#মেঘমিশ্রিত _পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৬+৭
‘ছিঁড়ে গেছে’ কথাটা তুমুল বেগে বাড়ি খেল। আমি নতজানু হয়ে পিছিয়ে গেলাম। ঠেকে গেলাম পেছনে। গাছের সাথে বাড়ি খেলাম। তার কটু উক্তি কমার নামই নিচ্ছে না। না এক চুল পরিমান নড়ছে। আমাকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাতে অ্যাঞ্জেলের ন্যায় হাজির হলেন ধ্রুব স্যার। আমার মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীর গলায় বললেন,
“কোনো সমস্যা হয়েছে?”
আরও শেটে গেলাম গাছের সাথে। মিনমিনিয়ে বললাম, “না, স্যার।”
“তাহলে গাছের সাথে এভাবে মুচড়া-মুচড়ি করছ কেন? গাছটাকে ধ’র্ষণ করার মতলব করতেছ না-কি? আশ্চর্য। অনুষ্ঠান ওখানে হচ্ছে, এখানে নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেদের মজা দিচ্ছ।”
ইতিকথা বিরবির করে বললেন তিনি। তবে আমার কানে ঠিকই পৌঁছাল। না পেরে এবার কেঁদেই দিলাম। পেছনে ফিরে পিঠ দেখালাম। নাক টেনে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,
“আপনি দেখেছেন আমি মজা দিচ্ছে। ভিড়ের চাপে আমার ব্লাউজের চেইন ছিঁড়ে গেছে। এখানে এসে একটু দাঁড়িয়েছি, এই ছেলেগুলো অবধি বাজে দৃষ্টিতে..
আর বলতে পারলাম না। তার পূর্বেই ধ্রুব স্যার চ্যাঁচিয়ে উঠলেন।
“এটা কোন ধরনের অস’ভ্যতা’মি। তোমাদের বোনের মত একটা মেয়ে বিপদে পড়ছে। তোমরা হেল্প না করেই এইসব করছ? তোমার মত স্টুডেন্ট এই অনুষ্ঠানে থাকার যোগ্য নয়, বেরিয়ে যাও। আমার চোখের সামনে যাতে না দেখি, দেখলে চড়িয়ে সবকিছু দাঁত ফেলে। যাও..
ছেলেগুলো ধ্রুব স্যারের হুঙ্কার শুনেই প্রস্থান করলেন। নতুন স্যার হলেও ভার্সিটিতে তার দাপটে কোণঠাসা করে রাখেন সবাইকে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “সেফটিপিন দিয়ে আটকিয়ে নাও!”
“সেফটিপিন নেই।”
“তাহলে আছে টা কী, ইডিয়েট! শাড়ি পড়ছ সেফটিপিন রাখবে না।”
ধ্রুব স্যার দ্রুত ফোন বের করে ফোন করলেন কাউকে। তার কথার ধরণ থেকে মনে হল, রাহাত স্যার। কিন্তু ভালোভাবে কথা শুনতে পেলেন না। ভিড়ভাট্টা হইচই শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে উপস্থিত হলেন রাহাত স্যার।
“এতবার ফোন দিচ্ছিস কেন?”
“ভিড়ের ভেতরের না দাঁড়িয়ে পাশে গিয়ে ফোন রিসিভ করা যেত না? বাদ দে, সেফটিপিনের ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?”
“আমি আবার এইসব কোথায় পাবো?”
রাহাত স্যার চলে গেলেন। পদচারণ করলেন ধ্রুব স্যার। কাগজ লাগানোর পিন মেশিন বের করলেন পকেটে থেকে। সোজাসাপ্টা বললেন, “ঘুড়ে দাঁড়াও।”
নিজের ঘুড়িয়ে দিলেন। পিন মেশিনের সাহায্যে চেইন টা ভালোভাবে লাগিয়ে দিলেন। সেফটিপিনে আঁটকে রাখা আঁচলটা খুলে পেঁচিয়ে পিন দিয়ে লাগিয়ে দিলেন। কাগজে লাগান পিন শেষে জামায় লাগালেন তিনি।
“নাও পারফেক্ট। আপাতত ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। এখানে বসে থাকো তোমরা। প্রয়োজন হলে আমি এসে সামনে নিয়ে যাবো। কেমন!”
বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। আমি লজ্জা নত মাথা তুললাম। আজ আর কারো মুখোমুখি হতে পারব না। তাই ঝটপট বেরিয়ে এলাম। বাড়িতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। সেদিন আর ঘুম হলনা। নির্ঘুম রাত পেরিয়ে ভোরের সূচনা হল। ফজরের আযান দিল। আমি নামাজ আদায় করে ব্যালকেনিতে বসলাম। সাড়ে পাঁচটায় বাজেনি। এতক্ষণ কীভাবে সময় অতিবাহিত করব। অনেকদিন জিমে যাওয়া হয়না। তাই ড্রেস চেঞ্জ করে জিমের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। শিতল হাওয়ার সাথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম জিমে। তখন ছয়টা পাঁচ বাজে। অনেকেই এসেছে। ছয়টায় ওপেন করা হয়, তাই কোনো সমস্যা হল না।
.
সাতটা পনের বাজে। সাইকেলিং করছি। ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। অনেকদিন পর বিধেয় অনেক কষ্ট হচ্ছে। আজ আর করব না। নেমে এলাম। ব্যাগের কাছে এসে এক ঢোক পানি পান করলাম। ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে আসার প্রয়াস করতেই ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। ছিটকে পড়ল পানির বোতল। বোতল না তুলে সামনের মানুষটিকে কিছু বলার প্রয়াস করতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ধ্রুব স্যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভুল দেখছি নাতো? চোখ পরিস্কার করে পুনরায় তাকালাম। না আমার দৃষ্টি ভ্রম নয়। সন্দিহান স্বরে বললাম,
“আপনি এখানে? আপনাকে তো কখনো এখানে দেখি নি?”
“তুমি! তুমি এখানে কী করছ? তোমাকেও এর আগে দেখিনি।”
“আমি তো সবসময়ই আসি। মাসে দশ থেকে এগারো দিন। আপনি কেন এসেছেন?”
“মানুষ এখানে কেন আসে? নিশ্চয়ই জিম করতে, মাছ ধরতে তো নয়। আশ্চর্যান্বিত কথা বার্তা।”
“তাহলে আপনি আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি কেন এসেছি? হম!”
“তোমাকে দেখতে শুকনো টিকটিকির লেজের মত লাগে। শুকনো টিকটিকির লেজ জিম করে বিশ্বাস যোগ্য হয়নি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
আমি তেড়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। তার সাথে কথা বলাই বেকার। উল্টো রাজ্যের কথা শুনিয়ে দিবে আমায়। আমি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তৈরি হয়ে ভার্সিটিতে যেতে হবে। ধ্রুব স্যার আসার পর থেকে পড়ে যাওয়া আর ছিঁড়ে যাওয়া জিনিসটা অটোমেটিক শুরু হয়ে গেছে। কখনো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছি, কখনো ব্লাইজের চেইন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কখনো ললিপপ গুলো পড়ে যাচ্ছে, তো আবার উপর থেকে পানি পড়ছে।
।
পুরো ভার্সিটি খুঁজেও কোথাও দেখা পেলাম না ওদের। বেল বেজে গেছে। আমি ক্লাসের দিকে অগ্ৰসর হলাম। ততক্ষণে স্যার ক্লাসে ঢুকে গেছেন। ধ্রুব স্যার ক্লাসে। আমাকে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দিলেন না। গম্ভীর গলায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। ক্লাসে এসে বাইরে হাঁটাহাঁটি কেন করি তার শাস্তি। আমি দরজায় হেলান দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছি। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরেই স্যার কড়া গলায় ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ‘ওমা’ যাদের জন্য এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম তারা ভেতরে। পেছনে ওদের পাশে বসতে গেলেই কড়া হুকুম জারি করলেন মহাশয়। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“সামনে বসো! কালকে বসন্ত উৎসবে শেষে তোমাকে কেন দেখা যায়নি?”
“শরীর ভালো লাগছিল না, স্যার?”
“তোমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই অসুস্থ ছিল? ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছ তাই চারদিন কলেজ মিস্ দিয়েছ, কালকে এসেই সাথে সাথে চলে গেছ। থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল। অনেক কষ্টে ভার্সিটি সাজানো হয়েছিল, কিন্তু তোমরা তার দামই দিলে না। নট অ্যালাউ। আমি অন্তত আমার ক্লাসে এটা অ্যালাউ করব না। তোমাদের প্রথম শাস্তি, তোমরা কেউ জোড়ায় ক্লাসে বসবে না। চারজনে চার কোণে আর একজন মাঝে। দ্বিতীয় শাস্তি, সবকিছু খুলতে কর্মীদের কাজে হেল্প করবে। মনে থাকে যেন।”
.
ক্লাস মিস্ দিয়ে ক্যাম্পাসে বসে আছি। দাঁতের কারণে নখের অবস্থা নাজেহাল। আমরা আড্ডায় বসেছি। আড্ডার মেইন কারণ হল প্রিয়া। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কাল রাতেই জানতে পেরেছে। তাই নিয়ে মন খারাপ বললেই চলে এককথায়। নিরব হা হুতাশ করতে করতে বলল, “তুই কি আদৌ মেয়ে? মা বাবা তোর বিয়ে ঠিক করে দিল আর তুই নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলি। এখন আমাদের সামনে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস। হাউ ওয়ান্ডারফুল! আমাকে বিয়ের কথা বললে, কালকেই মারিয়ারে নিয়ে পালিয়ে যেতাম। ”
“কী করতাম আমি। বাবাকে প্রচুর ভয় পাই!” [অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয়া]
বিরক্তি নিয়ে তারিফ বলল,
“ছেলের নাম কী? কী করে? বয়স কত? বাড়ি কোথায়? ছবি দেখেছিস?”
“জানি না। ভয় করে যে..
নিরাশ কণ্ঠে বলে, “নে! আমারে নে। নিয়ে পানিয়ে চুবিয়ে দেখ তোর ভয় কমে কি-না? আশ্চর্য। যদি বুড়া দাদার সাথে তোর বিয়ে দেয়। তখন কী করবি, বুড়ার ই ধরে টানবি? একটু পরে দেখবি, ওটা পেঁকে লেওয়া হয়ে হাতে চলে এসেছে।”
নাক কুঁচকে বললাম আমি, “ছিঃ! কী কস এডি!”
“আবার ছিঃ কস। এডিই ওর প্রাপ্য। বল’দির মত সং সেজে না থেকে একটু মাথাটাকে কাজে তো লাগাতে পারিস।”
টেনে টেনে বলল প্রিয়া, “ছেলে পুলিশ, নামটা মনে নেই। ‘ত’ দিয়ে হতে পারে।”
অবাক কণ্ঠে বলল,
“বাহ্! বাহ্! তা মনে কেন থাকবে?
তোর বাপ মায় তো খাইয়ে দাইয়ে একটা কুমির পুষে। কুমিরের কী আর অতকিছু মনে রাখে? ও শুধু পারে গিলতে। যত্তসব।”
আমরা গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলাম। কী করে বিয়েটা আটকানো যায়। তারিফ ব্যাগ নিয়ে ললিপপ ব্যাগ করে কাঠি সমেত মুখে পুড়ে বসে রইল। এটা নতুন কিছু নয়। অতঃপর বলল, “খেউ খেউ খেউ।”
ললাট কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল নিরব, “তুই কুত্তার মত খেউ খেউ না করে, ললিপপ বের করে কথা বল।”
“থানাটাকেই যদি বো’ম মে’রে উড়িয়ে দেই তবে? না থাকবে পুলিশ, না হবে বিয়ে।”
“চুপ করবি তুই। দেখলে প্যাঁদানি তো দিবেই। সাথে জেল তো হবে, ফাঁসিও দিতে পারে।”
“তোরে কইছে।”
শুরু হয়ে গেল। একেই তো কোনো উপায় পাচ্ছিনা, আবার এদের এই অবস্থা। বিরক্তি নিয়ে কিছু বলার প্রয়াস করতেই জুনিয়র ভাই হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“এখানে বড়ুই কে? ধ্রুব স্যার তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।”
“হাউ ফানি বড়ুই।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সব ছেড়ে শুরু হয়ে গেল। ছেলেটা বলেই হাওয়া। ধ্রুব স্যার এটা ইচ্ছে করে করেছে, এটা বুঝতে সময় লাগল না আমার।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৭
“মিস্ চড়ুই, তুমি কি ডিভোর্সি? তোমার আইডি কার্ডে শুধু চড়ুই দেওয়া। একটাতে মিস্ চড়ুই একটায় মিসেস চড়ুই, এভাবে সাইন করেছ! তোমার ডকুমেন্ট ফাইল দেখে আমি কনফিউজড!”
আইডি কার্ড দেখিয়ে বললেন তিনি।
বজ্রের ন্যায় আঘাত হানল শ্রবণপথে। ফট করে অবলোকন করলাম ধ্রুব স্যারের দিকে। তিনি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার আইডি কার্ড তার কাছে কী করছে? আমি দ্রুত নিয়ে নিলাম। নিজেকে সামলে বললাম, “আপনার কাছে আমার আইডি কার্ড কী করছে?”
“তুমি সেদিন ভুল করে রেখে গিয়েছিলে। কেয়ারল্যাস। [এতদিন নিজের আইডি কার্ড নিজের কাছে নেই অথচ তার খেয়ালই নেই] আমি যেই প্রশ্নটা করেছি তার উত্তর দাও, তুমি ডিভোর্সি।”
তার মিনমিনে বলা কথাগুলোও শুনতে পেলাম। আমি তো ডিভোর্সি নই, এখনও একজনের বউ। তাছাড়া আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন কারো কাছে শেয়ার করতে বাধ্য নই। গম্ভীর গলায় বলি, “না। আগের ভুল করে মিসেস লিখেছিল। তাছাড়া চড়ুই আমার নিকনাম। এটা ভার্সিটির আইডি কার্ড ন্যাসনাল নয়। তাই কিছু জানাইনি। এবার ঠিক করে দিয়েছি। কোথায় সাইন করতে হবে, দিন। করে দিচ্ছি।”
ধ্রুব স্যার দ্বিমত পোষণ করলেন না। আর যাই হোক, একজন স্টুডেন্টের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অবগত না থাকাই ভালো। ফাইল বের করে দিলেন। কিছুদিন পর ফাইনাল ইয়ারে উঠব, তাই নতুন আইডি কার্ডের ডাক পড়েছে। আমাদের ক্লাসের আইডি কার্ডের দায়িত্ব ধ্রুব স্যারের উপর পড়েছে।
আমি সাইন করে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ফাংশনের কাছে এলাম। ওরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
.
আজ সূর্যের প্রখর রোদে চামড়া ঝলসে যাওয়ার ন্যায় অবস্থা। ফুলে সজ্জিত স্টেজ খুলার চেষ্টা করছি। ডেকোরেশনের সব জিনিস প্রায় গাড়িতে তোলা শেষ। স্টেজ খুললেই শেষ। উপরের ফুলগুলো খোলার দায়িত্ব পড়ছে আমার উপরে। পাশেই মই রাখা। বাঁশের খুঁটির সাথে মই ঠেকিয়ে উঠে গেলাম উপরে। মই ধরার দায়িত্ব নিরব ও তারিফের। পুরুষালি শক্তির কারণে মই কখনো পড়তে পারে না।
ওরা দুজন আমাকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে নিচ থেকে নড়াচড়া করছে। আমি বাঁশের খুঁটি ধরার বিনিময়ে ঝুঁকে মই ধরলাম। হিতে বিপরীত হল। মই পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। ধ্যান ফিরতেই বাঁশ ধরলাম। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেল। সবকিছু ভেঙে নিচে পড়লাম। নেত্রযুখল থমকে গেছে। দ্রুত গ্রথণ করে নিলাম। মাটি স্পর্শ করার পূর্বেই ফ্লীমি স্টাইলে হাজির ধ্রুব স্যার। কোমর জড়িয়ে বাঁচিয়ে নিলেন। আমি কম্পিত নয়নে দৃষ্টি মেলতেই ধ্রুব স্যারের রুদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
“আমি তোমাকে হেল্প করতে বলেছি, পাকামি করতে নয়। জিম করা শরীর বলে নিজেকে সুপারম্যান মনে করছ কেন? ভুলে যাবে না, তোমার ললিপপে সব জিম ধুয়ে যায়।”
অবুঝ স্বরে বললাম, “বুঝলাম না, জিম আবার ধুয়ে যায় কেমনে?”
“তোমার মত চড়ুই পাখির মাথায় ঐসব ঢুকবে না। ক্লাসে যাও যাও।”
নত কণ্ঠে বলি, “হেল্প করব না।”
“না। দয়া করে ক্লাসে যান, আপনার সাহায্য লাগবে না। ঠিক সময়ে না আসলে, পুলিশ আমাকে হাজতে পাঠাত। যান।” [ব্যঙ্গ করে স্যার]
মনে মনে প্রবল উৎসাহ নিয়ে চলে এলাম। যদি জানতাম এমন করবেন। কাজ থেকে মুক্তি দিবেন, তাহলে আরও আগেই করতাম।
.
সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। হালকা হয়েছে প্রখর রোদ্দুর। বাচ্চারা পার্কে খেলাধুলা করছে। বেঞ্চিতে বসে আছি আমি। বসন্তের হাওয়া বইছে। ফুলের সুবাস আসছে। প্রজাপতি উঠছে। অজ্ঞাত যুবকের সাথে দেখা করতে এসেছে প্রিয়া। সাথে আমাকে নিয়ে এসেছে। পুলিশি বেশে এসেছে সে। ঝোপের আড়ালে ঐ দিকটায় কথা বলছে। দেখতে বেশ সুন্দর। পুলিশের চাকরি করে বলে কথা, সুদর্শন যুবক হওয়ারই কথা। পেন্সিল পেন্টিং করছি আমি। তৎক্ষণাৎ ব্যাঘাত সৃষ্টি করল একটি কুকুর। বিরাগী চোখে অবলোকন করলাম। কুকুরটি ইতোমধ্যে পেন্সিলের সূচালো অংশ ভেঙে ফেলেছে। হা হুতাশ করলাম আমি। অসম্পূর্ণ পেন্টিংটা রেখে দিলাম ব্যাগে। গোধূলির রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। এখন বাড়ি ফেরা দরকার। ওড়নায় টান পড়ল। কোনোরকম চেপে ধরে পশ্চাৎ ফিরি। কুকুরটা ওড়নার এক কোণ ধরে টানছে। এগিয়ে ওড়না ধরার প্রয়াস করতেই দৌড় দিল সে। কিংকতব্যবিমূঢ় হয়ে ওড়না আঁটকে ধরলাম। হুট করে আক্রমণ করার নিমিত্তে ফ্যালফ্যাল নেত্র দ্বারা চেয়ে রইলাম। সবকিছু মস্তিষ্কে হানা দিতেই আমিও ছুটলাম। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে ব্রীজের উপর নিয়ে এলো। গার্ডরা আশেপাশে জঙ্গলের মাঝে কিছু খুঁজছে। কুকুরটা আমাকে সেখানে দাড় করিয়ে ঘেউ ঘেউ স্বরে ডেকে উঠল। কুকুরের ডাক শ্রবণ হতেই পশ্চাৎ ফিরল কেউ। পলক থেমে গেল। ধ্রুব স্যার এখানে কী করছেন? তিনি এগিয়ে এসে কুকুরটাকে কোলে তুলে নিলেন। আদর করে ধন্যবাদ দেওয়ার নিমিত্তে মুখ খুলতেই থেমে গেলেন। গার্ডদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ডগকে নিয়ে যাও এখান থেকে। তোমরাও বাড়ি ফিরে যাও।”
“কিন্তু স্যার, আপনি একা!”
“কোথায় একা। একা নই। ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো আমি।”
তারা প্রতুক্তি করলেন না। নতজানু হয়ে পাজোড়া গতিশীল করে সম্মান প্রদর্শন করে স্থান ত্যাগ করলেন। আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বললাম,
“ওটা আপনার কুকুর?”
“হ্যাঁ।” সোজাসাপ্টা উত্তর।
“তাহলে ডগ বলে কেন ডাকলেন? নাম ধরে ডাকতেন।”
“কুকুরের জন্য আমার মেমোরি নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না। আমি সবকিছু সংক্ষেপে মনে রাখি।”
এরুপ প্রত্যুত্তরে মোটেও সন্তুষ্ট হলাম না। সামান্য একটা নামে মেমোরি নষ্ট হওয়া কী আছে, আশ্চর্য। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “তাহলে আপনি আমার নামটাকে সংক্ষেপ করলেন না কেন?”
“সবকিছু সংক্ষেপ করা যায় না। যে আমার মনের সবটা দখল করে আছে তার নাম মেমোরি থেকে সরিয়ে ফেলা যায়? কখনোই যাবে না।
তাছাড়া, তোমার নাম সংক্ষেপ করলে হবে চড়। মানে থাপ্প’ড়। অন্যথায় চোড় মানে চো’র। তুমি কি চাও তোমাকে এই নামে ডাকি?”
বলেই শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে চলে গেলেন তিনি। আমি পেছন থেকে আশ্চর্যান্বিত নয়নে চেয়ে রইলাম। আমার নামটা আর নাম নেই, পুষ্পা গান হয়ে গেছে। যে যেমন পারছে নেচে যাচ্ছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় তাকালাম। ততক্ষণে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছেন তিনি। আমি উল্টো পথ ধরলাম। বাড়িতে এসে বসলাম। সামনে বাবুইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা। পড়ায় সাহায্য লাগবে, তাই ওকে সাহায্য করতে গেলাম। আজ আর পড়া হল না।
মাঝরাতে নিদ্রা ভঙ্গ হল। ইদানীং রাতে জেগে যাই। যখন কাঁটায় কাঁটায় তিনটা বাজে। আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। ধ্রুবের মায়ের পাঠানো ডিভোর্স পেপারটা কাবার্ড থেকে অতিশয় যত্নে বের করলাম। নিজের কোনো জিনিস এতটা যত্ন করেছি বলে মনে হয়না। অথচ নিজের সবচেয়ে অপছন্দের জিনিসটা যত্নে রাখা। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে খামটা খুললাম। ভেতরে মোড়ানো একটা চিঠি। আগে খুলিনি, তাই জানি না। হাতের লেখা চিনতে অসুবিধে হলনা, এই লেখাটা রমিলা অর্থাৎ ধ্রুবের মায়ের। তিনি লিখেছেন,
বউমা শ্রেয়া,
আমি চমকালাম। আজ কতগুলো বছর পর এই নামের সম্মোধন। ভুলতে বসেছিলাম, মায়ের দেওয়া নামটা ‘শ্রেয়া’। মামার চড়ুই দেওয়া নামটাই সবাই জানে। বউমা শব্দটা লিখে কেটেছেন। হয়ত বুঝতে পেরেছেন, এই আহ্বান আমার জন্য নয়।
শ্রেয়া,
ভালো আছিস মা! আমার দেওয়া কথাটা রাখতে পারলাম না। বড়ো মুখ করে বলেছিলাম, তোকে আমার ছেলের বউ করব। বউ ঠিকই করেছি কিন্তু প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি।
ধ্রুব দেশে ফিরেছে। গ্ৰাম থেকে শহরে এনেছে আমায়। একসাথে থাকি এখন। তবে আমাদের মাঝে কথা হয়নি কখনো। ছেলের চোখে আমি অপরাধী, তোর চোখে অপরাধী। ধ্রুব হয়ত কখনো তোকে মানতে পারবে না। আমিও চাইনা, আমার মিথ্যা সিদ্ধান্তে তোর জীবনটা শেষ হয়ে যাক। তাই অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে তোদের দু’টোকেই বের করে আনব।
তোর মামাকে বলেছি, রাজপুত্র দেখে তোর বিয়ে দিতে। ধ্রুবের সাথে বিয়েটা ভুলে যাস। ছেলের সাতাশতম জন্মদিনে তাকে গিফ্ট দিতে চাই। চার বছর পরপর এই দিনটি আসে। গতবার কথাই বলেনি। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। আগামীবার বেঁচে থাকব কি-না জানা নেই। এবার তার সবচেয়ে বড়ো গিফ্টটা দিতে চাই। পারলে ক্ষমা করে দিস। দয়া করে সাইন করে দিস পেপারে। ভালো থাকিস।
ইতি
রমিলা।
.
আমি চিঠিটা ভাঁজ করে রাখলাম। ধ্রুব দেশে ফিরেছে। অথচ আজ জানতে পারলাম। অভিমান জমাট বাঁধল। ভেতর থেকে মূল পেপার বের করলাম। ধ্রুব সাইন করেনি। হয়ত আমার পরে ধ্রুব সাইন করবে। কাঁপা কাঁপা হাতে সাইন করে দিলাম। যে আমার নয়, তাকে বেঁধে রাখা উচিত নয়। চিঠি লেখতে বসলাম। ধ্রুবকে দেওয়ার জন্য প্রথম এবং শেষ চিঠি।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]