#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১০|
সাদিয়া মেহরুজ
চিকন মতো কৃষ্ণবর্ণের ছেলেটা নিজের র/ক্তা/ক্ত কাঁধ চেপে ধরে কা/ত/রা/চ্ছে। প্রচন্ড য/ন্ত্র/ণা/য় দু, তিনবার বমি করেছে। নি/ষ্ঠু/র অনিক ছেলেটার মলিন মুখোশ্রী দেখে খ্যাকখ্যাক করে হেঁসে উঠলো।হলো সে আরেকটু পাষাণ! গু/লি করলো নিষ্পাপ ছেলেটার হৃদপিণ্ড বরাবর। থমকে গেল ছেলেটার পৃথিবী। ছটফট করতে করতে দেহ থেকে ছিটকে বের হলো প্রাণ। উপস্থিত বাকি পাঁচ জন কেবল করুণ চোখে চেয়ে রইল প্রাণ/হীন দেহটার পানে। অনিক হিং;স্র হয়ে উঠল! চেঁচাল সে,
-‘ দেখছস এটারে? দেখ ভালো করে। আমার সাথে বিশ্বাসঘা;তকতা করবি তো এমনেই ম/রবি। সাহস কতো বড়! ও পুলিশরে ফোন দিতে নেয় আমারে ধরায় দিতে। ‘
ফোঁস ফোঁস করে অনিক ছেলেটার মৃ/তদেহে লাথি মা/র/ল কয়েকটা। হাতের পি/স্ত/ল/টা কোমড়ে গুঁজে নিল। নি/ষ্ঠু/রের মতো ছেলেটার লা/শে/র ওপর দাঁড়িয়ে নির্দেশ করলো,
-‘ মেহতিশারে আমার চাই। বুঝতে পারছস? ও আমার সোনার হরিণ। এই জীবনে বহুত মেয়ে আমি পা/চা/র করছি, বি/ক্রি করছি বিদেশী গো কাছে। কিন্তু মেহতিশারে যতো দামে নিতে চাইছে অতো দাম আমি কাওরে পাই নাই। দশ ভাগের দেড় ভাগ পাইছি এতদিন মেহতিশার দামের ক্ষেত্রে। মেহতিশা যদি আমার হয় তাহলে তোদেরও অনেক অনেক টাকা দিবো। যা খুঁজে আন ওরে। ‘
সকলে সম্মতি জানিয়ে গহীন কাননে ছুট দিলো। অনিক মৃ/ত ছেলেটার ওপর থেকে নেমে সামনেই বসে রইল।
-‘ ভিডিও ধারণ করেছেন ঠিক মতো? ‘ মেহতিশার ফিসফিসানো কন্ঠস্বর।
ভিডিও সেভ করা শেষে সারতাজ বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাল ছটফটে মেয়েটার পানে। সারতাজের অমন দৃষ্টি দেখা মাত্রই মেহতিশা চুপটি হয়ে বসলো। বোধ এলো তার। সে যে একটু বেশিই অস্থির হয়ে উঠছে।
-‘ করেছি ম্যাডাম। ‘ ভারী গলা সারতাজের।
গু/লি/র শব্দ শ্রবণ করা মাত্র দু’জনেই ছুটেছিল শব্দ উৎস ধরে। বেশী দূর যেতে হয়নি। অনিক এবং বাকিদের দর্শন মিলেছিল নিকটেই। ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ভেঙে পড়েছিল অনেক গাছপালা। সেই ভেঙে পড়া গাছ-গাছালির মাঝেই দু’জন ঘাপটি মে/রেছিলো।
অস্থিরমনা মেহতিশা কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,
-‘ কি করবেন এখন? এখানে আর কতক্ষণ বসে থাকব এভাবে? ‘
-‘ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় আছে? আপনার প্রিয় স্বামী তো এখানেই বসে আছে। ‘ সারতাজ খানিকটা ব্যাঙ্গ করে বলল।
বরাবরের মতো অনিককে ‘ স্বামী ‘ হিসেবে সম্মোধন করায় চটে গেল মেহতিশা।
-‘ আবার! আপনি আবার ওকে আমার স্বামী বলে সম্মোধন করছে? সাথে আবার প্রিয়ও এড করে নিয়েছেন দেখছি। অসহ্য লোক! ‘
-‘ সহ্য যেহেতু হচ্ছে না তাহলে আমি বরং চলে যাই। আপনি এখানে বসে বসে মশা মা/র/তে থাকুন আর গুনবেন অবশ্যই ক’টা মে/রে/ছে/ন। ‘
হাতে মোটা একটা ডাল নিয়ে সারতাজ ঝোপঝাড় থেকে বেড়িয়ে এলো।নিঃশব্দে, বিড়াল পায়ে এগোল
অনিকের পেছনটায়। অনিক টের পেলো তার পিছন দিকে কারো উপস্থিতি। ঘুরে তাকাবে অমনি বেশ জোরে আ/ঘা/ত পড়লো তার মাথায়। মাথা ঘুরে উঠল তার। ব্যা/থা/য় আ/র্ত/না/দ করার অবকাশ অব্দি পেলো না। তার মুখ চেপে ধরেছে সারতাজ। মেহতিশা ছুটে এলো জলদি।সারতাজের পাশে এসে দাঁড়াল। চক্ষুযুগল তার বড়সড় হয়ে রয়েছে। চাপা উত্তেজনা নিয়ে শুধাল,
-‘ আমার ওড়নাটা ছিঁড়ে ওর হাত, পা বেঁধে দেই? ‘
-‘ বাঁধুন দ্রুত! ‘
নিজের প্রিয় ওড়নাটা নিমিষেই ছিঁড়ে ফেললো সে। বাঁধা শুরু করলো অনিকের হাত, পা। অবাক নেত্রে তাকিয়ে থাকা অনিক কাজে বাঁধা প্রদান করলেই তাকে দুই – চারটা আঘাত করে নড়াচড়া করা বন্ধ করিয়েছে মেহতিশা। সারতাজ হাসলো! শব্দ যোগে হাসি। মেহতিশার একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, এমন মূর্হতে পা/গ/লের মতো হাসছেন কেন আপনি? জিজ্ঞেস করা হলো না। সারতাজ উপহাস করলো,
-‘ দেখো পৃথিবী! এক নি/ষ্ঠু/র স্ত্রীকে দেখো। যে কিনা নিজের স্বামীকে আ/ঘা/ত করছে প্রতিনিয়ত।’
বিরতি নিয়ে খানিকটা আফসোস করে উঠলো,
-‘ আহারে বেচারা! দেখেশুনে বিয়ে করবিনা একটু ব্যাটা? নাহলে আজ কি এমন মা/র খেতে হতো? ‘
সারতাজকে কেবল কঠিন চোখে দেখল মেহতিশা। কিছু বলল না। বলে লাভ আছে? দেখা যাবে কোনো এক কথা ধরে উপহাস করা শুরু করবে ফের। ভারী ব/দ/মা/শ ছেলেটা!
_
-‘ হেই মেজর শাকিব! ‘
উচ্চস্বরে ডাকল সারতাজ। কালো পোশাকে আবৃত সুদর্শন পুরুষটা ঝট করে পিছনে তাকালো। দেখল সারতাজকে, সারতাজের সাথে থাকা অনিক এবং সবশেষে এক নমনীয় নারীকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোল শাকিব। তার পিছন পিছন আসছে দু’জন
র্যাব। এসেই তারা অনিককে ঝপাট করে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ছটফট করছিল অনিক। বলিষ্ঠ দেহের র্যাব দু’জন তার পিঠে কয়েক ঘা লাগালো আর সঙ্গে সঙ্গেই সে স্থির হলো। শাকিব মেহতিশাকে দেখছিল সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে। তারপর হটাৎ তার নজরে এলো সারতাজের আ/ঘা/অপ্রাপ্ত হাতটা। চিন্তিত হলো শাকিব।
-‘ হাত দিয়ে র ক্ত পড়ছে কেন? কা ট লে কি করে?’
সারতাজ তার হাত দেখল। গুরুত্বহীন কিছুর প্রতি নজর পড়েছে এমনি করে ঝট করে দৃষ্টি সরালো। বেখেয়ালিপনা জড়ালো তার কন্ঠে,
-‘ ঐ অনিক ছেলেটা জংলী বিড়ালের মতো! আঁচড় দিয়েছিল। ‘
-‘ ওনার পায়েও কি আঁচড় দিয়েছে? ‘
মেহতিশার পায়ের দিকে দৃষ্টি পড়ল সারতাজ এবং শাকিবের। মেহতিশাও অপ্রস্তুত হয়ে তাকাল। তার পায়ে যে কা টা বিঁধেছিল তা আর তোলা হয়নি। সে আ/ঘা/তের চিহৃ সঙ্গে শুকিয়ে আসা র ক্ত চামড়া জুড়ে লেপ্টে রয়েছে। সারতাজ কিছুটা বিরক্ত হলো। বিরক্তিমাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ তখন যে কা টা ঢুকেছিল, বের করেননি? ‘
-‘ উঁহু। খেয়াল ছিল না। ‘ মেহতিশার নিভু নিভু স্বর।
-‘ কেয়ারলেস মেয়ে মানুষ! ‘
সারতাজ এগোল। মেহতিশার পা টেনে ধরলো। পড়ে যেতে নিলে নিজেকে সামলালো মেহতিশা। রাগ হলো তার।
-‘ আশ্চর্য তো! এভাবে কেও পা টেনে ধরে? ‘
উত্তর এলো না। খানিকটা জোরে টান দিয়েই কা টা বের করে অদূরে ছুঁড়ে ফেললো সারতাজ। উঠে দাঁড়িয়ে শাকিবের নিকট এলো। মেহতিশা চোখ বুঁজে আছে। ব্যা/থা পেয়েছে সে! নি/র্দ/য় ছেলেটা তাকে ব্যা/থা দিয়েছে।
-‘ চলো অফিসে। কিছু কাজ করতে হবে। ‘ শাকিব কাঠ কাঠ গলায় বলল।
ভীষণ ভীষণ বিরক্তি, ক্ষোভ নিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল সারতাজ। কপালে পরে থাকা চুলগুলোকে পিছে ঠেলে দিলো। খানিকটা রাগ নিয়েই বলল,
-‘ উফ! বিরক্ত আমি ব্রো। আর কত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে এই আইনের মামলায়? কিছুদিন ধরে এসব করতে করতে ফটোগ্রাফিতে মন দিতে পারছি না। সামনে আমার লাইফের কতো বড় একটা টাস্ক আছে! ‘
-‘ বেশিক্ষণ লাগবে না চলো। উনি হাঁটতে পারবেন তো? ‘
-‘ হাঁটতে না পারলে কি তুমি ওনাকে কোলে নিতে বলবে আমায়? আমি কিন্তু পারবো না। তুমি নিও। ‘
-‘ সারতাজ! ‘ শাকিব চাপা গলায় চেঁচাল।
-‘ কিডিং ম্যান। ‘
জঙ্গলে থাকাকালীন শহরের কিছুটা কাছাকাছি আসতেই নেটওয়ার্ক পেয়েছিল ফোনে সারতাজ। সে তৎক্ষনাৎ শাকিবকে ফোন দিয়ে পুরো বিষয়টা সংক্ষেপে বলে। শাকিব তার কাজিন। সালমার বড় বোনের একমাত্র ছেলে।
অনিক যেই পাঁচজন লোককে ভাড়া করেছিলো মেহতিশাকে কব্জায় আনতে সে পাঁচজনকে শাকিব তার টিম নিয়ে আ/ট/ক করেছে। সাথে উদ্ধার করেছে সেই ছেলেটাকে যাকে অত্যল্পকাল পূর্বে অনিক নি/র্ম/ম ভাবে হ/ত্যা করেছে।
শাকিব নিজের ব্যাক্তিগত গাড়ি এনেছে। সে গাড়িতে উঠে বসল সারতাজ, মেহতিশা। ড্রাইভিং সিটে বসল শাকিব সবেমাত্র।গন্তব্যে পৌঁছাল মিনিট দশেক পর। র্যাব-০৭ এর অফিস নিকটেই। যাবতীয় কার্যাদির ইতি টানতে সময় লাগল ভালোই। অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে সারতাজ অবিরত পায়চারি করছে। শাকিব ভাইকে দেখল। তাকে কিছুটা শান্ত করতে বলল,
-‘ কফি খাবে সারতাজ? সকাল থেকে তো মনেহয় কিছুই খাসনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খাবার আনতে বলি। ‘
-‘ কোনো কিছু খাবো না আমি। জাস্ট চলে যেতে চাচ্ছি। ভালো লাগছেনা। ‘
-‘ তোমার ক্ষিদে না পেলেও ওনার হয়তো ক্ষিদে পেয়েছে। জিজ্ঞেস কর তো একটু। ‘
সারতাজ পদচারণ থামাল। বকের মতো বড় বড় পা ফেলে শাকিবের নিকট এগিয়ে এসে ঝুকল। ভ্রু’দ্বয় কুঞ্চিত করে বলে উঠলো,
-‘ ব্যাপার কি ভাইয়া? একটু বেশিই তদারকি করছো মেহতিশার ব্যাপারে। এনিথিং রং? ‘
শাকিব সারতাজকে ভস্মীভূত করা চাহনিতে পরখ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে শুধালো,
-‘ তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ আমার ফিয়ন্সে আছে। সব ব্যাপার এতো প্যাচাও কেন তুমি? ‘
ঘুনে ধরা চেয়ারটাতে সারতাজ শব্দ করে বসলো। কেমন মড়মড় আওয়াজে কেঁপে উঠলো চেয়ারটা।দেয়ালে মাথা এলিয়ে সিলিং ফ্যানে তার দৃষ্টি স্তব্ধ হলো। কেমন নিষ্প্রাণ, মরা গলায় বলল,
-‘ আমার লাইফটাই তো প্যাচালো। তাই হয়তো সব ব্যাপার প্যাচিয়ে ফেলি। আমার কোনো দোষ নেই ব্রো। সব দোষ আমার লাইফের, লাকে’র। ‘
স্তিমিত, নিষ্প্রভতা লেপ্টে থাকা সারতাজের মুখশ্রী দেখে শাকিবের কেমন আ/ঘা/ত লাগল অন্তরালে। সে নিজেকে সামলে স্বাভাবিক গলায় বলল,
-‘ ঐ চেয়ার থেকে ওঠ সেন্টি! চেয়ার ভাঙবে মনে হয় এক্ষুনি। পরে কোমড় ভেঙে গেলে আমার দোষ দিতে পারবি না। ‘
-‘ র্যাবরা এতো কিপ্টে হয় আজ জানলাম। কেমন ভাঙাচোরা চেয়ার রেখে দাও। ‘ সারতাজের কন্ঠে স্পষ্টত বিরক্তি। শাকিব মৃদু হাসল। বলল না কিছু।
ক্ষিদে পেয়েছে মেহতিশার। অতিরিক্ত ক্ষিদের দরুন পেট গুলিয়ে বমি আসতে চাইছে।মুখ ফুটে খাবারের কথা বলতেও লজ্জা করছে। তার হাত যে একদম খালি! টাকা – পয়সা কিচ্ছু নেই। মেহতিশার চেহারা দেখে শাকিব আন্দাজ করেই নিল মেয়েটার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। লোক দিয়ে খাবার আনিয়ে নিজে নিয়ে গেল খাবার মেহতিশার কাছে।
-‘ আপনার ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। খেয়ে নিবেন। ‘
খাবারের প্যাকেট টেবিলে রাখল শাকিব। মেহতিশা নত মস্তকে বসে। নিম্ন কন্ঠে বলল কেবল,
-‘ ধন্যবাদ ভাইয়া। ‘
খাবার খেতে খেতে আচানক সে রক্তশূণ্য, ফ্যাকাসে চেহারার সারতাজকে দেখল। খাওয়া থেমে গেলো তার। উঠে দাঁড়িয়ে সারতাজের কাছে ছুটলো।
-‘ কি হয়েছে আপনার? ‘
সারতাজ কেমন খাপছাড়া, অবিন্যস্ত শব্দগুচ্ছ ঝট করে উগলে দিলো,
-‘ ঢাকা ফিরতে হবে দ্রুত মেহতিশা। আম্মু… আম্মু স্ট্রোক করেছে। ওনার অবস্থা আ/শ/ঙ্কা’জনক। ‘
#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১১|
সাদিয়া মেহরুজ
আই.সি.ইউ এর সামনে কেমন নির্জীব, নিষ্প্রাণের মতো বসে আছে সারতাজ। উদাস দৃষ্টি তার আঁটকে রয়েছে আই.সি.ইউ এর দরজায়। গুনছে অপেক্ষার প্রহর। অন্তঃকরণ তার অস্থির, নিশ্চল! ঘন্টাখানেক ধরে কেবল এভাবেই বসে সারতাজ। দৃষ্টি সরানোর নাম নেই, নড়াচড়া করার খেয়াল নেই। অদূরে বসা মেহতিশা সারতাজকে দেখছিল। অস্থির’মনা সারতাজকে দেখে তার ভীষণ মায়া হচ্ছে। মেহতিশা তার কোলে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট মেহজাকে দেখল। নিদ্রায় আচ্ছন্ন মেয়েটা। তন্দ্রা ঘোরে তার কমলাটে অধর জোড়া কাঁপছে। ফুঁপিয়ে উঠছে বারংবার। মেয়েটা আজ বেশি কেঁদেছে কি?
মেহজার মাথার নিচে নরম তুলতুলে চাদরটা দিয়ে মেহতিশা সামনে পা ফেলল।
-‘ আন্টি যদি জ্ঞান ফেরার পর আপনার এ অবস্থা দেখে তাহলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবেন তিনি সারতাজ।’
নড়চড়বিহীন সারতাজ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো পিছনে। মেহতিশাকে খেয়াল করে ছোট্ট শ্বাস ফেললো। তারপর কিয়ৎক্ষণের মাঝেই কেমন ছন্নছাড়া হয়ে উঠল সে। অস্থিরতা নিয়ে মেহতিশার কোমল হাত আঁকড়ে ধরল। বলে উঠলো,
-‘ মায়ের কখন জ্ঞান ফিরবে মেহতিশা? মা আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছেন কেন বলুন তো! আমি কি খুব বেশি অপরাধ করে ফেলেছি? ‘
মেহতিশার বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ করেছেনই তো! এই যে মানুষটার থেকে দূরে থাকে আপনি তাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। ‘
কিন্তু বলল না! সারতাজের মুখশ্রী দেখে তার মায়া হলো, কষ্ট লাগল। সে সান্ত্বনা দিলো,
-‘ খুব বেশি অপরাধ করেননি তো। সত্যি বলছি! একটু ধৈর্য ধরুন। আন্টি সুস্থ হয়ে যাবেন আল্লাহর রহমতে। ‘
শক্তপোক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরা হাতটা সারতাজ ছাড়ল না। বেখেয়ালি মনে ধরেই রইল। সারতাজ স্বরণ করলো কয়েক প্রহর পূর্বে চিকিৎসকের বলা কিছু বি/ষা/ক্ত বার্তা,
-‘ দেখো সারতাজ, স্ট্রোক করার সাথে সাথেই রোগী কে হাসপাতালে আনতে হয় কিন্তু তোমার মা কে একটু দেরীতেই আনা হয়েছে। তার ওপর তোমার মায়ের স্ট্রোক ধরনটা রিস্কি। র/ক্তনালি ব্লক হয়ে মস্তিষ্কে র/ক্ত চলাচল কমে যাওয়ার কারণে যে স্ট্রোক হয় তা সেরিব্রাল ইনফার্কশন। মস্তিষ্কের কোনো র/ক্ত/নালি ছি/ড়েঁ গিয়ে মস্তিষ্কের ভেতর
র/ক্ত/ক্ষরণ হয় একে বলা হয় হেমোরেজিক স্ট্রোক যা তোমার মায়ের ক্ষেত্রে হয়েছে। এ ধরনের স্ট্রোকে ৫০% মৃ/ত্যু ঝুঁকি থাকে। তোমার মায়ের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। বলা যাচ্ছেনা কবে বা কখন ফিরবে। তবে তার হেল্থ কন্ডিশন অতটা ভালো নয়। আমরা চেষ্টা করছি বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভরশীল। দোয়া করো। ‘
মেহতিশা অস্বস্তি নিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। হুঁশে এলো সারতাজ। অত্যল্পকাল পূর্বে নিজের করা উদ্ভট কাজটার জন্য লজ্জিত বোধ করলো। উঠে দাঁড়িয়ে সম্মুখে কদম ফেলার পূর্বে কন্ঠের খাদ নামিয়ে শুধালো,
-‘ দুঃখিত! খেয়াল করিনি আসলে। ‘
-‘ ইট’স ওকে। ‘ মেহতিশার নিম্ন কন্ঠে জবাব।
সারতাজ যেতে যেতে পথিমধ্যে একবার মেহজার প্রতি নজর বুলিয়ে হাসপাতালের বাহিরে চলে গেল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাসঁফাসঁ লাগছে কেমন। সালমার মায়াময়ী মুখশ্রী বারংবার অক্ষিপটে ভেসে উঠে তাকে নিদারুণ য/ন্ত্র/ণা দিচ্ছে।
_
-‘ এই সেন্টি রাস্তায় এভাবে বসে আছিস কেন? ভিক্ষা করতে নাকি? ‘
শাকিবের কন্ঠ শ্রবণ করে সারতাজ একটু ঘুরেও দেখল না। যেভাবে ছিল সেভাবেই স্থিরচিত্তে বসে রইল কেবল। শাকিব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ব্রিজের ওপর নিজেও পা দুলিয়ে বসলো। তাকাল সারতাজ এর পানে। ছেলেটা এক মনে কালচে, নোংরা পানির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে।
-‘ তোমার কাছে সিগারেট হবে? ‘ ম্লান গলায় জিজ্ঞেস করলো সারতাজ।
শাকিব চমকাল কি? বোধহয়! যে ছেলে তাকে সিগারেট খেতে দেখলেই চেঁচিয়ে মহল্লা মাথায় তুলতো সে কিনা সিগারেট চাচ্ছে? আশ্চর্যজনক ব্যাপার তো! শাকিব বিষ্ময় ঝাড়লো,
-‘ খালামনির শোকে তুই একদম পাগল হয়ে গেছিস সারতাজ। কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিস! আমি তোকে কখনোই সিগারেট দিব না। খালামনি ঠিক হয়ে যাবে ব্যাটা, ইনশাআল্লাহ! তুই তো অনেক শক্ত, কঠিন একটা ছেলে। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে?’
সারতাজ কিছু বলতে নিলো। তবে বলার মাঝেই ফোন কেঁপে উঠল তার। মেহতিশা কল দিয়েছে। ওর নাম্বারটা সেভ ছিলো ফোনে। ফোন কানে লাগাল সে। অপাশ হতে অত্যান্ত ব্যাস্ত শোনাল মেহতিশার কন্ঠস্বর,
-‘ সারতাজ আপনি কোথায়? জলদি আসুন। আন্টির জ্ঞান ফিরেছে। উনি আপনাকে দেখতে চাচ্ছে। ‘
সারতাজ কল না কে/টেই ছুটতে আরম্ভ করলো। পিছন থেকে চেঁচাচ্ছিল শাকিব। সারতাজের ধ্যান নেই তাতে। সে বুভুক্ষু এর ন্যায় ছুটে চলেছে সম্মুখে।
-‘ মা..,’
সালমা ভারী কষ্ট করে তার বদ্ধ নেত্রজোড়া উন্মুক্ত করলেন। তাকিয়ে দেখলেন সারতাজকে। ছেলেটা হাঁপাচ্ছে! ললাট চুইয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।মুখশ্রীতে বেজায় ক্লান্তি তার। সালমা বহু কষ্টে কন্ঠনালী দিয়ে শব্দগুচ্ছ বের করলেন,
-‘ এদিকে এসো সারতাজ। ‘
বাধ্য ছেলের মতোন সারতাজ মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। মেহতিশার অনড় দৃষ্টিপাত তখন আটকাল গিয়ে তার ওপর। সালমা আদুরে হাত বুলিয়ে দিলেন সারতাজের ঘন কেশে। বললেন,
-‘ তোমার এ অবস্থা কেন? খাওয়া – দাওয়া করো না ঠিক মতো? ‘
সারতাজ মায়ের হাত মুঠোয় পুড়লো। জবাবদিহিতা দেয়ার মতো করে বলল,
-‘ করি তো। ‘
-‘ ঘুমাও না ঠিকমতো মনে হয়। ‘
-‘ ঘুমাই তো মা। ‘
শাকিব ভেতরে প্রবেশ করলো। ললাটে ভাজ ফেলে কঠিন গলায় বলল,
-‘ তোমার ছেলে মিথ্যা বলছে খালামনি। ওকে চার পাঁচটা থা/প্প/ড় দাও তো। ‘
সালমা হাসলেন। ইশারা করে শাকিবকে কাছে ডাকলেন। শাকিব গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালো। নত মস্তকে বসে থাকা সারতাজ কি মনে করে যেন বলে উঠলো,
-‘ তোমাকে কিছু জানানোর আছে মা। ‘
-‘ বলো শুনছি। ‘
জুইঁ, জুইঁয়ের এবং শরীফের করা কর্মকাণ্ড, জুইঁয়ের মৃ/ত্যুসহ সকল ঘটনা সারতাজ মা’কে খুলে বললো। সালমা সহ বাকি দু’জন মানুষ কেবল চুপটি করে সারতাজের বলা কথা শ্রবণ করলো। শাকিবের জানা ছিল এ ঘটনা। তাই তার চেহারায় বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু মেহতিশা আশ্চর্য হয়ে শুনল! মানুষ এতোটা পা/ষা/ণ হতে পারে কি করে?
সালমার সুস্থ হাতটা কম্পমান। তার এক হাত বাদে পুরো দেহ প্যা/রা/লা/ই/জ’ড! তিনি তার সুস্থ হাত দিয়ে সারতাজের কপোল স্পর্শ করলেন। স্বাভাবিক গলায় শুধালেন,
-‘ এসব ভুলে যাও বাবা। এগুলা ভেবে কখনো কষ্ট পাবে না। আল্লাহ তায়ালা ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে কেও তা আটকাতে পারবে না। তোমাকে এই ছন্নছাড়া, নিজের প্রতি বেখেয়ালিপনা থেকে বের হতে বাবা। পৃথিবীতে কেও কারো জন্য নয়। নিজের লড়াই নিজেকেই করতে হবে। আমি তোমার পাশে থাকবো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা অব্দি। তুমি না নিউইয়র্কে যাবে আর কয়েকমাস পর? আমার কথা না ভেবে তোমার কাজে মন দাও। আমি…, আমি কতক্ষণ সুস্থরূপে থাকতে পারবো জানিনা। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে। তুমি এই পৃথিবীতে একা এসেছ, তোমাকে একাই চলে যেতে হবে। তোমার সকল বি/প/দ নিজেকেই মোকাবেলা করতে হবে। কারো আশায় বসে থাকা বোকামি। বাবা, তুমি আমার প্রথম সন্তান। তোমার বাকি দুই ভাইয়ের থেকে আমি তোমায় বেশি ভালোবাসি এ কথা বলতে দ্বিধা নেই। এমন কিছু করবেনা যাতে আমি কষ্ট পাই। আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি নিজেকে একাই সামলাবে। একাই উঠে দাঁড়াবে। কথা দাও! ‘
-‘ তুমি এসব কেন বলছো মা? ‘ সারতাজের কাতর কন্ঠ।
সালমা দ্বিতীয়বার কিছু বলতে ভারী চেষ্টা করলেন। পারলেন না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে কেমন স্থির হয়ে চোখ মুদে নিলেন। সারতাজ অস্থির হলো। শাকিব ছুটে গিয়ে চিকিৎসা ডাকলেন। সারতাজের বেহাল দশা দেখে মেহতিশা এগিয়ে এলো। শান্ত হতে বলল। তবে সারতাজ গ্রাহ্য করলো না তার কথা। মেহতিশা সালমার ফ্যাকাশে মুখোশ্রী দর্শন মাত্র তার বক্ষঃস্থল জুড়ে শীতল হাওয়া বইল। ভী/তি ঝাপটে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে। চিকিৎসক এসে সালমাকে পরিক্ষা করে ব্যাক্ত করলেন কিছু কঠিন বার্তা।
-‘ যার আ/শ/ঙ্কা করেছিলাম আমরা। শি ইজ ইন এ কোমা সারতাজ। ‘
__
দু’দিন বাদে আজ বাসায় ফিরেছে মেহতিশা। মাত্রই কর্মস্থল থেকে হাসপাতালে গিয়ে আজ বাসায় ফিরে এসেছে সে। শাকিব আজ বহু চেষ্টায় সারতাজকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পাঠানোর পরই সে নিজ নীড়ালয়ে এসেছে। শাকিব চলে গেছে চট্টগ্রাম। এ নিয়ে মেহতিশার একটু চিন্তা হলো। একা বাড়িতে সারতাজ যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে? তবে পরক্ষণেই নিজের ভাবনা চট করে হাওয়ায় মিশিয়ে দিলো। সারতাজ অমন না। ছেলেটা অবশ্যই বোকা নয়। সালমার বলে যাওয়া কথা কখনো ফেলবেনা সারতাজ। শাকিব থাকতে চেয়েছিল সারতাজের সাথে কয়েকদিন। তবে জরুরি কাজ পড়ে যাওয়াতে তাকে চট্টগ্রাম ছুটতে হয়েছে।
মেহজাকে ঘুম পাড়িয়ে মেহতিশা কেবলমাত্র খেতে বসেছিল। তৎক্ষনাৎ কল এলো তার ফোনে।সাবিনা কল দিয়েছে। সারতাজের বাসার কাজ করে সে। ঝট করে কল রিসিভ করলো মেহতিশা। সাবিনা বিলাপ করছিল তখন।
-‘ আপা…আপা গো সব্বনাশ হইয়া গেছে আপা। সারতাজ ভাইয়ের অবস্থা ভালা না আপা। আপনে একটু এই বাড়িতে আহেন আপা। ‘
চলবে~
চলবে~