#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ আটত্রিশ
শীত চলে এসেছে। হালকা হালকা ঠান্ডার প্রকোপ পরেছে। শীতের সকালের মিষ্টি রোদ চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছে। ঘাসের ওপর ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু জমে রয়েছে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা বাতাস মনকে একদম ঠান্ডা করে দিচ্ছে। তুলতুল বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার ধার দিয়ে হাটছে। মাঝে মাঝে সে ওপরের দিকে চোখ বন্ধ করে তেজহীন হালকা রোদের আভা মুখে মাখছে। আজকে রাফসানের আসার কথা এখানে। তাকে নিয়ে যাবে বলেছে কোথাও। দেখতে দেখতে দুইমাস পেরিয়ে গিয়েছে। এ দুইমাসে সে দেখেছে একদম নতুন রাফসানকে, যে গুন্ডা স্বভাবের নয়। যখন তখন আগের মত তাকে খুব একটা বকে না, ভালো ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে। তার ভেতর একটা প্রেমিক সুলভ আচরণ আছে। তুলতুলের কেয়ার করা, তাকে ভালোবাসা, সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নিতে শেখানো, আবেগে যেন কখনো কোন ভুল না করে সব কিছু যেন তার মনের ভেতর গড়ে তুলেছে আস্তে আস্তে। রাফসান যেন তার অস্তিত্বে মিশে গেছে। সময়ের সাথে সাথে মনের ভেতর ভালোবাসার গভীরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে তুলতুলের। তুলতুলের মনের ভেতর ভালোবাসা তৈরি হলেও ম্যাচুয়ারিটি তৈরি হয়নি। তার স্বভাবে এখনো বাচ্চামো রয়েছে, যে দুরন্ত, চঞ্চল, আনাড়ি ও কিশোরী মনের অধিকারী। রাফসান সব মাথায় রেখেই সম্পর্কে আগায়, তুলতুলকে ভালো মন্দ বোঝানোর চেষ্টা করে। সে চায় তার প্রতি তুলতুলের যে টান এটা যেন কিশোরী বয়সের একগুচ্ছো আবেগ না হয়, সেটা যেন এই কিশোরী মনকে ছাপিয়ে পরিপূর্ণ নারী রুপে প্রস্ফুটিত হওয়া পযন্তও তুলতুলের মনের গহীনে শুধু তার অস্তিত্ব বিরাজ করে। শুধু পরিপূর্ণ হওয়া নয় সে চায় আজীবন যেন তুলতুলের মনের ভেতর তার বসবাস হয়৷ ভালোবাসে যে খুব তাকে। ঐ মায়া ভরা দুচোখে তার জন্য ভালবাসাহীনতা দেখতে চায় না সে, দেখতে চায় তার প্রিয় মানুষটির চোখে তার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। সেই চোখদুটো দেখলেই যেন তার মনে প্রশান্তি আসে, আসে একরাশ স্নিগ্ধতায় ভরা ভালোবাসা, সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যায় প্রিয়তমার সেই দুচোখের দিকে তাকিয়ে।
তুলতুলের মনে হয় সে আরো আগে কেন রাফসানের প্রেমে পড়লো না, কেন আরো আগে দেখা হলো না? তাহলে এতদিন তার বিয়ে হয়ে যেত রাফসানের সাথে। দিয়ারও বিয়ে হয়ে যাবে তার ভাইয়ের সাথে পরীক্ষার পরে, সব কথা ঠিকঠাক করে ফেলেছে, শুধু তারই বিয়ে হবে না। অসভ্য লোকটা তাকে এত ছোট থাকতে বিয়ে করবে না বলেছে, পড়ালেখা শেষ হলে তাকে বিয়ে করবে। হুহ্! বিয়ের পর বুঝি মানুষ পড়ালেখা করে না? সেও নাহয় বিয়ের পর পড়াশোনা করলো, সাথে সংসারও করা হয়ে গেলো। কিন্তু না রাফসান স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে পড়াশোনা শেষ করে তারপর বিয়ে। তুলতুলকে সে যদিও এ ব্যাপারে বুঝিয়েছে। কিন্তু তুলতুলের ভাবনা তুলতুলের কাছে। তার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাবে আর সে বছরের পর বছর থেকে বুড়ি হবে নাকি? একদম না। দরকার পড়লে ব্লাকমেইল করবে। তবুও সে বিয়ে করবে। তার তো বিয়ের বয়সও হয়ে গিয়েছে, আঠারো বছর সাত মাস চলে তাহলে সে কিভাবে ছোট হতে পারে? একদম ছোট নয় সে। হুহ্! তাদের সম্পর্কের ব্যাপারের শুধু দিয়া জানে। জানার পরে রোবটের মতো তাকিয়ে থেকে একটা চিৎকার দিয়েছিল। যে তার বান্ধবী ভয়ংকর লোকের প্রেমে পড়ছে, তার জীবন শেষ। প্রথম দিকে তুলতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তুলতুল বোঝে নি। আস্তে আস্তে যখন তুলতুলের ব্যাপারে রাফসানের কেয়ারনেস দেখেছে তখন মেনে নিয়েছে। আর তুলতুলের মাথায় বিয়ের ভূত টাও সেই ঢুকিয়েছে। আর এখন রাফসানের সাথে দেখা করার আগেও তার এই কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে আনমনে হেঁটে চলেছে। কিন্তু পেছন থেকে মাথায় টোকা পড়ায় থেমে পেছনে তাকায়, দেখে প্রান্ত পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-” কিরে পেত্নী সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস? তোর না একা একা বের হওয়া মানা? চল আমি দিয়ে আসি কোথায় যাবি?” প্রান্তর কথায় তুলতুলের খাবি খাওয়ার মত অবস্থা হলো। প্রান্ত সাথে থাকলে সে রাফসানের সাথে দেখা করবে কিভাবে? লোকটাকে দেখেছে সে সপ্তাহ হয়ে গেলো। আজও কি দেখা হবে না। তুলতুলের এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কান্না করলে তো হবে না। তাই সে প্রান্তকে বোঝানো চেষ্টা করলো
-” ভাইয়া, কি বলো তো? আমি না কোথাও যাচ্ছি না। শুধু বাড়ির সামনে দিয়ে একটু হাঁটাহাটি করছি। মর্নিং ওয়াক বলে যাকে হে হে হে।” তুলতুলের কথায় প্রান্ত ভ্রু উঁচু করে তার দিকে তাকায়।
-” আগের বারও তোকে বাড়ির সামনে হাঁটাহাটি করার সময়েই তুলে নিয়ে গেছিল। সো কোন কথা না, আমি তোকে একা ছাড়ছি না। আর তুই এই সময় মর্নিং ওয়াক করছিস? একটা চটকানা দেবো মিথ্যা বললে। রোদ উঠেছে কখন, সকাল থেকে দুপুর হওয়ার পালা আর উনি এখন মর্নিং ওয়াক করছে। লেইম এক্সকিউজ!” বলে তুলতুলের দিকে রাগী ভাবে তাকায়। আর তুলতুল চুপসে যায়। সে মুখ কালো করে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। প্রান্তর তা দেখে খারাপ লাগলো, বেশি বকে ফেলেছে। কিন্তু এভাবে তো তাকে ছেড়ে দিতে পারে না, চারপাশে কতরকম বিপদ আপদ ওত পেতে রয়েছে। কিছুদূর এগিয়ে রাস্তার পাশে আইসক্রিম ওয়ালাকে দেখলো। প্রান্ত তুলতুলের দিকে তাকালো। মুখ ফুলিয়ে রয়েছে এখনো।
-” আইসক্রিম খাবি? চল, কোনটা নিবি ভ্যানিলা নাকি চকলেট?”
-” আমি খাবো না তুমিই খাও।” তুলতুল বলে অন্য দিকে তাকালো। প্রান্ত হেসে তুলতুলের হাত ধরে আইসক্রিমের দোকানের দিকে গেলো।
-” মামা কোণ আইসক্রিম দেও তো দুইটা, চকলেট আর ভ্যানিলা ফ্লেভারটা দিও।” আইসক্রিম নিয়ে প্রান্ত একটা তুলতুলের দিকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু তুলতুল নেয় না সে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে প্রান্ত তার সামনে গিয়ে বলে
-” আচ্ছা বাবা সরি, আর বকবো না খুশি? এখন এটা নে।” প্রান্তর কথায় তুলতুল তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আইসক্রিম নিয়ে বলে
-” ইট’স ওকে!” তুলতুলের কথায় প্রান্ত হেসে উঠে তার নাক টেনে দেয়। তারা হাঁটতে থাকে। তুলতুল আইসক্রিম খাচ্ছে আর প্রান্ত তার পাশে হাঁটছে হাতে অন্য আইসক্রিম। সে খাচ্ছে না। তুলতুল কিছুক্ষণ প্রান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কিছু খুঁজছে। প্রান্ত তা বুঝতে পেরে বলে
-” কি হয়েছে হুম? আইসক্রিম না খেয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?”
-” আপুকে অনেক ভালোবাসতে তাইনা?” তুলতুলের আকষ্মিক এই কথায় প্রান্ত থেমে যায়। তার দিকে একবার দেখে আবার সামনে ফিরে হাঁটতে লাগে। সে বোঝে নি কোনদিন যে তুলতুল তার মনের কথা জানতো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। মানে তুলতুল প্রথম থেকেই সব জানতো। তুলতুল আবার বলে
-” কেন বলো নি তাকে যে তুমি তাকে অনেক ভালোবাসতে?” প্রান্ত তুলতুলের দিকে শান্ত ভাবে তাকিয়ে বলে
-” সব সময় সবকিছু বলতে নেই। তাতে কিছু সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।”
-” বলেই দেখতে একবার।”
-” কি হতো বললে? তার মনে যে অন্যকাউকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা ছিল। আর তিয়াসা শুধু আমার কাজিন নয় আমার বেস্ট ফ্রেন্ডও ছিল। যদি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেত আমার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অনুভূতি তাহলে বন্ধুত্ব টা নষ্ট হয়ে যেত। আমি তা চাইতাম না কখনো। কারন আমাকে সে অনেক বিশ্বাস করতো। ওর ভালোবাসার দরকার নেই আমার শুধু বন্ধুত্ব সারাজীবন থাকলেই তা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু দেখ মানুষটাকেই আমি হারিয়ে ফেলেছি।” প্রান্তর গলা কাঁপছে। পুরনো ক্ষত তার ভেতরে জেগে উঠেছে। ভুলে থাকার চেষ্টা করে সে পুরনো স্মৃতি গুলো। ভুলেও যায়, কিন্তু যখন মনে পড়ে তখন তার ভেতর সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
-” আপুর কথা মনে করে কখনো তুমি আইসক্রিম খাও না। মনে আছে তোমার সেদিনের কথা?” তুলতুলের কথায় প্রান্তর মস্তিষ্কে পুরনো কিছু স্মৃতি হানা দেয়। গ্রীষ্মের কোন এক রোদতপ্ত দুপুরে সময় ছিল তখন। প্রান্ত আর তিয়াসা ভার্সিটি থেকে ফিরছিল, আর তুলতুল স্কুল থেকে। দুপুরের গরমে তুলতুল বায়না করে সে আইসক্রিম খাবে। কারন পাশে আইসক্রিমের দোকান ছিল। প্রান্ত গিয়ে তিনটা নিয়ে আসে। তুলতুলকে দিয়ে সে নিজে একটা রেখে তিয়াসা দিতে যায়, কিন্তু তিয়াসার ফোন আসায় সে আইসক্রিম না নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কথা বলে। প্রান্তর নিজেরটা খাওয়া শেষ কিন্তু তিয়াসার কথা শেষ হয়নি দেখে সে তিয়াসার টাও খেয়ে ফেলে। তুলতুল তা দেখে খিকখিক করে হাসে। যে এবার নিশ্চয়ই ঝগড়া লাগবে। কারন, তুলতুলের মতোই তিয়াসারও আইসক্রিম অনেক পছন্দ। তিয়াসার কথা শেষ হলে সে প্রান্তর দিকে হাত বাড়ায়। তা দেখে প্রান্ত বলে
-” কি? এভাবে হাত পেতে আছিস কেন? ইহ! তোর হাত আমি ধরতাম না।”
-” বান্দর থাপ্পড় খাবি। আমার আইসক্রিম দে।” তিয়াসা ভ্রু কুঁচকে বলে।
-” ওহ! কিন্তু আইসক্রিম তো নাই।”
-” নাই মানে? ওই ফাজলামো করিস? তাড়াতাড়ি আমারটা আমারে দে। পানি পিপাসা লাগছে পানি নাই এখন আইসক্রিম দিয়েই চালাতে হবে।” প্রান্ত দাঁত কেলিয়ে বলে
-” খেয়ে ফেলছি।”
-” কিহহ! তোর টা কি করছিস?”
-” ওইটাও খাইছি।” প্রান্তর কথায় তিয়াসা চোখ গরম করে ওর দিকে তাকায়। তারপর প্রান্তর দিকে এগিয়ে ধুমধাম করে করে কিল বসিয়ে চুল টেনে বলে
-” ওই তুই আমার আইসক্রিম খাইছস কিল্লাই? আইনা দিবি এখন আমি জানিনা। নাইলে পানি দিবি। বাড়ি এখনো কত দূর আমার গলা শুকায় গেছে। বড় হইয়াও বাচ্চাদের মতো আইসক্রিম খাইছস আরেকটা বাচ্চার সামনে দাঁড়ায়। তোরে তো আমি আজকে টাকলু বানায় দিমু। তুলতুলরে দেখ পিচ্চিটা নিজের টা ছাড়া আর কারোটায় নজর দেয় নাই। খাওয়ার কথা তো ছিল ওর তুই খাইছোস ক্যান?”
-” ওরে আমার চুল ছাড় চুরেল। আমি আইনা দিতেছি তোরে আরেকটা।” প্রান্তর কথায় তিয়াসা তার চুল ছেড়ে দেয়। আর প্রান্ত আইসক্রিম আনতে গিয়ে দেখে আইসক্রিম ওয়ালা চলে গেছে। প্রান্ত অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তিয়াসার দিকে তাকায়। আর তিয়াসা কটমট করে তার দিকে তাকায়। আবার গিয়ে তার চুল টেনে ধরে বলে
-” আর খাইবি আমার আইসক্রিম?”
-” চরি”
-” কি কইলি?”
-” সরি”
-” বল, আমারে ছাড়া আর কোনদিন আইসক্রিম খাবি?”
-” খাবো”
-” তবে রে? আজকে তুই শেষ। ” বলে তিয়াসা প্রান্তর চুল জোরে টান দেয়। প্রান্ত দ্রুত বলে
-” খাবোনা, কোন দিন তোরে ছাইড়া খাবো না। আমার চুল ছাড় এখন ডাইনি।”
প্রান্ত আগের কথা মনে হেসে দিল। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো। সে আলগোছে চোখের পানি মুছে ফেলে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে
-” পুরনো কথা কেন তুলছিস? ভুলে যা। কিছু অতীত শুধু কষ্ট দিতে জানে।” তুলতুল প্রান্তর দিকে তাকালো। তারও মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। আর কিছু ভালো লাগছে না। তারপরও বললো
-” আচ্ছা আপু কাকে ভালোবাসতো তুমি জানতে?”
-” উহুম, শুধু জানতাম সে কাউকে ভালোবাসে। অবশ্য নিজেই বলেছিল।”
-” কখনো জানতে চাওনি কে ছিল?”
-” না, আর সেও বলেছিল সঠিক সময়ে বলবে তাই আর জিজ্ঞেস করিনি কখনো।”
-” আচ্ছা এমন ও তো হতে পারতো যে আপুর জীবনে কেউ ছিল না, তোমার রিয়াকশন দেখার জন্য সেটা বলেছে?”
-” নাহ, সেটা হবার নয়। কারন তিয়াসা আমাকে কখনো মিথ্যা বলেনি।”
-” এতটা বিশ্বাস করতে?” তুলতুলের কথায় প্রান্ত মুচকি হাসলো।
-” বিশ্বাস? হ্যাঁ বিশ্বাস করতাম অনেক। আর সেও আমাকে বিশ্বাস করতো, তাইতো কখনো নিজের মনের কথা জানায় নি। যদি বিশ্বাস ভেঙে যায়। যদি সে মনে করে বন্ধুত্বের দোহায় দিয়ে তার মন অর্জন করতে চেয়েছি।তাই! প্রত্যেক টা সম্পর্কে বিশ্বাস থাকা জরুরি। হোক সেটা বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা। বিশ্বাস না থাকলে কোন সম্পর্কই স্থায়ী হয় না।ঠুনকো তা, একটু কিছুতেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাই সম্পর্কে বিশ্বাস থাকা জরুরি। আর আমি কখনো চাই নি আমাদের বন্ধুত্ব কখনো ভেঙে যাক। বুঝেছিস?”
-” সত্যিই কি বিশ্বাসের ওপর সব সম্পর্ক টিকে থাকে?” তুলতুল ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করলো। প্রান্ত তা শুনে হেসে তুলতুলের মাথায় হাত দিয়ে বলে
-” বড় হ তখন বুঝবি, এখন এসব ভাবার দরকার নেই। বাড়ি চল, আর হাঁটা লাগবে না।” প্রান্ত সামনের দিকে ফিরে এক পা, দু পা এগোতে লাগলো। আর তুলতুল পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ভাবে
-” প্রেমে পাস করে ফেলছি, এখন বিয়ে পাস করলেই আমি বড় হয়ে যাবো। হি হি হি।”
-” কিরে চল, আর বাহানা চলবে না।” বলে প্রান্ত তুলতুলের হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। আর তুলতুল প্রান্ত হাত ধরে নিজের মতো লাফিয়ে হাঁটছে মাঝে মাঝে। কখনো প্রান্তর হাত ধরে টানছে, আবার কখনো রাস্তার আশেপাশে কোন বনজ ফুল দেখলে থেমে কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে ধরতে যাচ্ছে আর প্রান্ত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির কিছুটা সামনে যখন তারা তখন প্রান্তর ফোনে ফোন আসে। ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। কথা বলা শেষে সে তুলতুলকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলে
-” পিচ্চি এখন সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকবি, আর বাইরে যাবি না। আমার কাজ আছে, আমি এখন আসছি। আমি যেন না শুনি যে তুই একা একা আবার বের হয়েছিস। নাহলে কিন্তু খবর আছে। বুঝেছিস?” তুলতুল মাথা নাড়লো।
-” বাড়ি যা” প্রান্তর কথায় তুলতুল মেন গেট খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে। গেট লাগিয়ে দেওয়ার সময় বলে
-” ভাইয়া যাও তুমি, আমি গেট লাগিয়ে দিচ্ছি।” বলে তুলতুল গেট লাগিয়ে দিল। আর প্রান্ত কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে কাজে চলে গেলো। অনবরত ফোন আসছে তার কাজের, তাই সে বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। নাহলে তুলতুলকে একদম বাড়ির ভেতরে দিয়ে আসতো। বলা তো যায় না কখন আবার সে চলে গেলে এক ছুট লাগায়। বোনটা তার একটু বেশিই চঞ্চল হয়েছে। তুলতুলের জন্য টেনশন হয় তার, মেয়েটা কখন যে কি করে বসে।
তুলতুল মনে মনে চাইছে এখন যেন কেউ বাড়ি থেকে বের না হয়। তাহলে তাকে দেখে বাড়ি নিয়ে যাবে। একটু সময়ের জন্য বাইরে বের হওয়ার অনুমতি পেয়েছিল। সে গেটের এক সাইডে লুকিয়ে ছিল। যাতে প্রান্ত না দেখে। এদিকে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে ভয়ে, এই বুঝি ধরা পড়ে গেলো। রাফসানের সাথে বুঝি আজ তার দেখা হবে না। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই চিন্তায় তার অস্থির লাগছে। কিছুক্ষণ পরে গেট টা একটু খুলে সে চোরের মত চারদিকে চোখ বুলায়। দেখে প্রান্ত বা অন্য কেউ আছে কিনা। সে দেখলো আশেপাশে কেউ নেই, তাই বের হয়ে গেট নিঃশব্দে চাপিয়ে আরেকবার আশেপাশে দেখে দেয় এক দৌড়। আর কোনদিকে তাকানো নেই। সে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে ম্যারাথন দৌড়ের মত ছুটছে। কিছুটা দূরে গিয়ে রাফসানের গাড়ি খোঁজে। সে একটু থেমে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। ভয়, উত্তেজনা আর দৌড়ের কারনে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এদিক ওদিক তাকিয়েও সে রাফসানকে দেখতে পায় না। লোকটা কি এখনো আসে নি? নাকি তাকে না পেয়ে চলে গেলো? তুলতুলের এবার সত্যই কান্না পেয়ে গেলো। তার চোখ ছলছল করছে এখনি জল গড়িয়ে পড়বে এমন অবস্থা। কিন্তু সে আশাহত না হয়ে আর কিছুটা সামনে এগোয়, দেখে রাফসানের গাড়ি রাস্তার একপাশে দাড়ঁ করে রাখা। তুলতুল ঠোঁট ফুলায়। আরেকটু এগিয়ে গেলে কি হতো? সে তো ভেবেই নিয়েছিল রাফসান হয়তো চলে গিয়েছে। এখন যদি আর একটু এগিয়ে না দেখতো তাহলে কি হতো? তুলতুল চোখের পানি মুছে গাড়ির কাছে যায়। গাড়ির টিনটেড গ্লাসের জন্য ভেতরের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তুলতুল দরজা টান দিল কিন্তু তা লক করা দেখে খুললো না। তুলতুল এবার কাচে টোকা দিল। কয়েকবার টোকা দেওয়ার পরও কোন সাড়াশব্দ নেই। তুলতুল গাড়ির দিকে মুখ কালো করে তাকিয়ে রইল। এই লোক কি বউ সেজে গাড়ির ভেতর ঘোমটা দিয়ে বসে আছে নাকি? নাহলে এমন করে গাড়ি লক করে রেখে তার ভেতরে বসে আছে কেন? নাকি সে গাড়িতেই নেই। ধুরর! তুলতুল বিরক্ত হলো, এত কষ্ট করে সে আসলো আর যে আসতে বলেছে তারই খোঁজ নেই। সে গাড়িতে একটা লাথি দিয়ে নিজের পা চেপে ধরলো। লাথি মারতে গিয়ে নিজেই পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।
-” আমি জানি আপনি ভেতরে আছেন। বের হবেন না তো? ঠিকাছে আপনি গাড়ির ভেতরই ঘোমটা দিয়ে বসে থাকুন। হুহ।!” বলে তুলতুল রাগ করে চলে যেতে নেয় আর তখনই গাড়ির দরজা খুট করে খুলে তাকে টেনে গাড়ির ভেতরে নিয়ে টাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। তুলতুল ভ্যাবাচেকা খায় এতে, কিন্তু রাফসানের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। তার চোখ গুলো কেমন লাল হয়ে রয়েছে, চুলগুলো মনে হচ্ছে নিজেই এলোমেলো করে ফেলেছে, গাড়ির ভেতর সিগারেটের গন্ধ, আর রাফসান তুলতুলের দিকে রাগ নিয়ে চেয়ে আছে। তুলতুল কিছু বলার আগে রাফসান তাকে সিটের সাথে লাগিয়ে তার গাল চেপে ধরে। তুলতুল ভড়কে যায় সাথে ভয় পায়। রাফসানকে এ দুইমাসে এমন ভাবে দেখেনি। আগে দেখেছে কিন্তু তার আজ ভয় করছে। চোখ ছলছল করছে। রাফসান হুংকার দিয়ে বলে
-” কে ছিল ওটা? হ্যাঁ? কার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটেছো? খুব ভালো লাগছিল তাই না? আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে আরেকজন হাত ধরে হাঁটা তাইনা? এত সাহস কোথা থেকে আসে?” রাফসান তুলতুলের গাল জোরে চেপে ধরেছে। তুলতুলের গালের হাড্ডি মনে হয় ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে এমন মনে হচ্ছে। আর রাফসানের কথা শুনে তার আরো কান্না আসছে। সে প্রান্তর সাথে তাকে দেখে সন্দেহ করছে? সে এবার জোরে কান্না করে দেয়। রাফসান তা দেখে গাড়িতে একটা ঘুষি মেরে। তুলতুলকে একটা ধমক দেয়।
-” চুপ! কান্না বন্ধ করো। আমি যেন একটু শব্দও আর না শুনি।” বলে হাত মুঠ করে চোখ বন্ধ করে। তারপর চোখ মেলে তুলতুলের দিকে না তাকিয়ে বলে
-” বের হও” তুলতুল কান্না থামিয়ে রাফসানের দিকে তাকায়। অভিমানে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তারপরও গাড়ির দরজা খুলে বের হওয়ার আগে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলে
-” ওটা প্রান্ত ভাইয়া ছিল! আপনি তার সাথে আমাকে সন্দেহ করলেন? ভালো, খুব ভালো। আপনিও ভালো থাকবেন। ” বলে নাক টেনে তুলতুল নামতে যায় আর রাফসান তাকে টেনে ধরে কাছে নিয়ে এসে ঝুঁকে দরজাটা আবার ঠাস করে লাগিয়ে গাড়ি লক করে দেয়। আর তুলতুলের দিকে তাকিয়ে আবার তার গাল চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে
-” তো প্রান্ত তোমার হাত কেন ধরবে? আর তুমিই বা তার হাত ধরে কেন চলবে?” তুলতুলের গাল এবার আস্তে ধরায় সে ব্যাথা পায় নি, কিন্তু রাফসানের কথায় অবাক হলো।
-” আজব! আমি আমার ভাইয়ের হাত ধরতে পারি না?” তুলতুলের কথায় রাফসান ভ্রু কুঁচকে বলে
-” ভাই? কোথাকার ভাই?”
-” কোথাকার ভাই মানে? আমার চাচাতো ভাই, তাও আপন চাচাতো ভাই। তো সে তার ছোট বোনের হাত ধরতে পারে না? কেউ একজন হাত ধরে আছে দেখলেই হলো তার সম্পর্কে না জেনে উল্টো পাল্টা ভেবে বসেন। আজব! কেন আপনি এটা জানতেন না প্রান্ত ভাইয়া আমার চাচার ছেলে?” তুলতুল ধমক দিয়ে বললো। রাগ হচ্ছে তার এখন। যদি রাফসানের সাথে এভাবে কখনো কথা বলে না। তুলতুলের জোরে কথা বলা দেখে রাফসান চোখ গরম করে বললো
-” সাহস বেড়েছে দেখছি। তো এমনি সময় এত কথা বলতে পারো আর প্রান্ত যে তোমার ভাই এটা বলতে পারো নি?”
-” আমি কি জানি আপনি এটা জানেন না?”
-” গুড, ভেরি ভেরি গুড!” বলে গাড়ি স্টার্ট দিল। আর তুলতুল চেচিয়ে বললো
-” এই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমি কোন গুন্ডার সাথে যাবো না। যে কিছু না জেনে শুনেই আমাকে বকা দেয়। নামিয়ে দিন, আপনিই তো বললেন চলে যাও। কি হলো শুনছেন না?”
-” নামাবো তো, এমন ভাবে নামাবো যেনো আর উঠতে না পারো। আর একটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেব। ভালো হবে না?” রাফসানের কথায় তুলতুল মুখ ফুলিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আর রাফসান কোন কথা না বলে গাড়ি চালাতে লাগলো। যদিও এমন করায় তার নিজেরও খারাপ লাগছে, বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছে। কিন্তু তুলতুল কোন ছেলের হাত ধরে আছে সেটা দেখেই তার রাগ উঠে গিয়েছিল। সেটা যে প্রান্ত ছিল তা সে দূর থেকে অতটা বুঝতে পারে নি। আর ভালো করে দেখেও নি চেহারা শুধু দেখেছে ছেলে তারওপর হাত ধরে আছে ব্যাস! তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুলতুলকে যখন প্রান্ত এসে হাত ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাফসান গাড়ি অনেকটা সামনে পার্ক করে। তুলতুল একবার পেছন দিকে একটু সময়ের জন্য তাকানোয় সে তুলতুলকে চিনতে পারে। কিন্তু প্রান্ত ততক্ষণে সামনে ফিরেছিলো বলে আর বুঝতে পারেনি। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে আর হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে ওখানেই গাড়ি লক রাগে ভেতরে বসে সিগারেট টানতে থাকে। আর অপেক্ষা করে দেখার জন্য যে তুলতুল আসে কিনা বা তার কথা মনে আছে কিনা? রাফসান জানতো না যে প্রান্ত তুলতুলের চাচাতো ভাই। কারন সে আর তিয়াস গ্যাংস্টার থাকলেও কখনো সে সামনে যায় নি। দলের সুবিধার্থে আড়ালেই কাজ করেছে। কিছুদিন আগে প্রান্তকে তুলতুলের সাথে রাফসান দেখলেও ভেবেছে হয়তো তিয়াসের দলের কেউ হবে সেজন্য তুলতুল তাকে ভাই বলে আর প্রান্ত তিয়াসকে। সে ভাবেনি যে প্রান্ত তুলতুলের চাচাতো ভাই হবে। সেজন্য সেদিন গাড়িতেও প্রান্তর সাথে তুলতুলকে দেখে তার রাগ হয়েছিল। আর আজকে যখন তুলতুল বললো তার সাথে প্রান্ত ছিল তাই তো সে তুলতুলকে ধমক দিয়েছে। কিন্তু ভাই বলায় শান্ত হয়েছে। রাফসান তুলতুলের দিকে তাকায়। মুখ ফুলিয়ে বসে আছে এখনো, বাইরে তাকিয়ে থাকার কারনে কাচে তার মুখের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। চোখ তার ছলছল করছে। গাল চেপে ধরায় গাল লাল হয়ে রয়েছে। ভুল হয়ে গিয়েছে তার দ্বারা। রাফসান তুলতুলের একটা হাত ধরে। কিন্তু তুলতুল অভিমানে তা ছাড়িয়ে নেয়।
রাফসান আবারও হাত টেনে ধরে কিন্তু তুলতুল জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। রাফসান এবার গাড়ি থামিয়ে তুলতুলকে টেনে কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু তুলতুল তাকায় না তার দিকে। সে তুলতুলের মুখ ধরে তার দিকে ফিরিয়ে ভারী স্বরে বলে
-” আমার দিকে তাকাও।” তুলতুল রাফসানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। রাফসান তুলতুলের গালে হাত বুলিয়ে বলে
-” সরি, এরপর থেকে না জেনে আর সন্দেহ করবো না।” একথায় তুলতুল বলে
-” যদি করেন?” রাফসান ভ্রু কুঁচকে বলে
-” তোমার আরো কতগুলো ভাই আছে নাকি? থাকলে আগে থেকেই বলে দাও যাতে পরবর্তীতে আর এমন না হয়।”
-” না নেই ” বলে তুলতুল ভেংচি কাটে। সেটা দেখে রাফসান বলে
-” এই তুমি ভেংচি কাটলে কেন? এরপরে যদি দেখি তাহলে…”
-” তাহলে?” তুলতুল রাফসানের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। আর রাফসান চোখ টিপ দিয়ে বলে
-” সেটা তখনই দেখিয়ে দেব।”
-” খারাপ লোক!” তুলতুল রাফসানের কাছ থেকে সরে গিয়ে বলে।
-” হুম, হুম অনেক খারাপ।” বলে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট করে। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা তুলতুলকে দেখে। তারপর একটু ঝুঁকে তুলতুলের লাল হয়ে যাওয়ার গালে টুপ করে ঠোঁট ছোয়ে তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে বসে গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। আর তুলতুল গালে স্পর্শ পেয়ে হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে রাফসানের দিকে তাকায়। বেখেয়ালে থাকায় ততটা বুঝতে পারে নি। রাফসানও কখনো এমন কিছু করেনি। তাহলে সে কি ভুল ভাবছে? মাঝে মাঝে কি সে পাগল হয়ে যায়? নাহলে এসব কেন হয় তার সাথে? এ লোক দেখি সোজা হয়ে একদম মুখ গম্ভীর করে গাড়ি চালাচ্ছে। এমন করার প্রশ্নই আসে না। তাহলে এটা কি শুধুই তার ভাবনা? সে টুকুর টুকুর চোখ করে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। তা বুঝতে পেরে রাফসান বলে
-” কিছু হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
-” নায়ায়া, কিছুই হয়নি হে হে হে।” তুলতুল হাবার মতো হেসে মাথায় গালে হাত বুলাতে বুলাতে সামনের দিকে তাকায়। আর রাফসান মিটমিট করে হাসে যা তুলতুলের দৃষ্টির অগোচরে রয়।
___________
গাড়ি থামিয়ে রাাফসান বের হয়ে তুলতুলের হাত ধরে নামায়। তুলতুল চারদিকে তাকায়। একটা ছোট পার্কের পাশে গাড়ি থামিয়েছে। সকাল দিকে হওয়ায় বেশি কেউ নেই পার্কের ভেতরে। সামনে একটা স্কুল মাঠ, তার ডানদিকে স্কুল রয়েছে। মাঠে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, হয়তো এখন টিফিন টাইম। কেউ কেউ আবার সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে বসে আছে। রাফসান তাকে এখানে কেন এনেছে? সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান তাকে দাঁড়াতে বলে গাড়ি লক করে কোথাও যায়। তুলতুল মাঠের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু বাচ্চারা বসে যেখানে খেলছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। সে দেখে পিচ্চি গুলো মার্বেল খেলছে, কতগুলো মার্বেল রাখা থাকে একজায়গায়, কেউ একজন তার ভেতরে যেকোন একটা মার্বেল মার্ক করে, মানে যে খেলবে তাকে অন্য একটা মার্বেল দিয়ে ওতগুলোর ভেতর সেই মার্ক করা মার্বেল টা তার হাতের টা দিয়ে মারতে হবে। তুলতুলের কাছে খেলাটা ভালো লাগলো। মার্বেল মারার সিস্টেম টা আলাদা। ডানহাতের মধ্যমা আঙুল দিয়ে মার্বেল ধরে আরেক হাতের তর্জনী দিয়ে মধ্যমা দিয়ে কিভাবে যেন টার্গেট করা মার্বেলটায় মারছে। সে দেখলো এবার আরেকটা পিচ্চির মার্বেল মারার পালা। সে টার্গেট ঠিক করে, তারপর হাতে আরেকটা মার্বেল নিয়ে ঠিক করে মারার জন্য। তুলতুল একদৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তার ধ্যান অন্য কোনো দিকে নেই। ছেলেটা হাতের আঙুল টেনে মার্বেলে লাগায়। আর তুলতুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মার্বেলটা যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মার্বেলটা সরাসরি গিয়ে টার্গেট করা মার্বেলটায় লাগে আর তুলতুল ইয়াহু বলে লাফ দিয়ে ওঠে। এতে বাচ্চাগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পেছনে ফিরে তুলতুলের দিকে তাকায়। তুলতুল তাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে পেছনে ফিরে দেখে রাফসান তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে সে দাঁত বের করে হেসে বলে
-” কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?” তখন নজর যায় রাফসানের পাশে রাখা সাইকেলের দিকে। তুলতুল খুশি হয়ে বলে
-” কোথায় পেলেন এটা? আমরা কি সাইকেলে উঠবো এখন?” রাফসান উত্তর না দিয়ে তার নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে ফেলে, তা দেখে তুলতুল রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান সেটা এনে তুলতুলের কোমরে সামনে থেকে বেঁধে দেয়। আর তুলতুল বলে
-” আপনি এটা আমাকে এমন আজব ভাবে পড়াচ্ছেন কেন? কেমন লাগছে যেন।”
-” ঠিক আছে, কেমন লাগছে না। ” বলে সামনের বেঞ্চে বসা লোকটার দিকে চোখ গরম করে তাকায়। যে তুলতুলের দিকে কুনজরে তাকিয়ে ছিল। আর সাইকেলে বসলে জামা উড়ে সরে যাবে দেখে সে জ্যাকেট বেঁধে দিয়েছে। রাফসান তুলতুলের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তারপর সাইকেলে উঠে তুলতুলকে উঠতে বলে। তুলতুল উঠে বসে রাফসানের কোমরের দিকের শার্ট দুইহাতে শক্ত করে ধরে।
-” শক্ত করে ধরে বসেছো?”
-” হুম”
-” ওড়ানা আর জামা ঠিক করে গুছিয়ে রাখো, নাহলে চাকায় বেঁধে যাবে।”
-” ঠিক আছে। ” তুলতুলের কথায় রাফসানে সাইকেল চালাতে শুরু করে। এসব শুরু থেকে বাইকে বসে পর্যবেক্ষণ করছিল তিয়াস। রাফসান আর তুলতুলের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে সে অবগত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিছু না বলে সে চুপচাপ বাইক ঘুরিয়ে চলে যায়।
সাইকেল চলছে একটা নীরব রাস্তা দিয়ে। চারপাশে গাছপালা থাকায় রাস্তাটিতে রোদের আলো আসছে না। কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। বাতাসে তুলতুলের সামনে চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। সে চোখ বন্ধ করে রয়েছে, মুখে একচিলতে হাসি। রাফসান একবার পেছনে ফিরে তা দেখলো, সে নিজেও মুচকি হাসে। রাফসান সাইকেল থামিয়েছ অনেকক্ষণ। কিছু বলবে বলে তুলতুলকে। কিন্তু এখনো বলছে না। তুলতুলের দৃষ্টি সামনে নদীর দিকে। তারা নদীর পাড়ের অনেকটা সামনে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা সুন্দর অনেক। তুলতুলের ভালো লাগছে অনেক। বাতাসে তুলতুলের ওড়না উড়ছে।
-” জায়গাটা সুন্দর অনেক।” তুলতুল বললো।
-” মন খারাপ হলে আমি এখানে চলে আসি। নিরিবিলি প্রাকৃতিক জায়গায় এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়।” রাফসানের কথায় তুলতুল হাসলো। রাফসান একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বলে
-“তুলতুল ”
-” হুম” তুলতুল রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসান তুলতুলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।
-” তোমাকে আমার কিছু জানানোর আছে। জানিনা সেটা জানলে তুমি আদোও আমাকে ভালোবাসবে কিনা। কিন্তু তোমার সত্যিটা জানা দরকার। আমি কোন কিছু লুকিয়ে সম্পর্ক করতে চাই না। সব পানির মত পরিষ্কার হওয়া দরকার। যাতে কোন ঝড় আসলেও কখনো ভেঙে না যায়।” রাফসান একবারে বলে নিঃশ্বাস নেয়। তুলতুলের বুকের ভেতর ধুকপুক করছে, কি এমন বলবে রাফসান যাতে সে নিজেই নার্ভাস হয়ে গেছে? রাফসান তুলতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে
-” তুলতুল আমি তোমার..” সে আর বলতে পারে না ফোনের শব্দে। এসময় ফোন আসায় রাফসান বিরক্ত হলো। সে ফোন বের করে দেখে আবির ফোন দিয়েছে। ভাবলো ফোন রিসিভ করে কয়েকটটা ঝাড়ি দিবে। সে ফোন রিসিভ করে ঝারি দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে আবির উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠে
-” ভাই দাদী এক্সিডেন্ট করেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন। আমি ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি। রাখছি!” আবিরে কথা শুনে রাফসান স্তব্ধ হয়ে যায়। তুলতুল কাছে থাকায় সেও শুনতে পায়। তুলতুল ভীতু ভাবে রাফসানের মুখের দিকে তাকায়।
চলবে….