শিশিরের বিন্দু পর্ব ২২

শিশিরের বিন্দু
২২ তম পর্ব

বিন্দু ওর বাবার বেডের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। দুচোখে যেন পানির অঝোর ফোয়ারা নেমেছে। একজন নার্স এসে বলল,
___ ” আপনি কি হন প্রেশেন্টের?”
___ ” আমি উনার বড় মেয়ে “।
বিন্দু হাতের উলটো পাতায় চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দিল। নার্স তাড়াতাড়ি চোখ বড় করে বলল,
___ ” উনি তো একটু সেন্স আসলেই বিন্দু বিন্দু করছেন। আপনিই কি সেই বিন্দু? ”
বিন্দু কোন কথা না বলে নিরবে মাথা ঝুলালো। এমন সময় কিবরিয়া সাহেব যেন কোন মতে টেনে চোখ খুললেন। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন সামনে একটা অবয়ব আস্তে আস্তে বুঝলেন ওটা বিন্দু। একটা হাত হালকা উঁচু করে ইশারায় ডাকলেন বিন্দুকে। বিন্দু ছুটে যেয়ে ওর বাবার হাত ধরে বসে পড়ল। ঠোঁট কামড়িয়ে বারেবার কান্না আটকানোর আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। কিছুতেই ওর বাবার সামনে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলবে না। কিবরিয়া সাহেব ফিসফিসিয়ে বললেন,
___ ” এত দেরি করলি কেন?”
বিন্দু ধরা গলায় উওর দিল,
___ ” সরি আব্বু।আর হবে না এমন।”
___ ” তোর জন্য এত এতক্ষন অপেক্ষায় ছিলাম।”
কিবরিয়া সাহেবের নিঃশ্বাস যেন ঘন হয়ে পড়তে লাগল। বিন্দু চোখের পানি মুছে নাক ফুলিয়ে বলল,
___ ” কিচ্ছু হবে না তোমার। সোজা সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবে”।
___ ” তোর উপরে আমি অবিচার করেছি অনেক পারলে ক্ষমা করে দিস আমাকে।”
___ ” আব্বু একদম বাজে কথা বলবে না বলে দিলাম। কিচ্ছু হয় নি “।
কিবরিয়া সাহেব আর কোন কথাই বলতে পারলেন না। নার্স বলল,
___ ” উনি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে আপনি এখন যান।”
এই কথা বলে এক পর্যায়ে বিন্দুকে ধরে বেরই করে দিল কেবিন থেকে। বিন্দু বের হয়ে দেখল শিশির হাবিব সাহেবের পায়ের কাছে বসা। ওকে বের হতে দেখে সুর বলল,
___ ” বিন্দু তুই বাসায় যা, সারাদিন জার্ণি করে এসেছিস যেয়ে একটু রেষ্ট কর।”
বিন্দু চোয়াল শক্ত করে উওর দিল,
___ ” আমি আব্বুকে না নিয়ে কোথাও যাব না। ”
রাহেলা এগিয়ে এসে বলল,
___ ” পাগলামী করিস না মা যা তুই আমি আর সুর তো আছিই নাকি। ”
বিন্দু কিছু না বলে চুপ করে চেয়ারে যেয়ে বসল। ওদিকে আবির নীনা, বিপ্লব তুলি আর চমক কনা সবাই চলে গেল। হসপিটালের ওয়েটিং রুমে বসে রইল শিশির বিন্দু সুর রাহেলা জাহানারা আর হাবিব সাহেব। সারাদিন জার্নিতে শিশির আর বিন্দু সত্যিই কাহিল। হঠাৎ রাত দেড়টার দিকে রাহেলার চিৎকারে ঘুম ভাঙল বিন্দুর। ঘুম থেকে উঠেই দেখল রাহেলা মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। সুর যেন পাথরের মত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফেটে পানি পড়ছে। জাহানারা রাহেলার পাশেই ফ্লোরে বসে আছে। হাবিব সাহেবকে কোথাও আর দেখা যাচ্ছে না। বিন্দু উঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ওর মায়ের পাশে। রাহেলার মুখ দুহাতের তালুতে তুলে ধরে বলল,
___ ” আম্মু কি হয়েছে তোমার এমন করে কাঁদছ কেন?”
___ ” বিন্দু রে তোর আব্বু আর নেই।আমাদের সবাইকে ফেলে চলে গেছে।”
রাহেলা গগন বিদারী চিৎকার করে বলল। বিন্দুর মাথা যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিল৷ সুর দেয়াল ঘেসেই বসে পড়ল। পিছন থেকে শিশির চুপ করে সব শুনেই যাচ্ছে। বিন্দু যেন পাথর হয়ে গেছে না ওর কানে কোন শব্দ যাচ্ছে না ওকে কোন ব্যাথা ছুঁয়ে যেতে পারছে।

কিবরিয়া সাহেবকে যখন দাফন করে আসল তখনও বিন্দু এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলল না। সবাই অনেক চেষ্টা করেও পারল না বিন্দুকে কাঁদাতে। দিন যেতে থাকল দিনের মতই। শিশির একদিন হঠাৎ বিন্দুকে কল দিয়ে বলল,
___ ” বিন্দু একটু দেখা করতে পারবে?”
___ ” হুম, কোথায় আসব? ”
___ ” তোমার অফিসের নিচে থাকে তোমাকে আমি পিক করে নেব।”
বিকাল সাড়ে পাঁচটায় শিশির বিন্দুকে পিক করল ওর অফিসের নিচ থেকে। যেয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসল দুজনে। শিশির হঠাৎ বিন্দুর হাত চেপে ধরে বলল,
___ ” বিন্দু আমার ছুটি প্রায় শেষ ডেনমার্কে ফিরতে হবে এখন। তোমার কাগজ পত্রও রেডি প্লীজ বাসায় জানাও যে আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। ”
___ ” এখন জানানোটা কি ঠিক হবে? ”
___ ” এবার গেলে তিন বছরের আগে আর আসতে পারব না। আমি তোমার টিকিট কেটে ফেলেছি আঠারো দিন পরে আমাদের ফ্লাইট। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না প্লীজ বিন্দু…. ”
শিশিরের কন্ঠে যেন অনুরোধ ঝরে পড়ল। বিন্দু বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
___ ” ঠিক আছে আজকে ভাইয়ার সাথে কথা বলব।”
___ ” আমার ফ্যামিলির অমত নেই। আম্মুকে আর চমককে বলেছি ওরা বাবাকে ম্যানেজ করে নেবে। এখন সব কিছু তোমার উপরে ডিপেন্ড করতেছে”।
___ ” ভাইয়া আম্মু যদি না মানে তখন কি হবে?”
বিন্দুর গলার সুরে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। শিশির শক্ত কণ্ঠে বলল,
___ ” আমার বউ আমি নিয়ে যাব এটাই ফাইলান। নিজের জিনিস আদায় করতে আমি খুব ভাল করেই জানি।”
টুকটাক কথা শেষে শিশির বিন্দুকে ন্যমিয়ে দিয়ে গেল ওদের বাসার সামনে। বিন্দু নামার আগে হঠাৎ করেই শিশিরকে জড়িয়ে ধরল। শিশির বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
___ ” আরে পাগলি ভয় পাচ্ছ কেন তোমার স্বামী বেঁচে আছে এখানো। বিন্দাস বলে দেও দেখো কে কি বলে!”
এই বলেই শিশির বিন্দুর ঠোঁটে ঠোঁট মিশালো। বিন্দু শিশিরকে জোর করে ছাড়িয়ে নামলো গাড়ি থেকে। শিশির চোখ নাচিয়ে বলল,
___ ” রেডি থেকো সুদে আসলে উসুল করে নেবো “।
বিন্দু মাথা নাড়িয়ে সোজা চলল ভেতরে। উপরের ছাদ থেকে এই সমস্ত ঘটনাই দেখল কনা। ওর যেন নিজের বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না বিন্দু শিশিরের সাথে কি করে আবার সম্পর্কে জড়ালো। যে ছেলে ওকে আবর্জনার মত ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল সেই ছেলের সাথে আবার জড়ালো ও…এ কি সম্ভব বিন্দুর কি একটুও আত্মসম্মান নেই না কি? কনার শরীর যেন রাগে রি রি করতে লাগল। শিশিরকে ও আগে থেকেই দেখতে পারে না কনা। চুপ করে কনা রাগ সামাল দিল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল যে করেই হোক বিন্দুকে শিশিরের কাছ থেকে সরাতেই হবে। বিন্দু রুমে এসে দেখলো কনা গম্ভীর মুখে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ইজি চেয়ারে বসে। ও ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে রইল মনে মনে নিজেকে তৈরি করল যে আজকে রাতে যেভাবেই হোক বাসায় জানাতেই হবে শিশিরের ব্যাপারটা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here