মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব -২১

মেঘদিঘির পাড়ে – ২১
মালিহা খান

রাতের অমা মলিন করে জোছনা উঠেছে। একলা একা রুপালি চাঁদটা হয়তো আত্নশ্লাঘায় বিভোর। এমন অপরুপ সে!
বাড়ির উঠোনে বিভাকে পাওয়া গেলোনা। ইউসুফের চওড়া কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
এই নিঝঝুম রাতেরবেলা মেয়েটা একা একা গিয়ে ছাদে বসে আছে নাকি? এত সাহস যে কই পায়!
অত:পর তার চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে বিভাকে ছাদেও পাওয়া গেলোনা।

গাছের পাতা কম্পনশূন্য। বাড়ির পিছের এদিকটা গাছগাছালিতে ভর্তি। কাঁঠালীচাপার ঘ্রাণে মাথা ধরে যায়। আঁধারে সামান্য মানব ছায়াও দৃষ্টিগোচর হয় বহুকষ্টে। একটু জোছনার আলোতে…

-“এখানে কি করছো তুমি?”

এত একাগ্র নিরবতা মূহুর্তেই উবে গেলো। শুকনো পাতা পড়ে ছয়লাব হয়ে ছিলো নিচ, মড়মড় শব্দে সেই পাতা ভেঙে কাছে এসে দাড়ালো ইউসুফ।
অথচ তার উপস্থিতিতে নির্বিকারচিত্তে বসে থাকা ছায়ামানবী বিন্দুপরিমানও নড়লোনা। যেনো সেই কন্ঠ তার কর্ণকুহর অবধি পৌঁছাতেই পারেনি এমন একটা ভাব নিয়ে সে খুব নির্লিপ্তভঙ্গিতে একাধারে হাতের ছোট্ট লাকড়ির টুকরোটা দিয়ে উঠোনের মাটিতে খুঁটতে লাগলো। যা সে বিগত অনেকক্ষণ যাবত মনোযোগ সহকারে করেই যাচ্ছিলো। তার মনোযোগের পরিবর্তন ঘটলোনা। তবে মুখের উপর ছেঁয়ে থাকা খোলা এলোকেশের নিচে খুব যন্ত্রনায় একজোড়া আবেগী চোখ বারঁবার পলক ঝাপটাতে লাগলো।

তার মুখ তুলে চাওয়ার অপেক্ষায় ইউসুফ ঠাঁট হয়ে দাড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। গাছের ফাকফোঁকড় গলিয়ে অল্পআধটু জোছনা আসে। ছায়ামানবীর নির্লিপ্ততার পরিমাণ আঁচ করতে করতেই পাথর কঠোর চোখের চাহনী নরম হয়ে এলো ধীরে ধীরে। সামান্য নিবিড় হয়ে পাশে বসতেই গলার স্বর নেমে গেলো অনেকটা,

-“মন খারাপ কেনো?”

খুব রুক্ষ কন্ঠেও সহস্রাধিক অনুভূতি লুকোনো গেলোনা। প্রতিটা বায়ুকণা অবধি টের পেলো তার হৃদআকুতি। ছায়ামানবী মুখ না তুলেই থমথমে কন্ঠে উওর দেয়,

-“মন খারাপ না।”

-“খারাপ। কেনো?”

উওর এলোনা। প্রশ্নও হলোনা আর। সময় গেলো। হাতের লাকড়িটা পড়ে যাবার মৃদু শব্দ হলো। বিভা মুখ তুলে গাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা আকাশের বিশাল চাঁদটায় চোখ আটকালো। বিষন্ন, উদাসীন। বারকয়েক পলক পড়লো। কোঁণ ঘেঁষে তপ্ত জল গড়ালো কি? অন্ধকারে বোঝা গেলোনা। হাত বাড়িয়ে চোখের কোঁণ ছুঁয়ে দেখতে পারলোনা ইউসুফ। কি যেনো আটকে দিলো। অবগত পরিণতি?
বিষন্নার মলিনতায় জোছনাও ম্লান হলো যেনো। অদ্ভুত ম্লানিমা গ্রাস করলো চারপাশ।

-“ওঠো। রাত হয়েছে। ঠান্ডা পড়ছে। ঘরে চলো।”

ইউসুফ তাঁড়া দিলো। এবারে উওর এলোনা। তবে শিরা- উপশিরায় রক্তজমিয়ে দিয়ে তার শক্ত বাহুতে কাত করে মাথা ঠেকালো বিভা। নিজের দু’হাত দিয়ে তার একহাত পেঁচিয়ে ধরে বিরবির করে বললো,

-“চুপ করে বসে থাকেন, আমি আর কিচ্ছু বলবোনা।”

ওখানে আর টু শব্দটাও হলোনা। শীত ও কি ভীত হয়ে পড়লো মনের উষ্ণতায়? কাঁঠালীচাপাও কেনো হঠাৎ ওমন ঘ্রান ছড়ালো? খুব তীব্র।
মেঘদিঘির পাড়ে – ২১
মালিহা খান

(বর্ধিতাংশ)

৪০.
ধবধবে নরম লেপটা দুপুরেই নামানো হয়েছিলো। কড়া রোদে দিয়ে, ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কারও করে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে যৎকিন্চিৎ ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হওয়ামাত্র আলুথালু হয়ে আপাদমস্তক তার ভিতর ঢুকে পড়েছে তন্দ্রা। সেই যে ঢুকুছে, আর বেরোয়নি।
প্রাপ্তবয়স্ক সহধর্মিনীর চেনাজানা শিশুসুলভ আচরণে ঘরে ঢুকেই শব্দ করে হেসে ফেললো সরফরাজ। দরাজ কন্ঠের হাসি! নিশ্চুপ ভোরের প্রথম কলরবের মতোন পবিত্র।
সরফরাজের হাসি কর্ণগোচর হতে পারেনা, লেপের ভেতর থেকেই রাগে থিঁতিয়ে উঠা মেয়েলি কন্ঠ শোনা যায়,

-“খবরদার হাসবেন না সরফরাজ।”

যাকে উদ্দেশ্য করে রাগ ঝাড়া হলো সে খুব বিশেষ একটা তোয়াক্কা করলো বলে মনে হলোনা। বরং আরেক ঝলক চওড়া হাসি তার ঠোঁট বরাবর ছুঁয়ে গেলো। জোর করে ধমক দেয়া মেয়েলি কন্ঠটা ঠি ক বুক বরাবর ছুঁয়ে গেলো।
মাথার উপর দিয়ে লেপ টেনে ভিতরে বসে ছিলো তন্দ্রা। সরফরাজ লেপের উপর দিয়েই বারদুয়েক হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। বললো,

-“আচ্ছা হাসলামনা। তোমার বেশি শীত করছে তনু?”

লেপের ভিতরে তন্দ্রা ঠি ক টের পেলো সেই মোলায়েম স্পর্শ। মুখে অবশ্য বললোনা কিছু। এদিক ওদিক মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝানো কেবল। লেপসহ ছোট্ট মাথাটা এদিক ওদিক দুলে উঠতেই কি যে তুলতুলে একটা অনুভূতি হলো সরফরাজের। সহ্য করতে না পেরে সে আবার হেসে ফেলল। তবে এবার আর শব্দ হলোনা। নিভৃত চাপা হাসি অনেকক্ষণ একটানা একদিকে স্হির থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো।

হাল্কা গোলাপি রংয়ের উলের বলটা গড়াতে গড়াতে মেঝের মাঝবরাবর চলে গেছে। সরফরাজ হাতের কাগজগুলো আলমারিতে রেখে ফিরে এলো। উলের বলটা মেঝে থেকে তুলে খোলা উলের রশিটা বলের সাথে পেঁচাতে পেঁচাতে ঠিক যেয়ে দাড়ালো বিছানার সামনে। উলের উৎস্য লেপের নিচ। খুব যতনে দু’টো মমতামাখা হাত নিঁখুত কুশিকাটায় ব্যস্ত।
সরফরাজ অল্প করে লেপটা তুলে, ঝুঁকে গিয়ে ভেতরে মাথা ঢোকায়।

নিজের বানানো কৃত্রিম উষ্ণরাজ্য আকস্মিক সরফরাজের আগমন কিয়ৎক্ষণ চোখ বড় বড় করে হতচকিত হয়ে চেয়ে রইলো তন্দ্রা। তারপর মাথা নামিয়ে বিরবির করে স্বগতোক্তি করলো,

-“দৈত্য এলো কোথা থেকে?”

সরফরাজ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,”আমি দৈত্য তন্দ্রাবতী?”

-“কম কি?” মুখটা আগিয়ে আনে তন্দ্রা। সরফরাজ ভ্রু উঁচায়। হঠাৎই সামনের কালো চোখের মনিতে তন্ময় হয়ে চেয়ে কি যেনো ভাবে। বেশক্ষণ। অত:পর হাতের উলের বলটা তন্দ্রার কোলের উপর রেখে খুব ধীর হেয়ালিস্বরে বলে,

-“সামলে রাখো তন্দ্রাবতী। সামলে রাখো।”

তন্দ্রা একপলক কোলের দিকে তাকায়। উলের বলটা দেখে। পরমূহুর্তেই চোখ তুলে বলে,”হয়েছে যান, বাতাস ঢোকাচ্ছেন। ইশ!” তার কন্ঠ হু হু করে কেঁপে উঠে।

তন্দ্রার বলার ধরণে আবারো হেসে ফেলে সরফরাজ। তন্দ্রা ভীষণ রেগে যায়, ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে,

-“আপনি আবার হাসছেন! চুপ করুন সরফরাজ। আপনার শীত লাগেনা?”

-“লাগেনাতো, কখনো দেখেছ?”সরফরাজ ভ্রু নাচালো।

তন্দ্রা ঠেলে ধাক্কিয়ে সরফরাজকে বের করে দেয়। তারপর লেপের নিচে বসে একা একাই হাসে কতক্ষণ। অনেকক্ষণ, বহুক্ষণ।

৪১.
ইউসুফ ঠিক পাথরের ন্যায় বসে রয়েছে। কঠিন চোখদুটো বহুক্ষণ পরপর একবার পলক ফেলছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ। বিভা নরম হাতদুটো দিয়ে বারকয়েক খুব নেড়েচেড়ে তার শক্ত হাতের মুঠো ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। পারলোনা। ভীষণ আক্ষেপের সুরে বললো,

-“আপনি এতো জেদ করেন কেনো?”

ইউসুফ তার আক্ষেপ বিন্দুমাত্র আমলে নেয়না। হাতের মুঠো আরো শক্ত করে ফেলে। বিভা তার মুষ্টিবদ্ধ হাতটাই আঁকড়ে ধরে। মৃদু স্বরে বলে,

-“ভালোবাসবেন না ভালো কথা। ভালোবাসতে তো দিবেন?”

ইউসুফ চুপ করে রইলো। কতগুলো কথা কন্ঠনালি অবধি এসে শেষমেষ তুমুল বাধাপ্রাপ্ত হলো। ঠোঁট অবধি পৌঁছোতে পারলোনা।
আচ্ছা, সে যে এই হাঁড়কাপানো ঠান্ডায় পাতলা শার্ট গায়ে মেয়েটার অহেতুক অদ্ভুত পাগলামির সঙ্গ দিচ্ছে, হাত জড়িয়ে বসে থাকতে দিচ্ছে, এতেই কি ভালোবাসতে দেয়া হচ্ছেনা? সে যে কখনো বিভাকে বকা দেয়না, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনা, ভীষণ রেগেও একটু শক্ত করে বিভার হাত ধরতে পারেনা, এতেই কি ভালোবাসা হচ্ছেনা?
ঠি কআছে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না। তবুও তো সে ভালোবাসছে। বাসছেনা?

ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“তোমার মন খারাপ শেষ হলো? ভেতরে যাই?।”

কথাটা শোনামাত্র বিভা ঝুপ করে ইউসুফের হাত ছেড়ে দেয়। থমথমে গলায় আপত্তি করে বলে,

-“আমি যাবোনা। আপনি যান।”

-“আমি না, তুমি খুব জেদি বিভা, আমার কোনো কথা শোনোনা।” শান্ত গলায় কথাটা বলে একটু থামলো ইউসুফ। বসা থেকে উঠে দাড়ালো। খুক খুক করে গলা ঝেড়ে বললো,

-“এখনও সময় আছে। চলো আমার সাথে। একা একা কতক্ষণ বসে থাকবে?”

বিভার প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলোনা। ইউসুফও গেলোনা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
গাছের পাতাগুলো হঠাৎ দুলে উঠে। দূরে কোথাও শিয়াল ডাকছে। শীতের সময় শিয়ালের উপদ্রব বেড়ে যায় গ্রামে।
শিয়ালের ডাক ভয় পায় বিভা। সে হুট করে দাড়িয়ে গেলো। ইউসুফের শার্ট টেনে ধরে বললো,”আমাকে একা রেখে যাচ্ছেন, আপনি এতো নিষ্ঠুর কেনো?”

ইউসুফ হাসল। মেয়েটা কখন কি বলে বোঝা মুশকিল! বড্ড দূর্বোধ্য রমণী।

বাড়ির পেছনটা ঠিকঠাক পেরোনোও গেলোনা। দূর থেকে আতশবাজির শব্দে এতক্ষণে চকচক করে উঠলো বিভার বিশাদমলিন চোখদুটো। ইউসুফের শার্টে মারাত্বক টান দিয়ে হাসি হাসি কন্ঠে বললো,

-“হায় আল্লাহ! আমি তো ভুলেই গেছিলাম। উওরপাড়ায় না বড়মেলা হচ্ছে? যাবেন?”

ইউসুফ আগাগোড়া চমকে উঠলো,”এই রাতের বেলা? অসম্ভব।”

-“আমি যাবো।”

-“যাও।”ভাবলেশহীন উওরটা দিয়েই এগিয়ে যেতে চাচ্ছিলো ইউসুফ। বিভা দিলোনা। শার্টে দ্বিতীয় মারাত্বক টানটা দিয়ে বললো,

-“আপনি নিয়ে যাবেন।”

-“অসম্ভব।”

-“সম্ভব। চলুন।”

ইউসুফ আস্তে করে বলে,
-“কাল নিয়ে যাবো। এখন না।”

-“আমি বলেছিনা এখন?”

বিভার জেদ অটুট থাকে। মিনিটদশেকের মাথায় সরফরাজের থেকে চূড়ান্ত অনুমতি নিয়ে সে বিস্তর হাসি নিয়ে গাড়িতে বসে।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here