#রিকশা
।।৭।।
অনেক ক্ষণ হয়ে গেল বাইরে গিয়েছে শুভ্রা আর শাহরিয়ার। প্রায় বিশ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন ফিরে এলো না ওরা তখন শায়লার দুশ্চিন্তা আকাশ স্পর্শ করল।
কে জানে বোকা মেয়েটা কী না কী বলে ফেলছে শাহরিয়ারকে!
নাহ, আর ভালো লাগছে না।
খাওয়া দাওয়ার পাট শেষ, গ্রুপ ছবি সেলফির পাট চুকিয়ে নিমন্ত্রণ কর্তার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে শাহরিয়ারের মাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে হল রুম থেকে বেরিয়ে এলো শায়লা।
ব্যাপারটা ঠিক হলো না হয়ত। শাহরিয়ার ফিরে আসা পর্যন্ত তার মায়ের পাশে বসে থাকাই হয়ত শায়লার উচিত ছিল।
সেটাই হতো সুন্দর ও শোভন। কিন্তু শুভ্রা শাহরিয়ারকে কী না কী বলে ফেলছে, এই দুশ্চিন্তায় অস্থির লাগছে শায়লার।
আরো কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবার আগেই গিয়ে আটকাতে হবে মেয়েটাকে। আশা করা যায় এইটুকু সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর্ব সেরে শাহরিয়ারের সামনে নিজের অতীত প্রেম উপাখ্যানের ঝাঁপি খুলে বসেনি শুভ্রা!
আরেকটা কাজ করা যেত, “একটু ঘুরে আসছি” বলে দেখে আসা যেত। কিন্তু তাতে শাহরিয়ারের মায়ের সামনে শায়লার অতি আগ্রহ প্রকাশ পেয়ে যেত।
আর শুভ্রা যদি ইতোমধ্যে বলে ফেলে থাকে বেফাঁস কোনো কিছু, তাহলে উনি সুযোগ পেয়ে যেতেন শায়লাকে কিছু শুনিয়ে দেবার। সাত পাঁচ ভেবে শায়লা তাই বেরিয়ে এলো উদ্বিগ্ন মুখে।
সুইমিং পুলের সামনে পানির ঊর্ধ্বগামী স্রোতে আলোর ফুলঝুরি খেলার ওপরে চোখ রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহরিয়ার। এবং একা।
শুভ্রা নেই ওর সাথে!
বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠল শায়লার। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, “শুভ্রা…?”
চোখ তুলল শাহরিয়ার। আঙুল তুলে অনির্দিষ্ট একটা দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “গেটের সামনে গিয়েছে, ওর কোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে!”
“বন্ধু? হোয়াট দ্যা হেল!” নিজের মনেই বিড় বিড় করে বলে ফেলল শায়লা।
শুভ্রার সেটটা থেকে পারভেজের নাম্বার ব্লক করে দিয়েছিল সে। এবোরশনের পর পর পোস্ট অপারেটিভ থেকে শুভ্রাকে অত্যাধুনিক আরেকটা ক্লিনিকে ট্রান্সফার করার সময়ই কাজটা করেছিল শায়লা।
আজকের এই প্রোগ্রামে আসবে বলে গতকালই শুভ্রাকে সাথে করে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে নতুন হ্যাণ্ড সেট কিনে দিয়েছিল শায়লা, মনেই ছিল না নতুন সেটটা থেকেও পারভেজের নাম্বার ব্লক করে রাখবার কথা।
ওদের দুজনের কি আবার নতুন করে যোগাযোগ হয়েছে নাকি? এতগুলো মাস ধরেই কি শুভ্রাকে ফোন করে গিয়েছে পারভেজ?
নাহ আর ভাবতে পারছে না শায়লা। কেন যে নতুন সেটটা কিনে দিতে গেল শুভ্রাকে!
শাহরিয়ারের কাছ থেকে দায়সারা বিদায় নিয়ে হন হন করে হাঁটতে শুরু করল শায়লা। পেছন থেকে হেঁকে বলল শাহরিয়ার, “আস্তে যান, আই থিংক শি ইজ এন এডাল্ট এণ্ড ক্যাপেবল এনাফ টু টেইক কেয়ার অফ হারসেলফ!”
এ কথা বলল কেন শাহরিয়ার?
দুশ্চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে গেটের সামনে গিয়ে পৌঁছাল শায়লা। প্রথম কিছু ক্ষণ খুঁজে পেল না কাউকেই।
গেট থেকে বেরিয়ে অস্থির দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল এদিক ওদিক। তারপর একটু দূরেই দেখতে পেল শুভ্রাকে, যথারীতি সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই অপদার্থটা!
দৃশ্যটা দেখেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠল শায়লার। কোথায় আমি মরছি তোর ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে, আর তুই কিনা এখানে…
ওদের কাছাকাছি এগিয়ে গেল শায়লা, প্রথমেই বাধা না দিয়ে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কিছু ক্ষণ দেখতে লাগল এই সস্তা প্রেমের বাংলা নাটক!
শুভ্রার চোখে অশ্রু।
“এত দিন পর কেন? এত দিন পর কী মনে করে? এত দিন পার হয়ে গেল, একটা ফোনও তুমি করনি আমাকে!”
“প্রতি দিন ফোন করেছি। ফোন বিজি ছিল।“
“মিথ্যা কথা! আমি কারো সাথে কথা বলতাম না!”
“আমি মিথ্যা বলি না, তুমি ভালো করেই জানো!”
“এক বার বাসায় আসতে পারতে!”
“এসেছিলাম! তোমার আপা বলল তুমি নাকি আমার মুখ দেখতে চাও না?”
“তাই তুমি আমার সব জিনিসপত্র আর কাপড় চোপড় ফেরত পাঠিয়ে দিলে?”
“এক মিনিট! তুমি নিজেই তো লোক পাঠালে ওগুলো ফেরত চেয়ে? তোমার নাকি অফিস করতে অসুবিধা হচ্ছিল জামা কাপড়ের অভাবে?’
“আমি ফেরত চেয়ে লোক পাঠিয়েছি?”
হতভম্ব হয়ে তাকাল শুভ্রা। আর ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে গেল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শায়লার দিকে।
শুভ্রার দৃষ্টি অনুসরণ করে পারভেজও ফিরে তাকাল সেদিকে।
“এই তো, আপাও তো এখানেই! আপাকেই জিজ্ঞেস করে দেখো! আপা আপনি বলেননি শুভ্রা আমার মুখ দেখতে চায় না, আমি যেন ওই মুখ নিয়ে আর কোনো দিন ওর সামনে না আসি?”
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল শায়লা। “ওটা আমিই বলেছিলাম, তোমাদের দুজনের ভালোর জন্যই। আর জিনিসপত্র ফেরত চেয়ে লোকও আমিই পাঠিয়েছিলাম। সেটাও তোমাদের দুজনের ভালোর জন্যই। শুভ্রার সেট থেকে তোমার নাম্বারও আমিই ব্লক করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমি তোমাদের দুজনের ভালোই চাই।“
“আপা! আমার সংসার ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করে এটা কেমন ভালো চাওয়া তোমার?” আর্তনাদ করে উঠল শুভ্রা।
“যা বুঝিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না!” রেগে উঠল শায়লা। “ওদের সাথে আমাদের কোনো দিক দিয়ে মেলে? ওর বোন যে বাথরুমে সাবান পানি ছড়িয়ে মারতে বসেছিল তোকে, মনে নেই সেই কথা? কোথায় ছিল ও তখন? ও পেরেছিল তোকে প্রোটেকশন দিতে? জিজ্ঞেস করে দেখ কাজটা কি ওর বোনের একারই, নাকি ওরই বুদ্ধিতে হয়েছিল এটা?”
“না না!” দুই হাত তুলে প্রতিবাদ করল পারভেজ, “বিশ্বাস কর আমি কিছুই জানতাম না এর!”
শায়লা কিছু বলার আগেই বাধা দিয়ে শুভ্রা বলল, “জানি। বিশ্বাস করেছি। বিশ্বাস করেছি শুধু মাত্র এই জন্যে যে তোমার পক্ষে এরকম কোনো কাজ করা সম্ভব না। তুমি অনেস্ট। তুমি মিথ্যা বল না। তুমি স্টুডেন্ট লাইফ থেকে গরিবদের সাহায্য কর। এত এত গুণ তোমার। তোমার পক্ষে এরকম জঘন্য কোনো কাজ প্ল্যান করে করা সম্ভব না।“
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পারভেজ। “থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং! দেখো যা হওয়ার হয়েছে। আমরা আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করি প্লিজ? সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো!”
শুভ্রার হাত ধরল পারভেজ। আস্তে করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো শুভ্রা।
“না।“
“না? না কেন?”
“আমার এখন আর তোমাকে প্রয়োজন নেই পারভেজ! তোমাকে আমার যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দের মুহূর্তে, সেই সেলিব্রেশনে আমি তোমাকে পাইনি। আবার সেই খুশিটা যখন এসেও হারিয়ে গেল আমার বুকের কাছ থেকে, সেই যন্ত্রণার সময়েও তোমাকে পেলাম না। তুমি কোথায় ছিলে পারভেজ? তুমি কেন আমাকে আগলে রাখোনি? কেন তোমার আপার সাথে এমনভাবে আলোচনা করেছিলে যাতে করে আপা আমার স্বপ্নটাকে তুচ্ছ করে ভাবার সাহস পেয়েছিল? তোমার না কথা ছিল আমার যত্ন নেওয়ার? সাবধান থাকতে বলার? কেন বলনি সে কথা?”
বোনের হাত ধরে টানল শায়লা। “চল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ড্রামা অনেক হয়েছে। আমি তোর আবার দেখে শুনে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবো!”
এবার সজোরে হাত ছাড়িয়ে নিলো শুভ্রা।
“আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি আমি, আর কখনো তুমি আমার লাইফ ইনভেস্ট করে কোনো প্রফিট আদায় করার কথা ভাববে না!”
বোনের এমন উগ্র মূর্তি শায়লার কাছে নতুন। হতবাক হয়ে গেল সে।
“আমি কি পুতুল যে তোমরা যেমন ইচ্ছে নিয়ে খেলবে? যখন ইচ্ছা কোলে তুলবে, যখন ইচ্ছা ছুঁড়ে ফেলবে? আর কখনো তুমি আমার লাইফের কোনো ডিসিশনে ইন্টারফেয়ার করবে না! নেভার এভার!”
ওদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে রাস্তার দিকে একাই এগিয়ে যাচ্ছিল শুভ্রা। পারভেজ এসে পথ আটকে দাঁড়াল ওর সামনে।
চোখ তুলে তাকাল শুভ্রা।
“শুধু অনেস্ট হওয়া, গরিবদের সাহায্য করা, সেলফ রেসপেক্ট দেখানোর জন্য ফার্নিচার না নেওয়া, দেনমোহর শোধ করাই এনাফ না পারভেজ! তুমি যা করেছ সব তোমার নিজের ইগোকে স্যাটিসফাই করার জন্য! আমাকে কখনো ভালোবাসোনি! এক সাথে থাকতে হলে ভালোবাসাটাও থাকতে হয়! বোঝো ভালোবাসা? ভালো হয়ত তুমি বাসতে আমাকে কিন্তু নিজের ইগোর চেয়ে বেশি নয়। পার্টনারের খুশিতে খুশি হওয়ার মতো, পার্টনারের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন করে নেওয়ার মতো, সন্তানের জন্য স্যাক্রিফাইস করার মতো ভালোবাসা! ছিল তোমার? আছে তোমার? দিতে পারবে? ভালোবাসা?”
সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোতে নিষ্প্রাণ দেখায় শুভ্রার মুখ। উত্তরের জন্য দুএক মুহূর্ত অপেক্ষা করে শুভ্রা।
তারপর নিরুত্তর নির্বাক পারভেজকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে নগরীর ব্যস্ত রাজপথে। যেন আর কারো কাছে তার আর কোনো দেনা পাওনা নেই, কিছু বলার নেই, কিছু শোনারও নেই। যা কিছু বলার ছিল বলা হয়ে গেছে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকাই বুকের ভেতরে মুচড়ে উঠল পারভেজের। ওই দেখা যাচ্ছে দূর থেকে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে শুভ্রা, তার ভালোবাসার নারী।
এই চলমান জনস্রোতে মিশে যাবে, হারিয়ে যাবে এখুনি।
পারভেজ কি আর কখনো ফিরে পাবে তাকে?
ট্রাফিক সিগন্যালের লাল বাতিটা জ্বলে উঠলেই থেমে যাবে যানবাহনের দল, আর সেই সুযোগে রাস্তা পেরিয়ে ওপার যাওয়ার অপেক্ষায় রত এই শহরের অনেকগুলো মানুষ। কেউবা কর্মক্লান্ত, কাজ শেষ করে ঘরে প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায়, কেউবা ডাক্তারের চেম্বার ফেরত, হাতে চিকিৎসার ফাইল। কারো হাতে শপিং এর ব্যাগ, আবার কেউ বা সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত, ফিরছে কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে।
সেই সব মানুষের ভিড়ে মিশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুভ্রা, ছুটতে ছুটতে পারভেজ গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমাকে আরেকটা সুযোগ দেবে? প্লিজ! ওয়ান লাস্ট চান্স! আমি থাকতে পারব না তোমাকে ছাড়া!”
ঠিক সেই মুহূর্তে জ্বলে উঠল ট্রাফিক সিগন্যালের লাল বাতিটা, সেই ইশারায় থেমে গেল নানা আকারের যানবাহনের সম্মুখগতি। শুভ্রা আর পারভেজের দুপাশে দাঁড়ানো মানুষগুলো সেই সুযোগে পেরিয়ে যেতে লাগল রাস্তার ওপারে।
শুভ্রার আঙুলগুলো পারভেজের মুঠোয়, এই গাড়ির হর্ন, এত কোলাহল, সব ছাপিয়ে শুনতে পেল না কিন্তু ওর ঠোঁটের নাড়াচাড়া দেখে পড়তে পারল শুভ্রা, পারভেজ বলছে, “প্লিজ…”
ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারছে না শুভ্রা, এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। এখনই জ্বলে উঠবে সবুজ বাতিটা, আর বুঝি রাস্তা পার হওয়া হবে না শুভ্রার।
কী করবে এখন শুভ্রা?
(সমাপ্ত)
(যারা কষ্ট করে পুরো গল্পটা পড়েছেন তাদের কাছ থেকে মন্তব্যের আশায় রইলাম।)