শিশিরের বিন্দু পর্ব ১২

শিশিরের বিন্দু
১২ তম পর্ব

বিন্দু একটু নড়ে চড়ে বসলো। ভোরের সূর্য তখন পুরোটা ওঠে নি আবার রাতের আধাঁরের ছোঁয়াও পুরোটা যায় নি। শিশির আস্তে করে বিন্দুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এযেন সকল সুখের পরশ এসে ছোঁয়া দিল শিশিরের মনে। বিন্দু তখন জেগেই ছিল। শিশির কানের পেছনে চুল গুজে দেওয়ার সময়ই টের পেয়েছিল বিন্দু কিন্তু চোখ বুজে ছিল৷ শিশির যখন ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাগল বিন্দুর মনে। হ্যাঁ অন্যায় করেছে শিশির কিন্তু এই মূহুর্তে একদমই খারাপ মনে হল না ওর। যদি ভাল নাই বাসতো তাহলে অন্য জায়গায় কিস করত। ভাল বাসে দেখেই কপালে আদর করেছে। শিশির বিন্দুর মাথাটা ধরে নিজের ঘাড়ের উপরে রেখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এর একটু পরেই ওরা যশোর বেনাপোল কাষ্টমস এর সামনে চলে এলো। শিশির আস্তে আস্তে ডাক দিল বিন্দুকে,
___ ” এই বিন্দু ওঠো চলে এসেছি নামতে হবে এখন “।
বিন্দু কিছু না বলে পিটপিট করে চোখ খুলে চারিপাশ দেখে সোজা হয়ে বসল। বিপ্লব পিছনে ফিরে বলল,
___ ” শোন এখানে নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে হালকা কিছু খাবো। আর একবারে কলকাতা যেয়ে নাস্তা খাবো “।
___ ” ক্ষিধায় মরে যাচ্ছি আর উনি আছে কলকাতায় যেয়ে খাওয়ানোর তালে “।
তুলি উঠতে উঠতে বলল। বিপ্লব বিরক্তির সুরে বলল,
___ ” এখন সকাল সকাল ফ্রি আছে সব। একটু পরে বিশাল লাইন পড়বে। আর উনি আছে খাই খাই করার তালে!”
তুলি জানি কি কি বলল। তা আর শোনা গেল না। শিশির জোর করে বিন্দুর লাগেজ গুলো নিয়ে নিল। বিন্দুর মানা কানেই তুললনা। গাড়িতেই ওদের ডিপার্চার এর একটা ফর্ম দিয়েছি সেটা পূরন করে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সারল সবাই। কিন্তু সমস্যা হল আবিরের পাসপোর্ট নিয়ে৷ আবিরের NOC নিয়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে বেশ ভালো ক্যাঁচাল লাগে৷ পরে আবির বাদে সবাই এসে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন শেষ করে আবিরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বিন্দুর সারারাত বাসে থেকে কেমন জানি লাগছিল। মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরাচ্ছে তাই ও শিশিরের বাহু শক্ত করে চেপে ধরল। শিশির পেছন থেকে হাত দিয়ে ওকে আকড়িয়ে ধরল। নিনা বেশ চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে আবিরের জন্য।অনেক্ষন হয়ে যাওয়ার পরে বাসের সবার বিরক্তি বাড়তে লাগল তাই ওরা সবাই বাস চলে যেতে বলল। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আবির এসে হাজির। টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে তারপর এসেছে। সে যাই হোক এখন তো পৌঁছাতে হবে কলকাতা। বিপ্লব বলল,
___ ” তিনটা ওয়ে আছে এখন থেকে কলকাতা যাওয়ার। শেয়ার অটোতে বনগাঁ পর্যন্ত যেয়ে ট্রেনে করে শিয়ালদহ স্টেশনে তারপর ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে। বা বাস আছে এখান থেকে কলকাতা পর্যন্ত “।
তখন আবির বলল,
___ ” এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেছে।এক কাজ করি ট্যাক্সি করে সোজা চলে যাই হোটেলে টাকা বেশি লাগলেও তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। ”
ওরা যেখানে ছিল সেখানে অনেক ট্যাক্সির দালাল ছিল তাই কথা না বাড়িয়ে ওরা সামনে হাঁটতে লাগল। বিন্দু শিশিরকে জাপটে ধরে আছে। ওর কেন জানি না প্রচন্ড খারাপ লাগছে। কিন্তু ওরা তো জানত না সামনে আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।

ওরা আট সিটের একটা ট্যাক্সি ঠিক করল ১৪০০ রুপী দিয়ে। চুক্তি হল একদম নিউমার্কেটে ওদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ট্যাক্সিতে উঠেই বিন্দু এলিয়ে পড়লো। কেন যে এত খারাপ লাগছে সেটাই বুঝতে পারছে না। বর্ডার থেকে তিনটা নতুন সিম কিনেছে ওরা ১৫০ রুপি করে। মজার কথা হল সেই সিমে ১০০ রুপি রিচার্জ করে ২ জিবি নেট আর ফ্রি টকটাইমও পেয়েছে। আবির, বিপ্লব আর বিন্দুর আগেই সিম ছিল তাই ওরা আর কেনে নি। শিশিরের খুব চিন্তা হতে লাগল বিন্দুকে নিয়ে। সিট গুলো বেশ চওড়া ছিল। তাই বিন্দুকে বলল,
___ ” তুমি এক কাজ করো আমার কোলে মাতগা দিয়ে শুয়ে পড়ো।”
___ ” উহু লাগবে না?!”
বিন্দু মাথা নেড়ে বলল। শিশির বিরক্ত হয়ে বলল,
___ ” প্লীজ বিন্দু তর্ক করো না তো “।
বিন্দু কিছু না বলে হ্যান্ড ব্যাগটা নিচে রেখে শিশিরের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। শিশির আস্তে আস্তে বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আর জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। আশেপাশের দৃশ্য অনেকটাই বাংলাদেশের মত কিন্তু রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডের অক্ষর, মেয়েদের সাইকেল চালানো আর মাঝে মাঝে পোষাকের ফারাক দেখে বোঝা যায় যে এটা ইন্ডিয়া। বিপ্লব শিশিরকে বলল,
___ ” দোস্ত এখান থেকে সোজা যে রোড ধরে যাচ্ছি এটার নাম যশোর রোড। ”
___” কথা তো সেটা না কথা হল সবই তো ডলার এন্ডোস করে এনেছি পাসপোর্টে। রুপি করব কি করে এগুলোকে। ”
___ ” নিউমার্কেটের আশেপাশে অনেক মানিএক্সচেঞ্জ আছে ওখান থেকেই করাবো তখন রেট ভাল পাওয়া যায়। “।
আবির হামি দিতে দিতে উওর দিল। নিনা চিন্তিত ভঙিতে বলল,
___ ” বিন্দু কি অবস্থা দেখেছো তোমরা মাথাই উঠাতে পারছে না মেয়েটা।”
___ ” চিন্তা করো না আজকে রাতে ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে সব।”
বিন্দু ঘুরে শিশিরের পেটের দিকে মুখ করে শুয়ে রইল। বিন্দুর তপ্ত গরম নিঃশ্বাস শিশিরের পেট বুক সব জ্বালিয়ে দিতে লাগল। শিশির যেন অস্থির হয়ে উঠলো৷ বড়ই কঠিন হয় কিছু কিছু সময় নিজেকে আটকে রাখাটা। শিশির বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা করল। অগত্যা উপায় না পেয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রইল।

ওরা যখন নিউমার্কেটে ওদের হোটেলে পৌঁছালো তখন প্রায় ১২ টা বেজে গেছে বেলা। ক্ষুধায় সবার পেট চোঁচোঁ করছে। বিন্দু এই টানা দুই আড়াই ঘন্টা ঘুমিয়ে বেশ ভাল ফিল করছে। তাই গাড়ি থেকে বের হয়েই চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ওরা হোটেল ফ্যাব এ চারটা রুম বুক করেছিল কিন্তু যেয়ে দেখে বুকিং ক্যান্সেল করেছে হোটেল কতৃপক্ষ। সবার তো মাথায় হাত এখন কি হবে। এত এত ব্যাগপত্র নিয়ে কিভাবে কি করবে। শিশির বলল,
___ ” এত প্যানিক হয়ে লাভ নাই অন সিজন তাই হয়ত কেউ বেশি টাকা অফার করেছে দিয়ে দিয়েছে রুম। তাই এখন করনীয় হল আগে ভাত খাব তারপর হোটেল খুঁজবো “।
___ ” আশেপাশেই বেশ কিছু হোটেল আছে চিন্তা করো না ব্যবস্থা হয়ে যাবে “।
বিপ্লব আশ্বাস দিয়ে বলল। পরে ওরা সবাই একটু পাশেই যেয়ে এক মুসলিম হোটেলে খেতে বসল। খাবারের মেনু দেখে যে যার মত অর্ডার করে নিল। কিন্তু সমস্যা হল সবার পেটেই প্রচন্ড খিদা থাকা স্বত্তেও কেউই পেট ভরে খেতে পারল না। বাংলাদেশের প্রচলিত যেমন ঝাল ঝাল খাবার কিন্তু এখানকার খাবারগুলো কেমন জানি মিষ্টি মিষ্টি। সবাই কোনমতে উদরপূর্তি করে বেরিয়ে এল। একটু খোঁজাখুঁজির পরে পাশের মারকুইজ স্ট্রিটে একটা হোটেল খুঁজে পেল ওরা। হোটেলের নাম প্যারাডাইস গেস্ট হাউজ।ডাবল তিনটা এসি রুম পাওয়া গেল ১৭০০ রুপি করে। আসলে অন সিজন তাই ওরা সেটাই নিল। বিন্দু গাঁইগাঁইগুঁই করল কতক্ষন যে ও থাকবে কই। ছেলেরা এক্কটা রুমে ফ্রেশ হয়ে নিল আর মেয়েরা অন্যদুইটা রুমে৷ কিন্তু সমস্যা হল ঘুমানোর সময়। কে কই ঘুমাবে। আবির আর বিপ্লব গুন গুন করতে লাগল। আবির বলল,
___ ” আমার নিনারে ছাড়া ঘুমে ধরে না। আমি নিনার সাথে ঘুমাবো।”
বিপ্লব যে সহসা বেশি কথা বলে না সেও করুন চোখে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” দোস্ত কিছু একটা কর না প্লীজ।”
___ ” আচ্ছা দেখছি আমি কান্না কাটি থামা “।
মুখ শুকিয়ে শিশির বলল। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে যেয়ে দেখলো বিন্দু গোসল করে বের হয়ে চুল মুছতেছে। ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার চুল মুছতে লাগল বিন্দু। শিশির একটু কাশি দিতেই বিন্দু ঘুরে দাঁড়ালো ওর দিকে। শিশিরের হার্টবিট কয়েকটা মিস হয়ে গেল যেন বিন্দুকে দেখে। মিষ্টি কালারের একটা লং ফ্রক পরে আছে বিন্দু একদম পুতুলের মত লাগছে মেয়েটাকে। ভিজা চুল স্নিগ্ধ কোমল মুখবায়। আসলেই মেয়েরা গোসল করলে এত এত সুন্দর লাগে কেন। শিশির হাঁ করে বিন্দুকে দেখতে লাগল৷ বিন্দু বলল,
___ ” কি দেখছেন অমন করে “।
___ ” তুমি এত সুন্দর কেন? ”
মুখ ফসকে কথাটা বলেই শিশির জ্বিবা কামড় দিয়ে ধরল। বিন্দুর হাসি পেল খুব কিন্তু হাসি আটকিয়ে মুখ গোমড়া করে রইল। শিশির তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বলল,
___ ” বিন্দু একটা অনুরোধ ছিল, তুমি আমার সাথে থাকবা প্লীজ। ”
এই বলে আবার জিব্বা কামড়ালো শিশির। আজকে ওর হয়েছে কি? কি কি আবোলতাবোল বলেই চলেছে। আসলে বিন্দুকে এভাবে দেখে যেন ওর মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। শিশিরের কথা শুনে বিন্দুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আস্তে করে বলল,
___ ” আমি আপনার সাথে থাকব মানে কি???”
___ ” বিন্দু আমি কথা এলোমেলো করে ফেলেছি। আমি আর তুমি এক রুমে থাকি আর ওদের যার যার বউদের সাথে থাকতে দেই প্লীজ বিন্দু “।
___ ” আমি আপনার সাথে এক রুমে থাকবো মানে? ”
___ ” এর আগেও এক রাত ছিলে তুমি আমার সাথে। খারাপ যদি হতাম তাহলে প্রথম রাতেই………. ”
___” ঠিক আছে ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই “।
এটুকু বলেই বিন্দু…….

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here