#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat
রৌদ্র আরশিকে বারান্দায় আটকে রেখে রুমের বাহিরে চলে যায়। আরশি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র কাজ দেখে। পরক্ষণেই দরজায় ধাক্কাতে লাগলো।
“ডক্টর রোদ কোথায় আপনি? আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন কেন? দরজা খুলুন প্লিজ রোদ..”
আরশি বার বার রৌদ্রকে ডেকে যাচ্ছে কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। আরশির মনে খানিকটা ভয় ঢুকে যায়। ধীরপায়ে যেয়ে বারান্দার এক পাশে রাখা লোহার বেঞ্চিতে বসে পরে। মাথা নিচু করে রৌদ্রর এমন অদ্ভুত কাজের কারন খুঁজার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পরেছে। পাখিগুলো পাখা ঝাপটিয়ে কিচিরমিচির করছে। আরশি মাথা তুলে পাখির খাঁচাগুলোর দিকে তাকালো। কিছুটা সময় পর আরশি উঠে আবারও দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো। কিন্তু এবারও আরশি নিরাশ হলো। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এবারও পাওয়া গেল না। আরশি পুরো বারান্দায় পায়চারী করছে। প্রায় আধঘন্টা পর সশব্দে বারান্দার দরজা খুলে গেল। আরশি ঝটপট মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো। রৌদ্র হাঁপাচ্ছে। বুকে ডান হাত দিয়ে বড় বড় করে শ্বাস টানছে। কিছুটা সময় পর অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো। আরশি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে চেয়ে আছে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করছে না। রৌদ্র নিজে থেকে বলবে সে অপেক্ষায় আছে আরশি। রৌদ্র নিম্ন স্বরে বলল-
“সরি আরু। আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। আমি তো অল্প কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে এখানে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই বদমাইস গুলোর জন্য এমন হয়েছে।”
আরশি কপাল কুচকে তাকাতেই রৌদ্র থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে আবারও বলল-
“মানে নির্বান আর তোমার ফ্রেন্ড গুলো আমাকে আটকে রেখেছিল। ওদেরকে একটা কাজ করতে দিয়েছিলাম তাই একটু দেরি হয়েছে। কিন্তু যখন তোমার কাছে আসতে চেয়েছি তখনই আমাকে বাধা দেয়। তাদের না-কি বখশিশ লাগবে। বখশিশ দেওয়ার পরেও আটকে রেখেছিল তারপর নীল সবাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে আসতে দিয়েছে।”
“আমাকে এখানে আটকে কেন গিয়েছিলেন?”
আরশির গম্ভীর কন্ঠে রৌদ্র আহত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আরশি গাম্ভীরতার সঙ্গে বসে আছে বেঞ্চিতে। রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কোনো কথা না বলে রুমে চলে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আবারও ফিরে আসে রৌদ্র। হাতে অনেক গুলো সূর্যমুখী ফুল। রৌদ্র আরশির সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিল। আরশির দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ পরে বলল-
“রৌদ্র আর রুদ্রাণীর নতুন জীবন এই সূর্যমুখী দিয়ে শুরু করতে চাই আরু। তোমাকে কতটা ভালো রাখতে পারবো জানি না তবে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি বলে বুঝাতে পারবো না। তবে আমি চাই আমাদের ভালোবাসা যেন কখনো পুরনো না হয়। আমাদের ভালোবাসা কখনো অতীত হোক সেটা আমি চাই না।”
আরশির দিকে রৌদ্র ফুল গুলো এগিয়ে দেয়। আরশি রৌদ্রর দিকে অপলকভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মুচকি হাসি দিয়ে আরশি সূর্যমুখী ফুল গুলো নিজের হাতে তুলে নিল। সরু চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
“এই ফুলের জন্য এতো দেরি হয়েছে?”
রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। আরশি রৌদ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় উঠে আসার জন্য। রৌদ্র আরশির হাত ধরে তার পাশেই বসে পরে। দুজনে কিছুটা সময় চুপচাপ একে অপরের হাত ধরেই বসে থাকে। নিস্তব্ধতা ভেঙে আরশি রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-
“রোদ..আপনার কাছে কিছু চাইলে আপনি আমাকে দিবেন!”
রৌদ্র হাল্কা হেসে বলল-
“একটি বার চেয়েই দেখো তুমি।”
আরশি ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল-
“আমাকে কথা দিন আপনি কখনো পাল্টাবেন না। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাকে এই রূপেই দেখতে চাই।”
রৌদ্র আরশির হাত আরও শক্ত করে নিজের মুঠোয় বন্দী করে নিল। মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“কথা দিচ্ছি রৌদ্র আর রুদ্রাণীর ভালোবাসা কখনো পুরনো হবে না। হবে না কখনো অতীত। না হবে মলিন, ধূসর বর্ণহীন। আমাদের ভালোবাসা সব সময় সূর্যের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তবে যদি কখনো আমার ভালোবাসার বউয়ের কিছু হয়ে যায় তাহলে তোমার এই হার্টের ডক্টর নিজেই হার্ট এট্যাক করে মরে যাবে।”
কথা বলেই রৌদ্র শব্দ করে হেসে ওঠে। আরশি তার দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র হাসি থামিয়ে আবারও বলল-
“সত্যি বলছি তোমার কিছু হয়ে গেলে। আমি সত্যিই হার্ট এট্যাক করে সাথে সাথেই মরে যাবো।”
আরশি রৌদ্রর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগান্বিত কন্ঠে বলল-
“আপনার কি আজে বাজে কথা না বললে হয় না! অসহ্যকর”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি মিসেস আরু। অনেক ভালোবাসি।”
হঠাৎ করেই রৌদ্রর মুখে ভালোবাসার কথা আরশি ভ্রু কুচকে ফেলে। পরক্ষেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। কিছুটা সময় নিয়ে নিম্ন স্বরে বলে-
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি রোদ।”
রৌদ্র আরশির লাজুক চেহারা দেখে হাসলো। আবারও দুজনের মাঝে একঝাঁক নিরবতা এসে হানা দিল।
যদি বলি আমার প্রতিটা রাত তোমার কোলে চাই,
বলো ঠোঁটের ছোঁয়ায় আদর মাখাবে গালে?
যদি বলি হ্যাঁ হাসছি আমি শুধুই তুমি আমার তাই,
বলো ছেড়ে তো দেবেনা কখনো মনের ভুলে?
আজ দ্বিতীয় বারের মতো আরশির রৌদ্র কন্ঠে গান শুনছে। রৌদ্রর কন্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অপলকভাবে রৌদ্র দিকে তাকিয়ে আছে আরশি।
গোধূলি আকাশ মুছে দিলো সাজ
অযথা দূরে তবু তুমি আজ,
অভিমানী ভুল ধরবে আঙ্গুল
মন করে বায়না।
তুমি কি আমায় করবে পাগল
শাড়ির আঁচল, চোখের কাজল,
প্রেমে তুমিও পড়ে যাবে হায়
দেখো যদি আয়না।
আরশির রৌদ্রর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রৌদ্রর কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে গাইতে লাগলো-
বাঁচি এই বিশ্বাসে, শেষ নিঃশ্বাসে
তোমাকেই পাশে চাই,
তুমি না থাকলে আমি শূন্য এ মহাদেশে।
যদি ঘুমিয়েও পড়ি
শেষ ঘুমে আমি তবুও তোমাকে চাই,
তুমি স্বপ্নেই এসো রূপকথার ওই দেশে।
রৌদ্র আরশিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আরশির মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আবারও গান গাইতে লাগলো-
আমি বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে
যত কথা আছে সবই তোমাকেই বলি।
আমি কান পেতে সেই মনের গভীরে
লুকোনো যন্ত্রনা শুনে ফেলি।
আরশি রৌদ্রর কাধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে। রৌদ্র গান থামিয়ে আরশির দিকে তাকায়। ঘুমন্ত অবস্থায় লাল শাড়িতে মোহনীয় লাগছে আরশিকে। রৌদ্র আরশির কপালে গভীরভাবে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়ে বলল-
“তোমার কিছু হলে এই রৌদ্র কখনো ঠিক থাকতে পারবে না রুদ্রাণী। তোমাকে ছাড়া এক দিন থাকাও আমার জন্য খুব কষ্টকর।”
————————
“আল্লাহর রহমতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল। যাক তাহলে বিয়ের চিন্তা শেষ, এখন তো শুধু রৌদ্রর বাচ্চাদের সাথে খেলার অপেক্ষা।”
সকালের নাস্তা করার সময় ডাইনিং টেবিলে সবার সামনেই নির্বানের আম্মু মজার ছলে কথাটা বলল। কথাটা শোনার সাথে সাথেই আরশির মুখের ভঙ্গিমা পালটে গেল। এই মুহূর্তে অন্য কোনো স্বাভাবিক মেয়ে থাকলে হয়তো লজ্জায় নুয়ে পরতো তবে আরশির ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন। থমথমে চেহারায় খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে আরশি। রৌদ্র স্থির চোখে আরশির মলিন মুখের দিকে চেয়ে আছে। রৌদ্র মা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“হ্যাঁ সেই অপেক্ষা তো করবোই। আল্লাহ হাতেই তো সব কিছু। উনি যখন ইচ্ছে আমাদের অপেক্ষার পহর শেষ করবেন।”
রৌদ্রর মা’র কথা শুনে আরশি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। নাস্তা শেষে আরশি নির্বানের আম্মুর সাথে সোফায় বসে নির্বানকে নিয়ে কথা বলছে। নির্বানের আম্মু আরশিরকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“জানো মা এই ছেলেটা ঘুমালে দিনদুনিয়ার কোনো হুশই থাকে। কুমিরের মতো পরে পরে বেঘোরে ঘুমায়।”
নির্বানের আম্মুর কথা শুনে আরশি হাসছে। তখনই নির্বান সোফায় শুয়ে থাকা অবস্থায় পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তার মার দিকে অলস ভঙ্গিতে চেয়ে বলল-
“উফফ মা বাসার নতুন বউকে এসব কি বলছো তুমি! ক্রাশ ভাবি তুমি আম্মুর কথায় কান দিও না তো।”
নির্বানের আম্মু নির্বানের পায়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“বেশি কথা না বলে এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা কর যা।”
আরশি নির্বান আর নির্বানের আম্মুর খুনশুটি দেখে মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে।
————————
“তখনকার জন্য থ্যাংকস মা।”
রৌদ্র রান্নাঘরে এসে তার মা’কে জড়িয়ে ধরে কথাটা বলল। রৌদ্র মা তার ছেলের পিঠে আস্তে করে থাপ্পড় দিয়ে বলল-
“এখনে থ্যাংকস বলার কি আছে!”
রৌদ্র তার মা’কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“তুমি সব কিছু শুনে আমাদের বিয়েতে রাজি হয়েছো তাই থ্যাংকস। আরুকে অস্বস্তি পাওয়া থেকে বাঁচিয়েছো এই জন্য থ্যাংকস ”
ছেলের কথা রৌদ্র মা মুচকি হাসলেন। রান্নাঘরের কাজ করতে করতেই বললেন-
“তুই তো ব্যস্ততায় নিজেকে একদম পালটিয়ে ফেলেছিলি। দিন দিন কেমন গম্ভীর হয়ে উঠেছিলি। কিন্তু আরশি তোর জীবনে আসার পর থেকে তুই আবারও আগের মতো হাসিখুশি থাকা শুরু করেছিস। এই জন্য আমি আরশির কাছে অনেক ঋণী৷ আরশি আমাদের পুরনো রৌদ্রকে আবারও আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর তার থেকেও বড় কথা হলো তুই আরশিকে ভালোবাসিস। এখন তোর ভালোবাসা যেমনই হোক সেটা তোর কাছে থাকলেই তুই খুশি থাকবি আর তোর খুশিতেই আমরা খুশি রৌদ্র।”
রৌদ্র তার মা’র কপালে চুমু দিয়ে মুচকি হেসে বলল-
“লাভ ইউ মা।”
রৌদ্রর মা হাসলো। তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল-
“যা এখন আরশির কাছে যা। আর হ্যাঁ আরশিকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে না বলিস। আল্লাহ চাইলে সব কিছুই সম্ভব হবে।”
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৪৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“রুদ্রাণী..”
রৌদ্রর ডাকে আরশি ঘাড় বাকিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। রৌদ্র বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে আরশির দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরশির বারান্দার রেলিং-এ হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ বাতাসের ঝাপটা এসে আরশির চুল গুলো উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গায়ে লালচে-হলুদের সংমিশ্রণে সুতি শাড়ি জড়ানো। হাতে লাল আর হলুদ রঙের অল্প কিছু কাচের চুড়ি। নাকে ছোট্ট এক পাথরের নাকফুল। রৌদ্র আরশির পাশে এসে বারান্দার রেলিং-এ হাত রেখে বলল-
“গল্প উপন্যাসে পড়েছি বিয়ের পর না-কি মেয়েদের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায় আজ তার প্রমাণ সরূপ তোমাকে দেখে ফেললাম। আজ তোমাকে একদম পারফেক্ট মিসেস ডক্টর লাগছে। বিয়ের অনেক দিন পাড় হয়ে গেলেও এতদিন তোমাকে প্রেয়সী হিসেবেই দেখেছি। তবে এই দু’দিন ধরে তোমাকে বউ বউ লাগছে। বউদের তোমার শাড়ি পড়া আমাকে স্মরণ করে দেয় তুমি আমার বউ। তোমার নাকের এই ছোট্ট জিনিসটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। সকালের তোমার ঘুমন্ত মুখটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় তুমি আমার ভালোবাসার জীবনসঙ্গিনী। এখন আমার প্রতি দিন শুরু হয় তোমার ঘুমন্ত চেহারা দেখে আর আমার নির্ঘুম রাত কাটে তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখে।”
রৌদ্র কথায় আরশি মাথা নিচু করে ফেলে। আরশিকে লজ্জা পেতে দেখে রৌদ্র হাসলো। আরশির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল-
“তোমার লজ্জা পাওয়াটা আমার বুকে তীরের মতো করে এসে আঘাত করে। তোমার এই লাজুকতা আমাকে বার বার ঘায়েল করে রুদ্রাণী। রোদের তীর্যক রশ্মির মতো ঝলসে দেয় আমার মনকে।”
রৌদ্রর কথা শুনে আরশির লজ্জার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে দু হাত কচলাচ্ছে। রৌদ্র আরশির হাত ধরে তার কিছুটা কাছে নিয়ে আসে। আরশির হাতটা নিজের মুঠোয় বন্দী করে নিয়ে বলল-
“এতো হাত কচলাতে হবে না। এখন বলো বারান্দায় একা একা কি করছিলে?”
আরশি একটা জোড়ালো শ্বাস ফেলে। নিজেকে স্বাভাবিক করে মাথা তুলে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে বলল-
“কিছু না। এমনিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“কাল থেকে আমি হসপিটালে যাবো। আর তোমাকেও কাল থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে।”
আরশি ভ্রু বাঁকিয়ে রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-
“দু’দিন যেতে না যেতেই শুরু হয়েছে আপনার পড়া পড়া করে জ্ঞান দেওয়া!”
রৌদ্র সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“আমার বউ হয়ে তুমি পড়াশোনাকে এতো ভয় পাও কীভাবে আরু! তুমি তো দেখছি খুব ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে।”
রৌদ্রর কথায় ধপধপ করে আরশির মাথায় রাগের আগুন জ্বলে উঠলো। জ্বলন্ত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
“আপনি কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন ডক্টর। আমাকে অপমান করছেন আপনি!”
রৌদ্র আরশির রাগকে কোনো পাত্তা না দিয়ে নির্লিপ্ততার সাথে বলল-
“আমি কোনো বাড়াবাড়ি করছি না মিসেস আরু। আমি একদম ঠিক বলেছি। প্রথম থেকেই দেখে আসছি আপনাকে পড়াশোনার কথা বললেই আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যায়।”
রৌদ্রর কথায় যেন আরশির রাগ আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। রৌদ্রর গাঁ জ্বালানো কথায় আরশি প্রচন্ড রেগে কিছু বলতে নিবে তার আগেই রৌদ্র হুট করেই আরশির ডান গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে আবারও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। আরশি স্তব্ধ হয়ে আছে। আচমকাই রৌদ্রর এমন কাজে আরশি বরফের মতো জমে গেছে। তৎক্ষনাৎ একরাশ লজ্জা এসে আরশিকে আঁকড়ে ধরে। রৌদ্র মুচকি হেসে বলল-
“কাল তোমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবো। তুমি রাজি তো মিসেস আরু!!”
আরশি নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রৌদ্র ঠোঁট চেপে হাসলো। কেউ আর কোনো কথা বলল না। নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে তাদের দু’জনকে। চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করছে রৌদ্র আর তার রুদ্রাণী।
————————
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আরশি বরাবরের মতো পাশে তাকালো। কিন্তু আজ রৌদ্রকে পাশে দেখতে না পেয়ে আরশির উঠে বসলো। অগোছালো চুল গুলো হাত খোপা করে। বিছানা থেকে নেমে যায়। হঠাৎই বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে একটা নীল রঙের কাগজ দেখতে পেল। আরশি কোতুহলবশত কাগজটা হাতে তুলে নেয়। বিস্ময় নিয়ে কাজগের ভাজ খুলতেই আরশির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
প্রিয় রুদ্রাণী,
অনেক দিন পর তোমাকে চিঠি লিখলাম। নিশ্চয়ই আমার চিঠির অপেক্ষায় ছিলে তা-ই না রুদ্রাণী! দুঃখিত ব্যস্ততার জন্য তোমাকে চিঠি লেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে এবার থেকে একদম ঠিকঠাক নিয়মিত চিঠি দিবো তোমার নামে। আসলে ভালোবাসার মানুষকে পাশে পেলে সব কিছুই একদম এলোমেলো হয়ে যায়। সময় যেন চোখের পলকের সাথেই চলে যায়। তাই আর কোনো কিছুর খেয়াল থাকে না। তবে আর যাইহোক রৌদ্র তার রুদ্রাণীকে নীল চিরকুট দেওয়া কখনো ভুলবে না। তুমি কি তোমার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে ভুলে যাবে আমাকে চিঠি লেখা??
[বিঃদ্রঃ চিঠির উত্তর খুব তাড়াতাড়ি চাই। তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করা আমার জন্য খুবই কষ্টকর।]
ইতি
রৌদ্র
আরশি চিঠিটা পড়া শেষে হাসিমুখেই নীল চিরকুটটা ভাজ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। রৌদ্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে বলল-
“আরু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমাদের যেতে হবে।”
আরশি মাথা দুলিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষন পর দুজনে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়। কাসফিয়া রেডি হয়ে সোফায় বসে ফোন টিপছে। রৌদ্র কাসফিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“সরি কাসফিয়া আমাদের দেরি হয়ে গেল।”
কাসফিয়া ফোন থেকে নজর সরিয়ে গোমড়া মুখে বলল-
“আপনারা কাজটা একদমই ঠিক করেননি ভাইয়া।”
আরশি কাসফিয়ার কাছে এসে ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কেন আমরা কি করেছি?”
কাসফিয়া গম্ভীর গলায় বললো-
“কি করেছিস মানে! তুই আর দুলাভাই আমাকে এই ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিস কেন? তোদের নতুন বিয়ে হয়েছে। আমি তোদের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে থেকে কি করবো?”
আরশি সিরিয়াস হয়ে বলল-
“তাহলে কি তুই ওই ফ্ল্যাটে একা একা থাকবি না-কি!”
রৌদ্র আরশির কাছে এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল-
“এতো বড় ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে একা একা থাকবে এটা তোমার জন্য খুব বিপদজনক। আর আমিও সারাদিন হসপিটালে থাকবো আরুও এই বাসায় একা একা থাকবে। তার চেয়ে বরং তুমি এখানে থাকবে এটা তোমাদের দুজনের জন্যই ভালো।”
কাসফিয়া আর কথা বাড়ালো না। তাদের কথাই মেনে নেয়। নাস্তা করা শেষে রৌদ্র আরশি আর কাসফিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। আরশি আর কাসফিয়াকে ভার্সিটিতে দিয়ে রৌদ্র হসপিটালে চলে যায়। নীল আরশিকে দেখে দুষ্টুমি করে বলল-
“বিবাহিত বেবি তোমার নতুন বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে?”
আরশি কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নীলা আর নীলের মাঝে বসে পরে। হঠাৎই নীলের পিঠে সজোড়ে একটা থাপ্পড় মেরে আরশি ক্ষিপ্ত গলায় বলল-
“আসতে না আসতেই শুরু হয়েছে তোর হারামিগিরি।”
নীল ব্যথায় মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে। ডান হাত পিঠে দিয়ে বলল-
“তুই আসলেই একটা শাকচুন্নি। কই নতুন বিয়ে হয়েছে সেই জন্য ট্রিট দিবি তা না করে উল্টো আমার মতো নিরীহ একটা ছেলেকে মারছিস। তোর কি আমার জন্য একটুও দয়ামায়া হয় না!!”
নীলের কথায় আরশি শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“নিলু তোর ভাই না-কি নিরীহ একটা ছেলে!!”
আরশি কথাটা বলেই আবারও হাসতে লাগলো। আরশির সাথে সাথে নীলা, কাসফিয়া আর আদ্রাফও হাসছে। নীল তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধমকের স্বরে বলল-
“দাঁত কেলানো বন্ধ কর তোরা।”
নীলের কথা শুনে সবাই আরও বেশি করে হেসে ওঠে। হাসিঠাট্টার মাঝে হঠাৎ করেই আদ্রাফ বলল-
“দোস্ত আমি আমার আর কাসফির সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে দিয়েছি।”
আদ্রাফের কথায় সবাই থমকে যায়। হতভম্ব হয়ে আছে সবাই। নীলা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। কাসফিয়া প্রচন্ড অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল-
“তুই আমাকে না জানিয়েই সব বলে দিলি আদ্রফ!! আর আমাদের সম্পর্কের কথা শুনে আংকেল আন্টিই বা কি বলেছেন?”
আদ্রাফ সহজ গলায় জবাব দিল-
“তেমন কিছু না। বলেছে আমাদের ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই তোর বাসায় কথা বলবে।”
আরশি আর নীল চুপ করে আছে। দুজনের মনেই চলছে নীলাকে নিয়ে হাজারো চিন্তা ভাবনা। নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে আদ্রাফ আর কাসফিয়াকে দেখে পরক্ষণেই মুচকি হাসি দিয়ে খুশিতে গদগদ করে বলল-
“তার মানে খুব শীগ্রই আমরা তোদের বিয়ে খাচ্ছি!”
আদ্রাফ কোনো উত্তর দিল না শুধু মাথা চুলকিয়ে হাল্কা হাসি দেয়। আরশি আর নীলের একে অপরের দিকে একবার চেয়ে নীলার দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসি দেয়। মুহুর্তেই নিজেদের স্বাভাবিক করে নেয়। নীল আদ্রাফের কাধে হাত দিয়ে বলল-
“বাহ আশুর বিয়ে দেখে মনে হচ্ছে তোরও বিয়ে করার শখ জেগেছে আদ্রাফ!!”
আদ্রাফ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“আরে বিয়ের কথা বলিনি জাস্ট আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছি।”
আরশি দুষ্টুমি করে বলল-
“আচ্ছা তোকে কি এখন থেকে আমরা দুলাভাই ডাকবো না-কি কাসফি কে ভাবি ডাকবো!! আমি তো খুবই কনফিউজড।”
কাসফিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকায়। সাথে সাথেই নীলা, আরশি আর নীল ঝংকার তুলে হেসে ওঠে। নীলা হাসছে প্রান খুলে। নীলে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে এতদিনে। অন্য কারও ভালোবাসার মানুষকে সে নিজের মনে রাখতে চায় না। তাই আদ্রাফের জন্য জমিয়ে রাখা গচ্ছিত ভালোবাসা গুলো নীলা অনেক আগেই নিজের মনে দাফন করে দিয়েছে। মেনে নিয়েছে কাসফিয়া আর আদ্রাফের সম্পর্ক। বন্ধ করে দিয়েছে নীলার মনে ভালোবাসার দরজা।
——————————
হসপিটালে রোগী দেখার পর রৌদ্র আরশির সাথে কথা বলার জন্য পকেটে থেকে ফোন বের করতে নেয়। তখনই পকেটের মধ্যে একটা লাল রঙের চিরকুট পায়। রৌদ্র মুচকি হাসে চিরকুটটা দেখে।
প্রিয় রৌদ্র,
অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে মনে রাখার জন্য। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমাকে ভুলেই গেছেন। সত্যি বলতে আপনার নীল চিরকুটটাকে বড্ড মিস করছিলাম। চিঠির মাধ্যমেই তো ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছি তাই কখনো চিঠি দেওয়ার কথা ভুলবো না।
[বিঃদ্রঃ রুদ্রাণী তার রৌদ্রকে কখনো কষ্টে মাঝে রাখে না। তাই তাড়াতাড়ি করেই চিঠির উত্তর দিয়ে দিলাম।]
ইতি,
রুদ্রাণী
চিঠিটা পড়ে রৌদ্রর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো৷ ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে রৌদ্র নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। তবুও মনের কোণে কিছুটা ভয় আর আক্ষেপ রয়েই গেছে। আরশিকে সত্যিই সকল সুখ দিতে পারবে কি না! আরশির মা ডাক শোনার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারবে তো!! যদি কখনো রৌদ্রর মিথ্যে কথা আরশি জেনে যায় তখন কি হবে!! রৌদ্র নিজের মনে নানানরকম চিন্তা ভাবনা করেই মলিন মুখে বসে রইলো।
চলবে….