।
তারপর বলল, “সারাজীবন এভাবেই আমাকে ভালোবাসবি তো?”
“সন্দেহ আছে?”
তাহিরা মাথা নাড়ায়, “না। কিন্তু এখন উঠে তো অফিসে যা, নাহয় তীর্থ আবার আমাকে ফোন দিয়ে বকবে। আর সাথে অফিসে স্যারের কাছেও বকা খাব।”
“সবাই আমার প্রেমের দুশমন। ধ্যুর।”
বিরক্তি নিয়ে ধ্রুব তাহিরাকে ছেড়ে উঠে যায়। তাহিরাও উঠে জলদি করে নাস্তা বানায় ধ্রুবর জন্য।
যদিও ধ্রুব একটু দেরিতে পৌঁছায় অফিসে কিন্তু মিটিং ভালোই গেল। মিটিং শেষে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ধ্রুব। আর বলে, “ভাই কত ঝামেলা এইসব কাজে!”
তীর্থ ল্যাপটপে কাজ করছিলো। কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ধ্রুবর দিকে। আর বলে, “সকাল এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে মিটিং এ দেরিতে আসাকে ঝামেলা বলে না।”
বিরক্তি নিয়ে তীর্থ তাকায় ধ্রুবর দিকে। আবার চোখ নামিয়ে নেয়।
ধ্রুব নড়েচড়ে বসে, “আরে ভাই এসে স্বাক্ষর তো সময়ে করলাম তাই না? তুই তো জানিস এইসবে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি বলেছিলাম তোকে। সম্পূর্ণ মালিকানা তুই নিয়ে নে।”
“যখন আমার প্রয়োজন ছিলো তখন তুই মূলধন সম্পূর্ণ দিয়েছিলি। আর আজ যখন আমাদের ব্যবহার সফল তখন সব ভুলে যাব? অসম্ভব।”
“তোর যত জীবনের নীতি। আচ্ছা এইসব বাদ দে, আজ পলাশের বোনের বিয়ে। মনে আছে তো? যেতে হবে।”
“তুই যা, আমি যাবনা। আমার কাজ আছে।”
“ভাই তোর কাজ একদিন অপেক্ষা করতে পারব। ওর বোনের বিয়া না। পলাশ অনেক মন খারাপ করবে তুই না গেলে।”
একপ্রকার বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলল তীর্থ। তারপর বলল,
“ঠিকাছে দেখি। আচ্ছা আমি একটু কারখানা থেকে ঘুরে আসি।” তারপর ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
রাহাত গভীর নিশ্বাস ফেলে তীর্থ যেতেই। তার মনে হচ্ছিলো এতক্ষণ ধরে সে নিশ্বাস আটকে রেখেছিলো। সে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আপনি এতটা মজার মানুষ তীর্থ স্যার আপনার বন্ধু হলো কীভাবে? উনি কী সারাজীবন এমনই ছিলো?”
“অনেকটা। কিন্তু সেন্টি খেয়ে তারপর আরও মেন্টাল হয়ে গেছে। জোকটা একটুও মজার হয় নাই। আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে না। শুনো রাহাত, ছটফট করে আমার জন্য নাস্তার আয়োজন করো। তারপরে যেয়ে আমার বন্ধুর বোনের জন্য গিফট আনবে। আমি একটা মুভি দেখে নেই এই মাঝে।”
.
.
সন্ধ্যায় বিয়ের অনুষ্ঠানে যায় তীর্থ ও ধ্রুব। তাদের দেখে তো পলাশের পরিবার খুশিতে আত্নহারা। তাদের আপ্পায়ানের কোনো কমতি রাখে না। পলাশ তার সাথেই কাজ করে শুরু থেকে। আগেও ভার্সিটিতে পলাশের পড়াশোনার অনেক খরচ তীর্থ করতো। তার ভীষণ সম্মান করে পলাশের পরিবার।
তীর্থের ভীষণ বিরক্তি লাগছিলো অনুষ্ঠানে। তার এইসব পছন্দ না। চারদিকে গান বাজনার শব্দ। এরই মাঝে ফোন বেজে উঠে তার। ফোনটা উঠানো জরুরী। সে উঠে খুঁজতে থাকে এক নীরব জায়গা, কথা বলার জন্য। বারবার ফোন বাজতে থাকায় চিন্তায় পড়ে যায় সে, ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। এমতো সময় কারও সাথে ধাক্কা লাগে তার। ফোন থেকে চোখ সরাতেই দেখতে পায় মেঝেতে বসে আছে একজন যুবতী। যুবতীটি একহাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের কনুই ডলে নিলো। সে বিরক্তি নিয়ে উপরে তাকিয়ে বলে, “আপনার কি চোখ নেই? দেখে হাঁটা যায় না?”
উপরে তাকিয়ে এসে থমকে যায়। তীর্থকে দেখে। একবার দৃষ্টি পড়ার পর সে আর চোখ সরাতেই পারে না। তাকিয়েই থাকে অপলক।
তীর্থ জিজ্ঞেস করে, “ঠিক আছেন আপনি?”
মেয়েটির ঘোর ভাঙ্গে। সে অপ্রস্তুত হয়ে তাকায় আশে পাশে। তারপর হাত বাড়িয়ে দেয় তীর্থ তাকে উঠাবে আশায়। কিন্তু তীর্থ হাত বাড়িয়ে মেয়েটির হাত ধরে না। মেয়েটি লজ্জিত হয়। সে উঠে দাঁড়ায়।
তীর্থ তার পকেটে হাত ভরে শীতল গলায় বলে মেয়েটিকে, “আমার তো কাজে মোবাইলের দিকে তাকাতে হলো, কিন্তু আমার সাথে তো আপনিও দেখে হাঁটছিলেন না। দেখ হাঁটলে। নিচে পড়তেন না।”
বলেই সে মেয়েটির পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় তীর্থের দিকে। এরইমধ্যে তার ডাক পড়ে, “এই মৃণা ছবি তুলব তো, জলদি আয়।”
মৃণা পিছনে তাকায়। দূর থেকে তাও বান্ধবী রূপা তাকে ডাকছে। সে উঁচু স্বরে বলে, “আসছি।”
মৃণা আবারও একপলক তাকায় সুদর্শন পুরুষটির দিকে। তারপর যায় তার বান্ধবীদের কাছে। যেতেই রূপা মৃণার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “তুই পলাশ ভাইয়ার বসের সাথে কী কথা বলছিলি?”
“উনি পলাশ ভাইয়ার বস?”
“তো কি? দেখছিস না বরপক্ষ থেকে উনাদের বেশি খাতিরযত্ন করা হচ্ছে। বাট দুইজন দেখতেও সেই আসে। একেকটা মাল।”
মৃণা চোখমুখ বানিয়ে বলল, “মাল আবার কী?”
“আরে জানিস না। আচ্ছা শুন…”
“না ভাই শোনা লাগবে না। গত একমাস হলো আমার বন্ধুত্বের এরই মধ্যে তোর মুখ থেকে যা শুনছি তা শুনে আমার কান দিয়ে রক্ত বের হয় নাই এই বেশি। তুই বলতে চাইলে আমি তোর বয়ফ্রেন্ডকে কল দিতে পারি।” মৃণা ফোন বের করতেই রূপা খপ করে তার হাতের থেকে ফোন নিয়ে বলে, “এক লাত্থি মেরে সদরঘাট পাঠায় দিব। বেশি কাহিনী করবি না। যেহেতু প্রিয়ার বিয়ে সেহেতু ওর সাথে দুই চারটা ছবি তুলে নেই। তারপর যেয়ে ওই দুইটা লোকের সাথে কথা বলব।”
“কথা বলব! কেন?”
“কারণ দুইজনই দেখতে জোস।”
“এখানে আরও অনেকে আছে যারা দেখতে জোস।”
“কিন্তু তাদের দিকে তো তুমি হ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলে না। আর এত ভালো পজিশনে আছে ভবিষ্যতে আমাদের কাজেও আসতে পারে। ইনফ্যাক্ট ভবিষ্যত কেন আমাদের এসাইনমেন্টের কাজেই আসতে পারে।”
রূপা মৃণাকে নিয়ে প্রথমে যেয়ে প্রিয়ার সাথে ছবি তুলে সত্যিই যায় ধ্রুব ও তীর্থের কাছে। যেয়েই ধ্রুবর সাথে কথা বলা শুরু করে। ধ্রুবও কি সুন্দর তার সাথে কথা বলল। মৃণা বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিল তীর্থের দিকে। তার সম্পূর্ণ ধ্যান ফোনে। তীর্থ একবার চোখ তুলতেই দুইজনের চোখে চোখ পড়ল। হলো একমুহূর্তে দৃষ্টিবন্ধন। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয় মৃণা। লজ্জায় সে কুঁকড়ে গেল। মৃণা আবারও তাকায় তীর্থের দিকে। দেখার জন্য যে তীর্থ কী তার দিকে তাকিয়ে আছে কি’না? কিন্তু তীর্থের দিকে তাকিয়ে দেখে সে উঠে চলে গেছে। মৃণা হতবাক। এমন লোক সে আর দেখে নি। তার রঙ একটু চাপা কিন্তু তার সৌন্দর্যের গুণগান সে ছোট থেকে শুনেছে। কোনো পুরুষের দৃষ্টি একবার পড়লে সহজে সরে না। অথচ তীর্থ তার দিকে তাকাচ্ছেই না।
.
.
“বউ…এই বউ আমার চা কই?” জাহানারা বেগম উঁচু স্বরে ডাকলেন কবিতাকে। কবিতা তার ছেলে কাব্যকে খাওয়াচ্ছিলো। শাশুড়ির ডাক শুনে সে বলল, “মা কাব্যকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
“কেন তুমি জানো না আমি এই সময় চা খাই? তোমার ছেলেরে আগে পরে খাওয়াইতে পারো নাই? ছেলের চার বছর হইয়া গেছে এখনো হাত দিয়ে খাওয়ানো শিখে নাই। জমিদারের বংশ থেকে আসছে।”
কবিতা বেশ বিরক্ত হয় শাশুড়ির কথা শুনে। সে-ও বলে, “মা এভাবে বংশ তো আপনাদেরই।”
এই হলো। এরপর শুরু হলো তার শাশুড়ির কথা। সে হাই হুতাশ করে নানান কথা বলতে থাকে। তার কথায় কবিতার দুইবছরের মেয়ে কুহুও ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে। কবিতা তার ছেলেকে খাবার খাওয়া রেখে দৌড়ে যায় তার রুমে। কুহুকে যেমন তেমন করে সামলে নিয়ে তার শাশুড়ির জন্য চা’য়ের পানি বসায়। ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে ঘরের সব কাজ সেরে নেয়। ঘড়ির দিকে একবার তাকায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে তার স্বামীকে ফোন দিলো কিন্তু ফোনটা সে ধরলো না।
.
.
দুইদিন পর মৃণা ও রূপা যেয়ে হাজির হয় তীর্থের অফিসে। দুইজনে আসে তাদের ভার্সিটির এসাইনমেন্টের জন্য। তাদের বাংলাদেশের শিল্প উন্নোয়ন নিয়ে একটি এসাইনমেন্ট করতে হবে। ধ্রুব ও তীর্থ দুইজনই শহরের বড় ব্যবসায়ী। এর উপর প্রিয়ার পরিচিত। তারা নিজেরা
দুইজনের সাথে কথা বললে ভালো মতো বুঝতে পারবে। এছাড়া কারখানাতেও কীভাবে কাজ করা হয় তাও নিজের চোখে দেখতে পারবে। রূপা ধ্রুব এবং পলাশের সাথে কথা বলে এসাইনমেন্টের জন্য তাদের রাজি করেছে।
দোতলা বিল্ডিং। অথচ এই দোতলায় উঠতে যেয়েই তার অনেক অস্থির লাগছে। এই দুইদিনে সে তীর্থের কথা অনেকবার চিন্তা করলো। কেন যেন লোকটার কথা বারবার মাথায় ঘুরছিলো। প্রথমে রূপা উপরে যায় ধ্রুবর সাথে কথা বলতে। মৃণা নিচেই দাঁড়ানো ছিলো। রূপার কল পেয়ে সে উপরে উঠার জন্য রওনা দিলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিলেই হঠাৎ সে সামনের থেকে আসা তীর্থকে দেখতে পেল। বোকামি করে পিছাতে নিলেই পড়ে যেতে নিলো সিঁড়ি দিয়ে। ভাগ্যিস তীর্থ তার হাত ধরে নেয়। তীর্থ তার হাত ধরে টান দিতেই মৃণা কাছে চলে আসে তার। চোখে চোখ পড়ে। পরের মুহূর্তেই বুকের ভেতর ধক করে উঠে মৃণার। দৃষ্টি বন্ধনের পরের মুহূর্তেই সে চোখ সরিয়ে মৃণা। লজ্জার লালিমা তার মুখে মেখে যায়। কেমন এক অনুভূতি আঁকড়ে ধরে তাকে।
হঠাৎ-ই রূপার কন্ঠ তার কানে ভাসে, “ও’মা এখানে দেখি অন্য এক কান্ড চলছে।”
রুপা দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির কাছেই। ধ্রুব তার পাশেই দাঁড়ানো। মৃণা তাদের দেখে আরও লজ্জা পায়। আবারও তীর্থের দিকে তাকায় একরাশ লজ্জা নিয়ে। তারপর এক পা পিছিয়ে যায়।
ধ্রুবও মশকরা করে বলল, “বাহ ভালোই তো যাচ্ছিস। আমি তো তোর থেকে এইটা কল্পনাও….”
তীর্থ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকাতেই সে চুপ হয়ে গেল। তার জোর করে হেসে বলল, “আমি তো মজা করছিলাম। সবকিছু এত সিরিয়াস নেওয়া ঠিক না ব্রো।”
তীর্থ কিছু না বলে যেতে নিলেই ধ্রুব বলে, “দোস্ত ওদের একটু সাহায্য লাগতো। ভার্সিটিতে এসাইনমেন্ট দিয়েছে ওদের তা নিয়ে। আমাদের ব্যবসা, কীভাবে আমরা সব শুরু করেছি এবং কীভাবে এতটা সাফল্য অর্জন করলাম এইসব নিয়ে।”
“আমার এত ফালতু সময় নেই। তোর আছে, তুই বসে হেল্প কর ওদের।”
“ব্রো প্লিজ। আমি ওয়াদা করেছি ওদের।”
“তুই করেছিস আমি না।” বলেই তীর্থ পাশ কাটিয়ে চলে যায় মৃণার। মৃণা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় তীর্থের যাওয়ার দিকে।
রূপা তার বুকের বা পাশে হাত রেখে বলে, “উফফ এটাটিউড দেখেই তো আমি ফিদা হয়ে গেলাম। এমন এটাটিউডে আরও দশগুণ বেশি হ্যান্ডসাম লাগে তাকে।”
“আমি তো বুঝেছিলাম তোমার কাছে আমাকে বেশি হ্যান্ডসাম লেগেছে।” ধ্রুবর কথা শুনার সাথে সাথে ভাব পরিবর্তন করে নেয় রূপা। বলে, “আপনাকে একদম নায়ক নায়ক লাগে।”
“এখন তো বলবেই। আচ্ছা আসো, কেবিনে আসো।”
রূপার সাথে মৃণাও গেল ধ্রুবর পিছনে। সে আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করে ধ্রুবকে, “আচ্ছা উনার ব্যবহার এমন রুক্ষ কেন?”
“উনি মানে কে? তীর্থ?”
“হুঁ”
ধ্রুব হেসে বলে, “তোমার তো বেশ আগ্রহ দেখছি।”
খানিকটা লজ্জা পেল মৃণা। সে আমতা-আমতা করে বলল, “এমনিতেই। জানতে ইচ্ছা হলো।”
ধ্রুব প্রথমে কিছু বলে না। নিজের কেবিনে যেয়ে বসে উওর দিলো মৃণার প্রশ্নের, “একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসতো। মেয়েটার বিয়ে অন্যকোথাও হয়ে গেছে। তীর্থ তাকে প্রচুর ভালোবাসতো। কেবল তার জন্যই হাসতো।”
হঠাৎ করে মন খারাপ হয়ে গেল মৃণার। অচেনা একজন মানুষের জন্য এতটা খারাপ লাগতে পারে সে জানতো না। ধ্রুব একটু ঝুঁকে ভালোভাবে তাকায় মৃণার দিকে। তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, “তোমাকে অনেকটা ওই মেয়ের মতো দেখা যায়।”
রূপা মিটিমিটি হেসে বলে, “মানে ওর চান্স আছে?”
“থাকতেও পারে। কিন্তু কথা হলো ওর সামনে ভুলেও বলবে না আমি তোমাদের কথাটা জানিয়েছি। আমাকে খুন করে ফেলবে।”
হাসলো রূপা, “এক শর্তে, আপনি তীর্থকে আমাদের এসাইনমেন্টে সাহায্য করতে বলবেন।”
“ওরে বাবা ভালো ফাঁসলাম তো। আচ্ছা ঠিকাছে ডান।”
এরপর ধ্রুব ও রূপার গল্প শুরু হলো। দুইজনের মাঝে বসে মৃণার অস্থির লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো এইখানে তার কোনো কাজ নেই। তাই সে উঠে বাহিরে গেল। বাহিরে যেতেই তার চোখ পড়ে সামনে রুমে ঢুকতে যাওয়া তীর্থের দিকে। তার ইচ্ছা করল তীর্থকে ডাক দিয়ে কিছু বলবে কিন্তু কোনো কথাই পেল না সে। তীর্থ তার সামনে দিয়ে কেবিনে ঢুকে গেল কিন্তু সে কিছু বলতে পাড়ল না।
.
.
আজ আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। রাতের আঁধারে বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে দোলনায় বসে আছে মৃণা। বাতাস বইছে তীব্রভাবে। বাতাসে মাখানো প্রকৃতির সুরভী। সে দোলনায় বসে গ্রিলে পা রেখে দুলছে তার কোলে একটা ডায়েরি এবং হাতে একটি কলম। কলমটা সে দুই ঠোঁটের মাঝে নিয়ে ডুবে গেল এক কাল্পনিক জগতে। তার ঠোঁটের কোণে এঁকে উঠে এক চিলতে হাসি। চোখের সামনে ভেসে উঠে এক রাজকুমারের মতো দেখতে পুরুষ। সে রাজকুমারটা দেখতে একদম তীর্থের মতো। নিজে নিজেই লজ্জা পেল মৃণা। তার ডায়েরিতে লিখল এক ছন্দ,
“মুহূর্তখানিকের দেখা,
শুভ দৃষ্টি মিলনের রেখা,
মাতাল হাওয়ায় ছড়াছড়ি
আমার মন তো শুনে না কোনো জোরাজুরি,
কল্পনায় এসো তুমি প্রিয়,
আমার জন্য তুমি যে শ্রেয়।
আচ্ছা আরেকটিবার ভালোবাসার স্বাদ
কী জানতে চাও তুমি?
এক রোদ্দুর ভালোবাসার ছোঁয়ায়
কী জগৎ ভুলতে চাও তুমি? ”
মৃণা কবিতাটি বারবার পড়ে। তার বিশেষ ভালো লাগে না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৃষাঙ্গ মেঘে ভরা আকাশটার দিকে আবারও তাকায়। সে বুঝে না, তীর্থের মতো ছেলেকে ছাড়ার মতো বোকামি কোন মেয়ে করেছে। সে জীবনে তীর্থের মতো সুদর্শন পুরুষ অনেক কম দেখেছে। এর উপর এত বড় বিজনেস আছে তার। মেয়েটাকে না’কি অনেক ভালোও বাসতো, কেবল তার জন্য হাসতো! ভাবা যায়? তারপরও তীর্থকে ছেড়ে অন্যকাওকে বিয়ে করেছে সে? সে হলে তো কখনোই এমন পুরুষকে ছাড়তো না। তার জন্য সারা দুনিয়াকে ছেড়ে দিতো। আচ্ছা তীর্থ কী দ্বিতীয়বার কাওকে ভালোবাসতে পারে? তার প্রথম প্রেমিকার মতোই আবার কাওকে ভালোবাসবে তীর্থ? অথবা এরচেয়ে গভীর ভাবে? এমন ভালোবাসার অনুভূতিটা ঠিক কেমন?
মৃণার বুকের কোণে কেমন একটা অনুভূতি হলো।মিষ্টি অনুভূতি। ওদিকে মৃণার ফোন বেজেই যাচ্ছে অথচ তার সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। সে ডুবে আছে তীর্থের কল্পনায়।
চলবে….
[