মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -১৯+২০

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৯
মালিহা খান

ইউসুফ হাসলো। স্মিত হাসি। বিভার মিনমিন করে করা প্রলয়ংকর প্রশ্নটা যে বেশ একটা ঝড় তুলে দিলো, বাহিরে তার লেশমাত্র প্রকাশ পেলো না। জবাবে প্রতীক্ষারত অঙ্গনাকে প্রতিক্ষায় রেখেই উঠে দাড়ালো সে। বিষন্নার মতোন চেয়ে থাকা চোখদুটোকে বেমালুম উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা নেই, তবু করতে হয়। করে যেতে হয়..হচ্ছে।
ধৈর্য্যর পারদমিটারটা যেনো কাঁচফেটে চৌঁচির হয়ে গেলো মূহুর্তেই। খপ করে ইউসুফের কবজির কাছে প্রচন্ড শক্ত করে টেনে ধরলো বিভা। শেষ শ্রাবণের ঘনকালো মেঘটার মতোন অভিমানিনী স্বরে বললো,

-“আপনি উওর দিবেন না?”
নিজের উপর নিয়ন্ত্রনহীন সে বরাবরই। রাগের বসে, ছেলেমানুষী করে কখন কি পাগলামি করে নিজেও জানেনা। আর এই পুরুষের উপর তো আজন্মের আক্রোশ।
অথচ তার দ্বারা কৃত সকল ঝড় যে এই মানুষটা মাথা পেতে সয়ে নেয় সেটাই কেবল চোখের আড়াল হয়ে যায় সবসময়। কেবল মানুষটার নির্লিপ্ততাই দেখে গেলো বোকা মেয়েটা। এই নির্লিপ্ততার পিছনে লুকিয়ে থাকা অগাধ প্রশ্রয় টা দেখতে পেলোনা। কখনোই..।

নখগুলো খুব সম্ভবত মাংস ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। ইউসুফের ঠিক তেমনটাই মনে হলো। একটা একান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিকটা নরম গলায় সে বললো,

-“সারাক্ষণ এসব ঘুরে কেনো মাথায়?”

-“আপনার কি? আমার মাথা। আমি ঘুরাই। আপনার কি?” রাগে থিঁতিয়ে উঠলো বিভা। হাতের চাপ প্রবল হলো। তার ছেলেমানুষী উওরটায় আবারো হেসে ফেললো ইউসুফ। একবার হাতের দিকে তাকালো। চটচটে রন্জিত তরল পদার্থটা বেরিয়ে এসেছে। বললো,

-“নখে ব্যাথা পাবে বিভা। ভেঙে যাবে। ছেড়ে দাও।”

-“হোক, ভাঙুক, ছাড়বোনা।” ব্যস! হাতের দিকে ফিরেও তাকালোনা বিভা। চোখদুটো কি লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। গলা দিয়ে নেমে যাওয়া শুকনো ঢোক গুলোও নজর এড়ায়না। কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা। চোখের টা নাহয় পারছে, মনেরটা?
ক্লান্ত ইউসুফ আবার বসে পড়লো হাঁটু গেড়ে। এর কাছে তার কন্ঠটাও উঠেনা। তুলোর মতোন নরম হয়ে যায়। এতো চায়। তবু একটু ধমকাতে পারেনা।

-“জেদ করেনা? ছেড়ে দাও?”কি অদ্ভুত নরম পুরুষালী স্বর।
বিভা গোল গোল করে তাকালো। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকালো। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করে হাসলো ইউসুফ। আস্তেধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।
বিভা বারদুয়েক পলক ফেললো। পুতুলের মতোন ঠেকলো ইউসুফের কাছে। বললো,

-“সবসময় এতো জেদ করো কেনো?”

-“আপনার সাথেই তো করি। আর কারো সাথে তো করিনা। এতেও আপনার সমস্যা?”

ইউসুফ হাঁফ ছাড়ে। উঠে যেতে যেতে বিরবির করে বলে,”সমস্যা নেই। কোনো সমস্যা নেই।”
আর মনে মনে বলে,
-“তোমার প্রদর্পণেই আমার সমর্পণ।”

৩৬.
গ্রামে শীত পড়ে গেছে। অক্টোবরের শুরু কেবল। তবু শেষরাতের দিকে মোটা কাঁথার নিচেও ঠান্ডায় শরীর জমে হিম হয়ে যায়।
বরফের মতোন পা দু’টো সুঁড়সুঁড় করে কাঁথার ভেতর গুঁটিয়ে নিলো তন্দ্রা। আধঘুম চোখদুটো কোনরকমে মেললো। সরফরাজ সোজা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। একহাত কপালে উঠানো, আরেকহাতে সে ঘুমিয়েছে। একেতো রক্তজমানো ঠান্ডা। তারউপর কোথ্থেকে যেনো দমকা বাতাস এসে ঘর ছেঁয়ে গেলো। তন্দ্রা হুরহুর করে কেঁপে ওঠে। উওরের জানলাটা বোধহয় খোলা। নিশ্চিত উনি খুলেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার নূন্যতম শক্তিটাও পেলোনা সে। নড়েচড়ে সরফরাজে দিকে চেপে আসলো। একহাত উদোম বুকের উপর রাখলো। উষ্ণ বুকটাও কি ঠান্ডা হয়ে আছে!
অস্ফুট স্বর শোনা গেলো সাথেসাথেই,

-“তন্দ্রাবতী? নড়ছো কেনো?”

তন্দ্রা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অভিযোগ ছুঁড়ে,
-“শীত করছে। আপনি আমাকে ধরে ঘুমান না কেনো?”

সরফরাজ চোখ মেলে। কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে তন্দ্রার গায়ের কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দেয়। কিভাবে জড়িয়ে ধরবে সে মেয়েটাকে? পেটে চাপ লাগবেনা? বুঝতে চায়না।
তার কাছে লেপ্টে থেকেও তন্দ্রার দাঁত কাঁপছে। কিড়কিড় শব্দ হচ্ছে। সরফরাজ বুক থেকে তন্দ্রার হাতটা সরিয়ে দেয়। মাথার নিচ থেকে নিজের হাতের বদলে বালিশ টেনে দিয়ে উঠে বসে। তন্দ্রা শিশুসুলভ কন্ঠে বুলি ছাড়ে,

-“কই যান?”

-“জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি। শীত কম লাগবে।”

জানলা বন্ধ করে দিয়ে আলমারি খোলে সরফরাজ। দেখেশুনে আরেকটা কাঁথা বের করে। বেশ ভারি দেখে।আসার আগে ধীরগতিতে চলতে থাকা ফ্যানটাও বন্ধ করে দেয়। ঘরটা নীরব হয়ে যায়। নিশ্বাসের শব্দও প্রতিধ্বনির মতো শোনায়।
তন্দ্রার গায়ের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে হাতের কাঁথাটা দু’ পাল্লা করে ছোট্ট শরীরটার উপর দিয়ে দেয় সে। তারউপর আবার পাতলা কাঁথাটা দিয়ে কপালে হাত রেখে বলে,

-“এখনো শীত করছে তনু?”

-“উহু। শুতে আসেন।”

সরফরাজ নির্ভার শ্বাস ছাড়ে। কাঁথাটা আরেকটু টেনেটুনে তন্দ্রার পেছনে যেয়ে শুতেই তন্দ্রা যারপরনাই অবাক হয়ে বলে,”পেছনে যেয়ে শুচ্ছেন কেনো? এপাশে আসেন।”
সরফরাজ কাঁথার নিচে ঢুকে যায়। তন্দ্রাকে কাছে টেনে পিঠটা চওড়া বুকের সাথে ঠেকিয়ে নিতে নিতে বলে,”এইযে তোমাকে ধরে শুচ্ছি। আর কথা না। ঘুমিয়ে পড়ো।”

তন্দ্রা হাসল। সুখের হাসি। ওপাশ থেকে জড়িয়ে এপাশে আসা শক্তপোক্ত হাতটার উপর হাত রেখে চোখ বুজে বললো,
-“কাল লেপটা নামাতে হবে বুঝলেন?”

সেকেন্ড পাঁচেকও কাটলোনা বোধহয়। গ্রীবার উপর অপ্রস্তুত আদরটায় তীব্র শীতের চেয়েও শিরশির করে কেঁপে উঠলো তন্দ্রা। কোনরকমে বললো,”কি করেন! ঘুমানতো।”

পেছনের থেকে সরফরাজের মৃদুহাস্য কন্ঠ শোনা গেলো,
-“আমি থাকতে তোমার লেপের কি দরকার তনু?”

-“ছিহ্!”

-“ভয় পেলে তো আব্বা আম্মার সামনে জাপটে ধরতেও লজ্জা পাওনা। আর এখন এক কাঁথার নিচে ছিহ্ ছিহ্ করছো। হায় তন্দ্রাবতী!”
মেঘদিঘির পাড়ে – ২০
মালিহা খান

৩৭.
সকাল হতেও সূর্যের দেখা মিলেনি। দূরের গাছগুলোর উপর পেলব তুলোর মতোন কুয়াশারা ভেসে আছে যেনো। গাছের পাতাগুলো শীঘ্রই পতনোন্মুখ। শীত এসেছে বলে!
ঘড়িতে আটটা দশ কেবল।
নরম বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে বিভা। একহাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে তাকে বুকের পাশে লাগিয়ে রেখেছে সরফরাজ। নিজের মেলে রাখা পায়ের উপর পাহাড়সম বিরক্তি নিয়ে কিন্চিৎ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে বিভা।
পায়ের ব্যাথায় রাত থেকে কাহিল অবস্থা বেচারীর। একছটাক ঘুমাতে পারেনি। কাল সারাদিন হেঁটেফিরে ঘুরে ব্যাথাটাকে নেহাতই অবহেলা করেছিলো। ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি এই ব্যাথা ধীরে ধীরে এমন তুখর তীব্র হবে। তার উপর পড়েছে শীত। শীতে একটু ব্যাথা পেলেই মানুষের মরি মরি অবস্থা হয়। সে তো বেচারি হোঁচট খেয়ে যেয়ে ইটের উপর পড়েছে। উঠোনে কে কোন অলুক্ষুণে সময়ে যে ইট গুলো রেখেছিলো আল্লাহ জানে।
গরম পানির বোতল কাপড়ে মুঁড়িয়ে হাঁটুর কাছে দিয়ে রেখে দিয়েছেন জাহানারা। বিশেষ লাভ হচ্ছেনা অবশ্য। অনবরত টনটন করেই চলেছে জা’গাটা।
বিভা বিরবির করে বললো,”ভাইজান? আমিই কেনো পড়ে গেলাম বলেনতো?”

উওরে আলতো করে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সরফরাজ।

-,সেড়ে যাবে।”

-“সাড়ছেনাতো।”

-“সারাদিন উড়নচন্ডীর মতোন টইটই করলে ব্যাথা তো হাওয়ায় সেড়ে যাবে।”
চাপা ভৎসর্নায় ভরপুর কন্ঠটা এলো দরজার কাছ থেকে। বিভা চোখ তুলে তাকায়। ইউসুফের নির্বিকার চেহারাটা একপলক দেখে সরফরাজের বুকে গাল লেপ্টিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। সরফরাজ হেসে ফেললো। ইউসুফ ভুল কিছু বলেনি। বিভা সত্যিই ধুরন্ধর চন্চল।
ইউসুফ ঢোকে। জাহানারার সাথে কি কথা বলে।
বিভা মৃদুকন্ঠে সরফরাজকে বলে,”ভাইজান? আপনি কিছু বললেননা?”

-“কি বলবে?”নিজের কথা থামিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ফিরে তাকায় ইউসুফ।

বিভা চুপ করে গেলো। কড়া চোখে একবার ইউসুফের চোখে চেয়ে দৃষ্টি নামালো। সরফরাজের কাছে গুঁটিয়ে গিয়ে মিষ্টি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন তুলতুলে কন্ঠে বললো,
-“পানি খাবো ভাইজান, খাইয়ে দিন।”

বিভার বলতে দেরি হলো, সরফরাজের ব্যস্ত হতে দেরি হলোনা। পাশের টেবিল থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা তুলে নিলো জলদি। বিভার ঠোঁটে ঠেকিয়ে ধরতেই সেদিকে চেয়ে মলিন হাসলো ইউসুফ। এইযে রুষ্টপুষ্ট প্রচন্ড রাগী মানুষটা যাকে দেখলে গ্রামের নেতা, চেয়ারম্যানরা পর্যন্ত মাথা নুঁইয়ে সালাম ঠুকে তারকাছে একমাত্র এই বিভা, ইভাই এমন আবদার করতে পারে। এতো ভালোবাসে সে বোনদের। আজপর্যন্ত কোনোদিন বকা তো দূর সামান্য উচুকন্ঠে কথাও বলতে শোনেনি। একমূহুর্তের জন্যও না।
ইউসুফ হাসার চেষ্টা করে। একটা দীর্ঘশ্বাসও কি বেরোয় সঙ্গে?

৩৮.
সকালে ঠান্ডার মধ্য আর গোসল করা হয়নি। সূর্যের দেখা মিলতে মিলতে দ্বিপ্রহর গড়িয়ে গেলো। ঘড়ির কাঁটা যখন যখন চারটা ছুঁইছুঁই, ঝলমলে কড়া রোদ ঠি কড়ে পড়লো বারান্দায়। ঝটপট গোসল সেড়ে ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বরফ শরীরটা নিয়ে সেই রোদেই এসে আশ্রয় নিলো ইভা। কাঁপুনি দিচ্ছিলো, রোদ গায়ে পড়তে কিছুটা আরাম হলো। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। গলার জামা ভিজে যাচ্ছে। স্তব্ধ মধ্যদুপুর। একপাশে এনে বিশাল চুলগুলো বারকয়েক ঝাড়া দিতেই দু’তিনটে পুরুষকন্ঠের হাসির শব্দে হাত থেমে গেলো তার। কন্ঠগুলো চেনে, কিন্তু!
সামান্য ঝুকে উঠোনের ঘাসের উপর বেতের চেয়ার পেতে সরফরাজ, ইউসুফ অত:পর সামনের চেয়ারটায় কালো টি- শার্ট পরিহিত চওড়া কাঁধের ব্যক্তিটাকে দেখেই বারকয়েক বিষম খেলো ইভা। উত্তপ্ত রোদটা বোধহয় হঠাৎই আর কাজ করলো না। রগে রগে কাঁপুনি ধরে গেলো। সায়ন কখন এলো? ভাইয়েরা বাসায় আছে জানে। ছুটির দিন। কিন্তু সায়ন? এরা এতো হাসাহাসি করছে কেনো? এমনে কি হাসি ভাইজানের সাথে, আর তাকে কিসব বলে! অসভ্য পুরুষ!
চুল ঝাড়ার শব্দে দূর থেকেই মিষ্টি রোদে মুড়িয়ে থাকা রমণীর একপাশে এনে রাখা ঝড়ঝড়ে ভেজা চুলগুলোর দিকে চোখ পড়েছিলো সায়নের। রমণী বিস্ময়ে হা হয়ে চেয়ে আছে। টুকটুকে গালদুটো রোদে লাল হয়েছে নাকি লজ্জায় ঠি ক বোঝা গেলোনা।
আশেপাশের পুরুষদুটোর উপস্থিতি লক্ষ্য করে নিভৃতে চোখ নামিয়ে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলো সায়ন। এরপর আবার চোখ তুললো যখন; ইভা তো দূর, ইভার ছায়াটুকুও নেই সেখানে। ফাঁকা ধুঁ ধুঁ বারান্দার দিকে চেয়ে এবার নিশ্চিত হয়ে গেলো সে, গালদুটো তবে লজ্জায়ই লাল হয়েছিলো।

হাসিঠাট্টায় মশগুল থাকতে থাকতে কখন যে এত সময় গড়িয়েছে বুঝতেই পারলোনা সায়ন। পছন্দের বাদামী বেল্টের হাতঘড়িটার দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই চোখ কপালে উঠলো যেনো। এসেছিলো কেবল আধঘন্টার জন্য। ইভার বাবা- মার সাথে একটু দেখা করেই আবার চলে যাবে। গ্রামে আসার সময় করে উঠতে পারেনা। একদিনের জন্য এসেছে যখন দেখা না করে চলে যাওয়াটাও ভালো লাগছিলোনা। তাছাড়া উনারা ওকে বড্ড স্নেহ করেন।
এসেছ্লিও দুপুরের পর। যেনো খাবার দাবারের ঝামেলা না থাকে। কিন্তু না, সরফরাজ যেতে দিলো কই? হাল্কা চা খাবার কথা বলে এইযে বসলো খোলা আকাশের নিচে। সে নিজেও টের পায়নি কখন সময় গিয়েছে।

-“ভাইয়া? আমার যেতে হবে যে এবার। পাঁচটা বেজে গেছে। শুক্রবার এমনিই জ্যাম থাকে। এখন রওনা দিলেও ফিরতে দশটা এগারোটা বেজে যাবো।”

তার কথা শেষ হলোনা। জমিলার মা খালি কাপের ট্রে টা বদলে দিয়ে গেলো। এতক্ষণে আরো চার- পাঁচবার সে ট্রে বদলেছে। কাপভর্তি গরম চা দিয়ে গিয়েছে।
সরফরাজ চাপা স্বরে বললো,
-“এটা খেয়ে নাও। তারপর আর আটকাবোনা।”

মানা করতে পারলোনা সায়ন। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিলো। নির্জন পড়ন্ত বিকেলের নিস্পন্দনতা কাটিয়ে সরফরাজের ফোন বাজলো। চোখের ইশারায় অনুমতি নিয়ে ফোন হাতে সে একটু দূরে গিয়ে দাড়াতেই সায়নের দিকে চেপে এলো ইউসুফ। গলা খুশখুশ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো। সায়ন তাকালো।

-“কিছু বলবেন ভাইয়া?”

-“অবশ্যই।”

-“বলুন।”

ইউসুফ চেপে এলো আরো খানিকটা। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে ফিসফিস করে শুধালো,
-“চায়ে চুমুক দেবার বাহানায় আপনি যার জন্য বারবার ওদিকে তাকাচ্ছেন সে আর আসবেনা সায়নসাহেব।”

আচমকা ধরা খাওয়া অপরাধীর মতো একপলক তাকিয়েই মৃদু শব্দ করে হেসে ফেললো সায়ন। হঠাৎই কি একটা অদ্ভুত সুপ্ত লাজুকতা খেলে গেলো পুরুষ চোখেও। ছোট্ট একটা উওর এলো,
-“জানি।”

-“জানো তবু তাকাচ্ছো কেনো?” বলে চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিলো ইউসুফ। অপরপাশের মানুষটাকে বেশ জব্দ করে ফেলার প্রমানস্বরুপ ঠোঁটের কোঁণে বাঁকানো একটা হাসি বেশ শোভা পাচ্ছে।

-“ওইযে মরীচিকার পিছে ছোঁটা, মানুষের আদিস্বভাব। আমিও মানুষ বটে।”

ইউসুফ সপ্রতিভ হলো। মাথা নাড়ালো। ছেলেটার কথার ধাঁচ আছে।

৩৯.
সন্ধ্যার পরপরই একটু বেরিয়েছিলো ইউসুফ। যাবার আগে একবার বিভার ঘরে দেখে গিয়েছে। মেয়েটা ঘুমাচ্ছিলো চুপ করে। কিন্তু ফিরে আসার পর আর তাকে আর চুপটি করে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গেলোনা। ফাঁকা ঘর, শূন্য বিছানা। আদ্যপান্ত চোখ বুলিয়ে ঘরের দরজাটা নিরবে লাগিয়ে দিলো ইউসুফ।
দ্বিতীয় গেলো ইভার ঘরে। দরজা খোলাই ছিলো। কোলের উপর বই রেখে পড়ছিলো ইভা। দরজায় ইউসুফকে দেখেই চোখ তুলে তাকালো। কিছু বলতেও পারলোনা তার আগেই প্রশ্ন ছুড়লো ইউসুফ,

-“তোর বোন কই?”

আকস্মিক প্রশ্নটায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো ইভা। কিছু বলবে তার আগেই ইউসুফ আবার বললো,

-“টইটই করছে না? কই গিয়েছে? ওকে না আমি দুপুরে বললাম, দু’একটা দিন ছুঁটোছুঁটি করতে না।”

-“না ঘুমিয়েইছিলো, একটু আগে উঠেছে।”বোনের সাফাই গাওয়াটা বিশেষ একটা যুত্সই হলোনা বোধহয়। ইভা নিজেও বুঝলো।

-“এখন কোথায়?”

-“ঘরেও নেই? নিচে গিয়েছে মনেহয়।”

-“আমিতো নিচ থেকেই এলাম।”

-“উঠোনে মনেহয়। ছাদেও হতে পারে।”

-“বেশ।”দরজাটা আলগা করে ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো ইউসুফ। ইভা একা একাই আমতা আমতা করলো কিছুক্ষণ। তার বোনটা কেনো যে কথা শোনেনা!

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here