মেঘের আড়ালে বৃষ্টি পর্ব -১২

#মেঘের আড়ালে বৃষ্টি
#বারো
#প্রজ্ঞা–জামান–দৃঢ়তা

আরও একটি নির্ঘুম রাত কাটল প্রয়াসের। কাল সব ভালো লাগলেও। আজ সবকিছু বুকের ভেতরে এক অসহ্য যন্ত্রনার সৃষ্টি করেছে। মানুষের জীবন কখন কী হয়, কেউ বলতে পারে না। নয়তো একদিন যাকে চিনতোই না, আজ তার জন্য মন কাঁদে। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। আচ্ছা ভালবাসা কী কোনো চুম্বক যা তার বিপরীত দিকের মানুষটিকে কাছে টানে। প্রয়াস আনমনে ভাবছে বসে।

সকাল হয়ে গেছে, সবাই ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসছে। আজ কেউ আলাদা আলাদা ঘুরতে পারবে না,স্যারদের আদেশ। কারণ ফেরার সময় যেন কাউকে খুঁজতে না হয়।

আজ রোদ পরেছে একটা নীল এক কালার জামার সাথে গাঢ় গোলাপি ওড়না প্রয়াস খেয়াল করতেই দেখল। এই মেয়েটির ড্রেস-আপ অনেকটাই সাধারণ। কিন্তু যখন এই সাধারণ ড্রেস সে পরে মনে হয় তার মাঝে একটা অসাধারণ ভাব চলে আসে। আজ কপালে একদম ছোট একটি নীল টিপ। এই ছোট টিপ যেন রোদের সোন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে প্রয়াস তার দিকে।

সকাল প্রয়াসের পিঠ চাপড়ে বলল,
“কীরে এভাবে দেখাদেখি আর কতদিন চলবে? এবার তো বলে দেয় দোস্ত।”

“বলব খুব তাড়াতাড়ি বলতে হবে। না বলে যে আমি শান্তি পাচ্ছি নারে।”

সবাই আজ একসাথে ঘুরছে অন্যদিন রোদ প্রয়াসের কাছাকাছি থাকলেও আজ তার উল্টো দিকে হাঁটছে।কেন যেন এক অজানা দূরত্ব বজায় চলছে রোদ।প্রয়াসকে এই বিষয়টা খুভ ভাবাচ্ছে। কেন এমন করছে রোদ?

সবাই একটা খাবার হোটেলে ঢুকে নাস্তা করতে।এখানে মাছের রেসিপি অনেক বেশী। মাছের বারবিকিউ খাচ্ছে সবাই। সমুদ্রের রূপ চাঁদা মাছে খেতে খুবই সুস্বাদু।

সবাই স্যারকে বলছে এখন সমুদ্রের পানিতে তারা গোসল করবে। কিন্তু স্যার রাজি হচ্ছেন না। সবার অনুরোধে স্যার রাজি হলেন। সবাই একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠে। স্যারের চোখ রাঙানোতে সবাই চুপ করে গেল। আচমকা এমন চিৎকারে হোটেলের বাকি সবাই ভয় পেয়ে তাকায় এইদিকে।

★★★

সবাই পানিতে নেমেছে। সনির চোখ চারদিকে খুঁজছে রহিমকে, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছে না।সকাল থেকে একটিবারও রহিমকে দেখেনি। কোথায় গেল শয়তানটা। সনি একবার ভাবে আমিই বা কেন এত ভাবছি। এসব ভাবছে ঠিক কিন্তু নিজের মনকে শান্ত করতে পারছে না।

রোদ বলল, ” কিরে কাউকে খুজছিস তুই?”

“রহিমকে সকাল থেকে দেখছি না ।তুই দেখছিস?”

“নারে দেখিনি। তোকে বলে যায়নি। সে তোকে না বলে কিছুই করে না।” কথাটা বলে সে পানির দিকে এগিয়ে গেল।

রোদ পানিতে নামছে। পাড়ে বসে সবার আড়ালে দুটি চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ তার খবর জানে না।

হ্যাঁ প্রয়াস বসে আছে, তার মন আজ খুব খারাপ।আজকেই চলে যাবে। আর চাইলে ইচ্ছে মত এই মেয়েটাকে দেখতে পারবে না। হঠাৎ কারো চিৎকারে চমকে যায় প্রয়াস। মাহি নামের একটা মেয়ে নাকি জোয়ারের সাথে দূরে চলে গেছে। সে নাকি সাঁতার জানে না। অথচ সবগুলো ছেলে বসে আছে কেউ নামছে না। কেউ না গেলে মেয়েটা ভেসে যাবে।কোনোকিছু না ভেবে প্রয়াস নামে তার পিছু পিছু।সকাল ও যায়।
জোয়ারের শক্তি এতই বেশী যে, দুইজন বলিষ্ঠ পুরুষ তার সাথে পেরে উঠতে কষ্ট হচ্ছে।
অনেক কষ্টে মেয়েটাকে প্রয়াস ধরে সকালের কোলে দেয়।
সকালকে বলল,
” তুই মেয়েটাকে নিয়ে যা আমি আসছি।”

এইদিকে রোদের অবস্থা কাহিল। কেন যেন তার দু’চোখ বেয়ে নোনা জল নামছে। কেন কাঁদছে সে জানে না। তবে তার বুকের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছে। কারণ সকাল এতোক্ষণে মাহিকে নিয়ে পাড়ে এলে ও প্রয়াসকে দেখা যাচ্ছে না। সকালের পেছনে একবার দেখা গেলেও। এখন সকাল চলে আসলেও প্রয়াস আসছে না।

সমুদ্রের জোয়ার বেড়ে যাওয়ায়। সবার মনে এক অজানা ভয় কাজ করছে। সবাই উঠকন্ঠা হয়ে আছে।সবার মনে একই ভাবনা।প্রয়াস হয়তো ভেসে গেছে এই ভয়ংকর স্রোতে। কিন্তু কেউই তা মুখে আনছে না। পাছে মুখের কথা সত্যি হয়ে যায়!

রোদের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কান্না যেন দলা পাকিয়ে তার গলায় আটকে গেছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। তবে কী সত্যি প্রয়াস হারিয়ে গেল সারাজীবনের জন্য?
তবে কী অসমাপ্ত রয়ে গেলো একটা প্রকাশ না পাওয়া ভালবাসার গল্প? তবে কী রোদের মেঘলা আকাশের মেঘের আড়ালে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিকে কাছে পেয়ে ও তাতে গা ভেজানোর ভাগ্য হলো না তার?

★★★

একটুপর দেখা গেল প্রয়াস সমুদ্রের যে জায়গা গিয়েছিল তার থেকে কিছুটা দূর থেকে উঠে আসছে।
সকাল হাসছে। কীরে তুই এমন কেন করলি? তোর জন্য অনেকে কেঁদে – কেটে এক শেষ হয়ে গেল। তারা তো জানে না তুই খুব ভালো সাঁতারু, তাই ভাবল তুই বুঝি তাকে ছেড়ে.. কথাটা শেষ করার আগেই স্যার চলে এলেন।

এই প্রয়াস এমন কেউ করে, স্যার বললেন।।

“স্যার আপনি তো জানেন আমি এমন কাজ প্রায়ই করি।”

“হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু সমুদ্র আর পুকুরে যে বিস্তর ফারাক আছে তা তো বুঝতে হবে ইয়াংম্যান। সত্যি বলতে আমিও একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আর এমন করো না। ”

“জি স্যার মনে থাকবে।”

রোদের এতক্ষণে প্রাণ ফিরে এল। প্রয়াসকে উপরে উঠে আসতে দেখে। এখন সমুদ্রের বালিতে বসে আছে নিশ্চুপ নিরব হয়ে। দৃষ্টি তার নিচের দিকে।জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন আমরা যাকে চিনি না, জানি না। তার জন্য মন পুড়ে। তাকে হারানো ভয় প্রতি মুহুর্তে তাড়িয়ে বেড়ায়। জীবন এভাবেই কাকে কখন কার সাথে জুড়ে দেয় তার কোন হিসেব থাকে না। মাঝে মাঝে মানুষ তার করা কিছু কাজের অর্থ সে নিজেই বুঝে না। যেমন এই মুহুর্তে রোদের মাথায় আসছে না সে কেন প্রয়াসের জন্য এমন অস্থির হয়ে ওঠলো। কেন তাকে হারানোর ভয়ে মন আর দেহে এক অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করল।
তখন সবাই রোদকে খেয়াল করছিল। এখন তারা কে কী ভাবছে কে জানে? তখন এটা মনে না থাকলেও এখন ঠিক মনে হচ্ছে।

প্রয়াস রোদকে আঁড় চোখে দেখছে। কিন্তু একবারও সরাসরি তাকায়নি।

প্রয়াস এখন নিশ্চিত যে, রোদ তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। মনের ভেতর শান্তি অনুভব করছে ।ভালোবাসার মানুষ যখন ভালোবাসে, তখন সেই শান্তি যে কতটা আনন্দের, কতটা সুখের হয় তা শুধু যারা পেয়েছে তারা জানে। সারাদিন প্রয়াস রোদের সাথে একটা কথা ও বলেনি। রোদ এতে বেশ অবাক হয়েছে। কিন্তু নিজ থেকে গিয়েও সে কথা বলেনি।

বিকেল হয়ে আসায়। সবাই রিসোর্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে,যার যার জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। এখন তারা টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। বের হওয়ার সময় দুজন মুখোমুখি পড়ে যায়।

রোদ বলেল,
“আপনার শরীর ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ ঠিক আছে।”

রোদ সৌজন্য হাসি দেয় ।দুজনে আবার সবার সাথে হেঁটে যায়।

সবাই জাহাজের ভেতর বসে আছে। আজ রোদ আর প্রয়াস একসাথেই বসেছে। কারণ আজ ও সকাল একই কাজ করেছে। কিন্তু আজ তারা কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। অথচ আসার সময় বেশ ভালো কথা বলেছিলো। এখনতো আরও কাছে চলে এসেছে আরও বেশি কথা বলার কথা, কিন্তু তারা তা কেউই করেছে না। হয়তো দুজনেই বুঝে গেছে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছে। তাই দুজনের মাঝেই কেমন একটা জড়তা কাজ করছে। যদি মুখ ফোসকে বেফাঁস কিছু বলে ফেলে তারা।

প্রয়াস ঠিক করে ফেলেছে চট্টগ্রাম ফিরেই সে রোদকে বলে দিবে তার ভালোবাসার কথা। যেহেতু এখন সে অনেকটাই নিশ্চিত তাকে রোদ ভালোবাসে। তাই আর দেরি না করাই শ্রেয়।

রোদ নিজের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছে। প্রয়াস তার পাশে বসায় তার শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে আসে।বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যায়। আচ্ছা এটাকে কী বলে! কেন এমন হয়?

এভাবেই দুজন কথা না বলেও, মনে মনে দুজনের কথাই ভেবে যাচ্ছে। যেন মনে মনেই শতসহস্র কথা বলে ফেলছে।

রোদ ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মাঝে তার মাথা প্রয়াসের কাদে পড়ে। হঠাৎ প্রয়াসের সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। তার শিরদাঁড়ায় বেয়ে শীতল স্রোত নামছে।
অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে তার ভেতর।
রোদের ঘুমন্ত চেহেরার দিকে তাকিয়ে আছে প্রয়াস।যে শত জনমের পিয়াস মেটাচ্ছে সে।

★★★

রহিম দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের বাইরের দিকে। তার মন বড্ড অশান্ত। কিছুতেই যেন শান্ত করতে পারছে না। সনিকে দেখলেই তার মন উলটপালট হয়ে যাচ্ছে।এই যন্ত্রনা থেকে বাঁচার উপায় কী? সনি থেকে দূরে যাওয়া? হ্যাঁ সেটাই করতে হবে। তাকে ভুলতে হলে আমাকে তার থেকে দূরে থাকতে হবে। একবার যদি কাউকে ভালোবাসা যায়। আর যাই হোক তাকে বন্ধুর তকমা লাগিয়ে তার সাথে চলা যায় না। এতে করে কখনোই ভালোবাসা কমে না,বরং বেড়ে যায়। তাই ফিরে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সনি থেকে দূরে যাওয়ার সব প্ল্যান করতে হবে।

জাহাজ থেকে নেমে সবাই বাসে উঠে। চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। এখন নিশির সাথে বসেছে রোদ। প্রয়াস সকাল একসাথে বসেছে।

রোদ বসেছে বাসের ডান পাশে,প্রয়াস বসেছে তার বাম পাশের সিটে। তাই কিছুক্ষণ পর পর দুজনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দুজন দুজনকে, কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।

রোদ ব্যাগ থেকে চিপস বের করে খাওয়া শুরু করেছে। রোদের চিন্তা হলে চিপস খাওয়ার বাতিক আছে। কারণ সে মনে করে চিপস খাওয়ায় মন গেলে তার চিন্তা কমে যায়। কী অদ্ভুত তাই না! তাই সে সবসময় চিপস সাথেই রাখে। এটা কেমন নিয়ম কে জানে। চিপস খেলে নাকি চিন্তা কমে।

সনি বলল, “এই এখন আবার তোর কীসের চিন্তা শুরু হলো? চিপস খাচ্ছিস যে?”

“প্লিজ বিরক্ত করিস না। আমি এখন চিপস খাব মন দিয়ে।”

“কী আজব ব্যাপার! মানুষের চিন্তা হলে সিগারেট খেতে শুনেছি। মদ খেতে শুনেছি। চিপস খেতে বাপের জন্মে শুনিনি। এসব তোর দ্বারাই সম্ভব রোদ।”

“এই তুই চুপ করবি।”

সবাই চট্টগ্রাম এসে গেছে। যে যার বাড়ি যাবে।
রোদ অনেক্ষণ ধরে প্রয়াসকে খুঁজছে। প্রয়াস ব্যস্ত ওইদিকে,যেহেতু সব তাকে সামলাতে হয়েছে। তাই এখন একটু ব্যস্ত আছে। এদিকে রোদ অপেক্ষা করছে তার খবর নাই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রোদ সনির তাড়ায় বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে বাধ্য হয়। রোদ রিকশা উঠে গেছে। কেন যেন মন খুব খারাপ তার প্রয়াসের সাথে দেখা হলো না। আগামী তিনদিন কলেজ বন্ধ দিয়েছে। সবাই যাতে রেস্ট নিতে পারে তাই। এদিকে আর প্রয়াসের সাথে এই কয়দিন তার দেখা হবে না। দূর লোকটা কী একটু দেখাও করল না।প্রায় বাসার সামনে এসে গেছে রোদ।

হঠাৎ একটা বাইক এসে থামে রোদদের রিকশার সামনে। রোদের বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে তাকে দেখে। কী হয়েছে কেনই বা উনি এসেছেন?
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দুজন দুজনের দিকে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here