মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব -২৭+২৮

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৭

“মামা শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছি। একটু আদর যত্ন করবে না, এটা হতে পারেনা। লাঠির পিটুনি দিয়ে সেই আদর যত্ন করেছে। প্রথমবার গিয়েছে বলে কথা।”

ধ্রুব মলমটা রেখে আয়েশ ভঙ্গিতে বসলেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে তার পিঠের দিকে চেয়ে রইলাম। মামা শ্বশুর বাড়ি বলতে থানাকে বুঝিয়েছে, তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কীভাবে নির্দয়ভাবে আঘাত করেছে। কালচে হয়েছে প্রতিটি আঘাত। আলতো হাতে স্পর্শ করলাম পিঠ। অবিলম্বে সব অভিমান অভিযোগ অদৃশ্য হয়ে গেল শূন্যতায়। ছলছলিয়ে উঠা চোখজোড়া নিরবে নিভৃতে রক্তক্ষরণ ঘটাল। সৌজন্য হাসি দিলাম। দ্রুত মলম লাগিয়ে দিতে ব্যস্ত হলাম। ব্যথার্ত স্থানে মলম লাগতেই জ্বলে উঠল জায়গাটা। ‘আহ্’ করে আর্তনাদ করলেন। দ্রুত কণ্ঠে বললাম, “লেগেছে আপনার, বুঝতে পারিনি।”

“একটু তো লাগবেই, তাড়াতাড়ি লাগিয়ে মাকে ডেকে দিও।”

অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কেন?”

“মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, একটু চুলগুলো টেনে দিতে বলতাম আর-কি।”

হাত চালালাম দ্রুত। ফুঁ দিয়ে ধীরে ধীরে পুরো পিঠে স্বযত্নে মলম লাগানো শেষ করলাম। বালিশ কোলের উপর রেখে মুখ কুঁচকে বললাম, “আন্টিকে ডাকার দরকার নেই। আপনি শুয়ে পড়ুন, আমি টেনে দিচ্ছি।”

ধ্রুব গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মুখে উচ্চে পড়া সেই হাসি। বাধ্যবাধকতা নেই। বালিশ সরিয়ে কোলে মাথা রাখলেন। কোমর জড়িয়ে ধরল। মুখ গুঁজে দিল। কেঁপে উঠলাম আমি। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। শীতলতা ছড়িয়ে গেল সবাঙ্গে। তিনি সেভাবে থেকেই চোখ বন্ধ শুধালেন,
“আমাদের মাঝে কোনো দেয়াল রেখো না, তোমার শরীরে অনুভব করা, ‘তুমি নামক সুবাসটা’ আমার কাছে আসতে বাধা পায়।তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধু আমার, বালিশের কোনো অধিকার নেই।”

আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তার কথার ধরণ বুঝতে পারছি না। আমাকে স্থির দেখে তিনি পুনরায় বললেন, “তাড়াতাড়ি কর..
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। হাত বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তেলের বোতল নিলাম। ধীরে ধীরে তেল লাগিয়ে দিতে লাগলাম চুলে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে হাতের বাঁধন হালকা করলেন। বুঝতে পারি, তিনি ঘুমিয়েছেন। আমি বিন্দু পরিমাণ নড়াচড়া করলে তার ঘুম ভেঙে যাবে, তাই নড়লাম না। পেছনে বালিশ দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম। তখনও ধ্রুব মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল কথপোকথন শুনে। আমি হাই তুলে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে তাকালাম। ধ্রুব তো ঘুমিয়ে ছিল কোলে মাথা রেখে। কোনো জিনিস প্রয়োজন পড়ল না-কি। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অন্যকিছুর সাক্ষী হলাম। ধ্রুব নেই। আমি বিছানার মাঝ বরাবর ঘুমিয়ে আছি। গেলেন কোথায় তিনি। নিশ্চয় আমাকে ঠিক করে শুইয়ে রেখে গেছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে নেমে যাওয়ার প্রয়াস করতেই পেছনে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কর্ণপথে মুঠোফোন ধরা। আমাকে দেখেই ফোন নামিয়ে ফেললেন। “রাখছি পরে কথা বলব।” সংক্ষেপে বলেই ফোন রেখে দিলেন। ওপাশের উত্তরের অপেক্ষায় রইল না। ফোন পকেটে রেখে কোলে তুলে নিলেন আমায়। অগ্ৰসর হল সামনের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। চেয়ার টেনে বসতে বললেন। খাবার সাজিয়ে দিলেন। মামুনি, রমিলা আন্টি আর রাহাত স্যার খাচ্ছেন। আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলেন দু’জনে। খাবার মুখে দেওয়ার মত শক্তি অবশিষ্ট নেই। হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। খাবার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব হাত ধরে ফেললেন। মুখের খাবারটুকু চিবিয়ে বললেন, “কিছুই তো খেলে না, উঠে যাচ্ছ কেন?”

“আমার ক্ষুধা নেই।” সংক্ষিপ্ত জবাব।

“ফিনিস ইট। কুইক।”

“প্লীজ, যেতে দিন।”

“ঠিক আছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
ধ্রুব হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে জোরপূর্বক মুখে তুলে দিলেন। আমি ধীরে ধীরে খাবার চিবুতে লাগলাম। বিষম খেলাম। কেশে উঠলাম। চোখ মুখ রক্তিম হয়ে এলো। দম বন্ধ হল। পানি ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই চুমুক বসালাম। পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। ধ্রুব ধমকের সুরে বলল, “ঘরে জামাই রেখে এসেছ? খাবার গিলছ কেন? চিবিয়ে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খাও।”

ধ্রুব কথায় সায় দিয়ে খাবারে হাত দিলাম। মনযোগী হলাম খাওয়াতে। ধীরে ধীরে পুরোটা খাওয়া শেষ করে ঝুটো প্লেটেই হাত ধুয়ে নিলাম। বেসিন একটু ভেতরের দিকে অবস্থিত। পায়ে বেসামাল অবস্থা নিয়ে হাত ধোঁয়ার জন্য বেসিনে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আমার দেখাদেখি ধ্রুবও ঝুটো হাত ধুয়ে নিলেন প্লেটে। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। রমিলা আন্টি অবশিষ্ট খাবার গুছিয়ে রাখছেন। ধ্রুব মুখ মুছে অতঃপর হাত মুছতে মুছতে রমিলা আন্টিকে ডেকে টেবিলে বসার অনুরোধ করল। রমিলা আন্টি নিকটে আসতেই ধ্রুব বিগত দিনে ঘটা যাওয়া ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে খুলে বলতে আরম্ভ করলেন। স্যারের মেয়ের জন্মদিন থেকে শুরু করে আজ অবধি ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা। যেমন, আমাকে মেসেজ দিয়ে ব্লাকমেইল করা, ভিডিও, দেখা করা সবকিছু। সবকিছু শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন কিছুর প্রত্যাশা করেনি। মামুনি অনুতপ্ত হয়ে বলেই ফেললেন, “এতকিছু হয়েছে, তুই আমাকে কেন কিছু বলিস্ নি।”

“আমি কাউকে জানাতে চাইনি।” নত কণ্ঠে।

“আমি ওর মা, তোরও মা। তোরা দু’জনেই আমার কাছে সমান। এক মেয়ের জন্য অন্য মেয়েকে বিপদে ঠেলে দিবো, এমনটা হতে পারেনা। আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতাম।”

“আইনি ব্যবস্থা নিলে ব্যাপারটা পাবলিক হত মামুনি। মামার সম্মান এবং বাবুইও জেনে যেত। সামনে ওর পরীক্ষা। ভেঙে পড়ত মানুষিক ভাবে।”

রমিলা আন্টি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন, “কিন্তু তোকে যে ভুল বুঝলাম। কথা বলা বন্ধ করে দিলাম, এড়িয়ে চললাম। তার বেলায়..
ক্ষমা করিস মা। ছেলেকে পুলিশে ধরে নিয়ে মে’রেছে। মা হিসেবে সহ্য করতে পারিনি। তাই রাগে তোর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।”

সরল ভাষায় বললাম, “ক্ষমা চেও না। আমি একটু অবাক হয়েছি বটে কিন্তু..
_____
চুলোয় চায়ের পানি টগবগিয়ে ফুটছে। মাঝারি আঁচে আগুন ঝরছে। পরিমাণ মত চা’পাতা দিতেই মৃদু রঙিন হল উত্তপ্ত পানি। ধীরে ধীরে গাঢ় হতে লাগল। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো আমি। আগুনের তাপ লাগছে না।
ধ্রুব আর রাহাত স্যার উপরে আলোচনা করছে। কালকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়’ অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। রাতে দু’জনে পরিকল্পনা করে সকাল সকাল ভার্সিটিতে যাবেন। ঘুম কাটানোর জন্য রাহাত স্যার চা করতে বলেছিলেন। পায়ের অবস্থা শোচনীয় থাকায় বাড়িতে যাওয়া হয়নি, মামুনি একা চলে গেছেন। কালকে সকাল সকাল বাবুই আসবে।

আমি কেতলিতে ঢেলে ট্রেতে সাজিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে পা ফেলে স্টার্ডি রুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। ধ্রুব আর রাহাত স্যার উল্টো ঘুরে কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। আমাকে দেখামাত্রই থেমে গেলেন। ‘আসব’ বলার আগেই হাতের ইশারায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন।
চা ঢেলে এগিয়ে দিলাম। ধ্রুব চা নিয়ে রাখলেন। রাহাত স্যার চুমুক দিলেন কাপে। দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার পূর্বে বললেন, “সুপার! একদম সুপার ডুপার। কী স্বাদ! ইচ্ছে করছে তোমার হাতে চুমু খেতে।”

প্রশংসাটা মোটেও পছন্দ হলনা আমার। তবে এই কথাটা ধ্রুব দেখিয়ে বললেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ অবশিষ্ট নেই। ধ্রুব শান্ত অথচ গম্ভীর। গরম চা’টুকু ফুঁ ছাড়াই খেয়ে ফেললেন। যেন ঠান্ডা শরবত তৈরি করেছি। থেমে রইলেন না ধ্রুব স্যার। জোরপূর্বক রাহাত স্যারের কাপ এনে সেটাও শেষ করলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“চা খেতে না পারলে চুমু খাবি কেমনে? চা নেই, চুমু খাওয়ার দরকারও নেই।
অন্যের বউকে চুমু খেতে এসেছে।”

প্রত্যুত্তরে রাহাত স্যার বললেন, “তোর বউ কীসের হ্যাঁ? ও আমার বউ।”

“তোর বউ, কোনো প্রমাণ আছে?”

“দিব্যি আছে।‌ ওর অনামিকা আঙুল দেখ। মা সেদিন রিং পড়িয়ে দিয়েছে। ডায়মন্ডের রিং, সিটি গোল্ড কিংবা গোল্ড নয়।” ভাব নিয়ে বললেন।

তৎক্ষণাৎ ধ্রুব আমার বা’হাত ধরলেন। একটু উঁচুতে তুলে পরখ করে নিলেন। রিংটা খুলে নিজের কনিষ্ঠা আঙুলে পড়ে নিলেন। পুরোপুরি ঢুকল না। প্রথম কড় অবধি গেল। কড় বাকিয়ে সামলে নিল কোনোরকমে। টাওয়াল দিয়ে মাথা ঢেকে নিলেন। কেতলি থেকে চা ঢেলে রাহাত স্যারের দিকে এগিয়ে দিলেন। রাহাত স্যার ধ্রুবের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ধ্রুব কাপ ধরিয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ মেলে দিল। বিদ্রুপ করে বললেন,

“নে এবার চুমু খা! একদম হাত ছাড়বি না। খেতে থাক, খেতে খেতে খেয়ে ফেল। তোরই বউ।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৮

“তোরই বউ” শব্দটা শোনামাত্র রাহাত স্যার পলক ফেলতে ভুলে গেলেন। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ধ্রুব স্যারের হাস্যকর মুখপানে চেয়ে রইলেন। রাহাত স্যারের অসহায় দৃষ্টিতে যোগদান করলাম আমি। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই নিজেকে সংযত করে বললেন, “তোর মাথা খা’রাপ ধ্রুব? কীসব বলছিস? আমরা উভয়েই ছেলে। ছেলে হয়ে ছেলেকে বিয়ে? কীভাবে সম্ভব?”

ধ্রুব স্যার কোনোরুপ না ভেবে বললেন, “কেন সম্ভব নয়। অন্য বউয়ের হাতে চুমু খেতে চাস। তাহলে আমাকে কেন খেতে পারবি না।
তাছাড়া তোর মা চড়ুইকে বউ করবে বলেই হাতে রিং পড়িয়েছে। এখন রিংটা আমার হাতে। অতএব আমি তোর বউ। সময় নেই,কাজ আছে। তাড়াতাড়ি চুমু খা! ”

ধ্রুব তার হাতটা রাহাত স্যারের আরেকটু কাছে আনতেই ছিটকে সরলেন তিনি। চেয়ার থেকে ধপাস করে নিচে। কোলের উপর রাখা কাগজপত্রগুলো অবিলম্বে নিচে পড়ল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাহাত স্যারের কাণ্ড দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। তিনি কাগজ গোছানো শুরু করলেন। ধ্রুব রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। হাসি থামিয়ে দিলাম পরক্ষণে। ডানহাতটা উঁচু করে পরপর দু’বার ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শে ভরিয়ে দিলেন। হাত ছাড়িয়ে টাওয়াল মেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যালকেনির দিকে পা বাড়ালেন। আমি পূর্বের ন্যায় হাত শূন্যতায় তুলে দাঁড়িয়ে আছি। ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন একে অপরের থেকে। হাত নামাতে ভুলে গেলাম। স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। ধ্রুব ফিরে এলেন। পূর্বের ভঙ্গিতে দেখে বললেন, “ঘরে যাও, দাঁড়িয়ে আছো কেন? পরপর দুইচুমুতে হয়নি? আরও চাই?”

হাত নেমে গেল। নিজের ভেতরে ফিরলাম আমি। মাথা ঘুরছে। প্রচণ্ড ঘুরছে। লজ্জা ঘিরে ধরল সবাঙ্গ। নুইয়ে গেল মাথা। দ্বি মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মাথা নিচু করে ছুটে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুবের ঘরে এসে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লাম। এখনও ক্রমাগত কাঁপছে শরীর। কী ঘটলো একটু আগে।
_____
সূর্য ঝুলেছে পশ্চিম প্রান্তে। হলদেটে রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ রশ্মি নেই। আকাশে দুই চারটে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। যার রং নীলচে। জলহীন। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা নেই। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাতে নুডুলসের বাটি আর এক কাপ কফি। নুডুলসটা আমার জন্য, তবে তৈরি করা হয়েছে বাবুইয়ের জন্য। প্রথমবার এই বাড়িতে এসেছে, তাই। আমি টেবিলের উপর কফির কাপটা রেখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। হুটহাট, সময় অসময়ে শাওয়ার নেওয়ার অভ্যাসটা বিদেশ থেকে শিখে এসেছি। আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। তার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি কিন্তু কফি তো রাজি নয়। মিনিট পেরুবার আগেই ঠান্ডা বরফের টুকরার রুপ ধারণ করবে। দরজায় দুই টোকা দিলাম। পরবর্তী টোকা দেওয়ার পূর্বেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে দিলেন। মাথা বের করে দিলেন। সাবান ফেনা দিয়ে ভর্তি সমস্ত মাথা। চুসে চুসে পড়ছে কপাল বেয়ে। তিনি চোখের কাছের ফেনা পরিষ্কার করে বললেন,
“এসো।”

“কোথায় আসব?”

“কেন, ভেতরে।”

“ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! কীসব বলছেন? আমি কেন ভেতরে যাবো।”

“তাহলে নক করেছ কেন?”

“আপনার কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বিভ্রান্ত হলাম। তৎক্ষণাৎ ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ শব্দ পেলাম। পানির কারণে বেশি শব্দ শোনা গেল না। দরজার কড়া নাড়বার সাহসটুকু আর নেই। দরজার বাইরেই পদচারণ শুরু করলাম। মিনিট দশেক অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ধ্রুব। পড়নে শুকনো টাওয়ার ছাড়া কিছু নেই। কালচে দাগগুলো হালকা হয়েছে। কিছুটা মিলিয়ে গেছে শরীরে। ডান পাশের পেটের উপর কুচকুচে কালো তিল। বেশ আকর্ষণীয় লাগছে তাকে। আচ্ছা তিলটার উপর যদি কামড় দেই, ব্যথা পাবেন? নিজের ভাবনায় নিজেই আনমনে বিস্মিত হলাম। ধীরে ধীরে শুধালাম, “দ্বিতীয়বার।”
হাত দিয়ে মাথা ঝসতে ঝসতে বেরিয়ে এলেন। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “সাবানে স্লিপ করে পড়ে মাথায় লেখেছে। দেখো তো জখম হয়েছে কি-না।”

অসহায় দৃষ্টিতে ধ্রুবের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার এই হাইট নিয়ে তার কান অবধি দেখা যায়। কিন্তু মাথার জখম কীভাবে দেখব। বিরক্তিকর কণ্ঠে বললাম,

“ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমি পড়াশুনা করব না। আপনি নিচু হয়ে দাঁড়ান।”

মৃদু হাসলেন ধ্রুব। আমি বিছানায় বসলাম। হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন। পেছনের চুলগুলো সরাতেই বাজ পড়ল। বেশ কিছুটা ফুলে গেছে। এমনিতেই শরীরে ব্যথা, মাথাটাই বাকি ছিল। এখন ষোল কলা পূর্ণ হয়েছে। অস্ফুট স্বরে বললাম, “একটু দেখে শুনে কাজ করবেন না। কতটা ফুলে গেল।”

“একটু লেগেছে ঠিক হয়ে যাবে।”
বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কাবার্ড থেকে কাপড় নামিয়ে রুমেই পড়তে শুরু করলেন। লহমায় দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম
তড়িগড়ি করে বললাম, “কফি! কফি এনেছিলাম। ঠান্ডা হয়ে গেছে মনে হয়। আরেক কাপ নিয়ে আসছি..

“দরকার নেই, খেতে ইচ্ছে করছে না। নুডুলসটা খাইয়ে দাও। হালকা ক্ষুধা লেগেছে। কফিতে সাড়বে না। [আমাকে নড়তে না দেখে পুনরায় বললেন] তাড়াতাড়ি করো, দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

দ্বিধাগ্ৰস্থ থাকার সত্বেও বাধ্য হয়ে খাইয়ে দিতে লাগলাম।
______
রাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত দিনের আকাশ। তারারা মিটিমিটি জ্বলছে। চাঁদ ঝুলছে আকাশের কোণে। ধ্রুব বাড়িতে ফেরেননি। এখনো শেষ হয়নি তাদের সম্মেলন।
আমি বাবুই আর রমিলা আন্টি বসে বসে টেলিভিশন দেখছি। চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে গিয়ে থামল একটা ভিন্নরকম চ্যানেলে। ধ্রুবের চিন্তিত মুখ দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই লাইভ বিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলনে দেখানো হচ্ছে। প্রতিবছরই হয়, তবে এতটা আগ্রহ প্রকাশ করিনা। ধ্রুব আছেন বলেই হয়ত একটা কৌতুহল। তাছাড়া এই প্রথমবার আমাদের ভার্সিটি যোগ হয়েছে। আমাদের প্রতিক্ষার ইতি টেনে অনুষ্ঠান শেষের দিকে। প্রথমে পুরো অনুষ্ঠানের স্থান দেখানো হল। অতঃপর ভেতরটা। গোল টেবিলের আয়োজন করা হয়েছে। একেক ভার্সিটির জন্য একেক গোল টেবিল। ধ্রুব রাহাত স্যার পাশাপাশি। কিছু একটা আলোচনা করছে। ক্ষণে ক্ষণে কুঁচকে যাচ্ছে কপাল। টিসু দিয়ে মুছছেন জমে থাকা জলকণাগুলো।

বক্তব্য দিলেন একজন চল্লিশ উর্ধ্বের ভদ্রলোক। সম্মান করে বললেন, “এবারে নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয় যোগ হয়েছে আমাদের সাথে। তাদের শিক্ষা দিক্ষা বেশ উন্নত মানের। যথেষ্ট পরীক্ষা নীরিক্ষা করে অংশ দেওয়া হয়েছে। আশা রাখছি, ভালো কিছু উপহার পাবো।
তাদের স্টেজে আসার অনুরোধ করছি। প্লীজ কাম।”

স্যার স্টেজের দিয়ে এগিয়ে গেলেন। করতালির আওয়াজ শোনা গেল। ছোট একটা ট্রফি স্যারের হাতে দিতে নিলেই বাঁধ সাধলেন কেউ। অপরিচিত লোকটি তৃতীয় নং টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচিয়ে বললেন, “এই ভার্সিটিতে শিক্ষার মান ভালো থাকলেও শিক্ষকদের মান ভালো নয়। চরিত্রের ঠিক নেই। ছাত্রীদের সাথে চিপকে থাকতে দেখা যায়।”

ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ধ্রুব বোতলের ছিপি খুলে পানি পান করলেন। ঠোঁট কামড়ে নিচু হয়ে রইলেন। গতকালের ঘটা ব্যাপারটা আলোচনায় স্থান পেয়েছে। লোকটি দম নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
“আমরা সবাই জানি, কালকে ধ্রুব নামের স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কেন নিয়ে গেছে, তা অজানা নয়। তারই ছাত্রীর জন্য।”

ধ্রুব ফোড়ন দিয়ে বললেন, “স্যার, আপনি অভিজ্ঞ একজন শিক্ষক। আপনার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি। আপনার কাছ থেকে আমরা শিখব, জানব। সত্যিটা না জেনে ডিল ছুড়াটা ভালো দেখায় না।”

তৎক্ষণাৎ লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। ঝামেলা হচ্ছে সেখানে। আমাকে নিয়ে যত ঝামেলা। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা কেন পাবলিকে আসছে। এখানে এক মুহুর্ত থাকা ঠিক নয়। এক্ষুনি যেতে হবে সেখানে। ঠিকানাটা জানা ছিল। অপেক্ষা করলাম না। তড়িগড়ি করে পার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রমিলা আন্টি যেতে বারণ করলেন। তার কথা শুনলাম না। বাধ্য হয়ে বাবুইকে পাঠালেন সাথে।

বাড়ি থেকে বের হতেই সিএনজির দেখা পেলাম। তবে রাত বেশি হওয়াতে যেতে নারাজ। ব্যাগ নিয়ে পায়ে হাঁটা দিলাম। সময় ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। জনমানবহীন রাস্তাঘাট। বাবুইয়ের হাত ধরে হাঁটা দিলাম। কিছুদূর অগ্ৰসর হতেই সিএনজি পেলাম। দ্বিগুণ ভাড়ার নিচে যাবে না। উপায়হীন হয়ে উঠে বসলাম। ক্রমাগত ফোনে সময় দেখছি। মনে হচ্ছে, চোখের পলকের পূর্বেই সেখানে পৌঁছে যাই। রাহাত স্যারকে ফোন করলাম। যদি তিনি সামলে নিতে পারেন। কিন্তু রিসিভ হলনা। শরীর কাঁপছে। অবশেষে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। পাঁচতারা হোটেলের সামনে। গার্ডরা ঢুকতে দিবেন না। ভেতরে গন্ডগোল হচ্ছে, কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া যাবেনা।
বাবুইকে নিয়ে হোটেলের পেছনে গেলাম। পাঁচিল টপকে ঢুকে গেলাম ভেতরে। বাবুইকে নিরিবিলি শান্ত জায়গায় দাঁড় করিয়ে ভেতরের দিকে অগ্ৰসর হলাম।

[চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here