শিশিরের বিন্দু পর্ব ২১

শিশিরের বিন্দু
২১ তম পর্ব

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিন্দু দেখলো এখনও বাইরে সূর্যের আলো ঠিক করে ফোটে নি। শিশির তখনও ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। বিন্দু আড়মোড়া ভেঙ্গে আবারও শিশিরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। বেশ বেলা করে বিন্দুর ঘুম ভাঙলো। ফোন হাতে নিতেই ও দেখলো প্রায় ১৬ টা মিসকল এসেছে কনার নাম্বার থেকে। বিন্দুর কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।এত কল বাসা থেকে এসেছে কোন অঘটন ঘটল না তো। বিন্দু তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করল। দুই বার রিং হওয়ার পরেই কনা ফোন রিসিভ করল,
___ ” হ্যালো “।
___ ” কি রে কনা এত এত বার ফোন দিচ্ছিলি কেন? আমি ঘুমিয়ে ছিলাম ফোন সাইলেন্স করে তাই টের পাই নি রে!”
___ ” আপু তুই আজকেই পারলে বাংলাদেশে চলে আয়।”
কনার গলাটা কেমন যেন কান্না কান্না শোনালো। বিন্দুর বুকের মধ্যে কেমন জানি বিশাল মোচড় দিয়ে উঠলো। ও তাড়াতাড়ি করে বলল,
___ ” কনা সব ঠিক আছে তো? কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।”
___ ” আপু আব্বু স্ট্রোক করেছে। হসপিটালে আছি সবাই। যদি পারিস চলে আয় এক্ষুনি।”
কনার কথা শুনে বিন্দুর হাত থেকে ঠকাস করে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেল। ফোন পড়ে যাওয়ার শব্দে শিশির লাফিয়ে উঠে বসলো। সামনে তাকিয়ে শিশির দেখলো যে বিন্দু বিছানার দিকে পিঠ দিয়ে বরফের মত দাঁড়িয়ে আছে। শিশিরের কেন জানি না মনে হচ্ছে কিছু তো একটা গড়বড় আছেই। ও তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে বিন্দুর পাশে এসে দাঁড়ালো। বিন্দুর দিকে তাকিয়ে দেখলো টপটপ করে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শিশির তাড়াতাড়ি বিন্দুকে বলল,
___ ” কি হয়েছে বিন্দু? কাঁদছ কেন?”
___ ” আব্বু স্ট্রোক……… ”
এটুকু বলেই বিন্দু শিশিরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল৷ ও কাঁদতে কাঁদতে বলল,
___ ” আমি এক্ষুনি বাসায় যাব। আমারে তুমি বাসায় নিয়ে যাও। ”
___ ” শান্ত হও কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো।”
শিশির চিন্তিত স্বরে বলল। বিন্দু কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বলল কনার ফোনে কি কি বলেছে সব। সব শুনে শিশির তখনই আবির আর বিপ্লবকে কল করে ওর রুমে এনে সব খুলে বলল। তারপর শিশির আবির আর বিপ্লবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
___ ” দেখ ট্যুরের এখনও তিনচারদিন বাকি। তোর ট্যুর শেষ করে আয় আমি বিন্দুকে নিয়ে দেশে ফিরে যাই।”
___ ” তুই কি আমাদের জাত সেলফিস মনে করিস নাকি তাই বল তো? আংকেল অসুস্থ আর আমরা এখানে ট্যুর করব। যা সালা তোর সাথে কথাই নাই।”
আবির ঝাঝাল স্বরে বলে উঠলো। বিপ্লবও আবিরের কথাত স্বায় দিল। তখনই ওরা অনলাইনে শ্রীনগর থেকে কলকাতা আর কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার ফ্লাইট বুকিং দিল। ফ্লাইট বুকিং দেওয়ার পরে বিপ্লব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
___ ” আমাদের শ্রীনগর থেকে ফ্লাইট টাইম দুপুর সাড়ে তিনটায়। এখনই বের হতে হবে। তাই সবাই কুইক রেডি হও।”
বিপ্লবের এই এক কথায় ম্যাজিকের মত কাজ হল। যে আবিরকে সবাই লেট লতিফ বলে ক্ষেপায় সেই ছেলেটা পর্যন্ত মেশিনের মত সব গোছাতে লাগল। বিন্দু এক কোনে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগল। বারবার মনে হচ্ছে আসার সময় হেসে বলেছিল ওর বাবা, অনেক গুলো চকলেট নিয়ে যেতে। পারবে তো ও ওর বাবার হাতে চকলেট গুলো তুলে দিতে? শিশির সব গোছানোর ফাঁকে ফাঁকে বারেবার বিন্দুকে স্বান্তনা দিচ্ছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ও জানে এই মূহুর্তে স্বান্তনার কোন মানেই হয় না তাও যেন ওর মন মানছে না। বিন্দুর চোখের পানি দেখে ওর বুকের মধ্যে যেন বারেবার মুচড়ে মুচড়ে উঠছে কিন্তু ও কি করে বুঝ দেবে বিন্দুকে। পেহেলগামের হোটেল থেকে ওরা শ্রীনগরের উদ্দেশ্য রওনা দিল সকাল সাড়ে দশটারও পরে৷ শ্রীনগর ফেরার পথে সারারাস্তা বিন্দু শিশিরের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। গাড়ির মধ্যে যেন বিষাদের ছায়া নেমেছে। আবির নিনা পর্যন্ত ঝগড়া বন্ধ করে মুখ ঝুলিয়ে রেখেছে। ওরা শ্রীনগর এয়ারপোর্টে যখন নামল তখন প্রায় দেড়টার কাছাকাছি বাজে। প্রায় ছুটে যেয়ে ওরা ইমিগ্রেশন এর ফর্মালিটি পূরন করে ভেতরে ঢুকলো। আবির শিশিরকে বলল,
___ ” শিশির বিন্দুকে কিছু খাওয়া। সকাল থেকে মেয়েটা কিছু খায় নি।”
___ ” দেখি চেষ্টা করে। ”
শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। বিন্দুকে জোরাজোরি করে শুধু একটু মাফিন আর জুস ছাড়া কিছুই খাওয়াতে পারল না শিশির। প্লেন একদম অনটাইমেই ছাড়ল। এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে করে ওরা শ্রীনগর থেকে যখন কলকাতা এসে পৌঁছালো তখন প্রায় বিকাল সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি। রাত আটটায় ওদের ঢাকার উদ্দেশ্যে ফ্লাইট তাই আর বের হল না ওরা এয়ারপোর্ট থেকে। কলকাতা থেকে ঢাকা আসতে প্লেনে মাত্র আধা ঘন্টা লাগে। ওরা যখন ঢাকা এসে নামল তখন প্রায় আটটা চল্লিশের কাছাকাছি। ইমিগ্রেশন এর ঝামেলা শেষ করে ব্যাগ পেয়ে যখন বাইরে বের হল তখন সাড়ে দশটার উপরে বাজে। আবির উবারের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলল। বিপ্লব সুরের সাথে কথা বলে জানলো কিবরিয়া সাহেবকে রাখা হয়েছে ল্যাব এইড হসপিটাল। গাড়ি যখন প্রায় ধানমণ্ডির কাছাকাছি তখন বিন্দু শিশিরের হাত চেপে ধরে বলল,
___ ” সবাই তোমাকে আমার সাথে দেখলে কেউ কিছু বলবে না তো?”
___ ” কিচ্ছু ভেব না কিছুই হবে না!”
শিশির ওর হাত চেপে ধরে অভয় দিয়ে বলল। ওরা যখন হসপিটালে কিবরিয়া সাহেবের কেবিনের সামনে পৌঁছালো তখন ওখানে আগে থেকেই হাবিব সাহেব জাহানারা বেগম চমক সুর কনা সবাই চুপ করে বসে ছিল। যখনই বিন্দু সুরকে দেখলো দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
___ ” ভাইয়া আব্বু কই? কেমন আছে আব্বু?”
___ ” বেশি ভাল না রে, আম্মু ভেতরে আছে। তুই এত দেরি করলি কেন। আব্বু বারেবার তোর কথা বলছিল। ”
এই সব ঝই ঝামেলায় চমকের হঠাৎ চোখ পড়লো শিশিরের উপরে। ওর বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না যে শিশির দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। ও একপ্রকার ছুটে যেয়ে ঝাপিয়ে পড়ল শিশিরের বুকের মধ্যে। শিশির পরম মমতায় আগলে ধরল ওর বোনকে। চমকের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। হাবিব সাহেব সুর আর কনাও খেয়াল করল তখন শিশিরকে। এত বছর পরে ছেলেকে দেখে হাবিব সাহেবের চোখের কোনে পানি উছলে উঠলো। কিন্তু পানি সামলে মুখ শক্ত করে বসে রইলেন এক পাশে। শিশির চমককে সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হাবিব সাহেবের পায়ের কাছে এসে বসল। ততক্ষনে কিবরিয়া সাহেবের রুম থেকে ডাক্তার সহ রাহেলাও বেরিয়ে এসেছে। প্রথমত বিন্দুকে দেখে উনি অনেক খুশি হয়েছেন কিন্তু শিশিরকে দেখে যেন উনি বরফের মত জমে গেলেন। কারো মুখেই কোন কথা নেই। শিশির এক চোখ পানি নিয়ে হাবিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
____ ” বাবা কেমন আছো “।
হাবিব সাহেব কিছু না বলেই অন্যদিকে ফিরে রইলেন। শিশির আবারও গলায় আকুতি ঝরিয়ে বলল,
___ ” বাবা কথা বলবে না আমার সাথে?”
___ ” প্রয়োজন বোধ করছি না। ”
হাবিব সাহেব কাঠ কাঠ স্বরে উওর দিলেন। বিন্দু ততক্ষনে ওর বাবাকে দেখতে কেবিনে ঢুকে গেছে। জাহানারা এবার অশ্রুভরা নয়নে হাবিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
___ ” ক্ষমা করে দেও না ছেলেটাকে। ভুল তো মানুষই করে। ক্ষমা করে দেও না ছেলেটাকে।”
___ ” বাবা দেও ভাইয়াকে মাফ করে ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।”
চমকও ওর মায়ের সাথে সায় দিয়ে বলল। হাবিব সাহেব জাহানারা আর চমকের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
___ ” আজ থেকে তিনবছর আগে যখন ছেড়ে চলে গিয়েছ তখন তো বোঝা উচিত ছিল ক্ষমা চাইতে হবে। আমি না হয় ক্ষমা করে দিলাম একটা মেয়ের লাইফ যে ও নষ্ট করে দিয়ে গেল তার কি হবে? ”
___ ” বাবা আমি বিন্দুকে বিয়ে করব আজ এবং এক্ষুনি “।
শিশির ওর চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো। হাবিব সাহেব এবার শিশিরের চোখে চোখ রাখলেন। সে দৃষ্টি যেন শিশিরকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল। ভারি স্বরে বললেন,
___ ” লাইফটাকে কি বাংলা সিনেমা পেয়েছ নাকি? যে যখন যা মর্জি তাই করবে। একটা মেয়েকে হুট করে ছেড়ে চলে গেলে। আবার মন চাইল এসে বলছ বিয়ে করবে। ফাজলামী পেয়েছ নাকি।”
হাবিব সাহেবের এই কথার উওর নেই শিশিরের কাছে।

বিন্দু কেবিনে ঢুকেই দেখলো কিবরিয়া সাহেবের বুকে হাতে নানান সেন্সর লাগানো। স্যালাইন চলছে। ওর ইচ্ছা করছিল গলা ছেড়ে কাঁদতে। অনেক কষ্টে কান্না সামলিয়ে ধী পায়ের ওর বাবার বেডের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো।

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here