যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ
~মিহি
১৪.
নয়ন আজ চলে যাবে। এই কয়েকটা দিন নাটক করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে সন্ধি। মনের বিরুদ্ধে কী করে কারো সাথে ভালো থাকার অভিনয় করা যায়? সন্ধির বড় মামা জমি বিক্রির টাকা পাঠিয়েছেন। এ নিয়ে নয়ন ও রামিলা পারভীনের মধ্যে অনেকটা মন কষাকষিও হয়েছে। রামিলা চাচ্ছেন নয়ন এ টাকা থেকে ব্যবসা করবে কিন্তু নয়ন টাকাটা সন্ধির হাতে তুলে দিয়েছে। এ কারণবশত তিনি সন্ধির উপরেও বেশ ক্ষেপে আছেন। তবে ছেলে চলে গেলেই যে তিনি টাকাগুলো নিজের সিন্দুকে ভরবেন তা বুঝতে বাকি নেই সন্ধির। সেজন্যই সন্ধি ঠিক করে রেখেছে আজ রাতেই এ বাড়ি ছেড়ে পালাবে সে। টাকাগুলো সাথে আছে, কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।
সকাল দশটার ফ্লাইট। বেশ ভোরবেলা উঠেছে নয়ন। মায়ের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে সন্ধির কাছে এলো সে। সন্ধি নয়নকে দেখেই ঘর ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা করল।
– ‘পালাতে চাচ্ছো সন্ধি?’
– ‘সে তো কবে থেকেই চাচ্ছি। আপনিই তো বেঁধেছেন এক জালে।’
– ‘আমি খুব শীঘ্রই চলে আসবো। নিজের খেয়াল রেখো। সামনে পরীক্ষা। মন দিয়ে পড়ো।’
– ‘আপনাকে আসতে বলছে কে? আসার দরকার কী?’
– ‘আচ্ছা আসবো না।’
নয়ন কথা বলতেই লাগল, সন্ধি শুনলো চুপচাপ। কিছু বলার ইচ্ছে নেই তার। নয়ন মানুষ হিসেবে ভালো তা সে বুঝেছে কিন্তু মাহিদের জায়গা সে যে কখনোই নিতে পারবে না। তাছাড়া নয়ন চলে যাওয়ার পর তার পড়াশোনা থেমে যাবে এটা সে নিশ্চিত। সুতরাং নিজের ভালোর জন্য সন্ধির স্বার্থপর হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
নয়ন মা ও সন্ধির থেকে বিদায় নিয়ে প্রস্থান করলো। নয়ন বের হতেই রামিলা পারভীন রূক্ষা স্বরে ডাকলেন সন্ধিকে। সন্ধি স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এমন একটা রুক্ষ স্বরের নিষেধাজ্ঞা যে তার কপালে জুটবে তা সে আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিল কিন্তু এত দ্রুত সে ধারণা ফলে যাবে তা ভাবেনি সন্ধি। মাথা উঁচু করে রামিলা পারভীনের ঘরে পা রাখলো সন্ধি। রামিলা পারভীনের চোখ বরাবরে চোখ রাখল।
– ‘স্কুল যাচ্ছো? আজ যেতে হবে না। পরীক্ষাগুলো দিও শুধু। এখন সংসারের কাজ শেখো। ছেলে তো এবার একেবারে ফিরবে। তখন তার যাবতীয় কাজ তো তোমাকেই করতে হবে।’
– ‘আমি কি ফ্রি’র কাজের মেয়ে? একে তো আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে। আমার ভালোমানুষির সুযোগ নিলেন আপনি আর আপনার বোন। এখন যদি আমি আপনার নামে বাল্যবিবাহের মামলা করি? কী হবে ভাবতে পারছেন? আমাকে সহজ সরল ভাববেন না। যা করেছি এতদিন, যথেষ্ট করেছি। মামার দেওয়া টাকায় নিজের লোলুপ দৃষ্টি না ফেলে আমার টাকা আমায় রাখতে দিন। আর তালাক আমি নিচ্ছিনা এটা ভাবার ভুল তো করবেনই না। আমি আজই যাবো চাচার কাছে। সত্যিটা জানাবো তাকে।’
– ‘ওরে মুখপুড়ী! তোর এতো সাহস? তোকে এজন্য আনছি আমি? খাল কেটে কুমির আনছি আসলেই। তোকে তো…’
কথা শেষ না করেই রামিলা পারভীন গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরোলেন। সন্ধি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলেন তিনি। খালার এহেন আচরণে বিস্মিত হলো সন্ধি। দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। বিশেষ কোন সুবিধা হলো না। অপর পাশ থেকে কেবল রামিলা পারভীনের উচ্চহাসির শব্দ শুনতে পেল। ভীতি ঢুকে গেল সন্ধির মনে। রামিলা পারভীন কি তাকে ঘরবন্দি করে রাখতে চান? আরো কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে চেঁচাতে থাকল সন্ধি। তাতেও কোন ভাবান্তর ঘটলো না তার খালার। একসময় ক্লান্ত হয়ে দরজার পাশেই বসে পড়ল সন্ধি।
___________________________
মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে মাহিদ। এক দিনে পুরো পৃথিবী এলোমেলো হওয়া কি সম্ভব? মাহিদের মনে হচ্ছে এই অসম্ভব বস্তুটাই ঘটেছে তার সাথে। কাজ শেষ করে গ্রামে ফিরতে চেয়েছিল মাহিদ কিন্তু হঠাৎ চাচাজান নেহার পরিবারসহ আসেন তার বাড়িতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেহার সাথে তার বাগদান অনুষ্ঠান ঘোষণা করেন ঐ দিনই। মাহিদ কল্পনাতেও আনেনি এসব। সরাসরি চাচাজানকে না করে দেয় সে কিন্তু এর বিপরীতে যা শোনে তার জন্য কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না সে। চাচাজান বেশ শান্ত স্বরেই বলেন, ‘যে সন্ধির জন্য নেহাকে প্রত্যাখ্যান করছো, সে বিয়ে করে ফেলেছে। তার মাকে নিয়ে এখন সারা গ্রামে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। আশা করি তুমি একটা বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে প্রণয় পুষবে না মনে।’ চাচাজানের এই কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারেনি মাহিদ। চাচাজান যে মিথ্যে বলার মানুষ না তা ভালো করেই জানে মাহিদ কিন্তু এই বাগদান করা সম্ভব না মাহিদের। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মাহিদ। নেহার পরিবারের সাথে সরাসরি কথা বলবে সে। তারপর সন্ধির শ্বশুড়বাড়িতে যাবে। সন্ধির সাথে কথা বলাটা খুব দরকার মাহিদের জন্য।
‘ নেহাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না, সেখানে বাগদানেরও কোনো প্রয়োজন নেই।’ মাহিদের কথায় একজোড়া ক্রুব্ধ দৃষ্টি এসে পড়ে তার উপর। নেহার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় মুহূর্তেই। মাহিদ বেশ সাবলীলভাবেই কথাটা বলে। এর বেশি কিছুই বলে না। নেহার পরিবার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফিরে যায়। চাচাজানও বেশ লজ্জিত তাদের কাছে। মাহিদের আচরণে তিনি যে প্রচণ্ড রাগ করেছেন তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হলো। বাড়িতে আর কোনো বাড়তি কথা হলো না। মাহিদের বাবা মা নেহার জন্য অনুশোচনা অনুভব করছেন অথচ মাহিদের মনের উপর দিয়ে যে কী যাচ্ছে তা বিন্দুমাত্র ধারণাতেও নেই তাদের।
________________
বাইরের কান্নার আওয়াজ বেশ স্পষ্ট কানে আসছে সন্ধির কিন্তু কান্নার কারণ অনুধাবন করতে পারছে না সে। কোনো এক মানুষের কান্নার শব্দ নয়, বেশ কয়েকজন মহিলা একযোগে কাঁদছেন বাইরে। শেষ চেষ্টা হিসেবে বারকয়েক দরজা ধাক্কাল সন্ধি। এক মহিলা এসে দরজা খুললেন। অনেকক্ষণ ঘরে বন্দি থাকায় চিন্তায় সন্ধির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। আচমকা সামনের মহিলাটি সন্ধিকে জড়িয়ে ধরে মরাকান্না জুড়লেন। সন্ধি মহিলাটিকে চিনলো না। অপরিচিত কেউ তাকে জড়িয়ে কাঁদছে বিষয়টা বিব্রতকর লাগছে তার। মহিলাটি সন্ধিকে নিয়ে দরজার সম্মুখে আনলেন। রামিলা পারভীনের সামনে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ রাখা। তিনি চিৎকার করে কাঁদছেন আর পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন। সন্ধির পাশে থাকা মহিলাটা রামিলাকে ধরলেন। কান্না করতে করতেই বললেন, ‘ আপা, সামলাতে হবে নিজেকে। নয়ন তো আর ফিরবে না।’ নয়নের নাম শুনেই কেঁপে উঠল সন্ধি। আতঙ্কে কয়েক পা পিছিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। কানের কাছে ঝনঝন করে বেজে উঠলো নয়নের সকালে বলা কথাটা, ‘আচ্ছা আর আসবো না।’ সন্ধির অবস্থা দেখে সবাই হাহুতাশ করতে লাগল কিন্তু রামিলা এসে সন্ধির উপর হাত তুলতে লাগলেন। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘এই ডাইনীটা খেয়েছে আমার ছেলেকে। ওর জন্য আমার ছেলে মরেছে আজ। এ অপয়াটারে কেন ঘরে এনেছিলাম আমি? আল্লাহ গো! ও ভাবী, ঐ মেয়েকে সরাও! সরাও আমার সামনে থেকে।’ ভদ্রমহিলা এসে সন্ধিকে ঘরে নিয়ে এলেন।
– ‘আমায় হয়তো চিনতে পারোনি সন্ধি। আমি তোমার মামী।’
– ‘মামী, নয়ন ভাই সকালেও ভালো ছিলেন। হঠাৎ …’
– ‘যাওয়ার পথে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়েছিল ওর রিক্সাটাকে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায় ছেলেটা।’
সন্ধির মুখের রঙ বদলে গেছে। প্রচণ্ড অনুতাপ হচ্ছে মনের ভেতর। কেন সে বলতে গেল নয়নকে আর না আসতে? যাওয়ার পথে এমন কথা না বললেও পারত। নয়নকে সে ভালোবাসেনি ঠিকই কিন্তু তাই বলে নয়নের মৃত্যু কামনা করেনি তো সে। এত বড় অঘটন কেন ঘটলো তার জীবনে? সে তো একটা স্বাভাবিকতা মুক্তি চেয়েছিল। নয়নের রক্তের রঞ্জিত হয়ে সাদা শাড়ি গায়ে জড়ানোর মুক্তি তো চায়নি সে। তবে কেন এমন হলো তার সাথে?
চলবে..