#লতাকরঞ্চ (৭)
” এক্সকিউজ মি! আমি যদি ভুল না করি তাহলে তুমিই লতা,তাইনা? ”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। ছাদে,বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া আর গুনগুনিয়ে গান গাওয়া আমার আঁতাত বলতে গেলে। কিন্তু এই মেয়েলী কণ্ঠ কোথা থেকে ভেসে আসলো তা দেখার জন্য পিছনে তাকাতেই আবিষ্কার করলাম বিদঘুটে সেই অসহ্য নারী, শোভাকে। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমি বললাম,
– জ্বী। আমিই লতা। ভালো আছেন?
— ভালো। তুমি আমাকে চিনো?
– হুঁ।
— কিভাবে?
– বলতে ইচ্ছা করতেছেনা। চিনি, ব্যস এতটুকু জেনেই খুশি থাকেন। চা খাবেন?
চা খাওয়ার অফারটা মন থেকে করার একদমই ইচ্ছা ছিলো না। তবু ও যে কেন করলাম…
ইচ্ছা করতেছে বারান্দার গ্রিলগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।
উনি বললেন,
– এইতো চা। তোমার প্রান্তিক ভাই এনে দিয়েছে।
কথাটা শুনে এবার কানের পাশের মাছিদের ভনভন আওয়াজটা আরো দৃঢ় হলো।
আমি কিছুই বললাম না শুধু বললাম,
– হুঁ।
চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই চা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে শোভা আপু।
শোভা আপু বললো,
– এই তুমি এত নীরস কেন? তখন থেকে আমিই বকবকিয়ে যাচ্ছি। আর এই হুঁ,হ্যাঁ ছাড়া কি আর কোনো কথা বলতে পারোনা নাকি? প্রান্তিক তো বলছে তুমি নাকি সেই ছটফটে মেয়ে। ইঁচড়েপাকা নাকি। কিন্তু আমি তার কোনো লক্ষণই দেখতেছিনা।
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।
আস্তে করে হুঁ বলতে গিয়েও বললাম না।
উনি আবার বললো,
– এই শোনো একটু মর্ডান হও বুঝছো? আর সেন্টার সিঁতা দিয়ে বিণুনি করে রাখছো কেন? গ্রাম্য কালচার। থ্রি পিস ছাড়া আর কিছু কি পরোনা? আচ্ছা শোনো আমি যখন আসছি তখন আমার সঙ্গ দাও বুঝলা? অনেক কিছুই শেখার আছে তোমার। লম্বা লম্বা এমন থ্রি-পিস,বিণুনির চল আছে নাকি এখন? যাই হোক, কোথায় পড়ো?
আমি আস্তে করে বললাম,
– কলেজে অনার্স পড়ি। এবার সেকেন্ড ইয়ারে উঠবো।
শোভা আপুকে আমার একদমই পছন্দ হচ্ছেনা। ইচ্ছা করতেছে পিছন থেকে হাত দুটোকে ঝাপটে ধরে চ্যাঙধোল করে, ঠাঁস করে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে, পার্মানেন্ট মার্কার পেন দিয়ে কিছুক্ষন আঁকিবুঁকি করি উনার মুখে। নিজের কৃত্রিম সৌন্দর্যবর্ধনতা নিয়ে বড্ড বেশি বড়াই উনার। বিরক্তিকর। আশ্চর্য! আমি কি আপনার কাছে কোনো সাহায্য প্রাথর্না করেছি? উজবেক কোথাকার!
শোভা আপু চলে যাচ্ছে।
ওহ্! বোঝাটা অবশেষে বিদায় হচ্ছে।
আবার দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ফিরে এসে বললো,
– এই লতা! একটু মোবাইলটা রাখোতো! আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি। অল্পকিছুক্ষনের জন্য। নিচেই আছি।
আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলাম।
চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি,
আমার বানানো চা প্রান্তিক ভাই কোন সাহসে শোভা নামের মেয়েটাকে দেয়!
নিচে প্রান্ত ভাইকে দেখা যাচ্ছে।
লাল কালারের শার্ট পড়ে হয়তো গাছ-গাছালি দেখছে হেঁটে হেঁটে। ব্যস্ত মানুষ। কানে সবসময় মোবাইল দিয়েই রাখে..
লাল শার্টে দারুণ মানায় ভাইয়াকে।
এতদিন খেয়াল করিনি ব্যাপারটা।
ইচ্ছা করতেছে এখনি গিয়ে একটা উইশ করতে।
ইশ!
যদি আজকে এই শোভা আপুটা না আসতো তাহলে ভাইকে একটা মেসেজ দিতাম। বিলের ধারে বসে উনার, “লতা তোর পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে” টাইপের কিছু বিরক্তিকর কথা শুনতাম।
কিন্তু সব পণ্ড হয়ে গেলো।
যাবো নাকি একবার? গিয়েই বলে দিবো,
” ভাইয়া শুভ জন্মদিন। কি খাওয়াবেন? ”
ভাইয়া মিটমিটিয়ে হাসবে আর আমি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো…
এসব ভাবনা-চিন্তার মোহে খেয়ালই করিনি যে শোভা আপু প্রান্তিক ভাইয়ের সাথেই হাঁটছে এখন…
আহ্!
কি মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিচ্ছে দুজন।
শোভা আপুও লাল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে আছে…
দুটি লাল মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।
চোখের সামনে নিজের একান্ত প্রিয় মানুষটাকে যখন অন্য কারো সাথে দেখা যায়… তখন যে কি নিদারুণ কষ্ট হয় তা শুধু তারাই বুঝবে যারা এই কষ্টটা ফেস করেছে কখনো।
•°•
শোভা আপুর ফোনের লক জানা থাকলে একবার মেসেঞ্জারে গিয়ে ঢু মেরে আসতাম।
কিন্তু লক জানা নেই।
পাশের একটা বাটনে চাপ পড়ে গেলো চায়ের কাপের হাতে নিতে গিয়ে..
মোবাইলে আলো জ্বলে উঠতেই দেখতে পেলাম,
প্রান্ত ভাই আর শোভা আপুর খুব অন্তরঙ্গ একটি ছবি ওয়ালপেপারেই দেওয়া।
এভাবে ওয়ালপেপারে এরকম একটি ছবি কেন বা কিসের জন্য দেওয়া তা বুঝতে আর আমার বাকি নেই।
____________
_______
ঐদিনের মত আজকের রাতটাও কঠিন হয়ে গিয়েছে… আজকের রাতটা দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
কিশোর ভাইয়ের সঙ্গ দরকার।
কিন্তু সেও তো নিঁখোজ…
আচ্ছা আমি এত অসহায় কেন?
•°•
শোভা আপু কিছুদিন থাকবে।
এমনিতেই বান্ধবী সেজে আমাদের বাড়িতে এসেছে থাকতে। আব্বা প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে আম্মা তাকে মানিয়ে নিয়েছিলো।
এদিকে লিমা আপু আর মঞ্জু ভাইয়ের বিয়ের দিন ও ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
সবাই বিয়ের শপিং নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু আমার মনে চলছে হাহাকার।
নিজের বোনের বিয়েতে মানুষের কত প্ল্যান থাকে।
আর আমার…
ভাবতেছি বিদেশে চলে যাবো।
কাকার কাছে।
এদিকে লিমা আপুর বিয়েটা হয়ে যাক, কোনোমতে ইয়ার ফাইনালগুলো সারি, বছর যাক, তারপর শোঁ করে…
লন্ডন।
পারলেতো এখনি চলে যাই..
কিন্তু সম্ভব না।
সেখানে বসে বসে প্রান্ত ভাই আর শোভা আপুর প্রেম কাহিনী শুনবো,দেখবো কিন্তু কিছুই করতে পারবোনা।
মজা হবে খুব!
____________
” চোখের জলেরা মানেনা বাঁধা, জানে না ক্ষণ, বুঝেনা কে তার আসল প্রিয়জন। ”
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর ভার বুঝি আমার পিঠে এসে পড়েছে…
মায়ের কাছে যেতে হবে।
কালুকে দিয়ে ফোনটা পাঠিয়ে দিলাম।
মায়ের রুমে ঢুকার আগে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে যাচ্ছিলাম তাই প্রান্ত ভাইয়ের সাথে খেয়ে গেলাম এক ধাক্কা। ভাই এখানে কি করছে তা আমার জানা নেই। আমার এখন শুধু একটাই লক্ষ্য আমি উনার মুখ দর্শন করতেও চাইনা।
আমি নিজেকে ছাঁড়িয়ে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছি।
ভাই তখন পিছন থেকে বললো,
– লতা? যাবি ঘুরতে? শোভা, তুই আর আমি?
আমি না সূচকভাবে মাথা নাড়ালাম। চলে যাচ্ছি দৌঁড়ে…
উনি বললো,
– লতা, এই লতা? কোথায় যাচ্ছিস! আমিতো তোর জন্যই আসলাম, তোকে নিতেই এলাম এখানে।
তুই যাবিনা আমাদের সাথে?
আমি শুনলাম কিন্তু কোনো উত্তর দিলাম না।
আম্মার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললাম।
চলবে…
#ফারজানা_রহমান_তৃনা