মুহুর্তে পর্ব -৫৩+৫৪

#মুহূর্তে
পর্ব-৫৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কথাটা শুনে মৃণা বড়সড় এক ঝটকা খায়। স্তব্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ ভয় তাকে এমনভাবে কাবু করেছে যেন তার প্রাণ গলায় আটকে এসেছে।

“কী হলো এখন এই চ্যাঁ চ্যাঁ করা মুখ বন্ধ হয়ে গেল কেন?” অনু বলল দৃঢ় কন্ঠে। আইদ তার বাহু ধরে বলল, “অনু এসব কথা সবার সামনে…”
অনু তার হাত এক ঝাড়নে সরিয়ে দেয়, “সবার সামনেই বলবো। এটা এখন আর তোদের ব্যাপার না যে তুই আমাকে চুপ থাকতে বলবি আর আমি চুপ থাকবো। ও আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলেছে। তোর কাছে নিজের সম্মান তুচ্ছ হতে পারে কিন্তু আমার কাছে অনেক মূল্যবান। এছাড়া তুই ছেলে তোকে এক দুইটা কথা বলে সবাই চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিকই আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলবে। তুই চাস তোর জন্য আমার চরিত্র সবার সামনে খারাপ হোক?”
আইদ কিছু বলল না। অনুকে আর থামাল না। অনু হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে মৃণার চোখে চোখ রেখে বলে, “তো কি বলছিলে আমি বেশরম? আর তোমার মধ্যে শরম উতলায় পড়ছে? তুমি সে না যে এক বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক তৈরির জন্য ব্যকুল হয়ে পড়েছিলে? তার দু’টো বাচ্চা আছে জেনেও।”

“দে..দেখো নিজের ভুল লুকানোর জন্য আমার নাম তুলবে না।” মৃণা আবার আইদের মায়ের দিকে তাকিয়ে বুল, “মা দেখেছেন এখন এরা নিজের ভুল লুকানোর জন্য আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলছে। কেবল আমার উপর না আপনার বংশের রক্তের উপরও।”
আইদ ধমক দিয়ে উঠলো, “মৃণা চুপ করো। তোমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করবে না? আমি ভেবেছিলাম তুমি এ কয়মাসে একটু হলেও শুধরে গেছ। কিন্তু তা ভাবাটা আমারই ভুল ছিলো। কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।”

বুঝে উঠার পূর্বেই আইদের মা তার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। উঁচু স্বরে বললেন, “তোর লজ্জা লাগে না, এই মেয়ের জন্য নিজের স্ত্রীকে কলঙ্কিত করছিস তুই? যদি এই মেয়ের কথা একটুও সত্যতা থাকতো, তাহলে এসব আগে বলিস নি কেন তুই? এখন নিজের চুরি ধরার পর নাটক করছিস?”

আইদের মা’য়ের কথা শুনে মৃণার প্রাণ ফিরে আসে। সে তার হাত ধরে বলে, “মা আমি এইখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। চলুন।”
মৃণা তাকে এবং নিজের মা’কে নিয়ে যাওয়ার সময় অনু বলে উঠে, “মিস্টার তীর্থের সংবাদ আপনারা সবাই নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেখানে তীর্থের বাহুডোরে একটি মেয়ের ছবি ছিলো। মেয়ের চেহেরাটা ঘোলাটে থাকার কারণে নিশ্চয়ই তার চেহারা দেখতে পারেন নি। আমার কাছে সে ছবিটা আছে, আপনারা চাইলে আমি আপনাদের সবাইকে তা দেখাতে পারি।”

কথাটা শুনেই সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মৃণা। পিছনে ফিরে দ্রুত যেয়ে অনুর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিলো। তার ফোন চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু কোন ছবিই পেল না সে। অনু তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “তুমি কিছু না করলে এভাবে দৌড়ে এলে কেন? তবে আপাতত আমার ফোনে না থাকলেও তা নিতে এক মুহূর্তেও লাগবে না। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আইদের কাছেই তো ছবি আছে। ওই তো ছবি তুলেছিলো।”

অনু একটু বাঁকা ঝুঁকে আইদের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “আর আন্টি আপনার বৌ’মায়ের প্রেগ্ন্যাসির কয় মাস জানেন? পাঁচমাসের বেশি হবে। আর আপনার ছেলের সাথে তার বিয়ের কয়মাস হয়েছে?”
আইদের মা এবং মৃণার মা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। তাদের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার অবস্থা। অনু আবার বলল, “একদম ঠিক। চারমাস। আপনারা এতদিনেও এটা ধরতে পারেন নি? আপনার ছেলের সাথে বিয়ের সময়ও ও গর্ভবতী ছিলো। অর্থাৎ তাদের বিয়ে হয় নি।”

মৃণা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাঁপছিল সে। এমন সময় তার মা সামনে এসে কাঁপানো গলায় জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বল…সত্যি বল এই মেয়ে কি ঠিক বলছে? কিছু বলছিস না কেন তুই? তুই… তুই কি সত্যি এসব করেছিস?” উওর না পেয়ে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সে মৃণার গালে, “তোর লজ্জা লাগে নি এসব করার আগে? তোকে এইসব করার জন্য এত ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি? তোর বাবা দিনরাত খেটে তোকে পড়াশোনা করিয়েছে, তোর সব ইচ্ছা পূরণ করেছে, তোকে এত সুন্দর একটা জীবন দিয়েছে। তাও তুই এসব করেছিস? লজ্জা লাগে নি তোর? একবার নিজের বাবার আমার কথা ভাবিস নাই? মুখ খুল নিলজ্জ মেয়ে কথা বল।”
বলতে বলতে সে মেঝেতে বসে পড়ে। অঝোরে কাঁদছে সে। নিজের কপালে মেরে বলে, ” আমি কষ্টে ছিলাম যে তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু এখন দেখি ভালোই হলো, সে তোর এই কুকীর্তির কথা জানলে এমনিতেই আর বাঁচতে পারতো না।”
আইদ এসে তাকে সামলায়, “আন্টি আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। দয়া করে সামলান নিজেকে।”

অনু এবার নরম গলায় কথা বলল, “আন্টি আমি জানি এ কথা এখন বলা ঠিক নয়। তবুও আপনার জানা উচিত। মৃণার বাবার মৃত্যুর কারণ আপনার মেয়েই। ও নিজের প্রেগ্ন্যাসির কথা ফোনে…” সম্পূর্ণ কথা বলার আগেই আইদ তাকে থামিয়ে দেয়, “অনু, হয়েছে। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ”
অনুও এবার আইদের কথা মেনে নেয়। চুপ হয়ে যায় সে। বুঝতে পারে তার কথাটা তোলা ঠিক হয় নি। মৃণার মা উঠে তার হাত ধরে বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করে, “না তুমি বলো। কি বলতেছিলে বলো। ওর কথা শুনো না। বলো তুমি।”

অনু আড়চোখে তাকায় আইদের দিকে তারপর মাথা নামিয়ে বলে, “মৃণার প্রেগ্ন্যাসির খবর শুনেই ওর বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন।”
স্তব্ধ হয়ে যায় মৃণার মা। সে আর একটা শব্দও মুখে আনতে পারে না। সে নিচে পড়ে যেতে নিলেই আইদ তাকে ধরে নেয়। বলে, “আন্টি আপনার আর কিছু জানা লাগবে না। বাসায় চলেন।”
আইদ মৃণার মা’কে চলে গেল। পিছনে গেল আইদের মা’ও।

মৃণা সেখানে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে কি বলবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। এমন সময় একটি মেয়ে বলল, ” আমি এত নিলজ্জ মেয়ে জীবনেও দেখি নি। নিজে দোষ করে অন্যজনের উপর চাপাচ্ছিলো। সব কুকীর্তি সবার সামনে এসেছে, একদম ঠিক আছে।”

অনু পিছনে তাকিয়ে উঁচু স্বরেই বলল, “আপনাদের মধ্যে কে যেন আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছিলেন? তাদের চাঁদমুখটা একটু দেখি তো। সে কি কখনো আমাকে আইদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখেছেন? বন্ধুত্ব ও প্রেমিকের মধ্যে একটি সীমানা আছে এবং সে সীমানায় আমি থাকতে জানি। আর আপনারাও নিজের চিন্তাধারাকে উন্নত করতে শিখুন। আধুনিক শুধু মুখে হলেই হয় না।”

অনু রাগে সেখান থেকে বেরোতে নিয়ে আবার ফিরে এলো। মৃণাকে বলল, “আর তুমি বাদাম খাও। সম্ভবত আমাকে মনে নেই তোমার। ক’মাস আগেও বলেছিলাম যে আমি কবিতার বান্ধবী। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য সেদিন তামাশা করি নি। তার সম্মানের খাতিরে। কিন্তু কি ভেবেছিলে আমি আইদের মতো সবার কথা চিন্তা করব? একদম না। রাস্তায় হাঁটতে যেয়ে সাপ কামড় দিলে তা কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে কিন্তু নিজে সাপের সামনে যেয়ে নাচতে থাকলে যদি ভাবো যে সে সাপ তোমাকে কাপড় দিবে না তাহলে তো তা বোকামি। টাটা।”
অনু ভেংচি কেটে সেখান থেকে চলে গেল। মৃণা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ। আজ তার সব শেষ। সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন কি মুখ নিয়ে যাবে সে আইদের বাসায়? তার যে আর কোনো ঠিকানা নেই।
.
.
রাতে কবিতা বাসায় এসে দেখে কথন এসেছে। আবিরের সাথে গল্প করছে সে। সে আজ কথনকে এমনিতেই কল দিতো। তাহিরার চিকিৎসার জন্য কথা বলতে। যেখানে এখন সে তাহিরার চিকিৎসা করাচ্ছে সেখানে কোনো প্রকার উন্নতি দেখতে পারছে না সে। কথন যেহেতু ডাক্তার, ভালো উপদেশ দিতে পারবে সে। সে কথনের সাথে কথা বলতে যাব তখনি দরজায় কলিংবেল বাজে।

কবিতা দরজা খুলে অনুকে দেখে বলল, “আরে তুই এত জলদি এসে পরলি? পার্টি শেষ?”
“কথা বলিস না এই বিষয়ে। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।”
“কী হলো?”
অনু উত্তর দেয় না। সোজা ভেতরে চলে যায়। কবিতাও যায় তার পিছনে, “আরে হয়েছে কি তা তো বল।”
“ওই মৃণার বাচ্চা, শাঁকচুন্নি, ডাইনি, রাক্ষসীটা পার্টিতে এসে বলে আমার না’কি আইদের সাথে কি চলছে। আমার ক্যারেক্টরে সমস্যা আছে। সাহস কি ওই মেয়ের? আজ একবারে ধুঁয়ে দিসি। শালী বেশরম মাইয়া।”
“বলিস কি? কি হলো তারপর?”
“মাথা ঠান্ডা হলে কাহিনী বলবো নে। এখন ভাল্লাগছে না।”
“আচ্ছা তুই কুল ডাউন হো। আমি তোর পছন্দের কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।”
অনুর উঁচু স্বরে আবির এবং কথনও রুমের সামনে এসে পরেছিলো। কবিতাকে রান্নাঘরে যেতে দেখে কথনও তার পিছনে গেল। আবির গেল অনুর কাছে। তার পাশে বসে বলল, “মেজাজ কি বেশি খারাপ?”

অনু বিড়বিড় করে বলে, “একটু ভালো তো হয়েছিলো। পরে মনে পড়লো জনাব তো আজ নিজের এক্সের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। জনাবের মুখে যে হাসি মনে হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ জয় করে এসেছে। যেন আকাশে উড়ছে সে।”
“কি বলছো? শুনতে পারছি না।”
“কিছু না। আপনি বলুন, শুনলাম আপনিও আজ কারও সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। মিটিং ভালো গেল?”
“এক পুরনো ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
অনু আড়চোখে তাকায় আবিরের দিকে। আবারো বিড়বিড় করে বলে, “ফ্রেন্ড না গার্লফ্রেন্ড বলেন।”
“তুমি কি বলছো শুনতে পাচ্ছি না।”
“কিছু না।”
“কাব্যকে নিয়ে গিয়েছিলাম বুঝলে? ফ্রেন্ডের বাচ্চার সাথে এত ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। আসতেই চাইছিলো না।”
অনু এবার খুশিতে লাফিয়ে উঠে। উড়ু উড়ু গলায় বলে, “তার বাচ্চা আছে?”
“হ্যাঁ, কেন কি হলো?”
অনু নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “না না কিছু না। তো বলেন কি বলছিলেন।”
আবির হাসে, “তোমার মুড দেখছি ভালো হয়ে গেছে। সেখান থেকে কথনের সাথে একটা বাসা দেখতে গিয়েছিলাম। পছন্দও হয়েছে। ক’দিনেই সেখানে উঠবো। বাসা কাছেই। আমার সাথে কালকে দেখতে যাবে?”

অনু চোখ দুটো বড় বড় তাকায় আবিরের দিকে। সে মুহূর্তেই সকল রাগ গলে যায় তার। গাল লালচে হয়ে যায়। সে চোখ নামিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। আবির আবারও বলে, “কবিতাকে বলেছিলাম তাহিরাকে নিয়ে আমার সাথে শিফট করতে। তখন ও আমাকে জানায় তুমি ওর জন্য কতকিছু করেছ। হয়তো অন্যকেউ হলে করতো না। কবিতা আসলেই ভাগ্যবান, সে তোমার মতো বান্ধবী পেয়েছে।”
“এভাবে বলবেন না। আমার যা করা উচিত ছিলো তাই করেছি।”
“বাই দ্যা ওয়ে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োর কারণে তোমাকে বলা হয় নি। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। নীল রঙ তোমার উপর বেশ মানায়।”

অনুর লজ্জা আরও বাড়ে। লজ্জায় যেন মিইয়ে যায় সে। সে সিদ্ধান্ত নিলো আজ থেকে নীল রঙ তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। আগামীকালও সে নীল রঙের ড্রেস পরেই আবিরের সাথে যাবে।
.
.
কবিতা অনুর প্রিয় নুডলস রান্না করছিলো। চুলায় পানি বসিয়ে সবজি কাটছে সে। কথন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকে। কবিতা সবজির কাটা শেষে নুডুলস এর প্যাকেট আনতে যেয়ে ফিরতেই কথনকে দেখে ঘাবড়ে পিছিয়ে যেতে নেয়। সে পরে যেতে নিলেই কথন তার কোমর জড়িয়ে ধরে।

কবিতা কেঁপে উঠে কথনের স্পর্শে। স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চমকে উঠে তাকায় কথনের দিকে।
#মুহূর্তে
পর্ব-৫৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কবিতা কেঁপে উঠে কথনের স্পর্শে। স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চমকে উঠে তাকায় কথনের দিকে।
কথন কবিতার অবাক দৃষ্টিতে দেখে হেসে দেয়। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “এখন না ধরলেই তো চুলার উপর যেয়ে পড়তে। এত অসাবধানতা নিয়ে কাজ করো কীভাবে?”
কবিতা চোখ নামিয়ে নেয়। পিছিয়ে যেয়ে বলে, “ধন্যবাদ।”
তারপর কথনের পাশ কাটিয়ে যেয়ে ড্রয়ের থেকে নুডলসের প্যাকেট নেয়। এই ঘটনার পর আর একবারও কথনের দিকে তাকানোর আর সাহস করে না সে।

কথনও কিছু বলে না। সে এক কোণায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। এই নিরবতা কেমন বেমানান লাগছিলো কবিতার কাছে তাই সে বলে, “আজ আমি চাকরি ছাড়বার কথা বড় ম্যাডামকে বলেছি। আগামী মাসে ছাড়বো। ভাবছি অনলাইনে ব্যাবসাতে ধ্যান দিব। কিছু করার ইচ্ছা থাকলে এতটুকু ঝুঁকি তো নিতে হবে।”
“আমি জানি তুমি সাফল্য অর্জন করবে। তুমি যখন একটু ভালো করে কামাই করতে শুরু করবে তখন তোমার স্বপ্ন পূরণ করো।”
কবিতা হাসে, “আমার আগে যে ফ্যাশন ডিজাইনার হবার ইচ্ছা ছিলো সে কথা বলছেন? কিন্তু এখন সে বয়স নেই।”
“শেখার কোনো বয়স হয় না কবিতা। ইচ্ছা থাকলেই সব হয়।”

কবিতা মৃদু হেসে কথনের দিকে তাকায়, “এখন আমার কি ইচ্ছা করছে জানেন? আমার পরিস্থিতিতে যে নারীরা পড়েছে অথবা ভবিষ্যতে পড়বে তাদের সাহায্য করার সুযোগ। তাদের যেন নিজেকে নিরুপায় মনে করে তার স্বামীর ঘরে পড়ে না থাকতে হয়। নিজে কাজ করে জীবনে এগোতে পারে। সবার ভাগ্য তো আর আমার মতো হয় না যে তারাও অনুর মতো কাওকে পাবে। অনেকে ফ্যামিলি প্রেশারে এসে অনেক অত্যাচার সহ্য করে। আমার থেকেও অনেক করুণ অবস্থা হয় তাদের কিন্তু কোনো সুযোগ না থাকায় সে নরক থেকে তারা বেরোতে পারে না।”
“আমি জানি তুমি একদিন তোমার সকল স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।”

কবিতা একটু অবাক হয়ে তাকায় কথনের দিকে। তার নিজের উপরও তো এত বিশ্বাস নেই। তাহলে কথনের এত বিশ্বাস কীভাবে? আকস্মিকভাবে তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। নিজ অজান্তেই। সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে, “আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি অন্যসবার মতো আমার সাথে করুণা দেখান নি। সাহস দিয়েছেন। ধন্যবাদ।”
“শুধু ধন্যবাদ দিলে হবে? তোমার মনে হয় না এর পরিবর্তে তোমার কিছু দেওয়া উচিত?”
কী?”
“তোমার কি মনে হয় আমি কি চাইব?”
কবিতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। অস্বস্তিবোধ করে। সে ফিরে নিজের কাজ করতে করতে বলে, “আপনি কি চাইবেন আমি কি করে বলবো? আমার তো বিশেষ কিছু দেওয়ার সামর্থ্যও নেই।”
“আমি যা চাইবো তা কেবল তুমি দিতে পারবে।”
মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কবিতার। সে তার কাজ ছেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কথনের দিকে। কড়া কিছু বলতে যাবে তখনই কথন বলে উঠে, “তুমি যে নুডলস রান্না করছো তা চাইবো। এখন তুমি যেহেতু রান্না করছো কেবল তুমিই দিতে পারবে।”
কবিতা হতদম্ব হয়ে তাকায় কথনের দিকে, “আপনি নুডুলসের কথা বলছিলেন?”
“হ্যাঁ। তুমি কি ভেবেছ?”
লজ্জা পেল কবিতা। তার মাথায় বাজে একটি ধারণা এসেছিলো। এত বাজে কিভাবে চিন্তা করলো সে? সে তো জানে কথন এমন ছেলে না। সে মাথা নামিয়ে বলল, “কিছু না।”
“তো তুমি কি ভাবলে? তোমার মাথায় কি বাজে কিছু এসেছিলো? ছিঃ ছিঃ কবিতা এসব ভাবো তুমি?”
“আমি তেমন কিছুই ভাবি নি।”
কথন শব্দ করে হেসে উঠে, “আমি মজা করছি। গম্ভীরভাবে নিও না।”

কবিতার ফোন বেজে উঠে। মেসেজ আসে তার। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তীর্থের মেসেজ, “অবশেষে তোমার ইচ্ছা পূরণ করলাম। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি। এখন থেকে তুমি মুক্ত।”
বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে কবিতার। সে কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় মেসেজটির দিকে। সে তো এটাই চাইতো তাই না? এই মুক্তির জন্যই তো তার এত সংঘর্ষ করা। তাহলে মনটা এত খারাপ লাগছে কেন? কেন হৃদয়টা শূন্যতায় ভরে গেছে। কেন চোখ দুটো ভিজে আসছে তার।

কথন প্রশ্ন করে, “কার মেসেজ এসেছে যে এতক্ষণ ভরে দেখছ?”
কবিতার ঘোর ভাঙ্গে কথনের কন্ঠে, “কেউ না। কোম্পানি থেকে মেসেজ এসেছে।”
কবিতা ফোন রেখে তার কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কথন তার মতো কথা বলছে। কবিতা টুকটাক উওর দিলেও তার মন সেখানে নেই। হঠাৎ তীব্র ব্যাথা উঠেছে তার বুকে। হৃদয়টার মাঝে বেদনা ছড়িয়ে গেছে।
.
.
রাত হয়েছে। মৃণা বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢোকার সাহস হচ্ছে না তার। ভয়ে তার জান বেরিয়ে যাওয়া অবস্থা। কিন্তু রাত হয়েছে, তার যাবার অন্য কোন জায়গা নেই। অনেক সংকোচ নিয়ে বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজায়। অনেকক্ষণ পর দরজাটা খুলে আইদের মা। কেমন ঘিনঘিন দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মৃণার কষ্ট হলো খুব। যে নারী সারাজীবন তাকে মমতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। আজ তার চোখে ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই। আইদের মা রাগান্বিত স্বরে বলে, “এতকিছুর পরও এই দোয়ারে আসতে লজ্জা করে নি তোমার?”
মৃণা জানে এখন আর কোনো মিথ্যা বানিয়ে লাভ হবে না। তবুও সে চেষ্টা করে। কান্না করতে করতে বলে, “মা বিশ্বাস করেন ওসব মিথ্যা ছিলো। এটা সত্য যে আমার বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আজকাল তা কার না থাকে? কিন্তু আমার পেটের এই বাচ্চা আপনার বংশের রক্ত।”
“আইদ আমাদের তোমার প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখিয়েছে মৃণা। আর কত মিথ্যা বলবে তুমি? আর কত নাটক করবে?”

মৃণার কন্ঠ শুনে গেস্ট রুম থেকে তার মা দৌড়ে বেরিয়ে এলো। তার পিছনে ছুটে এলো আইদও।
মৃণার মা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একের পর এক কয়েকটা থাপ্পড় মারে। তারপর বলে, “তোর লজ্জা লাগে নাই এখানে আসতে? লজ্জা লাগে নাই? আমাদের মুখে কালি মাইখা এখানে কীভাবে আসলি তুই? আরও বেইজ্জতি করাতে আসছিস তুই? আরে তুই জন্ম হওয়ার পরেই মরে গেলি না কেন? নিজের বাপরে খাইয়া লাইলি আর কারে মারতে চাস? আমাকে? নেয় মাইরা ফেল আমাকে। নিজের হাতে মাইরা ফেল। তোর মা হওয়ার থেকে তো মরা ভালো। সমাজে বের হওয়ার মতো অবস্থা রাখিস নাই। কলঙ্কিত করে দিলি আমাকে, তোর মরা বাপকেও।”
মৃণার মা তার হাত দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরে।

মৃণা চমকে উঠে। সে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। সে কি করবে, না করবে কিছুই বুঝতে পারে না। কাঁপতে থাকে সে।

আইদ দ্রুত যেয়ে মৃণার মা’কে ছাড়ায়, “আন্টি প্লিজ এভাবে বলবেন না। আমরা আছি তো আপনার সাথে।”
মা আবারও মৃণাকে বলল, “দেখ দেখ এই হীরার মতো ছেলের সাথে তুই কি করছিস। একবার বুক কাঁপে নাই তোর? দুই বাচ্চার বাপের সাথে তুই…. ছিঃ! আমার তো মুখে আনার আগেই লজ্জায় ডুইবা যাইতে মন চাইতেছে। এক মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার ভেঙে দিলি তুই? দুই বাচ্চা থেকে বাপ ছিনিয়ে নিলি? কেন করছিস তুই এমন? কেন করছিস? কীসের জন্য? ” মা আবার আইদের হাত ধরে কান্নাভেজা গলায় বলে, “আইদ বাবা তুমি আমাকে ওই মেয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি ওর পা ধরে ক্ষমা চাইব। যদি এতে এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার পাপও একটু কমে।”
“আন্টি শান্ত হন। ডাক্তার আপনাকে এত টেনশন নিতে মানা করেছে। আপনার সমস্যা হবে।”
“আমি আর আর বেঁচে কী করব? আমি মইরা গেলেই ভালো। এই মেয়ের মা হওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো।”
“এমন কথা মুখেও আনবেন না। আপনি কি আমার মা’য়ের মতো না? ছোটবেলা থেকে আমার মা বাবার মতো আপনি এবং আঙ্কেলও আমাকে আদর যত্ন করে বড় করেছেন।”
“আর এর পরিবর্তে এই কলঙ্কিনীকে তোমার ঘাড়ে তুলে দিসি। বাবা বিশ্বাস করো আমি যদি জানতাম যে এই মেয়ে এত জঘন্য চরিত্রের তাহলে আমরা কবে ওকে ত্যাজ্য করে দিতাম। বাবা বিশ্বাস করো। তুমি আমাকে বৃদ্ধ আশ্রমে দিয়ে আসো। আমার এখানে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে।”

আইদ মৃণার মা’কে শান্ত করতে জুটে যায়। আইদের মা’ও বলে, “রোমা আইদ ঠিক বলছে এখানে তোর কোনো দোষ নেই। সব দোষ এই মেয়ের। তুই আমাদের সাথেই থাকবি কিন্তু এই মেয়েকে আমি এঘরে কোনমতে জায়গা দেব না।”
মৃণা পায়ে পড়ে যায় আইদের মা’য়ের, “মা এমন করবেন না। আমি এই অবস্থায় কোথায় যাব বলেন?”
“যার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছো, তার কাছে যাও। আমার ছেলে অনেক ভালো দেখে ওকে ফুসলিয়ে ঘরে টিকতে পেরেছ। এখন আর না।”
“সে এই বাচ্চাকে জন্ম দিতে চায় না। মা দয়া করে আমাকে বের করবেন না। বাচ্চাটা জন্ম হওয়া পর্যন্ত আমাকে থাকতে দিন। আমি কোথায় যাব? কীভাবে বাঁচবো বলেন।”
মৃণার মা রাগে এসে তার বাহু ধরে তাকে টেনে তুলল। বলল, “বেশ্যাগিরি করে যেমন বাচ্চা পেটে ধরসোস তেমনি বেশ্যাগিরি জীবন কাটা। বের হো এখান থেকে।”
মৃণার মা ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

মৃণা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে স্তব্ধ, নিস্তেজ। এই ঠিকানা হারাবার পর তার কেবল খেয়ালে আসে তীর্থের ঠিকানার। আর কোনো উপায় নেই তার কাছে।
.
.
তীর্থের মা দরজা খুলে দেখে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আগে কখনও দেখেনি সে। মেয়েটির চুল এলোমেলো। গাল লালচে হয়ে আছে। আঙ্গুলের ছাপ বসা।
“আপনে কে? কী লাগবো?”
“তীর্থ আছে?”
“তীর্থের সাথে আপনার কি কাম? তাও এত রাতে?”
“দয়া করে উনাকে একটু ডেকে দিন।”
তীর্থের মা বিরক্তি নিয়ে গেল ভেতরে। একটু পর তার সাথে তীর্থও বের হয়ে আসে। সে মৃণাকে দেখে চোখজোড়া সরু করে নিলো। পকেটে হাত ভরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই সময় আমার বাসায় কেন?”
মৃণা মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলে, “আইদের পরিবারে সব জেনে গেছে। আমাকে আর রাখবে না তারা। আমার কাছে আর কোনো ঠিকানা নেই।”
“তো?”
বিস্মিত দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকায় মৃণা তীর্থের দিকে, “এটা তোমারও সন্তান তীর্থ। একটু তো মায়া রাখো।”

তীর্থের মা তো কথাটা শুনে চড়ে গেলেন। সে ছুটে এসে মৃণাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, “তাইলে তুই ওই নিলজ্জ মাইয়া যে আমার ছেলেকে ফাঁসাইয়া ওর জীবন নষ্ট করছিস? এখন আমার পোলার জীবন নষ্ট কইরা কি করতে আইসোস এখানে?”
“আন্টি আমার গর্ভে আপনার ছেলের অংশ। আমি তার জন্য এসেছি।”
“ছিঃ ছিঃ তোর মতো মাইয়ার পেট থেকে আমার বংশের রক্ত লাগতো না। তোর লাইগা আমার পোলার সংসার, ব্যবসা, জীবন সব নষ্ট হইসে। আমার দুইটা নাতি নাতনি আছে। তারা আমগো সাথে না থাকলে প্রয়োজনে আমার পোলার অন্য জায়গায় বিয়া করামু। তাও তোরে এই বাসার আশেপাশে রাখুম না। বাইর হো আমার ঘর থেকে।”

মৃণা ছুটে এলো তীর্থের কাছে। তীর্থের এক হাত ধরে নিজের পেটে রেখে বলল, “তীর্থ এটা তোমার সন্তান। তোমার অংশ। তোমার কি ওকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই? বিন্দুমাত্র না?”

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here