লাবণ্যপ্রভা পর্ব ২

লাবন্যপ্রভা
পর্ব-২

৩.
তুনিড় ভাইয়ের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কথা জানার পর আমার মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, আমি পাইলাম, তাকে পাইলাম।

কোনো বড়সড় কারনে যে তুনিড় ভাই আর রুপসা আপুর সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল সেটা আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু নিজে থেকে কিছু জানতে চাইলাম না। আসলে সেদিন আমার জানতেও ইচ্ছে করেনি। তুনিড় ভাইয়ের কষ্ট দেখে আমার সেদিন দুঃখ পাওয়ার বদলে খুশি খুশি লেগেছে।

তুনিড় ভাই আর রুপসা আপুর যেসব কমন ফ্রেন্ডরা ছিলো তারা ছিলেন রুপসা আপুর পক্ষে। ভাসা ভাসা যতটুকু সেদিন শুনেছিলাম তা হলো, বন্ধুরা সবাই ফাইনাল পরীক্ষার পর ঘুরতে গিয়েছিল। সেখানেই কোনো এক বিষয়ে রুপসা আপুর সাথে বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে রুপসা আপু নাকি নিজেই বলেছিলেন, যে তুনিড় ভাইয়ের সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না। পরে তুনিড় ভাই মাফ চাইলেও কোনো লাভ হয়নি।
আমার সেদিন একবারের জন্যও জানতে ইচ্ছে করেনি কেন কি কারনে ঝগড়া হয়েছিল ওদের।

ব্রেক আপের পর সবাই যখন তুনিড় ভাইকে ছেড়ে গিয়েছিল তখন আমাকে আকড়ে ধরেছিল সে। রাত বিরাতে ফোনে কথা বলা, ম্যাসেজিং এসব চলতেই লাগলো। এদিকে আমার ডক্টর লাবন্য হওয়ার স্বপ্ন আমি প্রায় ভুলেই গেলাম।

আমার বাবা ছিলেন কলেজের টিচার। আর মা ছিলেন সোশ্যাল ওয়ার্কার। দুজনেই দুজনের মতো ব্যস্ত ছিলেন মানুষের সেবার কাজে। কিন্তু আমার দিকে তাদের খেয়াল করার কথা মাথায় এলো না। আর আমি ভাবলাম কাঙ্ক্ষিত রাজপুত্র পেয়ে যাবার পর আর কি চাই আমার! আর তুনিড় ভাই নিজের দুঃখ ভুলতে গিয়ে ভুলেই গেলেন যে লাবন্য কে ডক্টর লাবন্য বানাতে হবে।

তুনিড় ভাইয়ের সাথে রাত জেগে কথা বলার পরিমান বেড়ে গেল। তখনও পর্যন্ত আমরা দুজন দুজন কে ভালোবার কথা বলিনি। তুনিড় ভাই সবসময় একটা কথাই বলতেন, লাবন্য তুমি হচ্ছ আমার প্রকৃত বন্ধু। তোমাকে আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আমার চোখের কোনায় তখন জল এসে যেত। আমি মনে মনে বলতাম তুনিড় ভাই আমি আপনার বন্ধু না আমি আপনার রানি হতে চাই।

কোচিং এর পর তুনিড় ভাইয়ের সাথে ঘোরাঘুরি, বাড়ি ফিরে তার সাথে অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলা, আর সকালে তার ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙা এই নিয়েই চলছিলো আমার জীবন।

দেখতে দেখতে মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা হয়ে গেল। এবারও আমি চান্স পেলাম না। বাবা মা দুজনেরই এবার মেয়ের দিকে খেয়াল করার কথা মনে পরল। দুজনেই হতাশ হলো তাদের মেয়ে মেডিকেলে চান্স পেলনা বলে। ঢাকার কোনো পাবলিক ইউনিভার্সিটি তে চান্স পেলাম না। বাবা চাইলেন ঢাকার বাইরে পাঠাবেন ভার্সিটির পরীক্ষা দেয়ার জন্য। আমি কোনোভাবেই রাজি হলাম না। এই নিয়ে বাবা মায়ের সাথে একরকম যুদ্ধ গেল। এরপর বাবা চাইলেন প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াবেন। আমি আপত্তি করলাম না। কিন্তু আপত্তি করলেন তুনিড় ভাই। সে বলল, মেডিকেল কলেজে পড়লে দিনরাত আমাকে পড়তে হবে। তখন পড়ার চাপ বেশি থাকবে। লাইফ টা তখন আর এরকম ইনজয় করা যাবে না। আমার কাছেও তখন সেরকম মনে হয়েছিল। সত্যিই তো তখন কি আর আমি তুনিড় ভাইয়ের সাথে এভাবে ঘোরাঘুরি করতে পারব!

পরদিন বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি মেডিকেলে পড়ব না। ন্যাশনালে পড়ব। বাবা মা দুজনেই খুব চিৎকার চেচামেচি করে এক পর্যায়ে ভালোভাবে বোঝাতে লাগলো। আমি শুনলাম না। বললাম মেডিকেলে না পড়লেও আমার লাইফ ভালোভাবে চলে যাবে। শেষে বাবা মা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, তাহলে অন্তত যেন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ি। কিন্তু আমি তাতেও রাজি হলাম না।

এই নিয়ে বাবা মায়েরও অশান্তি হয়েছিল খুব। বাবা মাকে খুব খারাপ কথাও শুনিয়েছে আমার দিকে খেয়াল না করার জন্য।

শেষ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছিলাম ইডেন কলেজে জুওলজি নিয়ে। বাবা মা দুজনেই ছিলো আমার প্রতি ক্ষিপ্ত। মা একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল
-রাতে এতো কার সাথে কথা বল লাবন্য?
আমি বন্ধু বলে কাটিয়ে যেতে চাইলেও মা গোয়েন্দাগিরি শুরু করল। আমার জন্য রাত জেগে কথা বলা সমস্যা হয়ে গেল। তারমধ্যে আবার মা আমার ক্লাস এইটে পড়া বোন নবনীকে আমার কাছে ঘুমাতে পাঠালেন।

তুনিড় ভাই আমার কোনো কথা শুনতেই চাইলেন না। কারন ততদিনে আমি তুনিড় ভাইয়ের অভ্যাস হয়ে গেছি। আমার সাথে কথা না বললে তার রাতে ঘুম হয়না। সে পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করলেন। দিনদিন তুনিড় ভাই আরও বেশী আমার উপর ঝুকতে শুরু করল। অবশ্য আমি তো এটাই চেয়েছিলাম যে তুনিড় ভাইয়ের জগৎ জুড়ে শুধু লাবন্যই থাকুক আর কেউ নয়।

এরপর এলো আমার জীবনে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। থার্টি ফার্স্ট নাইটে ছাদে নিয়ে গিয়ে তুনিড় ভাই একগুচ্ছ গোলাপ হাতে দিয়ে বলল,
-আমাকে ভালোবাসবে লাবন্য??
আমি খুশিতে কথা বলতে পারছিলাম না। সে এক অন্যরকম অনুভুতি ছিলো। আমার স্বপ্নের পুরুষ, আমার রাজকুমার আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছে। ওই রাত টা কে মনে হয়েছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তুনিড় ভাই বলেছিল,
-লাবন্য আমাকে ভালোবাসতে হবে না। প্লিজ আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিও না।

সেরাতে আমি কিছুই বলিনি। শুধু শক্ত করে তুনিড় ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এতটা শক্ত করে ধরেছিলাম যে তুনিড় ভাই বলেছিল,
-লাবন্য আস্তে ধরো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি ফিসফিস করে বলেছিলাম, তুমি শুধু আমার তুনিড় ভাই। ছেড়ে দিলে যদি অন্য কেউ তোমাকে নিয়ে যায়।
তুনিড় ভাই শব্দ করে হাসছিলো সেদিন। আর আমি চোখের জল ফেলে তুনিড় ভাইয়ের কাঁধ ভিজিয়ে ফেলেছিলাম।

আমাদের সম্পর্ক ভালোভাবেই চলতে লাগলো। মা বাবাও জেনে গেল। বাবা শুধু বলেছিলেন, এরজন্যই তাহলে তুমি গোল্লায় গেছ??
মা আরও বেশি রিয়েক্ট করেছিলেন। বলেছিলেন ছেলেটা মাস ছয়েক আগে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করছিলো আর এখন তোমার সাথে! কখন হয়েছে এসব? পড়তে গিয়ে??
আমি মাকে সেদিন বলেছিলাম, যা হচ্ছে হতে দাও। না হলে এরপর এমন কিছু হবে যাতে তোমাদের মুখ দেখানো কঠিন হয়ে যাবে।

বাবা মা আমার জেদ সম্পর্কে জানতেন তাই তারা আর কিছু বলেনি। বাবা মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক দুরের। বাবা শুধু বলেছিলেন ক্যারিয়ারে ফোকাস করো লাবন্য। সময় মতো আমি ওই ছেলের সাথেই তোমার বিয়ে দেব।

আমার আর কি চাই!!! আমি তো তখন বাধনহারা পাখির মতো আমার রাজকুমারের সাথে মুক্ত আকাশে ঘুরতে শুরু করলাম। আর দশটা প্রেমের মতো আমাদের প্রেম ছিলো না। আমাদের সম্পর্ক ছিলো আরও বেশী গভীর। সে সম্পর্কে কোনো ঝগড়া ছিলো না। ছিলো শুধু ভালোবাসা। তুনিড় ভাই যা বলতেন সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। হোক সেটা খারাপ কিংবা ভালো।

দেখতে দেখতে কেটে গেল দুইবছর। এই দুই বছরে কতশত স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, বাচ্চার নাম রাখা হয়েছিল, জ্যোৎস্নারাতে হাতে হাত রেখে গল্প করা হয়েছিল। হয়েছিল সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে ট্যুরের নাম করে কক্সবাজার আর সিলেট ঘুরতে যাওয়া। তুনিড় ভাইয়ের কথামতো সম্পর্কের কথা আমাদের পাড়ায় আর কেউ জানল না। তার বাবা মাও তখনও জানতেন না।

এই দুইবছরে তুনিড় ভাইয়ের ভালোবাসা আমার জন্য একটুও কমলো না। বরং দিনদিন বেড়েই যাচ্ছিলো। আমাকে ছাড়া তার একমুহুর্ত ও চলতো না।

যতটা গভীর সম্পর্ক দুটো মনের ছিলো। ততটাই ছিলো শরীরের। যেটা বিয়ের আগে হওয়ার কথা ছিলো না। সেটা হয়ে গেল। কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে প্রথমবার তুনিড় ভাই আমাকে গভীর ভাবে ছুয়ে দেখল। আমিও না করলাম না। কেনই বা করতাম সে তো আমার স্বপ্নের পুরুষ ছিলোই। দুদিন পর তো বিয়ে হবেই। তাই আমিও আর বাধা দিলাম না। এরপর সুযোগ পেলেই আমাদের দুটি শরীর এক হয়ে যেত। সেটা হতো শহরের বাইরে দূরে কোথাও।

এভাবেই চলছিলো জীবন। এর মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। প্রথম টা হলো আমি প্রেগন্যান্ট হয়েছিলাম। আর দ্বিতীয় টা ছিলো তুনিড় ভাইয়ের মালয়েশিয়ায় স্কলারশিপ হয়ে যায়।

আমার প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে তুনিড় ভাই দিশেহারা হয়ে যায়। এতো সচেতন থাকার পরও কিভাবে হয়ে গেল সেটা নিয়ে আমার সাথে অনেক রাগারাগি করল। আমাকে এবোর্শন করানোর জন্য জোর করল। আমি রাজি হলাম না প্রথমে। কিন্তু তুনিড় ভাই বলেছিল, লাবন্য এই বাচ্চা হলে আমি মরে যাব। আমার সম্মান ক্যারিয়ার সব শেষ হয়ে যাবে। শেষে আমি রাজি হলাম। রাজি না হলে যে তুনিড় ভাই মরে যাবে। আমি কিভাবে তাকে মরতে দেই!!!!

এবোর্শন করার পর সপ্তাহ দুই আমি লুকিয়ে রইলাম। মা একবার সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
-কোনো সমস্যা হয়েছে? তাহলে আমাকে বলো। আমি তোমার মা, শত্রু না।
আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি। জোর করে হাসিমুখে বলেছিলাম আমি ভালো আছি।।

তুনিড় ভাই মাস খানেকের মধ্যে মালয়েশিয়া চলে গেল। আমি খুব অনুরোধ করেছিলাম যেন না যায় কিন্তু শোনেনি। বলেছিল, রাজকুমারী কে নিতে পক্ষীরাজ ঘোড়া লাগবে, আরও কতকিছু লাগবে। সেগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে না!
আমি বলেছিলাম আমার কিছু চাই না তুনিড় ভাই। আমার শুধু রাজকুমার কে চাই।

তুনিড় ভাই শুনলেন না। চলে গেলেন। এয়ারপোর্টে যাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি আমার। আমি আমার রুমে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। তুনিড় ভাই প্লেনে ওঠার শেষ মুহুর্তে ফোন করে বললেন, নিয়মিত ফোন করবেন আগের মতই। আমি তবুও অনবরত কাঁদতে লাগলাম।

সেই কান্নাই ছিলো তুনিড় ভাইয়ের জন্য আমার শেষ কান্না। এরপর আর কখনো সে আমাকে কাঁদতে দেয়নি।

পিএইচডি শেষ না করেই তুনিড় ভাই ফিরে এসেছিল। আর সাথে করে নিয়ে এসেছিল অনেক বড় সারপ্রাইজ।

চলবে…………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here