#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_২৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
সেদিনের পর অবলীলায় পরপর পাঁচটি দিন কেটে গেছে। আর দশ দিন পরেই মেঘবৃত্তের লাস্ট সেমিস্টারের ফাইনাল এক্সাম শুরু হবে। তার রেশ ধরেই দুজনই পড়াশোনা নিয়ে মহাব্যস্ত। তবে, অন্যবারের মত মেঘা নোটের জন্যে বৃত্তকে একের পর এক কল দিয়ে জ্বালালো না। বরং, বৃত্তের কাছে থেকেই বৃত্তের কান দুটো জ্বালাপালা করে ফেললো। আর বৃত্ত বরাবরের মতোই চুপটি করে মেঘার এসব সহ্য করে নিলো।
রাত ঠিক দশটা। রাতের খাবার-দাবার শেষ করে বৃত্ত নিজের রুমে এসেছে। ঘরে এসেই পড়তে বসে গেছে সে। তবে, মেঘার সবকিছু গুছিয়ে আসতে আসতে বেশ সময় লেগে গেলো। অতঃপর, মেঘঘা ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ নিয়ে নিজ ঘরে এলো। ঘরে প্রবেশ করতেই পড়ার টেবিলে বৃত্তকে চোখে পড়লো। চোখে চশমা, টেবিলের উপর ছড়ানো-ছেটানো তিনখানা বই, হাতে কলম। সবমিলিয়ে বৃত্তকে দেখে মেঘা আরো একটুখানি তার প্রেমে পড়লো। এই মুহূর্তে বৃত্তকে কি সুন্দর লাগছে দেখতে, মেঘা বলে বুঝাতে পারবে না। শুধু অপলক চেয়ে রইলো তার একান্ত প্রেমিক পুরুষটার পানে!
ঘরে মেঘার উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই বৃত্ত বইয়ে মুখ গুঁজে বললো,
— হাবলার মত দাঁড়িয়ে না থেকে পড়তে আয়। দশদিন পর এক্সাম! ভুলে খেয়ে ফেলেছিস, নাকি?
মেঘা হুট করেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। বৃত্তের দিকে ওমন করে তাকিয়ে ছিল ভেবেই আড়ষ্টতায় ছেয়ে যেতে লাগলো তার সর্বাঙ্গ! বৃত্তের দিকে চেয়ে বোকার মত চাওনি নিক্ষেপ করে বললো,
— দাড়া, ফ্রেশ হয়ে আসছি।
কালবিলম্ব না করে, মেঘা চটজলদি বাথরুমে চলে গেল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। চুল চিরুনি দিচ্ছে সে। আজকাল চুল আঁচড়ানোর ইচ্ছে বা সময়, দুটোই সে পায়না। তার ফলস্বরূপ, বেশ জট হয়েছে চুলে। সেই জট ভাঙতে বেশ জোর জবরদস্তি করতে হচ্ছে তাকে।
বৃত্ত পড়ছিল। পড়ার ফাঁকে চোখ গেলো মেঘার দিকে। অতঃপর, সহসা চোখ গেলো মেঘার উন্মুক্ত উদরের দিকে। চুল আঁচড়ানোর তালে পাতলা শাড়ীর আঁচল সরে দেখা যাচ্ছে মেঘার শ্যামা রঙের উদর। এই প্রথম মেঘার শরীরের কোনো অংশে দিকে চোখ গেল বৃত্তের। সঙ্গেসঙ্গে বৃত্তের গলা শুকিয়ে গেলো। তার পরপরই জন্মালো নিজের প্রতি ঘৃনা, ক্ষোভ। হুট করেই বৃত্তের মনে হলো, এভাবে মেঘার উন্মুক্ত উদরের প্রতি চেয়ে থাকা ঘোর পাপ! যতই সে তার স্ত্রী হোক, দিনশেষে তারা শুধুই দুজন বন্ধুর মতন। বৃত্ত চোখ সরালো। পুনরায় মুখ গুজলো বইয়ের ভাজে।
মেঘা ঠিকঠাক ফ্রেশ হয়ে বৃত্তের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। বৃত্তের পড়ুয়া চেহারার দিকে ক্ষণকাল চেয়ে নিজেও এক বিশাল আকারের বই খুলে বসলো। কিছুক্ষণ বইটা নেড়েচেড়ে দেখে চোখ উল্টালো সে। এই পড়াশোনা মেঘার কোনো কালেই ভালো লাগতো না। মাঝেমধ্যে মনে হতো, যে এই পড়াশোনা নামক প্যারাটার আবিষ্কার করেছে তাকে হাতের কাছে পেলে তার গালে দু দুটো চাটা বসানো উচিত! তবেবআফসোস, মেঘা সেই লোকটাকে পেলেও না আর তার গালে চটাস চটাস থাপ্পড় মারাও হলো না।
মেঘাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বৃত্ত পড়া ছেড়ে তার দিকে তাকালো। মেঘা ঠোঁট উল্টে বসে আছে। বৃত্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ আর নতুন কি? মেঘা সদা করে এমন। বৃত্ত নিজের বইটা বন্ধ করে মেঘার দিকে ফিরলো। নাকের ডগায় থাকা চশমাটা চোখের উপরে তুলে বললো,
— কি সমস্যা বল, সলভ করে দিচ্ছি।
মেঘা মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো। বন্ধকৃত বইটা পুনরায় খুলে একের পর এক প্রবলেম বের করতে লাগলো। বৃত্তও খুব ধৈর্যসহকারে মেঘার সমস্ত প্রবলেম সলভ করে দিলো।
চোখের পলকে রাত দুটো বেজে গেছে। মেঘা বইয়ে মুখে গুজে ঘুমিয়ে ছিলো এতক্ষণ। খানিক পর ঘুম ভাঙলো তার। এখন বাথরুম ব্যবহার করতে হবে তার। মেঘা বই থেকে মাথা তুললো। সহসা চোখ গেলো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত বইয়ে মুখ গুজে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুবিধার জন্যে তার এক হাত মাথার নিচে রাখা। হয়তো এই হাতকেই সে বালিশরূপে ব্যবহার করেছে। মেঘা হাসলো। চশমাটাও খুলেনি অব্দি। মেঘা একট ঝুঁকে অতি সাবধানে বৃত্তের চোখের চশমা খুলে নিলো। চশমা টেবিলের এক পাশে রেখে বিছানা থেকে একটা ছোট কুশন এনে বৃত্তের মাথার নিচে রাখলো। এতে আরো একটু আরাম পেতেই বৃত্ত লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে উঠলো। অতঃপর, পুনরায় পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। মেঘা কিছুক্ষণ বৃত্তের দিকে চেয়ে রইলো। ইশ, মানুষটাকে ঘুমালেও কি যে সুন্দর লাগে! মেঘা আরো এক দফা এক ঘুমন্ত মানবের প্রেমে পড়লো। এই মেঘাও না! আস্ত এক পাগল প্রেমিকা! তার যত প্রেম সবই এই বৃত্ত নামক পুরুষকে ঘিরে, এই পুরুষকেই আঁকড়ে! এক পুরুষে এত সুখ, এত প্রেম!
____________________________
সকালের কাঁচা আলো বৃত্তের চোখে পড়তেই চোখ খিঁচলো সে। ঘনঘন নিঃশ্বাসের বহর ফেলে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো বৃত্ত। ঘুমের ভাবটা একটু কেটে যেতেই মনে পড়লো, সে তো কাল টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। বৃত্ত টেবিল থেকে মাথা তুললো। মাথা নাড়ানোর তালে ঘাড়ে অনুভব হলো, সূক্ষ এক ব্যথার। বৃত্ত ঘাড়ের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়লো। ঘাড়ে হাত গলিয়ে খানিক মালিশ করলো সে। হঠাৎ চোখ গেলো, টেবিলের উপর রাখা এক কুশনের দিকে। বৃত্ত অবাক হলো। এই কুশন এলো কোথা থেকে? কাল রাতে তো সে হাতে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাহলে, এই কুশন? পাশে মেঘাকে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখে মনে পড়লো তার, হয়তো মেঘাই কাল রাতে কুশন এনে দিয়েছিল। বৃত্ত ফিচেল হাসলো। মেঘার এসব ছোটখাটো বিষয়ে খেয়াল রাখা, তা তো অতি সাধারণ। সদা করে সে এমন। বৃত্ত হাসলো আবার। নিজের কুশনটা চুপচাপ মেঘার মাথার নিচে রেখে দিলো। এবার মেঘা আরামে ঘুমাক! মাথার নিচে নরম কিছুর অস্তিত্ব পেতেই মেঘা গুটিসুটি মেরে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। বৃত্ত আর দেরি করলো না। আজ একবার ভার্সিটি যেতে হবে তার। পরীক্ষার জন্যে কিছু কাজ আছে। সেটা শেষ করতে হবে। তাই সে চেয়ার ছেড়ে উঠে বাথরুমে চলে গেলো।
#চলবে