মৃত কাঠগোলাপ পর্ব -৩১+৩২

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________

আপাদমস্তক মন খারাপের নতুন ভোর! সারারাত আয়েশী ঘুমায় নি। শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদেছে। ধ্রুব সেসময় আয়েশীর পাশে থেকেছে। আয়েশীর মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে হরেক রকমের গল্প পেতেছে। দুঃখ গল্প, সুখ গল্প, আবেগ গল্প, রংতুলিতে গল্পের রঙ এঁকে আয়েশীর মন মাতানোর চেষ্টা করেছে। তবে পেরেছে কি?
আয়েশীর নিজেকে খুব দুঃখী মেয়ে মনে হচ্ছিল। সে সব পেয়েও অভাগার ন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে।
সেদিন রাতে অন্ধকার যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আয়েশীর বারবার মৃদুলের কথা মনে পড়ছিল। ছটফট করেছিল মনের পিঞ্জরে আটকে থাকা দুঃখী পঙ্খী। বুকের ভেতরে বারবার ডানা ঝাপটে ঘোষণা করেছিল মনের মধ্যে বহমান তীব্র ঝড়ো হাওয়ার বার্তা!

সকালের নাস্তা খাওয়ার পর ধ্রুব হাতে ব্লেজার নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। একটি গুরুত্বপূর্ন মিটিং আছে। যেতে যেতে আয়েশীর কপালের মধ্যখানে ক্ষুদ্র চুমু খেয়ে বলেছে, ‘ দ্রুত ফিরব। ভালো থেকো! মন খারাপ করবে না একদম, ঠিক আছে? ‘

আয়েশী কথা বলেনি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ভালো লাগছে না কথা বলতে। মুখ-হৃদয়ে কি অসহ্য ব্যথা।
ধ্রুব তুষারের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি ছেড়ে।
ধ্রুব চলে যাওয়ার এক ঘন্টা পর, আয়েশী সেই মেয়েকে ডাকে ধ্রুবর বাড়িতে। মেয়েটা আসে। সম্পূর্ন শরীর কালো বোরকা দিয়ে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না তার। আয়েশী মেয়েকে সোফায় বসিয়ে, উপর থেকে রেডি হয়ে আসে। নিচে এসে মেয়েটার হাত খপ করে ধরে বলে, ‘ তোমার কথার সত্যতা পরীক্ষা করব আজ। চলো আমার সাথে। ‘

আয়েশী ভেবেছিল, তার কথায় মেয়েটা ভয়ে লুটিয়ে পড়বে। ঘনঘন ঢোক গিলে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। আত্মা কাঁপবে, হাত পা কেঁপে অস্থির হবে। অথচ মেয়েটা এমন কিছুই করল না। বরং বলল, ‘ চলুন। ‘
আয়েশী হতভম্ব অনুভব করল। অশান্তি লাগছে তার। ভেতর ভেতর শঙ্কা হচ্ছে। মেয়েটার কথা না সত্যি হয়ে যায়!
আয়েশী আর কথা বাড়ায় না। ধ্রুব আসার আগেই কাজ শেষ করতে হবে। তাই আয়েশী দ্রুত মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। ধ্রুব পেছন সিটে বসে ল্যাপটপে আয়েশীর বাড়ি থেকে চলে যাওয়া দেখছে। ওসমান পাশে বসে ছিল। ধ্রুবর দৃষ্টি অনুসরণ করে ল্যাপটপে চোখ পড়লে, ওসমান ভয়ে আঁতকে উঠে। আয়েশী ম্যাম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন! আজ তো ধ্রুব স্যার ম্যাডামের হাড্ডি ভেঙে গুঁড়ো ফেলবেন। ওসমান আতঙ্কভরা চোখ নিয়ে ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব তখন শান্ত। ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দাড়ি চুলকায়। হঠাৎ বুকে হাত চেপে সিটে হেলান দেয়। ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ উল্টে বলে,
‘ তোমার ম্যাডাম এত সুন্দর কেন, ওসমান? তাকে দেখলেই কেন আমার বুক ধড়াস ধড়াস করে? আনসার মি, ওসমান।’

ওসমানের মুখ হা হয়ে যায় ধ্রুবর কথা শুনে। আয়েশী ম্যাডাম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, অথচ ধ্রুব স্যার এত নিশ্চিন্তে বুক কম্পনের গল্প পাতছেন? কিভাবে? তার তো এখন রাগে রণমূর্তি হয়ে সবকিছু ধ্বং’স করে দেওয়ার কথা। ওসমান বোকার মত চেয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। ওসমানকে চুপ করে থাকতে দেখে ধ্রুব ঘাড় কাত করে তাকায় তার দিকে। ওসমানের মুখ তখনো হা! ধ্রুব হেসে ফেলে। ওসমানের ধ্যান ভাঙে। লজ্জা পেয়ে যায় সে। সঙ্গেসঙ্গে মাথা নত করে বিড়বিড় করে বলে, ‘ সরি স্যার। ‘
ধ্রুব হাসে মিটিমিটি। এই প্রথম ওসমান ধ্রুবকে মন খুলে হাসতে দেখছে। আয়েশী ধ্রুবর জীবনে আসার পর থেকে ধ্রুবর সমগ্র জীবনটাই বদলে গেছে। ধ্রুব আগে ন্যায় সর্বদা মুখ গোমড়া করে থাকে না, হঠাৎ হঠাৎ হাসে। হাসলে তার সুন্দর মুখ আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে। ডান গালে গর্ত লক্ষ্য হয়। ধ্রুব আপাদমস্তক ভয়ংকর সুদর্শন পুরুষ! সকল নারীর স্বপ্ন রাজপুত্রের মত বদনের অধিকারী। ধ্রুব এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য্য পেয়েছে তার বাবার থেকে। ধ্রুবর বাবা ছিলেন ঠিক ধ্রুবর মত। সুন্দর তবে ভয়ংকর! ধ্রুবর সৎ মা অনেকেই ছিলেন। তবে ধ্রুবর মা ছিলেন ধ্রুবর বাবার একমাত্র ভালোবাসা। বাকি স্ত্রীরা শুধুমাত্র কামনা মেটানোর জন্যে ছিলেন। ধ্রুবর মা ছিলেন আয়েশীর মত সহজ সরল। ধ্রুব তার মায়ের সরলতা না পেয়ে পেয়েছে বাবার হিং’স্রতা! বিষয়টা হতাশাজনক!
ধ্রুবর এমন ভয়ংকর সৌন্দর্য্য দেখে ওসমানের মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওসমান যদি কখনো মেয়ে হত তাহলে সে নিশ্চয়ই ধ্রুবর প্রেমে পড়ত। ধ্রুবর হিংস্র’তা যে মেয়ে জানে না, সে প্রতি প্রার্থনায় ধ্রুবকে চায়। ধ্রুবর সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখে। যদি তারা ধ্রুবর ধ্বং’সাত্মক আচরন দেখত, তবে তারা কু’ক্ষণেও ধ্রুবর সঙ্গ চাইতো না। বরং মনের ভুলেও ধ্রুবর নাম উচ্চারণ করতে তাদের বুক কাঁপতো। ভয়ে তাদের শরীর বেঁকে যেত।

‘ ওসমান, প্যারিসের দুটো বিজনেস ক্লাস টিকেট কাটবে। বহুদিন হয়েছে কোথাও ঘুরতে যায়নি। তোমার ম্যাডামের মন খারাপ তাড়াতে প্যারিসের শীতল হাওয়া, রোমান্টিক পরিবেশ যথেষ্ট! তোমার জন্যেও একটা নরমাল টিকিট কেটো। তুমিও যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে। ‘

ধ্রুবর কথা শুনে ওসমানের মুখের অভিব্যক্তি তখন দেখার মত ছিল। এই প্রথম ধ্রুবর সাথে সে দেশ ভ্রমণ করতে যাচ্ছে। পূর্বেও ধ্রুব অনেকবার নানা দেশে ঘুরেছে, তবে একা। ধ্রুব একা একা ঘুরতে পছন্দ করে। কেউ সাথে থাকলে বরং তার উপভোগ করতে বিরক্ত লাগে। তবে আজ ধ্রুব আয়েশীকে সঙ্গে নিচ্ছে, আশ্চর্যের ব্যাপার ওসমানও যাচ্ছে তাদের সাথে। আজ কি ধ্রুব স্যারের মন খুব ভালো? মন ভালো হওয়ার কারণ কি? আয়েশী ম্যাডাম?
_______________________________
আয়েশী এবং মৃদুলের মা, তাহিয়া বেগম মুখোমুখি বসে আছেন। অনেকদিন পর তাহিয়া বেগম আয়েশীকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে পড়লেন। মৃদুলের মারা যাবার পর, আয়েশী মাঝেমধ্যে তাহিয়া বেগমকে যোগাযোগ করে খোঁজ খবর নিত। কিন্তু আয়েশীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, আয়েশী আগের মত খোঁজ নেয়নি। তিনি ভেবেছেন, নতুন সংসারে মেয়েটা হয়তো ব্যস্ত ভীষন। তাহিয়া বেগম একপলক আয়েশীর পাশে থাকা বোরকা পরিহিত মেয়েটার দিকে তাকালেন। মেয়েটিকে তাহিয়া বেগম চিনতে পারছেন না। আয়েশীকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটার নাম কি? আয়েশী বলল, ‘ মুনিজ’
আয়েশী সর্বপ্রথম তাহিয়া বেগমের হাল চাল জিজ্ঞেস করল। তাহিয়া বেগম আঁচলের কোণ কর্তৃক চোখের জল মুছে বললেন, ‘ ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ? অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। তোমার স্বামী কেমন আছে? ‘
স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলে, তাহিয়া বেগমের চোখে জল ভরে। আজ মৃদুল বেঁচে থাকলে, আয়েশীর মত লক্ষ্মী মেয়ে তাদের বাড়ির বউ হত। মৃদুল এবং আয়েশীর ভালোবাসায় এ ঘর মুখরিত থাকত। তাদের ছেলে মেয়ে হলে, ফাঁকা ঘরটা পূর্ণতা লাভ করত। তাদের নাতি নাতনি ছোটছোট পা ফেলে ঘরময় ঘুরে বেড়াত। ইশ, তাহিয়া বেগম সারাক্ষণ নাতি নাতনীদের সাথে হেসে খেলে বেড়াতেন। একাকীত্বে ভোগার সময় কোথায় তার? কিন্তু আজ? আজ মৃদুল নেই। আয়েশীও অন্য কারো ঘরের ঘরণী। আজকাল তাহিয়া বেগমের ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। রাত হলে তাহিয়া বেগম ক্লান্ত হয়ে পড়েন একাকীত্বের সাথেই যুদ্ধ করে। একমাত্র ছেলেবিহীন বাড়িটা মৃ’ত মৃ’ত মনে হয়। মৃদুলের বাবার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। ভালো চিকিৎসা করাবেন, তারও উপায় নেই। কবে যে সব ভালো হবে!

‘ মা? ‘
আয়েশীর মা ডাকে ধ্যান ভাঙে তাহিয়া বেগমের। মৃদুল থাকাকালীন আয়েশী বিয়ের আগেও তাহিয়া বেগমকে মা ডাকত। আজ মৃদুল নেই। তবুও আয়েশী তাকে মা ডাকছে। তাহিয়া বেগম সেই মা ডাক শুনে ক্রমশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন।
‘ মা, আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল। ‘
তাহিয়া বেগম নিজেকে সামলে বললেন, ‘ বলো! ‘
আয়েশী মুনিজকে নিকাব খুলতে বলল। মুনিজ কিছুক্ষণ থেমে নিকাব খুলে তাহিয়া বেগমের দিকে তাকাল।
মুনিজের চেনা চেহারা দেখে তাহিয়া বেগম ধপ করে সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন। মৃদু চেঁচিয়ে বললেন, ‘ তুমি? ‘
আয়েশীর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। অর্থাৎ, মেয়েটাকে মৃদুলের মা চিনেন। আয়েশী বলল,
‘ মা, আপনি কি তাকে চিনেন? ‘
তাহিয়া বেগম উত্তর দিলেন না। বরং মুনিজের হাত খপ করে ধরে বাড়ির বাইরে টেনে যেতে উদ্যত হলেন। আয়েশী তাকে থামাল। বলল, ‘ মা, থামুন। কি করছেন? শান্ত হোন। ‘
তাহিয়া বেগম শান্ত হলেন না। বরং অশান্ত হয়ে বললেন,
‘ তুমি একে চেনো না আয়েশী। এই মেয়েটা মিথ্যুক। আমার ফুলের মত ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে। আমি কতদিন এই মেয়েকে না করেছি মৃদুলের আশেপাশে না ঘুরতে। কিন্তু নির্লজ্জ মেয়ে মৃদুলের মৃত্যুর দিন এসে বলে আমার মৃদুল নাকি বিয়ে করেছে একে। আমি জানি আমার ছেলে কিছুতেই এসব করতে পারে না। মৃদুল পুরুষ মানুষ, আশেপাশে ঘুরছে তাই হয়তো দু একটা কথা বলেছে। কিন্তু বিয়ে? বিয়ে করতেই পারে না। আয়েশী, আমি চিনি আমার ছেলেকে। সে কি এসব করতে পারে? তুমি বের করে দাও একে আমার ঘর থেকে। আমার ঘর অপবিত্র হচ্ছে এই নোং’রা মেয়ের স্পর্শে। ‘
আয়েশী যা বোঝার বুঝে গেল। অর্থাৎ, তাহিয়া বেগম অনেক আগে থেকেই মুনিজকে চেনেন। মুনিজ মৃদুলের বিয়ের দিন তাহিয়া বেগমের সাথে দেখা করেছে। মৃদুলকে শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু তাহিয়া বেগম দেননি তাকে দেখতে। আয়েশীর চোখে জল উপচে আসতে চায়। তাহলে মৃদুল সত্যিই মুনিজকে বিয়ে করেছিল। আয়েশী মেয়েটার হাত তাহিয়া বেগমের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তাহিয়া বেগম রাগে ফুসফুস করছেন। মেয়েটা তাহিয়া বেগমকে একে একে মৃদুল এবং তার বিয়ের ছবি, কাবিননামা, এ্যাবোরশন রিপোর্ট, তাদের সকল অন্তরঙ্গ ছবি দেখাল। সব দেখে তাহিয়া বেগম চুপসে গেলেন। হতভম্ব হয়ে বললেন,
‘ আমি বিশ্বাস করি না। আমার মৃদুল এমন নোংরা কাজ করতেই পারে না। ‘
আয়েশী এবার মৃদু কন্ঠে বলে,
‘ যা সত্যি তা কখনো বদলাতে পারবেন না, মা। প্রমাণ আপনার চোখের সামনে। মৃদুল আমাকে, আপনাকে, আমাদের সবাইকে ধোঁকা দিয়েছে, মা। মৃদুল কখনো ভালো প্রেমিক, ভালো ছেলে কিংবা ভালো স্বামী ছিল না। সে ধোঁকাবাজ। সে ঠকেয়েছি আমাদের অনুভূতিকে। ‘
তাহিয়া বেগম ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। মাথা ঘুরছে তার। আয়েশী অনেকসময় নিয়ে তাহিয়া বেগমকে শান্ত করল। তাহিয়া বেগম শান্ত হয়ে, মুনিজকে কাছে ডাকলেন। হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন মেয়েটার কাছে। আয়েশী, মেয়েটা, তাহিয়া বেগম সবাই কাঁদছেন। এক পুরুষকে এই তিন নারী ভালোবেসে মনে রাখতে চাইছিলেন, অথচ আজ সবাই তাকে ঘৃনা করতে চাইছেন। কিন্তু এই তিন নারীর চোখের মণি ছিল মৃদুল। তাই তারা চেয়েও প্রিয় মানুষকে ঘৃনা করতে পারছেন না। আফসোস,এক সমুদ্দুর আফসোস!
#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________________
বইছে ঝড়ো হাওয়া, গাছের পাতায় শীতলতার ঢেউ খেলছে, পিচঢালা রাস্তায় স্তরে স্তরে কাদা জমেছে। ঝুমঝুম বৃষ্টি নামছে। আকাশের বুকে বিশাল ফাঁটল পরিলক্ষিত হল। বিদ্যুতের ঝলকানির শব্দে রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ ঝাঁজরা হল। আয়েশী ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টির ফোঁটা আয়েশীর মন-দেহ ছুঁয়ে। ওড়নার অগ্রভাগ ব্রিজের উপর গড়াচ্ছে। কাদা মেখে নোংরা! আয়েশী ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। মুখের হাত চেপে অবিরত কেঁদে মনের কষ্ট হালকা করার চেষ্টা করল। পারল কি? এখনও বুকের ভেতরটা জ্বলছে। কষ্টের তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে কষ্টের পাহাড় তৈরি করছে। হয়তো একসময় এই পাহাড় ধ্বসে পড়বে, আয়েশী সেদিন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হবে। মূর্তির যেমন কষ্ট হয় না, অনুভূতি থাকে না! আয়েশীরও বুঝি থাকবে না?
আয়েশীর চোখের জল হার মানল। ফুরিয়ে এল একসময়। এখন যা আছে শুধুই ভেজা কিছু অনুভূতি! আয়েশী দুহাতে চোখ মুছল। অতঃপর শেষমুহর্তে আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলল, ‘ আমি তোকে ঘৃনা করি মৃদুল, এতটা ঘৃনা বোধহয় আমি আর কাউকে করতে পারবো না! ”

মেয়েলী কণ্ঠের তেজে রাতের আঁধার ভয় পেল। গুটিয়ে গেল। পালাতে চাইল! জড়োসড়ো হয়ে চেয়ে রইল জমিনের উপর বাস করা এক পরম দুঃখী নারীর দিকে!
____________
ধ্রুব পরপর আয়েশীর সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। পারছে না। আয়েশীর সেলফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। ধ্রুব রাগে তার সেলফোন বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলল। রাগে কাঁপছে সে। ভোর সকালে বেরিয়েছে, এখনো বাসায় আসার নাম নেই। বেশি ছাড় দিয়েছে বলেই সাহস বেড়ে গেছে। ডানা কাটার জন্যে তড়পাচ্ছে। ধ্রুব ওসমানকে ডাকল। ওসমান জড়োসড়ো হয়ে ধ্রুবর কাছে এল। ধ্রুব দ্রুত গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে বলল, ‘ গাড়ি বের করো। আমি বেরুবো। ‘

ঢাকা শহর হন্যে হয়ে খুঁজে গেল আয়েশীকে। পেল না। রাত-বিরাতে কোথায় গেল এই মেয়ে? ধ্রুবর রাগে মাথা ধপধপ করছে। মস্তিষ্কের রক্ত ফুটছে। আয়েশীকে ধ্রুব ইচ্ছে করে একটু স্বাধীনতা দিয়েছিল। ভেবেছিল স্বাধীনতা পেলে আয়েশীর মন খানিক নরম হবে। ভালোবাসবে ধ্রুবকে। অথচ ঘটেছে তার উল্টোটা। কি লাভ এত স্বাধীনতা দেওয়ার? যদি দিনশেষে পাখি পিঞ্জিরায় ফিরে না আসে!

ধ্রুব হার মেনে ঘরে ফিরে এল। ইতিমধ্যে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। ধ্রুব বাড়ি ফিরে নিজের কক্ষে এল। আয়েশীকে পাওয়া যাচ্ছে না, কতটা ভয়ঙ্কর সংবাদ। আশেপাশে ধ্রুবর শত্রুর অভাব নেই। কেউ যদি জেনে যায়, ধ্রুব ইউহান শেখের মত ক্ষমতাশীল ব্যক্তির স্ত্রী নিখোঁজ, শত্রুদের জিহ্বা দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়বে আয়েশীর ক্ষতি করার জন্য। আর ধ্রুব এই সুযোগটা তাদের দিতে চাচ্ছে না।

‘ আয়েশীর সকল বন্ধু বান্ধবের আজ রাতের মধ্যে লকাপে দেখতে চাই। থার্ড ডিগ্রি টর্চার পড়লে সব উগলে দিবে। এক ঘণ্টার মধ্যে আয়েশীকে আমার সামনে চাই। বুঝেছ? ‘

ধ্রুব সেলফোনে কানে কথা বলতে বলতে আয়েশীর কক্ষে এল। উদ্দেশ্য, আয়েশী সম্বন্ধে কোনো গোপন তত্ত্ব পাওয়া যায় কি-না! হয়তো এই তত্ত্ব এর পেছনে ছুটে ধ্রুব আয়েশীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবে।

সেলফোনে কথা বলতে বলতে ধ্রুব আয়েশীর কক্ষে এল। কিন্তু হঠাৎ বারান্দা থেকে কান্নার শব্দ শুনে ধ্রুব থমকে যায়। আয়েশীর কণ্ঠ? আয়েশী কি বাড়িতেই?
ধ্রুব ধীর হাতে সেলফোন কান থেকে নামায়। সেলফোন পকেটে পুড়ে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে।
বারান্দার দরজা খুলে ধ্রুব হতভম্ব হয়ে যায়। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আয়েশী বারান্দার মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। মুখমন্ডল দু হাঁটুর মধ্যখানে লুকিয়ে রাখা। ফুপিয়ে কাদঁছে, যার ফলে শরীরে কম্পন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আয়েশীকে পেয়ে ধ্রুবর চোখে শান্তি নামে। মনের ঝড় নিমিষেই শান্ত হয়। অবশেষে আয়েশীকে খুঁজে পেয়েছে সে!
কিন্তু ধ্রুবর মাথায় আপাতত খুশির চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে। মন চাচ্ছে মেয়েটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। ধ্রুব নিজের রাগ দমন করতে পারল না। দ্রুত পায়ে আয়েশীর কাছে আসল। অতঃপর এক টানে আয়েশীকে সোজা করে দাঁড় করাল। আচমকা আক্রমন করায় আয়েশী ভয় পেয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে ধ্রুবর দিকে চাইল। ধ্রুব সে চাওনি লক্ষ্য না করে ধাম করে আয়েশীর ডান গালে সজোরে থা’প্পর বসাল। থা’প্পড়ের বিকট শব্দে চারপাশ ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠল। আয়েশীর কান ভনভন করতে লাগল। গালে বোধকরি কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার নরম তুলতুলে গাল। আয়েশী গালে হাত দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে চাইল। ধ্রুব এখনও রেগে আছে। রাগে তার পেটানো, বলিষ্ট দেহ কাঁপছে। ধ্রুব একটু সরে গেল। বাম হাত কোমড়ে রেখে, ডান হাতের আঙ্গুল কর্তৃক কপাল চুলকাল। আড়চোখে আয়েশীর দিকে একবার চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। আয়েশী গালের ব্যথায় কেঁদে উঠল। গাল আগুনের ন্যায় গরম হয়ে আছে। এত জোড়ে কেউ মারে? হাত নয় যেন দানব!
ধ্রুব আয়েশীর কান্নার শব্দে মহা বিরক্ত হলো। তর্জনী উচুঁ করে বলল, ‘ এই মেয়ে, কাদঁবে না। কাঁদবে না বলছি। কাঁদলে মে’রে ফেলব একদম। ‘
আয়েশী ভয় পেল। কান্না থামানোর চেষ্টা করল। ভয়ে কান্না থেমে গেছে, এখন ক্রমাগত হেঁচকি দিচ্ছে। ধ্রুব এবার একটু শান্ত হয়ে, ঢোক গিলে বলল,
‘ সকাল থেকে রাত অব্দি কোথায় ছিলে? হ্যাঁ? মানুষ মনে হয়না আমাকে? সম্পূর্ন ঢাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু না ম্যাডাম তো অদৃশ্য হয়ে আছেন। আর সেলফোন? সেলফোন আছে কিসের জন্যে? পূঁজো করার জন্যে? ফোন রিসিভ করে একবার বলা যাচ্ছিল না, আমি বাসায় আছি। চুপ করে থাকবে না, উত্তর দিবে। ‘

আয়েশী ভয়ে পেয়ে চোখ পিটপিট করল। গালে হাত রেখে বোকার মত বলল, ‘ সেলফোন ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। ‘
ধ্রুব অসহায় বোধ করল। চোখ উল্টে বিড়বিড় করল,’ওহ,ড্যাম। ‘
আয়েশীর কাদঁছে এখনো। তবে এ কান্নার শব্দ নেই, নীরবে শুধু চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে। প্রিয়তমার চোখের অশ্রু ধ্রুবর কাছে সহস্র তলোয়ারের আঘাতের সমান। প্রিয়তমা যখন কাঁদে ধ্রুবর ইচ্ছে হয়, সম্পূর্ণ দুনিয়াকে স্তব্ধ করে দিতে। প্রিয়তমাকে বুকের সাথে পিষে ফেলতে। তার চোখের জল নিজের জিহ্বা দ্বারা শুষে ফেলতে।
ধ্রুব তাই করল!
আয়েশীকে বাহু টেনে নিজের মধ্যে নিয়ে নিল। আয়েশীর নরম শরীরকে নিজের শক্ত দেহের মাঝে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি সুরে বলল, ‘ সরি বলবো না। কারণ ধ্রুব কাউকে কখনো সরি বলে না। দোষ করেছ, শাস্তি পেয়েছ। একই ভুল পুনরায় করবে না। ঠিক আছে? ‘

আয়েশী ধ্রুবর বুকের মধ্যে পড়ে আছে। ভীষন অস্থির লাগছে। ধ্রুবর বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল। পারল না। ধ্রুব বলল, ‘ শুধু-শুধু শক্তি অপচয় করছ। তুমি জানো, আমি যতক্ষণ না ছাড়বো, তুমি আমার থেকে ছূটতে পারবে না। ‘
আয়েশী রাগ হল, গুটিকয়েকবার চেষ্টা করল ছুটে পালানোর। পারলো না। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে পড়ে রইল ধ্রুবর বৃত্ত-বুকের উপর। আয়েশীর ভেঙে যাওয়া মনে প্রশ্ন জাগল, ধ্রুব কি সত্যি আয়েশীকে ভালোবাসে? নাকি মৃদুলের মত সেও আয়েশীকে ধোঁকা দিবে? একবার ধোঁকা পেয়ে আয়েশী শেষ হয়ে গেছে, আরেকবার ধোঁকা খাওয়ার শক্তি তার মধ্যে নেই। মৃদুল আয়েশীর মন থেকে সমস্ত বিশ্বাস, আশ্বাস বন্য রা’ক্ষুসের ন্যায় শুষে নিয়েছে।
‘ আমি মৃদুল না। ‘ ধ্রুবর কথায় আয়েশী চমকে উঠে। ধ্রুব কি তবে সব শুনে নিয়েছে? কেমন করে? সে কি মন পড়ার মন্ত্র জানে? ধ্রুব মুচকি হেসে আয়েশীর চুলে ঠোঁট বুলালো। আয়েশী চোখ খিঁচে নেয়। অন্য পুরুষের স্পর্শ আয়েশীর কাছে বিষ সমতুল্য!
ধ্রুব আয়েশীকে নিজের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে। বলে,
‘ ফ্রেশ হও। ভিজে শরীরে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। ‘

আয়েশী কিছু বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল নিজ স্থানে। ধ্রুব চলে যেতে উদ্যত হয়। তবে আয়েশী পেছন থেকে ধ্রুবর হাত ধরে ফেলে। ধ্রুব চরম বিস্মিত হয়। ভ্রুরু কুঁচকে যায়। কপালের ভাজ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়। আয়েশী নিজ থেকে ধ্রুবকে স্পর্শ করেছে! বিশ্বাস হচ্ছে না ধ্রুবর। ধ্রুব পেছন ফেরে। তার অবাক চোখ আয়েশী পানে আটকে। আয়েশী ধ্রুবর হাত ধরে কাতর স্বরে অনুরোধ করে,
‘ আমায় এই শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে চলুন না। যে শহরে ঘৃনা থাকবে না, ধোঁকা থাকবে না, মন ভাঙার খবর থাকবে না। এ ঘৃণার শহরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ‘

ধ্রুব কিয়ৎক্ষণ আয়েশীর দিকে চেয়ে রয়। অতঃপর মৃদু হেসে বলে, ‘ নিয়ে যাবো, খুব শীগ্রই! ‘
আয়েশী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ধ্রুবর হাত ছেড়ে বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাড়ায়। ভালো লাগছে না কিছুই। অস্থির লাগছে ভীষন। কিছু কি খারাপ ঘটছে? জানে না।
ধ্রুব এখনও নিজের হাতের দিকে চেয়ে। আয়েশীর স্পর্শ এখনও ধ্রুব নিজের হাতের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারছে। আয়েশীর গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ এখনও ধ্রুব অনুভব করছে। ধ্রুবর বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। ধ্রুব হাত উঠিয়ে আয়েশীর স্পর্শ করা জায়গায় গভীর চুমু খেল। আবেগে চোখ বুজে এল তার। ধ্রুবর মনে হলো, সে স্বর্গে ভাসছে। নিজেকে মাতাল লাগছে ভীষন। ধ্রুব চোখ তুলে আয়েশীর দিকে চাইল। আয়েশী আকাশের দিকে চেয়ে। আর ধ্রুব তার একান্ত ব্যক্তিগত আকাশের পানে চেয়ে! আয়েশী, ধ্রুবর একান্ত ব্যক্তিগত আকাশের নাম! যার উপর ধ্রুব ব্যতীত আর কারো অধিকার নেই। থাকতে পারে না। আয়েশী শুধু ধ্রুবর, এই ধ্রুব ইউহান শেখের।

#চলবে ( শব্দসংখ্যা- ১২০০+)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here