মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -১০

#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#দশ
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

জীবনে ভালবাসা চেয়ে বড় কোনো সত্যি নেই।জীবনে প্রেমের চেয়ে বড় কোনো অনুভূতি নেই।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এখনো দুটি চোখ তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত পরীটার দিকে।
ভোরের এই আলোয় রোদের মুখটা কোনো পরীর চেয়ে কম লাগছে না।

এই প্রথম একটা নারীর জন্য প্রয়াস নির্ঘুম রাত কাটাল। এই নির্ঘুম রাত কাটাতে পেরে মনে অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে।

যদি কেউ বলে রোদকে দেখে তার সারাজীবন না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। তবে হয়তো সে তাই করবে। অথচ কত ঘুম কাতুরে সে ।ঘুমের সাথে কিছুর কম্প্রোমাইজ সে করে না।

আসলে মানুষ যখন প্রেমে পড়ে। কাউকে ভালবাসে, তখন সে বুঝতে পারে না সে কি করছে।
কিংবা তার মন তার আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
ভালবাসা হয়তো এমনই। যা মানুষ কখনো করে না।তাই তাকে দিয়ে করিয়ে নেয়।
নয়তো প্রয়াসের মত ছেলে একটা মেয়ের জন্য না ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দিল! বড় আশ্চর্যের বিষয়!

সে ভাবল আচ্ছা আমি যে রোদকে বললাম ভালোবাসা কি, সেটাই কি ঠিক! ভালোবাসা আর প্রেমের মাঝে তো বিস্তর ফারাক। ভালবাসা আর প্রেম কি কখনো এক হয়? না তা কি করে হয়। ভালোবাসা যেকোনো একজনের দিক থেকে হয়। কিন্তু প্রেমে দুদিকের মত লাগে।
ভালোবাসা আর প্রেম। সারাজীবন শব্দদুটো শুনে যাচ্ছি। কিন্তু কখনো গভীর থেকে ভেবে দেখলাম। শব্দদুটোর মধ্যে আসলে পার্থক্য কোথায়? প্রেম আর ভালোবাসায় তেমন একটা তফাৎ নেই। শব্দদুটো ভীষণ নিকটবর্তী। কিন্তু তবুও একটা পার্থক্য তো আছে। পৃথিবীতে ভালোবাসার কোন সংজ্ঞা নাই। ভা লো বা সা এই চারটি অক্ষরের শব্দটি ইট পাথরের তৈরী কোন ভাল বাসা বা বাড়ি নয়। এটি দেখা বা ছোঁয়া যায় না অনুভব করে নিতে হয়। ভালোবাসা টিকে থাকে আস্থা ও বিশ্বাসের উপর। ভালোবাসাটা হচ্ছে মানুষের মনের আবেগ অনুভূতির একটা স্বাভাবিক রূপ। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোলাগা, শ্রদ্ধাবোধ, মমতা ও টান থেকেই মূলত ভালোবাসার উৎপত্তি। প্রেম ভালোবাসার একটা রূপ। কিন্তু ভালোবাসা স্বতন্ত্র।

আচ্ছা ভালোবাসা কী শুধু কয়েকটি শব্দের খেলা? না এমন না।

প্রেমের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ও সংকীর্ণ। আর ভালোবাসার ক্ষেত্র ব্যাপক ও সর্বজনীন।
ভালোবাসা হয় এক পক্ষ থেকে আর প্রেম হয় উভয় পক্ষ থেকে। ভালোবাসার জন্য প্রেম আবশ্যক নয়। কিন্তু প্রেমের জন্য ভালোবাসা অপরিহার্য। দুপক্ষের সম্মতিতে প্রেম হয়, আর ভালোবাসায় অপরপক্ষের সম্মতি মুখ্য নয়। প্রেম ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ভালোবাসা এমন কোন সিলেবাস মানে না। ব্যক্তি-বস্তু, সবকিছুই ভালোবাসার আওতায় পড়ে। ভালোবাসাটা মানুষের আবেগ অনুভূতির একটা স্বাভাবিক রূপ। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোলাগা, শ্রদ্ধাবোধ থেকেই মূলত ভালোবাসার উৎপত্তি।

ভালবাসার আগে কাউকে সম্মান করতে হয়। নাহলে সে ভালবাসার কোন দামই থাকে না।

সূর্যের আলো চোখে পড়তেই রোদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
প্রয়াসকে দেখেই সে চমকে উঠে। তারপর রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করে। সব মনে পড়তেই, কেমন যেন লাগল তার। একটু লজ্জা ও করছে। রাতে এতগুলো কথা বলায় এখন বেশ লজ্জা লাগছে তার।

“ঘুম ভাঙলো?”

“হুম, আপনি ঘুমান নি? আর আমাকে ডেকে দেননি কেন? রুমে গিয়ে ঘুমাতাম।”

“আসলে আমি ভাবলাম তুমি অনেক ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছো। ডাকলে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর যদি ঘুম না আসে। তাই ডাকলাম না। আর আমি ঘুমিয়েছি। প্রয়াস রাত জাগার কথা গোপন রাখল রোদের কাছে। যদি জানে সারারাত জেগে কাটিয়েছে সে হয়তো ভুল ভাবতে পারে। তাই আর বলছে না।”

“খুব ভালো ঘুম হয়েছে আমার। এখানের সকালটা খুব সুন্দর তাই না?”

“একদম।”

“প্রকৃতি যেন সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে।এতো সুন্দর এই জায়গাটা। জানেন আমার খুব ইচ্ছে ছিলোল সমুদ্রের পাড়ে চাঁদের আলো দেখতে দেখতে ঘুমাব। আপনার জন্য ইচ্ছেটা পূরণ হলো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ”

“আপনার ধন্যবাদ পেয়ে আমি ধন্য হলাম ম্যাডাম। ” প্রয়াসের কথা বলার ঢং দেখে হাসল সে।

“চলো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আবার বের হবো আমরা।”

দুজন দুজনের রুমে চলে যায়। প্রয়াস আজ খুব খুশী। এত ভালো সময় কাটাতে পেরে। রোদের মনও খুব ভালো। কেন এর কারণ সে নিজেও জানেনা।

সবাই বের হয়ে নাস্তা করে নেয়। তারপর বের হয় ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্য। একটা ট্রলারে করে তারা এখন ছেড়া দ্বীপের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে।
সুচি বলল, ” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“প্রয়াস বলে, ছেঁড়া দ্বীপ।সেন্টমার্টিনের অন্যতম সুন্দর স্থান এই ছেঁড়া দ্বীপ। গেলে বুঝতে পারবে কত সুন্দর জায়গা।”

রহিম আর সনি আজ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। অন্যদিন রহিম নিজে কথা বলত। কিন্তু আজ সে বলছে না। সনি একটু অবাক হচ্ছে। রহিম তার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না বলেই সে এতদিন জানতো। সে এখন অন্য একটা মেয়ের সাথে খুব হেসে হেসে গল্প করেছে। সনির খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না।

“এতোদিনের বন্ধু হয়ে শালা কি না আমায় ভুলে গেছে!অন্য মেয়ের সাথে কথা বলছে! টা কীভাবে সম্ভব? খুব সেয়ানা হয়েছে তাই না। দেখাচ্ছি মজা। আমার সাথে সবসময় ঝগড়া করবে। আর অন্য মেয়ে দেখলে একেবারে হাসিতে হাসিতে কথা কইবে? এটা হবে না।আমি হতে দিব না। “এসব মনে মনে বিড়বিড় করছে সে।

রোদ একটা ধাক্কা দিয়ে বলে,
” কী হয়েছে তোর এমন বিড়বিড় করে কি বলছিস?”

“দেখ রহিম্মা কি করতাছে। আমার সাথে কথা না বলে নাকি থাকতে পারে না। দেখ এখন কেমন হেসে হেসে কথা বলছে মেয়েটার সাথে। অথচ আমরা তার কত দিনের বন্ধু সেদিকে খেয়ালই নেই? এটা মেনে নেয়া যায় বল?”

“কেন মেনে নেয়া যায় না। সনু কই আমার মানতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু তোর হচ্ছে,আর কেন হচ্ছে জানিস? কারণ তুই রহিমের সাথে অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারিস না ।আর এর কারণ কি জানিস?তুই রহিমকে ভালবাসিস। কিন্তু সেটা বুঝেও না বুঝার ভান করছিস।”

সনি নিভলো। ইতস্ততভাবে বলল, “দেখ রোদ তুইইই রোদ…..!”

তাকে কিছু বলতে না দিয়ে রোদ চলে যায় সুচির পাশে। এখন একা থাকতে দেয়া উচিত বলে তার মনে হয়েছে। এখন একা থাকলে সে নিজের মনে কথাগুলো ভেবে নিতে পারবে।

সবাই ছেঁড়া – দ্বীপে এসে পৌঁছে যায়। আস্তে আস্তে সবাই নেমে যায়। রোদ নামার আগে ভয় পাচ্ছিল।হঠাৎ খেয়াল করলো তার সামনে দুটি হাত বাড়ানো আছে। প্রয়াস তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। রোদ হাত ধরে নামে।

সবাই যে যার মত করে ঘুরছে। রোদ আজও প্রয়াসের সাথে আছে। তার কেন যেন প্রয়াসের সাথে থাকতেই ভালো লাগছে। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। অনেক বাতাস বইছে এখানে। বাতাসে উড়ছে রোদের চুল। বারবার কানের পাশে গুজে দিচ্ছে। আবার বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল।এবার ওড়না উড়ছে।আজ সেফটিফিন দিয়ে ওড়না আটকাতে ভুলে গেছে রোদ। মনে মনে নিজেকে নিজে একশো একটা গালি দিলো। দূর এবার চুল সামলাবে নাকি ওড়না।

সামনে একটা বয়স্ক লোক কিছু কসমেটিকস, যেমন কাকড়া,হেয়ার ব্যান্ড, ঝিনুকের মালা,চুড়ি। খোপা নিয়ে বসে আছে।

প্রয়াস রোদকে বলে,
“তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।”

প্রয়াস একটু পর ফিরে আসে। একটা হেয়ার স্টিক,কাকড়া,ব্যান্ড আর সেফটিফিন নিয়ে।
রোদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে। তাড়াতাড়ি ওড়না ঠিক করো। আসার সময় ওড়না ঠিক করে বের হওনি কেন? ওড়না ঠিক করে পড়বে। নয়তো ভালো হবে না।”

প্রয়াসের এই অধিকার পূর্ণ কথা শুনে রোদ একটু অবাক হলো। কিন্তু ভালোও লাগল। এখনকার ছেলেরা তো সুযোগ নিতে ব্যস্ত। মেয়েদের সম্মান করতেই যেন তারা ভুলে গেছে। তারা ভাবে মেয়ে মানে একটা মাংসের দলা। যা গাপুস – গাপুস করে খেয়ে ফেলা যায়। ঠিক এমন সময় এই রকম ছেলে পাওয়া দুস্কর। তাছাড়া আমি তো উনাকে বলিনি, যে আমার এগুলো লাগবে। আর খেয়াল করেছি খুব একটা আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলেননি। কথা বলার সময় তার দৃষ্টি ছিলো সামনে। তাহলে বুঝলেন কি করে সব। না চাইতে আমার কি প্রয়োজন বুঝে গেলেন। এটা ভাবতেই খুব ভালো লাগছে রোদের।

রোদ এগুলো হাতে নিয়ে বলল, “আমি আয়না ছাড়া চুল বাঁধতে পারিনা। আর তাছাড়া এখানে কত মানুষ তাদের সামনে ওড়না পিন – আপ করব কিভাবে?”

প্রয়াস চারপাশে তাকিয়ে কি যেন দেখলো, তারপর বলে চলো। রোদ প্রয়াসকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো। একটা রিসোর্ট দেখতে পেল। তার সামনে গিয়ে প্রয়াস একটা লোককে কি যেন বলে।
তারপর রোদকে বলল,
“চলো। এখানে আয়না আছে ওয়াশরুমে গিয়ে চুল বেঁধে এসো। আমি আছি ওয়াশরুমের সামনে।”

“রোদ ভেতরে ডুকে দেখল ওয়াশরুমে আয়না ভাঙা। দূর কেমন লাগে। কোনরকম সেফটিফিন লাগিয়ে নেয়। বের হয়ে বলে আয়না নেই কি করব।”

প্রয়াস কি যেন ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে রোদের সামনে ধরে বলে,
“চলবে?”

রোদ হেসে বলে,
“দৌঁড়াবে।”

প্রয়াস রোদের সামনে ফোন ধরে আছে। রোদের চুল বাঁধা দেখছে। চুল বাঁধায় সামনের ছোট ছোট চুলগুলো সামনে এসে পড়েছে অপূর্ব লাগছে দেখতে রোদকে।

“হয়ে গেছে চলুন।”

দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটছে। রোদের মন আজ ভীষণ ভালো। এমন মানুষ ও আছে। যে তার সম্মান রক্ষা করে। তার কি লাগবে সব আগে থেকে বুঝে যায়।

ইশ্! সারাজীবন যদি এভাবে হেঁটে যাওয়া যেত একসাথে। কি ভালো হতো। তাই না!

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here