#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
রাত নেমেছে। রাতের সঙ্গী হিসেবে নেমেছে হিম বাতাস। চারপাশ কি ঠান্ডা! গা শিরশির করে উঠে। আকাশ নিংড়ে নামছে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা জানালা উপচে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। বৃত্তের মা সেটা লক্ষ্য করে জানালা আটকে দিলেন। মেঘার মায়ের দিকে চেয়ে বললেন,
— বাইরে তো বৃষ্টি পড়ছে? মেঘা তো অসুস্থ। আপনারা ওকে নিয়ে যাবেন কি করে? সিএনজি দিয়ে গেলে ভিজে যাবে ও। জ্বরের মধ্যে আরো ভিজলে শরীর আরো বেশি খারাপ করবে।
মেঘার মা মেয়ের দিকে কাতর চোখে তাকালেন। সামান্য সময়ে মেয়েটার কি হাল হয়ে গেলো? নজর সরিয়ে মেঘার বাবার দিকে তাকালেন উনি। মেঘার বাবা থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন। ভেবেছিলেন, বাসায় গিয়ে মেয়েটাকে আচ্ছামত বকবেন। কিন্তু, শেগুরে বালি! মেয়েটা মাঝপথে অসুস্থ হয়ে তার কঠোর হৃদয়কে গলিয়ে দিলো। মেঘার বাবা মেয়ের দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বললেন,
— ‘ মেঘা? মেঘা? উঠো। বাসায় যেতে হবে তো আমাদের। উঠো। মেঘা? ‘
মেঘা চোখ উল্টে শুয়ে রইলো। বিড়বিড় করে দু একটা কথা বললো, তা শোনা গেলো না। বৃত্ত পাশে দাঁড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। আজ তাদের প্ল্যানটা একদম সমতলে চলছে। প্রকৃতিও তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। বাহ! তবে, আজ আচ্ছা অভিনয় করছে মেঘ। এই মেয়ের নাট্যকলা নিয়ে পড়া উচিৎ ছিলো। তবেই ভালো কিছু করতে পারতো। কেনো যে ত্রিপোলি নিয়ে পড়তে গেলো,কে জানে? পাগলে ধরেছিলো বোধহয়। বৃত্ত মুচকি হাসলো।
বৃত্তের বাবা অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন,
— আজ নাহয় মেঘা আমাদের এখানেই থাকুক। কথা দিচ্ছি, বৃত্ত মেঘার থেকে দূরেই থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
মেঘার বাবা মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিলেন। এছাড়া আর উপায় কি? মেঘার বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বৃত্তের বাবার দিকে চেয়ে বললেন,
— আপনার ভরসায় রেখে যাচ্ছি, ভাই। খেয়াল রাখবেন। আসি তবে।
মেঘার বাবা-মা চলে গেলেন। বৃত্তের মা খাবার ঘর গুছাচ্ছেন। বৃত্তের বাবা বসার ঘরে বসে কিসের ফাইল ঘাটছেন।বৃত্ত চারপাশ একবার জরিপ করে নিলো। নত মুখে মাথা চুলকে এগিয়ে যেতে চাইলো মায়ের ঘরের দিকে। তবে, বাঁধ সাধলেন বৃত্তের বাবা। পিছন থেকে ডেকে বললেন,
— ‘ বৃত্ত, তুমি তোমার ঘরে যাও। মেঘার খেয়াল রাখতে তোমার মা আছেন।তাই, চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমাও। ‘
বৃত্ত বাবার কথা শোনে পা থামিয়ে ফেললো। তবে, পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো। অতঃপর, শান্ত পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
সেদিন রাতে বৃত্ত আর মেঘার কাছে গেলো না। বরং, নিজের ঘরে বসে পড়াশোনা করলো। কদিন ধরে যা জঞ্জাল যাচ্ছে। তাতে, পড়াশোনা লাটে উঠে রীতিমত তবলা বাজাচ্ছে। এমনিতেই মেঘার ব্যাপার নিয়ে বাবা কত কথা শোনালেন। এরপরে আবার রেজাল্ট খারাপ করলে বাবা রীতিমত মান-ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে ফেলবেন। না! তার চেয়ে পড়াশোনায় করাই ভালো। এতে বাবার মুখ খানিকটা হলেও বন্ধ হবে।
_________________________
রাতের আঁধার পেরিয়ে সকালের ম্লান আলো আকাশের কোণে দেখা দিচ্ছে। পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে। বৃত্ত অনেক রাত করে পড়ছিল। পড়তে পড়তে কখন যে টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়াল ছিলো না। ফজরের আজান কর্ণগহ্বরে প্রবেশ করতেই বৃত্ত চোখ কচলে মাথা তুললো। মাথা উচুঁ করে দেয়ালে রাখা গোল আকৃতির ঘড়িটায় চোখ বুলালো। চারটা পঞ্চাশ বাজে। বৃত্ত আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছাড়লো। গায়ে জড়িয়ে থাকা সাদা রঙের টিশার্ট টেনে টুনে ঠিক করে বাথরুমে চলে গেলো। মুখ হাত ধুয়ে একদম ওযু করে বের হলো। এমনিতে প্রায়শই বৃত্ত নামাজে অবহেলা করে। সুযোগ থাকলেও নামাজ বিষয়টায় তার বরাবরই ভালো লাগে না। তবে, আজ কি মনে করে নামাজ পড়ছে সেটা স্বয়ং বৃত্তও জানে না। বৃত্ত নামাজ শেষ করে জায়নামাজ আবারও কাবার্ডে রেখে দিলো। কি একটা মনে করে দরজা খুলে রুম থেকে বের হলো সে। চারপাশ এক নজর দেখে মায়ের ঘরে উঁকি দিলো। মা ঘুমুচ্ছেন। পাশে মেঘা। টি টেবিলের উপর একটা পানিভর্তি বাটি রাখা। তাতে রুমাল। মা যে সারারাত মেঘাকে জলপট্টি দিয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৃত্ত মনে মনে হাসলো। সে ঠিক ছিল। মা মেঘাকে পছন্দ করেন। কিন্তু, নিজেকে অযথাই শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। আর কটা দিন যাক। বাচ্চার কথা শুনলে এমনিতেই মায়ের মন গলে যাবে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। বৃত্ত পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করলো।
মেঘার পাশে দাঁড়িয়ে আলতো কণ্ঠে ডাক দিলো,
— মেঘ? এই মেঘ? উঠ। মেঘ?
মেঘা দুবার চোখের পলক ঝাপটালো। বৃত্তের পুনঃপুনঃ ডাক শুনে সে পিটপিট করে তাকালো। মুখের দিকে বৃত্তকে ঝুঁকে থাকতে দেখে মেঘা ভ্রু কুঁচকালো। বিরক্তি নিয়ে বললো,
— কি হয়েছে? মাঝরাতে গায়ে পড়ে যাচ্ছিস কেনো? সর। ঘুমাবো আমি।
কথাটা বলে মেঘা পাশ ফিরে আবারও চোখ বুজলো। বৃত্তের এতে মহা রাগ উঠলো। মেঘার পিঠে চাপর দিয়ে বললো,
— মেঘের বাচ্চা! উঠ। নাহলে, আমাদের সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। পরে ঘুমাস।
মেঘা ততক্ষণে আবারও ঘুম। বৃত্ত পড়লো মহা ফ্যাসাদে। আর একই পরেই মায়ের ফোনে অ্যালার্ম বাজবে। মা নামাজ পড়তে উঠে পড়বেন। আর একে দেখো? সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে পড়ে পড়ে নাক ডাকছে। বৃত্ত এবার মেঘার গায়ে জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে ফিসফিস করে বললো
— ‘ এই মেঘ? উঠ নারে বাবা! মা উঠে যাবেন একটু পর। উঠ না। মেঘ? ‘
মেঘা এবার খানিক নড়েচড়ে উঠলো। পাশ ফিরে বৃত্তের দিকে চেয়ে হতাশ গলায় বললো,
— আজ তোর জন্যে আমার সব শান্তি শ্যাষ! আগে বাচ্চাটা হোক। তারপর দেখিস তোরে আমি কি করি। ‘
মেঘা উঠে বসলো। বৃত্ত পাশে বসে মিটমিটিয়ে হাসলো শুধু। মেঘা বৃত্তের হাসি দেখে জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হলো। বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে বৃত্তের মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বৃত্ত মাথা চুলকে পিছু পিছু আসলো।
প্ল্যান মোতাবেক মেঘা বৃত্তের রুমে এলো। বৃত্ত চারপাশ দেখে দরজা আটকে দিলো। মেঘা বৃত্তের বিছানায় শটান করে শুয়ে পড়লো। বৃত্তের দিকে চেয়ে বলল,
— এবার আর ডাক দিবি তো, তোকে আমি খুন করে ফেলবো। খবরদার আমাকে ডিস্ট্রাব করবি না।
বৃত্ত মাথা নেড়ে সায় দিলো। অতঃপর, মেঘা ঘুমিয়ে গেলো। বৃত্ত ঘুমন্ত মেঘার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করলো, ‘ আমাকে রাজ্যের চিন্তায় ফেলে এ ঘুমাচ্ছে। তোর শান্তির ঘুম আমার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু কি আর করার। সবই কপাল! ‘
বৃত্ত বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে পড়লো। এক বিছানায় ঘুমুলে মেঘা যদি তেঁতে উঠে, সেই ভয়ে।
_________________________
মেঘা রুম ছেড়ে বেরোনোর কিছুক্ষণ পর বৃত্তের না নামাজ পড়তে উঠলেন। মেঘার জ্বর কমেছে কিনা দেখতে বৃত্তের মা পাশ ফিরলেন।কিন্তু, মেঘাকে পাশে না পেয়ে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। হন্তদন্ত হয়ে শোয়া থেকে বসে গেলেন। বারান্দাতে তাকালেন, মেঘা নেই। তিনি এবার বাথরুম দেখলেন। নাহ! মেঘা সেখানেও নেই। বৃত্তের মা এবার ছেলের ঘরের দিকে এগুলেন। মেঘা ওখানে নেই তো? ছেলের ঘরের দরজা আটকানো। দরজার বাইরে মেঘার জুতো দেখে যা বুঝার তিনি বুঝে গেলেন। বৃত্তের এমন বেপরোয়া ব্যবহার দেখে তার বেজায় রাগ হলো। সেই রাগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে তিনি দরজা ঠকঠকাতে গেলেন। তবে, কি একটা মনে করে মাঝপথে থমকে গেলেন। যতই হোক, তার ছেলে এখন আর অবিবাহিত নয়। এভাবে মাঝরাতে ছেলের ঘরে টোকা দেওয়া খুব বাজে দেখায়। বৃত্তের মা ফুস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লেন। যা দেখার কাল দেখা যাবে। এখন মাঝরাত্তিরে লজ্জাশরম ভুলে চুপ থাকাই শ্রেয়! বৃত্তের মা মনে মনে বৃত্তকে ইচ্ছেমত গালি দিয়ে নিজের রুমে চলে এলেন। তবে, মনে মনে একটাই চিন্তা, কাল সকালে বৃত্তের বাবাকে কি বলবেন তিনি?
#চলবে