মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব -২৯+৩০

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৯

কাঁচ ভাঙা টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মেঝে জুড়ে। আলোকিত করা রঙিন বাতিগুলো নেভানো। হয়ত তার প্রভাব চ্যুত হয়েছে। আমি একপাশে পর্দার আড়াল থেকে যাবতীয় কার্যকলাপ দেখছি। ধ্রুব তার টেবিলেই বসে আছে, তবে তখনকার ন্যায় স্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক। মুখশ্রী জুড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা। রক্তিম চোখজোড়া অস্বাভাবিক, কঠোর, গম্ভীর। প্রধান লোকটা সবাইকে ক্ষান্ত হতে বলছেন।

আমার চোখে চোখ পড়ল রাহাত স্যারের। চমকে গেলেন তিনি। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধ্রুবের হাতে আঘাত করে কিছু একটা শুধালেন। পরক্ষণে ধ্রুব স্যার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। ভ্রু কুঁচকে রাহাত স্যারকে তিনি কিছু বললেন। ওষ্ঠদ্বয় অনুসরণ করে বুঝলাম, “ও এখানে কী করছে?”

“আমি কীভাবে জানব।” মৃদু শব্দে।

“ওকে এখান থেকে সরা। ঝামেলা হতে পারে।”
ধ্রুব থামতেই রাহাত স্যার এগিয়ে এলেন। আরেকটু আড়ালে নিয়ে বললেন, “চড়ুই তুমি এখানে কী করছ? তাড়াতাড়ি এখান থেকে যাও।”

“না। আমি যাবো না।” রিনরিনে জবাব।

“চড়ুই প্লীজ যাও।” অসহায় কণ্ঠে।

কিন্তু আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তো এই ঝামেলার ইতি টানতে এসেছি। তাইলে? রাহাত স্যার হেলান দিয়ে ধ্রুবকে ইশারা করলেন।
তার ইশারার কারণ অজানা নয় আমার। অবিলম্বে ছুটে এলেন তিনি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তুমি এখানে কী করছ? সেটা পরে দেখছি। শেষ হোক অনুষ্ঠান। আপাতত এখান থেকে যাও।”

তেড়া ভাষায় বললাম, “বলেছি তো যাবো না। যাবো না মানে যাবো না। সরুন আপনি।”
আমার বলা কথনগুলো একটু বেশি আওয়াজে প্রকট হল। বিনিময়ে সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল আমার পানে। একটু ইতস্তত বোধ হলেও নিজের সংযত করে নিলাম। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে বললাম, “আমি চড়ুই, এখানে যেই বিষয়টা নিয়ে ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু আমি।
আমার কিছু প্রশ্ন ছিল, করতে পারি।”

আরেকটু সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। এই দু’দিনে পায়ের ব্যথাটা একটু ঘুচে এসেছিল বটে। কিন্তু উপর থেকে লাফ দেওয়ার ফলে পুনরায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। জুতো জোড়াও ছিঁড়ে গেছে। ক্ষত পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোলাম। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,

“প্লীজ কেউ কিছু মনে করবেন না।
শিক্ষক মানেই কি শুধু শিক্ষকতা? গম্ভীর ভাবে চলা? আমি মনে করিনা। শিক্ষক তো তখনই শিক্ষা প্রদান করতে ভালো পারে, যখন সে ছাত্র ছাত্রীর সাথে মিশে। ক্ষত পা নিয়ে এখানে এসেছি আমার ভার্সিটির সম্মান রক্ষা করতে। কতটা পথ হেঁটে দৌড়ে এসেছি, আমারই জানা।
দু’দিন আগের রাতে আমি কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। মাঝ রাস্তায় বিপদে পড়েছিলাম। তখন ধ্রুব স্যার আমাকে সাহায্য করেছিলেন। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই ঘটনাটা শেয়ার করতে চাইছি না। পায়ে ব্যথার কারণে আন্টি আমাকে যেতে দেননি। আমার ছোট বোনকে আনার ব্যবস্থা করেছেন। ইভেন্ট এখানে আসার সময় বোনকে পাঠিয়েছেন সাথে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ও।
আমার জন্য ধ্রুব স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, লাঠিচার্জ করেছে‌। আর আপনারা বলছেন সে চরিত্রহীন? উপযুক্ত কারণ দেখান, সে কী চরিত্রহীনতার পরিচয় দিয়েছে। একজন মানুষের ভেতরেটা না জেনে চরিত্রহীন বলাটা কি সাজে?”

সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন আমার কথা। ভেতরে কী হল জানা নেই। ধ্রুব আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। গাড়ির ভেতরে রেখে পুনরায় ভেতরে গেলেন। দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলেন। ফিরে এলেন কখন জানা নেই। বাবুই আর আমি গাড়ির ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন একটা রেস্তোরাঁয় সামনে।

রেস্তোরাঁয় বসে আছি চারজনে। ভিন্নরকম একটা পরিবেশ। রাত গভীর হওয়াতে জনশূন্য পরিবেশ। দুই-চার জন ওয়েটার দেখা যাচ্ছে। হাতে মেনু কার্ড সমেত দাঁড়ানো। ধ্রুব বিরক্তিকর চোখে একবার অবলোকন করে তাকে যেতে বললেন। অতঃপর কিনলে বোতল থেকে পানি পান করলেন। রাহাত স্যারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কেমন ওয়েটার পুষিস। বসার আগে কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বলি, কার্ড নিয়ে না দাঁড়িয়ে একটা ভাঙা বাটি নিয়ে দাঁড়াতে বলতে পারিস। কিছু খুচরা দেওয়ার পর অন্তত চলে যাবে।”

রাহাত স্যারকে এইসব বলার কারণ বোধগম্য হলনা। আমি বুঝার চেষ্টাও করলাম না। ক্ষিপ্র হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব আড় চোখে চেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কী খাবে?”

আমি গভীর ভাবনায় বিভোর ছিলাম বিধেয় খেয়াল করলাম না। ধ্রুব তুরি বাজিয়ে পুনরায় বললেন, “আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।”

ধ্যান ভাঙতেই অবুঝ স্বরে বললাম, “জি!”

“কী খাবে, অর্ডার করতে বলেছি।”

“আমি কিছু খাবো না। আন্টি বাড়িতে একা, আমরা বরং সেখানে গিয়ে ডিনার করব।”

ধ্রুব অন্য প্রসঙ্গ টেনে নিলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, “কালকে পরীক্ষা। কতদূর হয়েছে পড়া?”

থমথমে হল পরিবেশ। জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে নীরব হলাম। সৌজন্য হাসি দিলাম। বাবুই বই এনেছে ঠিকই কিন্তু ব্যাগ থেকে বের করাই হয়নি। আবার পড়া। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। লেগে আসছে ক্রমশ। হাই তুলে বলি, “আগের পড়া আছে।”

“তারমানে পড়নি! বাড়িতে কী করেছিলে?”

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। ধ্রুব কঠোর রুপ ধারণ করলেন। সরল স্বভাবের মানুষটি সাধারণ একটি কারণে এতটা কঠোর, ভাবা যায়! ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার করলেন। আমার ভাবনা ফুরিয়ে আসার পূর্বে খাবারে ভর্তি টেবিলের সম্পূর্ণ কোণাকানা। বিয়ে বাড়ির সব খাবার হাজির। তাজ্জব বনে গেলাম। এত খাবার কেন অর্ডার করল। আমি রোস্টের লেগপিচ নিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়া শেষ হতেই ধ্রুব হাত মুখ মুছলেন টিসু পেপারে। ধীরে ধীরে বললাম,
“এত খাবার কি ফেলে দিবে?”

“কেন তোমার পছন্দ হয়েছে? বাড়িতে নিয়ে যেতে চাও। নিয়ে নাও, বাড়িতে নিয়ে গরম করে খাবে। আধা খালা খাবার খাওয়ার মুরুদ তো নেই, আবার..

বাক্য সমাপ্ত করলেন না। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। বিল না দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে পেছন থেকে বললাম, “খাবারগুলো আমরা এঁটো করিনি। বাইরে কতগুলো পথশিশু দেখেছিলাম। ঘুমিয়ে আছেন। ওদের যদি..

কথা শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর গলায় বললেন, “ওয়েটার, এই খাবারের সাথে কিছু প্যাকেট বের দিন। আর প্রতিদিনের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ওদের দিয়ে দিবেন।”

“জি স্যার।”

ঝড়োহাওয়ার বইছে। মেঘে ঢেকে ফেলেছে অন্তরিক্ষ। রাস্তার ধুলো বালি ছাই মিশ্রিত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি আসার পূর্ব লক্ষণ। তবে আর্দ্রহীন মেঘ।
আনমনে হাঁটছি। ধ্রুবের এক কথায় ওয়েটার রাজি হয়ে গেল খাবার দিতে। তাও বিনামূল্যে। ভাবতে ভাবতে গাড়ির কাছে গেলাম। ধ্রুব হুডের উপর বসে ফোনে কথা বলছেন। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। আরও দু’কদম ফেলে একটু আবছায়াতেই দাঁড়ালাম। তিনি হেসে হেসে কথা বলছেন। তার দৃষ্টিতে আমি অনুপস্থিত। ধ্রুবের কথার ঝুলি শেষ হতে ঢেড় সময় লাগল। ফোনটা বুক পকেটে রেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলেন। হেলান দেওয়া রত অবস্থায় চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিলেন। মাথার উপর হাত দিয়ে ডেকে দিলেন মুখশ্রী। আমার হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ধ্রুবের আচরণে কয়েকশ’গুন বেড়ে গেল। তিনি মৃদু হেসে কোমলচিত্তে বললেন,

“তুমি গাড়িতে বসো। রাহাত খাবারগুলো দিতে গেছে। চলে আসবে।”

আমি কোনোমতে সম্মতি দিলাম। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করার স্পর্ধা উদ্বৃত্ত নেই। কিঞ্চিৎ পূর্বে যেভাবে হুংকার দিয়েছিলেন। আমি নত হয়ে পিছিয়ে এলাম। তৎক্ষণাৎ হিম স্পর্শে থমকে দাড়ালাম। ঘাড় কাত করে মানুষটিকে দেখার প্রয়াস করলাম। ধ্রুব ভারী কণ্ঠে বললেন,
“কিছু বলবে?”

সত্বর জবার দিলাম, “আপনি ভেতরে যাবেন না?”

ধ্রুব হাত ছাড়লেন না। অধিকন্তু কঠোরভাবে ধরে সুকণ্ঠে বললেন, “না, এখানেই বসে থাকব। আর কিছু?”

পুনরায় প্রশ্ন করতেই হতবুদ্ধু হলাম। আমি হাতের পানে একঝলক দৃষ্টিপাত করলাম। হঠাৎ উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম, আমি আমি স্বাভাবিক নেই। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধর জোড়া নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনি খাবার দিতে বললেই ওরা দিয়ে দিবে?”

ঈষৎ হেসে বললেন, “এটা রাহাতের বাবার রেস্তোরাঁ। প্রচুর খাবার বেঁচে যায়। অধিকাংশ ফেলে দেওয়া হয়। তাই বলেছি।”

“ওহ্।”
সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে বসলাম। হাত আলগা উপলব্ধি করলাম। ধ্রুব তার বলিষ্ঠ পুরুষালি বন্ধন থেকে মুক্ত করেছে আমায়। নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এজন্যই তখন ওয়েটারের জন্য রাহাত স্যারকে কথা শুনাচ্ছিলেন ধ্রুব। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে নিজেকে বললাম, “তুই আসলেই একটা বড়ুই। পানি বড়ুই। এইটুকু তোর মাথায় ঢুকে না‌। গাধী একটা।”

জানালা টোকা দিলেন। একটু ঝুঁকে বললেন, “ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“সব কথা কি বলে দিতে হবে? একটু বুঝে নিতে পারোনা? বুঝে নাও!”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩০

মাঝরাতে তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটল। প্রত্যুষের ঢের দেরি। অপরিচিত জায়গায় ঘুম না হওয়ার দরুন জেগে আছি। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বৈ-কি! মাথা চুলকালাম। এই রাতে উকুনের উদয় হল না-কি! সন্নিকটে ধ্রুব বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। মাঝখানে মানুষ সমান কোল বালিশ রাখা। পাঁচিলের সমান, একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা দুস্কর। তবুও বেশ কিছুটা দূরত্ব। আমি গালে হাত রেখে কিয়ৎক্ষণ নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব কাত হয়ে শুয়েছে। চোখের পাতা অর্ধেক বুজেছে। এক ভ্রু কুঁচকে রয়েছে। তৈলাক্ত ভাবটা মুখের উপর প্রকাশ পেয়েছে। নির্দ্বিধায় ঘুমাচ্ছেন তিনি। নিষ্পাপ লাগছে তাকে। কিছুদিন পূর্বেও বিবাহিত হওয়ার সত্বেও এই ট্যাগ ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছি। গুটিয়ে ছিলাম আর আজ এটাই আমার পরিচয়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে বদলে গেল জীবন, এটা মেয়েদের জীবন!

ধ্রুবের মাথার নিচ থেকে বালিশটা একটু দূরে সরেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। কারো অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ আমি। এই বলিষ্ঠ হাতের মালিক যে ধ্রুব, তা বোধগম্য হতে সেকেন্ডের প্রয়োজন হলনা। কোলবালিশের নিচে থেকে কোমর জড়িয়ে রেখেছে। সন্তর্পণে হাত সরিয়ে উঠে বসলাম। মৃদু ঝুঁলে ধ্রুবের মাথাটা শূন্যতায় উঁচু করলাম। সরে যাওয়া বালিশটা তার নির্দিষ্ট অবস্থানে রেখে মাথা রাখলাম। খোলা চুলগুলো মুখশ্রীর উপর পড়তেই ধ্রুব একটু নড়েচড়ে উঠলেন। দ্রুত সোজা হয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করলাম। তবে বেশিক্ষণ খোঁপা হিসেবে স্থির রইল না। খুলে গেল। বা’হাতের সহায়তায় গলার নিচে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে নিলেন তিনি। আমি উঠে ঘরের অভ্যন্তরে পদচারণ করলাম। পড়নের ওড়নাটা ধ্রুবের বালিশের নিচে চাপা পড়েছে। অন্ধকারে আবৃত ঘরে অতিশয় প্রয়োজন হলনা।

ব্যালকেনির পা রাখতেই হিম হয়ে এল শরীর। বাইরে ঝড়োহাওয়ার আর মেঝেতে জমা থাকা জলকণাগুলো পায়ের সাথে মিশে গেল। উড়ে আসা পচন ধরা গাছের পাতাগুলো পিষে গেল পায়ের তলদেশে। আমি দুহাত উজাড় করে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু জল আঁচড়ে পড়ল মুখে। ভিজিয়ে দিল আমায়। চোখজোড়া গ্ৰথণ করে ঘনঘন শ্বাস নিলাম।

চোখের পাতা উন্মোচন হল গভীর স্পর্শে। পেছনে থেকে আঁকড়ে ধরা মানুষটি কাঁধে গুঁজল মুখ। কানের ঝুমকা একটু টোকা দিল। রিনরিনে শব্দে বেজে উঠল। দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সরে এলাম। হতবাক সুরে বললাম, “আপনি! আপনি এখানে কী করছেন? ঘুমাচ্ছিলেন না?”

“হ্যাঁ। ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু মাঝরাতে বদ্ধ জানালা দিয়ে পেত্নি দেখলাম বারান্দায় বসে আছে। তাই দেখতে এলাম, হঠাৎ কোন পেত্নি উদয় হল।”

“পেত্নি? কোথায় পেত্নি?”

কপালে সরু ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, “দেখতে পারছ না? অবশ্য নিজেকে নিজে কীভাবে দেখবে, আয়না দিবো?”

পিলে চমকে উঠলাম। তিনি পেত্নি বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন, তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তেজ দেখিয়ে বললাম, “জানেনই যখন পেত্নি, তবে কেন এসেছেন পেত্নির কাছে? পেত্নি ঘাড় মটকে দিবে আপনার।”

কঠোর প্রতুক্তি করলেন, “মাছ দেখিয়ে নিজের কব্জায় করে নিবো।”

না বুঝার স্বরে বলি, “পেত্নি মাছ খায়?”

“হ্যাঁ। নদীর থেকে ধরে খায়, আর আমার ঘরের পেত্নি বৃষ্টির পানি সাথে মাছ পড়েছে কি-না সেটা খায়।”

গম্ভীর গলায় বললেন। অতঃপর পা দিয়ে বারান্দার মেঝের কিনারে থাকা ছোট গর্তটা খুলে ফেলেন। হুড়মুড় করে পানি বেরিয়ে গেল। তিনি দুকদম এগোলেন বিনিময়ে দুকদম পিছিয়ে গেলাম আমি। বৃষ্টির পানির কপালে লেপ্টে থাকার ফলস্বরুপ চুলগুলো হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিলেন। বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, “বৃষ্টির পানিতে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে?”

“আপনার একটু ভুল হচ্ছে, সূর্যের প্রথম রশ্মিতে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে।”

“কারেক্ট, কিন্তু বৃষ্টির পানিতেও একটা ভিটামিন থাকে? [গুরুতর ভঙ্গিতে ভেবে]
হ্যাঁ মনে পড়েছে, ভিটামিন ‘জে’ থাকে।”

অবিলম্বে তাজ্জব বনে গেলাম। ভিটামিন ‘জে’, সেটা আবার কী? জীবনে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। স্নিগ্ধ হেসে বললাম, “সেটা আবার কী?”

গ্ৰিল বিহীন ব্যালকেনির দেয়ালে হেলান দিয়ে সোজাসাপ্টা বললেন, “জ্বর! জে ফর জ্বর। ভিটামিন জ্বর। তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? কালকে পরীক্ষা আজ এখন বৃষ্টিতে ভিজছ? হাউ ফানি! ভেতরে যাও..

আদুরে আবদারে বলি, “আরেকটু থাকি..

প্রতিক্রিয়া করলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, “তিন সেকেন্ড তোমার সময়। তিন সেকেন্ডের পরে আর ভেতরে যেতে পারবে না। দরজা বন্ধ করে আমি ঘুমাবো। সারারাত এখানে ভিজতে হবে। কী করবে? ইউর টাইম স্টার্ট নাও। এক, দুই, তিন।”

নিজের সিদ্ধান্তে অটল। এক পা এগোলাম না। শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমতা-আমতা করে বললাম, “আপনি কী হ্যাঁ? আমি ভিজলে আপনার জ্বর আসবে? আসবে না। আমার আসবে। আপনি আপনার মত ঘুমান না যান..

“পেত্নির জায়গা আমার ঘরে নেই।” রাগে গজগজ করে উঠলাম আমি। ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে তেজ দেখিয়ে বললাম, “কী? পেত্নি। আপনি আবার আমাকে পেত্নি বলছেন?”

“তোমাকে দেওয়া তিন সেকেন্ড অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এবার বাইরে থাকো।”

বলেই ভেতরে প্রবেশ করলেন। দরজায় হাত রাখতেই ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার। দ্রুত বা’হাত দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে নিলাম। এক চিৎকার করে বললাম, “নাহহহ! যাচ্ছি তো।”

দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলাম। বুকে হাত রেখে বার কয়েক ঘনঘন শ্বাস টেনে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। একটু হলে সত্যিই দরজা তুলে দিত। পায়ের কাছে এলোমেলো হয়ে গুটিয়ে থাকা কম্বলটা টেনে সম্পূর্ণ শরীরে জড়িয়ে নিলাম। মুখটাও তখন ভেতরে। বিছানার একপাশে সেঁটে বিরবির করে বললাম, “ডেন্জারাস লোক একটা! নেই! আমার ভিটামিন জে খাওয়ার স্পৃহা নেই!”
____
প্রত্যুষের আলো উদিত হতে না হতেই তন্দ্রার অবসান হল। ধ্রুবের তীব্র কণ্ঠে বাধ্য হল। আমি বেঘোরে ঘুমাচ্ছি। ঘণ্টা তিন হয়নি সময়। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন এবার, “চড়ুই উঠ।”
আমি নড়েচড়ে উঠলাম। শূন্য মুখে অদৃশ্য কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে ফিসিয়ে ফেললাম। আড়শ ভঙ্গিতে বললাম, “প্লীজ একটু ঘুমাতে দিন। যান এখান থেকে। একটু আগেই তো জোর করছিলেন ঘুমাতে।”

ক্ষিপ্র গতিতে বললেন, “একটু আগে নয়, কয়েকঘণ্টা আগে।”

“সে যাই হোক, আমি দেরি করে ঘুমিয়েছি, তাই আরও ঘুমাব।”

“দেব এক চড় ফাজিল মেয়ে। আমি দেরিতে ঘুমাতে বলেছি? জোর করেও কাজ হয়নি, তাই ধমকে ঘরে এনেছি।”

“দেখুন..

মুখের শব্দ মুখেই রয়ে গেল। বৃষ্টির চেয়ে ক্ষুদ্র কয়েক ফোঁটা পানি মুখে এসে পড়ল। নাস্তানাবুদ হলাম। তড়িগড়ি করে তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে উঠে বসলাম। ধ্রুব চুল ঝাড়ছেন। এত ভোরে গোসল, কী আশ্চর্য! চোখ পরিষ্কার করে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বললাম, “আর মাত্র দশ মিনিট। পাক্কা!”

“নো! পরীক্ষা দিয়ে এসে ঘুমিও। কালকে শুক্রবার। পরীক্ষা নেই। বাট এখন নয়। কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে পরীক্ষা, এখন ঘুমাতে চাচ্ছ? লাইক সিরিয়াসলি?”

ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে শুধালাম, “তো! মানুষ কী ঘুমায় না। আমিও ঘুমাই। এখন ঘুমাব।”

ধ্রুব দৃষ্টি সরালেন। ঝুলন্ত ফুলের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, “তুমি তো আগে কুড়ে ছিলেনা। মানুষ মানুষের সংস্পর্শে এসে ভালো হয়, আর তুমি বাঁদর হচ্ছো।”

“হচ্ছি, তাতে আপনার কী? আজব! আপনি নিজের কাজে যান না। বিরক্তিকর!”

পরক্ষণেই ধমকে উঠলেন। আজ অবধি দেওয়ার সবচেয়ে ক্রুব্ধ এবং ভয়ংকর ছিল এটা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, “চুপ, একদম চুপ। দিন-দিন অসভ্য’তে পরিনত হচ্ছো। এক চড় দিয়ে সব বেয়াদবি ঘুচিয়ে দিব। এভাবে কথা বলে? বড়দের সম্মান করতে জানেনা। আমি শুধু তোমার রেজাল্ট দেখব আর কিছু বলব না, আজ পরীক্ষা। অথচ বইটা যদি স্পর্শ করে থাকে।
হাজবেন্ড শিক্ষক আর বউ ফেল করা ছাত্রী? টপ রেজাল্ট যদি না আসে তাহলে তুমি আর ঐ ভার্সিটিতে যাবেনা কিংবা আমি যাবো না।”

আমতা-আমতা করে বললাম, “কেউ জানে আপনি আর আমি..

“এখন জানে না, ভবিষ্য’তেও কি জানবে না? তাছাড়া তুমি ভাববে, কীভাবে পরীক্ষায় টপ হওয়ার যায়। তা-না ভেবে পরীক্ষার রেজাল্ট লুকানোর চেষ্টা করছ?”

বলেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলেন। আমি ধপ করে শুয়ে পড়লেন। অগোছালো কম্বলটা গোছানোর পরিবর্তে আরও এলোমেলো করে ফেলে দিলাম। নাকের জলে চোখের জলে মিশে গেল। শিক্ষক দেখে কী সবসময় শিক্ষকগিরি দেখাতে হবে? একটু আদর করলে, ভালোবাসা দিলে কী তোর সৌন্দর্য খসে পড়বে। শা’লা! শয়’তান!

সবসময়ই আমি টপ হই। টপ হই, টপ। প্রতিটা বই ভাজা ভাজা করা, গিলে ফেলার অপেক্ষা। এবার সাত ঘড়া পূর্ণ হয়ে গিলে ফেলাটাও সম্পূর্ণ হবে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here