রংধনুর রঙ কালো পর্ব শেষ

#রংধনুর_রঙ_কালো
শেষপর্ব

হসপিটালের করিডোরে অরিনকে দেখা মাত্রই অন্বয় ছুটে গেল কথা বলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অরিন তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে দ্রুতবেগে হেঁটে চলে গেল সামনে। অন্বয় না পারতে বলল,” মিসেস অরিন থামুন।”
অরিন এক মুহুর্তের জন্য থেমে একবার বাঁকা চোখে তাকালো অন্বয়ের দিকে। এই মানুষটিকে সে ঘৃণা করে। শুধুমাত্র এই মানুষটির জন্য তার বাবার মতো শ্বশুর তার প্রতি ভুল ধারণা নিয়ে মারা গেছেন। শাশুড়ীমা মুখ তুলে তাকাচ্ছেন না তার দিকে। সাদিকাকেও তিনি ঘৃণ্য চোখে দেখছেন। অন্বয় এতোবড় মিথ্যাচার করেছে। অরিনকে ধোকা দিয়েছে। তবুও কি অরিনের উচিৎ তার সাথে কথা বলা? অন্বয় কাছে এসে বলল,” কেমন আছেন অরিন? আপনাকে আমি কখন থেকে খুঁজছি।”
” কেনো খুঁজছেন আমাকে?”
অরিনের কঠিন প্রশ্ন শুনে অন্বয় একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” এমনি। কথা বলার জন্য।”
” আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”
অরিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে লাগল। অন্বয় তার পিছু নিল। নামতে নামতে বলল,
” আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
আশেপাশের মানুষ তাদের আঁড়চোখে দেখছে। অরিন কড়াদৃষ্টি নিক্ষেপ করল অন্বয়ের উপর। অন্বয় সহজ গলায় বলল,” চলুন ক্যান্টিনে বসি। কফি?”
তারপর সুন্দর করে হাসলো। অরিনের গাঁ জ্বলে উঠল আক্রোশে। সে হনহন করে নিচে নামতে লাগল। অন্বয় বলল,” আপনি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছেন? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
” আবার জিজ্ঞেস করছেন কিভাবে? আপনি জানেন না আপনি কি ভুল করেছেন?”
অন্বয় একটু ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা, চলুন আমরা কোথাও বসি। তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলি? প্লিজ।”
অরিন এই পর্যায়ে রাজি হলো। অন্বয় তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে এলো। দুইকাপ কফি অর্ডার করার পর কালো শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে সে বলল,
” এখন বলুন। কি হয়েছে?”
” আপনি আমার শ্বশুরবাড়িতে আমার নামে মিথ্যে কেনো রটিয়েছেন? সাদিকা বুঝি আপনার মেয়ে? আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য ইলহানকে ডিভোর্স দিয়েছি? আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল? এতোবড় নোংরা কথা আপনি আমার নামে ছড়াতে পারলেন? আপনাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আপনি কোনো মূল্য রাখলেন না সেই বিশ্বাসের। বাবা মরে গেল ভুল ধারণা নিয়েই৷ মা আমাকে ঘৃণা করছেন। সাদিকাকে পর্যন্ত দুই চোখে দেখতে পারছেন না। আপনাকে আমি কোনোদিন মাফ করবো না অন্বয়সাহেব।”
অন্বয় এতোগুলো কথা একসাথে শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো বলল,
” দাঁড়ান, দাঁড়ান। এইখানে কিছু একটা ভুল হচ্ছে। আমি যা করেছি আপনার ভালোর জন্যই করেছি অরিন।”
অরিন রাগে ফুঁসে উঠলো,” ভালো? এইখানে আমার কোন ভালোটা দেখতে পেলেন আপনি? সবার চোখে আমি খারাপ হয়ে গেলাম৷ এইখানে আমার ভালো?”
” কারো চোখে খারাপ-ভালো হওয়াটা মূল বিষয় না। মূল বিষয় হলো আপনি সুখে আছেন কি-না। আপনি নিজে সুখী থাকলে অন্যমানুষ যা ইচ্ছা ভাবুক। কিছু যায় আসা উচিৎ না।”
” তাই বলে সবাই আমাকে নিয়ে খারাপ ভাববে এটা আমি কেনো চাইবো? আপনি আসলে প্রতিশোধ নিয়েছেন তাই না? আপনাকে বিয়ে করতে আমি রিজেক্ট করেছিলাম সেই প্রতিশোধ। ”
অন্বয় আহত কণ্ঠে বলল,” আপনি আমাকে এতো নিকৃষ্ট মনে করেন?”
” আপনি নিকৃষ্টই।”
” শুনুন অরিন, আমি কখনও চাইনি ইলহান আপনার জীবনে আবার ফিরে আসুক। আপনি যেখানেই যেতেন ইলহান আপনাকে কোনো না কোনোভাবে বিরক্ত করতো। সে আপনাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। শুধুমাত্র এই কারণেই আমি মিথ্যেটা বলেছিলাম৷ যাতে ইলহান আপনাকে আর বিরক্ত না করে। আর সাদিকার কথা যদি ইলহান জানতে পারতো তাহলে কি সেটা আপনার জন্য ভালো হতো? আপনিই বলুন। সে কিন্তু সাদিকাকে আপনার থেকে নিয়ে যেতে চাইতো। বাবা হিসেবে সেই অধিকার তার ছিল।”
অরিন ভ্রু কুচকে তাকাল অন্বয়ের দিকে। অন্বয় বলল,” আমি সবসময় চেয়েছি আপনি ভালো থাকুন। কিন্তু সেটা ইলহানকে ছাড়া।”
” কিন্তু আপনি আমাকে না জানিয়ে এতোবড় মিথ্যে কেনো বলবেন?”
” ভুল আমার হয়েছে আমি জানি। কিন্তু সেই ভুলের পেছনের উদ্দেশ্যটা সঠিক ছিল।”
অন্বয় একদিক থেকে ঠিকই বলেছে। সে যদি এই মিথ্যে না বলতো তাহলে এতোদিন সাদিকাকে নিয়ে অরিন নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারতো না। কিন্তু তবুও অন্বয় যেটা করেছে সেটা ভুল। অবশ্যই অন্যায়। অরিন উঠে যাচ্ছিল। অন্বয় বলল,” দাঁড়ান অরিন, আমার কথা শেষ হয়নি।”
অরিন আবার বসল। গম্ভীর গলায় বলল,” জলদি শেষ করুন।”
অন্বয় মাথা নিচু করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল। ভেতর থেকে অপরাধবোধে সে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ইলহানের অবস্থা মরণাপন্ন। বাঁচার আশংকা নেই বলাই চলে। যে মানুষটা বাঁচবেই না সেই মানুষটাকে নিয়ে অরিনের মনে কোনো ভুল ধারণা থাকা উচিৎ না। তাছাড়া অরিনকে সে কোনোকালেই পাবে না। পাঁচবছরে অন্তত এইটুকু বোঝা হয়ে গেছে। ইলহানের মৃত্যুর আগে অরিনকে একটা সত্যি জানানো উচিৎ। আসলেই উচিৎ। নাহলে অন্বয় নিজেই নিজেকে মাফ করতে পারবে না হয়তো। অরিন প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার? কথা বলছেন না যে?”
অন্বয় শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” আমি আপনাকে একটা কথা বলবো যদি রাগ না করেন।”
” আগে বলুন।”
” সেইদিন ইলহান সোফিয়ার সাথে কিছু করেনি। ভিডিও ক্লিপে আপনি যেটা দেখেছিলেন সেটা মিথ্যে ছিল।”
” মানে?”
অরিন তৎক্ষণাৎ ধরতে পারল না কথাটা। অন্বয় আবার বলল,” পাঁচবছর আগের কথা বলছি। পরদিন আমরা এপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে এসেছিলাম। মনে আছে?”
অরিন উদ্দীপনা নিয়ে বলল,” ইলহান সোফিয়ার সাথে কিছু করেনি বলতে?”
” মানে ল্যাপটপে আপনি যেটা দেখেছিলেন সেটা ঠিক ছিল না।”
” আমি ভুল দেখেছিলাম?”
“না, একদিক থেকে ঠিকই দেখেছিলেন। কিন্তু বুঝেছেন ভুল। বলতে কি, আমরাই ভুল বুঝিয়েছিলাম আপনাকে।ওই ভিডিওটা ওইদিন রাতের ভিডিও ছিল না। অনেক আগের ভিডিও ছিল। সোফিয়া আমাকে ভিডিওটা ই-মেইলে পাঠিয়েছিল।”
” কেন পাঠিয়েছিল?”
” কারণ ইলহান যদি সোফিয়ার প্রস্তাবে রাজি না হয় তাহলে যেনো ব্যাকাপ হিসেবে আপনাকে ওই ভিডিওটা দেখানো যায়।”
” এর মানে কি?”
” মানে সেদিন ইলহান সোফিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু এই কথা আপনাকে জানালে আপনি ইলহানকে ক্ষমা করে আবার তার কাছেই ফিরে যেতেন। আমি বা সোফিয়া কেউই এটা চাইনি কখনও। ইলহানের সাথে আপনার সম্পর্কের পুনরুত্থান আমি মানতে পারছিলাম না।”
” মানে আপনি ইলহানকে হিংসা করতেন?”
অন্বয় হাসলো।
” হিংসা করার কি যথেষ্ট কারণ ছিল না? এতোকিছুর পরেও আপনি ওই মানুষটাকে এতো বেশি ভালোবাসতেন যে হিংসাটা আপনা-আপনি চলে আসতো।”
” বিশ্বাসঘাতক। অনেক বড় বিশ্বাসঘাতক আপনি।”
অরিন বড় বড় শ্বাস ফেলছে। তার বুকের ভেতরটা যে কি এক অসহ্য সন্তাপে পুড়ে যাচ্ছে!অন্বয় নিশ্চুপ। মাথা নিচু। অরিন বলল,” এতোদিন কেনো বলেননি কথাটা? আজকেই কেনো বলতে হলো?”
” জানি না। আজকে বলতে ইচ্ছে হলো। আমার এখন বলতে পেরে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বুক থেকে পাথর সরে গেছে।”
অরিন আর এক মুহুর্তও বসলো না। উঠে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে। অন্বয় একাই বসে রইল। তার আসলেই ভালো লাগছে।
অরিন ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যাচ্ছে। সামনেই দেখতে পেল মূর্তিমান অর্ণভ দাঁড়িয়ে। এক মুহুর্তের জন্য অর্ণভকে ইলহান বলে ভ্রম হলো তার। জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করল,” আই এম স্যরি৷ স্যরি!”
বলা হলো না। এর আগেই অন্বয় ভারী নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” ইলহান মনে হয় আমাদের মাঝে আর নেই অরিন।”
অরিন ধরে থাকা সিঁড়ির হাতল থেকে হাত ছুটে যাচ্ছিল। অর্ণভ একহাতে শক্ত করে ধরলো অরিনকে। ভাঙা গলায় বলল,” তোকে না বুঝে অনেক কথা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করিস না৷ ইলহান তার পাপের শাস্তি তিলে তিলে পাচ্ছে। আজ সে মৃত্যুর মুখে। এরপরও কি তুই তাকে ক্ষমা করবি না? মরার আগে তাকে দুনিয়ার সকল দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে দেওয়া উচিৎ। দুনিয়ার সাথে তার সমস্ত হিসাব চুকে-বুকে গেছে। ”
অরিন অর্ণভের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গেল ইলহানের কেবিনে। সেখানে দাঁড়িয়ে নুসাইবা, শ্যানিন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কি নিদারুণ এক দৃশ্য! আজ থেকে মা-মেয়ে সম্পূর্ণ একা। স্বামীহীন, পুত্রহীন এক মা, ভাইহীন, পিতাহীন এক কন্যা। তাদের কান্নার অসহনীয় চিৎকার ছড়িয়ে পড়েছে হসপিটালের করিডোরের দিগ্বিদিক। অরিন কি বলবে? কি করবে? বুঝতে পারছিল না। শ্যানিন মাকে একটা স্টিলের আসনে বসিয়ে অরিনের কাছে এগিয়ে এলো। ওর দুই বাহু চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ভাইয়ার হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অরিন। ডাক্তার বলেছে, সে মারা যাবে।”
অরিনের মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে সে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছে। কয়েক পা পিছিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে থরথর করে। মনের মধ্যে অসহ্য তোলপাড়! শ্যানিন কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেল হঠাৎ। অরিন দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো। সাদিকা অরিনের শাড়ির আঁচল টেনে ধরে মসৃণ কণ্ঠে বলল,” মাম্মাম, মাম্মাম, সবাই কাঁদছে কেন?”
অরিন উত্তর দিল না। আসলেই তো, কেন কাঁদছে সবাই? তার তো একটুও কান্না পাচ্ছে না। সে কোনোকিছু অনুভব করতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে আজ থেকে সবশেষ। সাদিকা একহাতে চোখের পানি মুছে বলল,” ইলু কি আর উঠবে না মাম্মাম? কথা বলবে না আমার সাথে?”
অরিন এবারও কিছু বলতে পারল না। অনুভূতিহীন দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। তার প্রথম থেকে সবকিছু মনে পড়ছে। ট্রেনে প্রথম যেদিন ইলহানকে সে দেখেছিল। হুট করে চড় মেরেছিল। চড় খেয়ে ইলহানের সে কি রাগ! তারপর ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া। ইলহান হুট করে চুমু খেয়েছিল অরিনের কপালে। বোকার মতো অরিনও একই কাজ করল। সিআরভিতে ইলহানের সেই গা জ্বালানো উক্তি,” আরেকবার ভাইয়া ডাকলে তোমায় জোর করে কিস করবো।” তখন কত বোকা ছিল অরিন। আতঙ্কে জমে গিয়েছিল। এরপর সত্যিই আর ইলহানকে ভাইয়া ডাকেনি সে। তার হারানো কানের দুল খুঁজে আনতে ইলহান বৃষ্টির মাঝে ছুটে গিয়েছিল। পাহাড়ে প্রথমবার অরিনকে প্রেম নিবেদন করা। আর অরিন ধাক্কা মেরে ইলহানকে ফেলে দিয়েছিল। ইলহান কতগুলো দিন হসপিটালে ভর্তি ছিল। তবুও অরিনের পিছু ছাড়েনি সে। আঠার মতো লেগে থাকতো। কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে শেষমেষ ওদের বিয়ে হলো। স্বপ্নের মতো দিন ছিল। কত সুন্দরভাবে কাটছিল জীবনটা। তারপর হঠাৎ এলো ঝড়। সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া ঝড়। কতকিছু বদলে গেল। ঝড় থামল। চারদিক এখন শান্ত, নিস্তব্ধ, মলিন। এই অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা সহ্য হচ্ছে না। অরিনের মন চাইল জোরে চিৎকার করতে। সাদিক হঠাৎ বলল,
” জানো মাম্মাম, ইলু বলেছিল সে আমার সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুঁজে দিবে। এই কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।”
অরিন তার শান্ত, স্তব্ধ চোখ দুটি দিয়ে সাদিকার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া বাবা? এর মানে ইলহান জানতো, সাদিকাই তার মেয়ে। এতোক্ষণ পর অরিনের বাম চোখ গলে স্বচ্ছ এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো। নিঃশ্বাসে মিশে আছে সীমাহীন ভার। সাদিকা ঠোঁট উল্টে বলল,
” কিন্তু এখন আমার একটুও খুশি লাগছে না। মনে হচ্ছে, বাবাকে তো কোনোদিন দেখিনি। তাই বাবাকে না পেলেও আর কষ্ট লাগবে না। কিন্তু ইলু যদি আমার সাথে কথা না বলে তাহলে খুব কষ্ট লাগবে। মাম্মাম, তুমি একটু ইলুকে রিকোয়েস্ট করো না। যেনো সে আমার সাথে একটু কথা বলে। প্লিজ মাম্মাম! প্লিজ!”
অরিন সাদিকার মাথাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আসছে। প্রকৃতির এই নিদারূণ কষ্ট সহ্য করার অসীম ক্ষমতা করুণাময় তাকে দিক, দিক, দিক!
লেডিস ওয়াশরুম থেকে শ্যানিন টিস্যুপেপার দিয়ে চোখমুখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছিল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে অনেক কেঁদেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ খবরটা সে শুনে ফেলেছে। তার ভাইটা আর বাঁচবে না। বাবাও নেই। পৃথিবীতে বড্ড নিঃস্ব মনে হচ্ছে নিজেকে। অন্বয় শান্তচোখে পর্যবেক্ষণ করছিল শ্যানিনকে। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো শ্যানিনের। অনুতাপে পিষ্ট কণ্ঠে বলল,
” স্যরি।”
শ্যানিন চমকে উঠল,” মি. অন্বয়, আপনি কেনো স্যরি বলছেন?”
” জানি না। মনে হচ্ছে এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। ”
” অদ্ভুত! আপনি কেনো দায়ী হবেন? মানুষের মৃত্যুর উপর কি কারো হাত আছে? আর ভাইয়ার মৃত্যু তো আরও আগেই হওয়ার কথা ছিল। যদি কোনোভাবে ভাইয়া বেঁচেও যেতো তাও সে বেশিদিন আমাদের মাঝে টিকতে পারতো না। তার ফাঁসি হতো।”
” সেই ফাঁসির জন্যও আমিই দায়ী হতাম।”
” ধূর, আপনি কিভাবে দায়ী হতেন? ভাইয়ার ফাঁসির জন্য তো আমি দায়ী৷ আমার জন্য ভাইয়া খুন করেছিল।”
” কিন্তু পাঁচবছর আগে যদি আমি আপনাকে বিয়ে করে নিতাম তাহলে এসব কিছুই হতো না। আজ আপনি এখানে দাঁড়িয়ে এভাবে কাঁদতেন না। জীবনটা হয়তো আরেকটু সুন্দর হতো।”
শ্যানিন কষ্টের মাঝেও হেসে ফেললো,” কি বলছেন এসব? অর্থহীন কথা-বার্তা। জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে সব বিধাতার নিয়ন্ত্রণে। আপনি-আমি কি এ বিষয়ে আদৌ কিছু করতে পারি?”
” পারি না? কেনো পারি না? জানেন আমি কি ঠিক করেছিলাম? সবকিছু এবার বদলে দিবো। ইলহান যদি বেঁচে যায় তাহলে ফাঁসির কেসটি নিয়ে আমি আবার লড়বো। সবকিছুর বিনিময়ে আপনার মুখে হাসি এনে দিবো।”
” আমার মুখে হাসি?”
” মানে, আপনাদের সবার মুখে হাসি। আপনার, মিসেস অরিন, সাদিকা।”
শ্যানিন মুচকি হাসলো। হঠাৎ একজন নার্স এসে বলল,” গুডনিউজ আছে।৩০৪ নাম্বার কেবিনের পেশেন্ট কোমা থেকে জেগে উঠেছে। সবাইকে সেখানে ডাকা হচ্ছে।”
শ্যানিন উদ্দীপ্ত হয়ে বলল,” ভাইয়া চোখ মেলে তাকিয়েছে? আল্লাহ, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মি. অন্বয়, চলুন যাই।”
অন্বয় শ্যানিনের একটি হাত চেপে ধরে বলল,” এইবার আপনি দেখবেন শ্যানিন, আমি সবকিছু ঠিক করে দিবো। ফাঁসির মামলা এক চুটকিতে ডিশমিশ হয়ে যাবে। কোনো ভয় নেই।”
সবাই কেবিনে এসে ভীড় জমিয়েছে৷ সাদিকা সবার সামনে। ইলহানের হাতের আঙুল চেপে ধরে তৃষ্ণার্তের মতো চেয়ে আছে সে। তার সুন্দর চোখ দু’টি উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। ইলহানের ঠোঁটে মুচকি হাসি। সাদিকা বলল,” ইলু, এতোদিন তুমি কেনো কথা বলোনি? রাগ করেছিলে? আমি আর কখনও তোমার কাছে কিছু চাইবো না। সমুদ্রে হারানো বাবাকেও চাইবো না৷ শুধু তুমি আমার সাথে আর কথা বলা বন্ধ করো না প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হয়েছে।”
ইলহান সাদিকার রেশমী চুলে অনেক কষ্টে হাত বুলিয়ে দিল৷ তৃপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য্যের মায়াকন্যার দিকে। অরিন সেই দৃশ্য দূর থেকে দেখতে দেখতে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ফেলল। কি আশ্চর্য! এখন তার এতো কান্না পাচ্ছে কেনো?

পরিশিষ্ট:
চঞ্চল ষোড়শী কিশোরীটির দৃষ্টি নিবদ্ধ জানালার বাহিরে। মেলবোর্নের বৃষ্টিভেজা রাস্তাটা চকচক করছে। মাথার দুই ধারের বেণী দুলিয়ে সে মনের আনন্দে বিড়বিড় করে চলেছে। তার রক্তজবা ঠোঁট দু’টো তাল মিলিয়ে কাঁপছে। কাঁপছে চোখের ঘন পল্লব। মায়াবী মুখে বৃষ্টির ফোঁটা এলোমেলো ভাবে লেপ্টে যাচ্ছে। সাদিকাকে ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে। গাড়ি চলছে সাইঁ সাঁই করে। আজকে চমৎকার একটা দিন। পথিমধ্যে এক শ্যামবর্ণ যুবককে দেখতে পেয়েই সাদিকা লাফিয়ে উঠলো। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল,” এই, এই, গাড়িটা এখানেই রাখুন আঙ্কেল।”
ড্রাইভার একবাক্যে গাড়ি থামালো। সাদিকা দ্রুতপায়ে হেঁটে শ্যামকায় ছেলেটির পেছনে দাঁড়ালো৷ উচ্চ কণ্ঠে বলল,” হ্যালো মি.।”
ছেলেটি ভ্রু কুচকে তাকালো। সাদিকাকে দেখে ওর চেহারায় একটা অজানা আতঙ্কের চাপ সৃষ্টি হলো। সাদিকা কোমড়ে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে দাঁত কেলাতে কেলাতে বলল,” কি খবর?”
ছেলেটা ভয়ে তটস্থ হয়ে বলল,” দেখুন, আপনি আমার পিছু নেওয়া ছেঁড়ে দিন।”
সাদিকা বেশ অবাক হলো,” কেনো কেনো? কিন্তু আপনিই না বলেছিলেন, আমাকে অনেক ভালোবাসেন? আমার জন্য জীবন বাজি রাখবেন? আমাকে না দেখলে অন্ধ হয়ে যাবেন?এখন কি আপনার ভালোবাসা ফুঁড়ুৎ?”
ভারী অসহায় দেখালো ছেলেটার মুখ। গমগম করে সে বলে উঠলো,
” ভালোবাসার আগে তো জানতাম না, ওইরকম রাক্ষুসে টাইপ বাবা আছে আপনার। সেদিন স্টারবার্গের সামনে কি মারটাই না দিল আমাকে। শুধু আপনার দিকে একবার তাকিয়েছিলাম বলে।”
সাদিকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। দুইহাতে বিণুনী চেপে ধরে বলল,” এই তাহলে আপনার সাহস? এই বুকের পাটা নিয়ে ইলহান মাহদীর মেয়েকে লাইন মারতে এসেছিলেন?”
” হ্যাঁ। কারণ আমি জানতাম না যে ইলহান মাহদী আসলে নিষ্ঠুর, বজ্জাত,অত্যাচারী, ফালতু, বাজে একটা লোক।”
ক্রোধে সাদিকার দাঁতে দাঁত লেগে এলো। আরেকটা শব্দ বলার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটির উপর। ধুরুম-ধারাম মারতে শুরু করল। রাস্তায় মানুষ জমে গেল। ড্রাইভার দ্রুত সাদিকাকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে এলো। সাদিকা ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছিল। কত্তবড় সাহস ছেলেটার। তার বাবাকে নিয়ে কটূক্তি? তার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। পৃথিবীর বাহিরে যদি অন্য কোনো প্লেনেট থাকে কিংবা অন্যকোনো গ্যালাক্সিও তাও সকল গ্যালাক্সি ছাপিয়ে তার বাবাই বেস্ট। সাদিকা গাড়িতে উঠেই বাবাকে ফোন করল। বাবা রাস্তার ঘটনা জানতে পারলে রেগে যাবে। ড্রাইভার আঙ্কেল বাবাকে কিছু বলার আগেই সাদিকা বলবে।

ইলহান জানালার কাঁচ তুলে দিল। তার চশমা ধূসর হয়ে আসছে। এতোক্ষণ বৃষ্টির জন্য শহরের রঙ সাদা মনে হচ্ছিল। এখন সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। আকাশে ভেসে উঠেছে রঙিন রঙধনু। মোবাইলটা সেই মুহুর্তে বেজে উঠলো। অরিন রুমেই ছিল। চেয়ারে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিল। মোবাইলের ভাইব্রেশন শুনে সে আঁড়চোখে দেখে নিল। ইংরেজি অক্ষরে নামটা লেখা,” মামনি।” ইলহান ফোনটা রিসিভ করেই ঠোঁটে আদুরে হাসি মিশিয়ে বলল,
” সাদিকা, মাই প্রিন্সেস।”
অরিন ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল। বাবা-মেয়ের ন্যাকামি দেখলে তার গাঁ জ্বলে যায়। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বাবা-মেয়ের আহ্লাদী কথোপকথন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাদিকা একটা ছেলেকে বেরধক পিটিয়েছে। এই শুনে অরিন জীভ কামড়ে উঠে দাঁড়ালো। অথচ ইলহান হাসছে। সাদিকা কেনো ছেলেটিকে মেরেছে তা অরিন জানে না। আর জানবে কি করে? বাবা-মেয়ের মধ্যে এমনকিছু সিকরেট আছে যেগুলো অরিন জানতে পারলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। অরিন তিরিক্ষ মেজাজে বলল,
” তোমার মেয়ে একটা নিরীহ ছেলেকে রাস্তায় ধরে অকারণে পেটালো। আর তুমি এইটা শুনে হাসছো? মেয়েকে শাসন করা উচিৎ। এভাবে চলতে থাকলে তো মেয়ে লাফরাঙ্গা হয়ে যাবে।”
ইলহান নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে অরিনকে চুপ করতে বলল। তার চেহারার প্রকাশ ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সাদিকা বীরের মতো একটা কাজ করেছে। অরিন তেড়ে আসলো।
” দেখি, ফোনটা আমাকে দাও।”
সাদিকা ওই পাশ থেকে বলল,” আমি মাম্মামের সাথে কথা বলতে চাই না বাবা। নেভার। মাম্মাম এখন আমাকে বকবে৷ আর আমি এখন বকা খাওয়ার মুডে একদম নেই।”
অরিন রাগে গজগজ করে উঠলো,” খুব ভালো। মেয়েকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছো না? এরপর দেখো কি হয়। আজকে রাস্তা-ঘাটে ছেলে পেটাচ্ছে। কালকে ছেলে ধরে রাস্তায় চুমুও খাবে। তারপর হঠাৎ একদিন রাস্তার একটা ছেলে ধরে এনে বলবে, বাবা বিয়ে দাও। তখন কি করবে শুনি?”
ইলহান খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” আমার মেয়েকে চিনি আমি। আমার পারমিশন ছাড়া ও বিয়ে কেনো, প্রেমও করবে না।”
সাদিকা ওইপাশ থেকে বলল,” কারেক্ট! লাভ ইউ বাবা।”
অরিন মুখ ভেঙচিয়ে বলল,” দেখা যাবে।”
বেডরুম থেকে বেরিয়ে সে সোজা সাদিকার রুমে চলে গেল। আর কিছুদিন সাদিকার ষোল বছর পূর্ণ হবে। তার জন্মদিনে শ্যানিন আর অন্বয় তাকে সারপ্রাইজ দিতে বাংলাদেশ থেকে আসছে। এই কথা এখনও সাদিকা আর ইলহান জানে না। অরিন বাপ-মেয়েকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। বলা বাহুল্য, শ্যানিন আর অন্বয়ের বিয়ের বয়স বারো বছর। তাদের একটা ছোট্ট ছেলে আছে। নাম সাফওয়ান। ছেলেটা ক্লাস ফোরে পড়ে। সাদিকা প্রত্যেকটি দেয়ালে বাবাকে নিয়ে অনেকগুলো চিরকুট লিখে রেখেছে। তার পড়ার টেবিলে তিনটি ফ্রেম একসাথে বাঁধা।ডানপাশে ইলহানের ছবি। মাঝখানে সাদিকা আর বামপাশে অরিন। কিন্তু অরিনের ছবির ফ্রেমটা আজকে নামিয়ে রাখা। সাদিকা প্রায়ই এটা করে যখন সে মায়ের উপর কিছু নিয়ে অভিমান করে। তার ধারণা, বাবা পৃথিবীর সরলতম মানুষ। আর মা নিষ্ঠুরতম মহিলা। সাদিকার সবচেয়ে প্রিয় আর ব্যক্তিগত ডায়েরীর কভারপেইজে লেখা,” আই লভ মাই ফাদার।” হুম, সাদিকার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই এখন তার বাবা। আর মা তো বানের জলে ভেসে এসেছিল। ডায়েরীর দ্বিতীয় পেইজেই অরিন আর ইলহানের পাশাপাশি ছবি পাওয়া গেল। নিচে লেখা পি স্কয়ার। আরেকটু নিচে অরিন দেখল সাদিকা সুন্দর করে লিখেছে,
Papa is my power
Mom is my peace.
অরিনের অদ্ভুত ভালো লাগল। এইবার পি স্কয়ারের অর্থ বুঝতে পারল।
ঘড়িতে রাত বারোটা। সাদিকা বাবার সাথে সিরিজ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। অরিন এসেছিল জানালা আটকাতে। তখনি দেখল বাবা-মেয়ের ঘুমের দৃশ্য। তাদের গাঁয়ে কাঁথাটা টেনে দিল অরিন। ইলহানের চোখের চশমা খুলে টেবিলে রাখল। কি সুন্দর লাগছে দুজনকে! ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন নেই। মানুষ চেহারা দেখলেই বুঝে যাবে এরা বাবা-মেয়ে। একে-অপরের চেহারায় আশ্চর্য মিল। অরিন বাতি নিভিয়ে দিল৷ অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল ঘর। অরিন চলে যাচ্ছিল। তখনই ইলহান পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরল। ঘুমো ঘুমো কণ্ঠ বলল,” যেও না।”
অরিন হাসলো মনে মনে। আকাশ ফেটে উঠলো মেঘের গর্জনে। ঘুমের ঘোরে সাদিকা বাবাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরল। অরিন তাদের পাশে গিয়ে শুতেই ইলহান জড়িয়ে ধরল তাকে। বাহিরে বৃষ্টির ঝনঝন শব্দে মুখরিত রাতের শহর। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশটি থেকে থেকেই গর্জন করছে। আজকের এই রাত, ঐশ্বরিক সুন্দর এক বৃষ্টির রাত!

-Sidratul Muntaz
______________________সমাপ্ত_______________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here