মেঘের পালক পর্ব -১৩ ও শেষ

#মেঘের_পালক
পর্ব-১৩ (শেষ পর্ব)

রাত বারোটার পাঁচ মিনিট আগে কথাবার্তার শব্দ শুনে উঠে পড়ল অরিন। তার ঘুমই আসেনি চোখে। এদিকে মা পাশে শুয়ে ঘুমে কাদা হয়ে আছে৷

অরিন উঠে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হলো। হলঘরের কাছে গিয়ে দেখল ইনায়ার জন্মদিন পালন হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা সবাই আছে সেখানে। এমনকি হুমায়রাও। তাহলে তাকে কেন ডাকল না? প্লাবন আয়োজন করেছে নিশ্চিয়ই! যেভাবে ওই মেয়ের ছবিতে হার্ট রিয়েকশন দিচ্ছিল!

আইডির নামটা দেখে নিয়েছিল অরিন৷ নিজে বের করে দেখে মেয়েটা চূড়ান্ত রকমের নির্লজ্জ। গাদা গাদা মেকআপ আর ঢঙ্গী অঙ্গভঙ্গি। কিছু কিছু ছবি অশ্লীলও মনে হয়েছে। প্লাবনের জন্য খারাপ লাগছে। সে তো ছেলে ভালো, তার সাথে মেলেনি ঠিক আছে, তাই বলে এমন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়বে?

রাতে ভালো ঘুম হলো না অরিনের। ভোরে উঠে পড়ল সবাই। যাবে টিপিটিলা নামক ছোটো একটা পাহাড়ে। সহজে উঠতে পারবে ওটাতে সবাই। ওখানে সুন্দর একটা ঝর্ণাও আছে। আছে অতিথিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা।

সবার সাথে চলল অরিন। তার মুখ কালো হয়ে আছে এটা অনেকেই খেয়াল করেছে৷ জিজ্ঞেস করেছে কেউ কেউ। উত্তর দেয়নি সে। ইনায়াকে দেখা গেল হাই তুলছে। হুমায়রা অরিনের কাছ ঘেঁষার চেষ্টা করে সুবিধা করতে না পেরে স্বাধীনের সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছে। আর প্লাবন কোথায় আছে সেটা জানার চেষ্টাও করেনি অরিন।

সে পাহাড়ের সৌন্দর্যে মন দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু সব কেমন অদ্ভুত রকমের বিষন্ন আর নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে যেসব পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে তারাও যেন দুঃখের গান শোনাচ্ছে! অরিনের মন খারাপ বাড়ছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে।

বিশাল দলটা পাহাড়ের মাথায় পৌঁছুল বেলা বারোটায়৷ খুবই ধীর ছিল গতি৷ নয়তো এই ছোটো পাহাড়ে উঠতে এক ঘন্টাও লাগার কথা নয়।

গিয়ে তারা দেখল ব্যবস্থা দারুণ! বেশ ভালো খাবারের দোকান আছে। যদিও দাম বেশি৷ কয়েকটা ছোটো ছোটো বসার গোল ছাউনি আছে। বুনোফুলের সমারোহ দেখে মনে হলো এগুলো লাগানো হয়েছে। প্রতিটা ছাউনির ওপর বাগানবিলাসও দেখা গেল।

চারদিকের দৃশ্যই মন ভরানো। একধারে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। অন্য তিনদিকে খোলা প্রান্তর। ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া অজস্র গাছের সারি। দূর পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা মেঘ। আর ঝকঝকে গাঢ় নীল আকাশ! পিকনিকের জন্য একেবারে উপযুক্ত।

বড়রা হাত পা ছড়িয়ে বসে গেল গল্প করতে। কয়েকজন গ্রুপ ফটো তুলছে৷ একা একা ছবি তুলছে ইনায়া৷ আজ তার ফটোগ্রাফার কোথায়? চারদিকে খুঁজল অরিন। পেল না প্লাবনকে। গেল কোথায়?

অরিনের রাগ এখন কমে গেছে। একটু আগেই সে হুমায়রার কাছে জানতে পেরেছে রাতে কেকের আয়োজন প্লাবন করেনি, করেছে স্বাধীন।

হঠাৎ প্লাবনকে দেখতে পেল সে। দূরে ঝোপের পাশে বসে আছে। অরিনের খুব ইচ্ছে হলো তার সাথে একটু কথা বলতে। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বসতে পারি?”

প্লাবন চোখ তুলে চাইল। বলল, “হুম।”

অরিন বসল। জিজ্ঞেস করল, “আপনার মন খারাপ?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“জানি না। তোমারও মন খারাপ?”

“হুম।”

“কেন?”

“জানি না।”

“অরিন আমাদের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। যা হয়েছে তাতে কারোই দোষ ছিল না। তাহলে আমরা কেন এই ভুল বোঝাবুঝির বোঝা টানছি বলতে পারো?”

“আপনি বোকার মতো কাজকর্ম করবেন কেন?”

“আমি কোন কাজটা বোকার মতো করেছি?”

“সেই যে প্রপোজ করা থেকে গতকালকের ইনায়ার সাথে রঙঢঙ করা, সবটাই বোকামি।”

“তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ কী হতো?”

“সুস্থ ব্যবহার করা।”

প্লাবন বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার সাথে সত্যি আমার ম্যাচ করবে না অরিন। তুমি সারাজীবন আমার কাজের ভুল ধরবে, আর রাগ করে বসে থাকবে। সংসার করতে আন্ডারস্ট্যান্ডিং লাগে আসলে। আমরা আলাদাই থাকি৷ সেটাই ভালো।”

প্লাবন চলে গেল। অরিনের চোখে পানি চলে এলো। কেন সেধে কথা বলতে এলো? নিজেকে খুব নির্লজ্জ মনে হচ্ছে!

পাহাড় থেকে নেমে বাংলোতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হাতমুখ ধুয়ে সবাই চায়ের আসরে বসল। আজও অরিন গেল না সেখানে। রাতে খেতে আসার সময়ও কারও সাথে কথা বলল না৷ হুমায়রা তার পাশে বসে বকবক করল কিছুক্ষণ। শেষে যাওয়ার আগে বলল, “ইনায়া নাকি আজকে রাত বারোটায় প্লাবনকে প্রপোজ করবে। চুমুও খাবে। আমাদের থাকতে বলেছে। তুমি থাকবে?”

অরিন কোনো কথা না বলে কটমট করে একবার হুমায়রার দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সেই ছেলের অন্য কারো হতেই হবে। হোক না! তার চোখের সামনে কেন?

রাত বারোটায় আর থাকতে পারল না অরিন। উঠে পড়ল। মা আগেই বেরিয়ে গেছেন৷ তারা বান্ধবীরা আজকে লেট নাইট পার্টি করবে, যাতে ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত নয়৷ কী আজব একেকজন!

অরিনের দমবন্ধ লাগছে। সে পারবে না প্লাবনকে এত সহজে হাতছাড়া করতে। এতদিন চোখের আড়াল ছিল, মন থেকেও তাই মেনে নেয়া গেছে। মাঝে অজস্রবার প্লাবনকে ফোন করতে গিয়েও থেমে গেছে। মনে হয়েছে থাক! যেখানে থাক, ভালো থাক। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না৷ অন্তত ইনায়ার মতো একটা মেয়ের সাথে প্লাবনকে মেনে নিতে সে পারবেই না!

হলঘরে ঢুকে অবাক হয়ে অরিন দেখল পুরো অন্ধকার। মায়েরা বলেছে তাদের পার্টি হবে উঠানে। অথচ সেখানেও সাড়াশব্দ, আলো কিছুই নেই। সব গেল কোথায়? মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সে একাই আছে। আর আছে কানে তালা লাগানো অসংখ্য ঝিঁঝি পোকার সম্মিলিত ডাক।

অরিন ভয়ে ভয়ে বলল, “কেউ আছেন?”

গলা দিয়ে জোরে স্বর বের হলো না। সে দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো?

পায়ে পায়ে হলঘরের ভেতরে ঢুকল সে। সুইচের কাছে পৌঁছে হাতড়ে আলো জ্বালল। আলোর বন্যায় ভেসে গেল হলঘর। সাথে সবার হাসির শব্দ। সবাই হলঘরেই ঘাপটি মেরে ছিল! মানে কী এসবের?

প্লাবন সবার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা সে হেঁটে অরিনের কাছে চলে এলো। হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তুমি জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে বিয়ে করবে?”

অরিন বিষ্ময়ে হতবার হয়ে গেল। কল্পনাও করেনি এমন হতে পারে! সে সরে যেতে চাইলে প্লাবন তার হাত টেনে ধরে বলল, “উহু, পালিয়ে গেলে চলবে না! উত্তর দিতে হবে!”

অরিন লজ্জা পেয়ে চারিদকে তাকাল। মায়েরাও খুশি৷ কী আজব! এই ছেলেমানুষীতে তারা খুশি?

প্লাবনের মা এগিয়ে এসে বললেন, “তোমাকে আমার ভারি পছন্দ মা। সেদিন বিয়েতে দেখলাম, তখন থেকে। প্লাবনকে বলতেই সে লাফিয়ে উঠে বলল তোমাকে নাকি সে আগে থেকেই পছন্দ করে। বুঝলাম এতদিন এত মেয়ে দেখেও কেন পছন্দ হয়নি তার।”

অরিনের মা বললেন, “আমারও দায়িত্ব মেয়েটাকে ভালো ছেলের হাতে তুলে দেয়া। প্লাবনের মতো ছেলে আর পাব কোথায়?”

প্লাবনের হাতে একটা আংটি ছিল। অরিনের চুপ থাকায় মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে সেটা পরিয়ে দিল তার হাতে।

সবাই একযোগে হাততালি দিয়ে উঠল। বাইরে সে সময় বাজি পোড়ানো হলো। নয়ন আর নবীন এই কাজ করছে।

অরিন দেখল ইনায়া আর স্বাধীন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে। এর মানে কী? হুমায়রা তখন ওর পাশে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “স্যরি, প্লাবনের কথায় তোমাকে মিথ্যে বলেছি। ওর প্ল্যানের অংশ ছিল সব। ইনায়া আসলেই প্রপোজ করেছে, কিন্তু সেটা স্বাধীন ভাইয়াকে।”

অরিন আরও ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “চুমু খেয়েছে?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কারো সামনে না।”

“যাক ভালো!”

হুমায়রা হেসে চলে গেল।

প্লাবন এখনো তার ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। অরিন নিচু গলায় বলল, “বিয়ের পর খুব ঝগড়া করবে?”

প্লাবন চোখ টিপে বলল, “তা তো করবই। কিন্তু করার পর আলমারি তালা দিয়ে রাখব। যাতে বাপের বাড়ি চলে যেতে না পারো। আমার সাথেই সারাক্ষণ থাকবে, আর ঝগড়া করবে। এক বছর কথা না বলার জন্য বিয়ের পর এক বছর বাপের বাড়ি যেতে পারবে না।”

“ইশ! বললেই হলো? তুমিও তো যোগাযোগ করোনি।”

“হ্যাঁ, আমিও বাপের বাড়ি যাব না।”

“মানে কী? তুমি তো বাপের বাড়িতেই থাকো।”

“তো সেটা আমার ফ্যাসিলিটি! কিছু তো করার নেই!”

“ফাজিল কোথাকার!”

“সেইম টু ইউ!”

অরিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল৷ জীবনটা ভালো কাটবে না খারাপ সে জানে না। সব মানুষের জীবনেই ওঠাপড়া থাকে, থাকবেই৷ সাথের মানুষটা মনের মানুষ হলে হয়তো জীবনের পথ পাড়ি দেয়া অনেকটা সহজ হয়ে যাবে! প্রিয় মানুষটার মুখ দেখলে হয়তো কঠিন সময়ও মেঘের পালকের মতো হালকা হয়ে যাবে!

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here