শিশিরের বিন্দু পর্ব ২৩(শেষ)

শিশিরের বিন্দু
২৩ তম পর্ব

রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে উষ্কুখুষ্কু করতে লাগল বিন্দু। কোথা থেকে শুরু করবে কি বলবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। কনা চুপ করে বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে বিন্দু কি বলবে। বেশ কিছুক্ষন পরে বিন্দু ভাত মাখতে মাখতে রাহেলার দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” আম্মু আমি কিছু বলতে চাই।”
বিন্দুর কথা শুনে সুর আর চমকও ওর দিকে তাকালো। বিন্দু গলা পরিষ্কার করে বলল,
___ ” আমি একজনকে পছন্দ করি।”
রাহেলার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো যাক এতদিনে কাউকে তো পছন্দ করেছে বিন্দু। সুর বিশাল এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
___ ” যাক এত দিনে একটা কাজের কথা বললি তুই। তোর পছন্দ মানে আমাদের পছন্দ। যাই হ্যক ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে আয়। আমরাও কথা বলি ওর সাথে”।
চমকের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল ওর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। শিশির যে খুব বেশি পছন্দ করে বিন্দুকে। এখন যদি বিন্দু অন্য কাউকে পছন্দ করে তাহলে শিশিরের কি হবে? কনা সুরের কথার মধ্যে বলল,
___ ” সবই তো বুঝলাম কিন্তু ছেলেটা কে? তাকে কি আমরা চিনি?”
বিন্দু এবার ঢোক গিলল। কারণ এবার আসছে মেইন পয়েন্ট। বিন্দু বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
___ ” আমি শিশিরকে পছন্দ করি।”
এ কথাটা শোনার সাথে সাথে খাবারের টেবিলের প্রতি জোড়া চোখ বিন্দুর উপরে যেয়ে পড়ল। কনার চোখদিয়ে যেন আগুন বের হতে লাগল। রাহেলা চুপ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল যে বিন্দু কি সত্যিই একথা বলেছে কি না? সুর কিছুক্ষন চুপ থেকে হঠাৎ চোয়াল শক্ত করে ফেলল। বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” যা বলছিস বুঝে বলছিস???”
___ ” হুম “।
বিন্দু মাথা নিচু করে উওর দিল। সুর তখন আরো শক্ত কণ্ঠে বলল,
___ ” এটা যদি তোর লাষ্ট সিদ্ধান্ত হয় তো আমি বলে দিচ্ছি এখন আব্বু নেই যে তো তোর যাবতীয় অন্যায় আবদার পূরন করা হবে। যদি ওই ছেলেকেই বিয়ে করিস তো এবাসার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে তোর জন্য”।
___ ” এসব কি বলছ তুমি”।
চমক সুরের হাতে চাপ দিয়ে ধরে বলল। সুর চমকের হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
___ ” তোর আর তোর ওই নষ্টা ফ্যামিলির জন্য হচ্ছে এসব আব্বুর জন্য শুধু বিয়ে করেছি তোকে না হয় সারাজীবন একা থাকতাম তাও তোকে বিয়ে করতাম না।”
সুরের কথা শুনে চমক কাঁদতে কাঁদতে খাওয়ার টেবিল ছেড়ে চলে গেল। সুর সব সময় এসব বলে কিন্তু বন্ধ দরজার ভিতরে বলে আজকে সবার সামনে এমন করে অপমান করটা নিতে পারছিল না চমক। বিন্দু সুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” আমার রাগ তুমি ভাবির উপরে দেখাচ্ছ কেন ভাইয়া? যা বলার আমাকে বলো।”
___ ” তোমার জন্য একটাই কথা যদি ওই ছেলেকে বিয়ে করো তাহলে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। যার কোন আত্মসম্মান নেই সে অন্তত আমার বোন না “।
___ ” আম্মু কনা তোমরা তো কিছু বলো “।
বিন্দু নিরুপায় হয়ে রাহেলা আর কনার দিকে তাকালো। কনা সোজা বাংলায় বলল,
____ ” আত্মসম্মান হারাবে ভাল কথা তাই বলে এত নিচে নেমে যাবে এট কখনও ভাবি নি আমি।তোমাকে বোন বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হচ্ছে আমার।”
কনার কথা শুনে বিন্দু এবার পুরোপুরি ভেঙে পড়লো। পানি ভরা চোখে রাহেলার দিকে তাকাতেই রাহেলা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
___ ” যদি জানতাম এই দিন দেখতে হবে তো জন্মের সময়েই লবন খাইয়ে মেরে ফেলতাম। ”
বিন্দু ডাইনিং টেবিলে হাত দিয়ে বাড়ি দিয়ে বলল,
___ ” ব্যাস অনেক হয়েছে আর না। আমি চলে যাচ্ছি থাক সবাই শান্তিতে।”
এই বলেই এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল বিন্দু ফোনটা হাতে নিয়ে। রাস্তায় যেয়ে শিশিরের নাম্বার ডায়াল করল, দুবার রিং হতেই অপর পাশে শিশিরের গলা শোনা গেল,
___ ” হ্যালো।”
___ ” তুমি কই? ”
___ ” এই তো আবিরদের বাসায় বের হব এখন। কেন কি হয়েছে?”
___ ” আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি এক কাপড়ে। ”
___ ” কই আছো তুমি ওখানেই দাঁড়াও আমি আসছি এক্ষুনি”।
বিন্দু জায়গার নাম বলতেই শিশির ফোন কেটে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার পাশে। হঠাৎ একট বিশাল আলোর ঝলক দেখলো বিন্দু তারপরই সব অন্ধকার।

___ ” বাবা তুমি এখনও এই ঠান্ডার মধ্যে লনে বসে আছো?”
রিধিতা বিরক্ত হয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল। শিশির চোখের কোনা মুছে নিল মেয়ের অলক্ষেই। দেখলে আবারও বকবে। মেয়েটা একদম ওর মায়ের মতই হয়েছে। এত মেজাজ ঠিক যেন চমকের অন্যরুপ। রিধিতার হাতটা টেনে ওকেও লনে বসায় শিশির। ছোট ছোট ঘাসের আগায় শিশিরের বিন্দু জমে আছে। সেদিকে আঙুল উঁচিয়ে শিশির বলল,
___ ” জানিস মা তোর বড় ফুপি আমার জীবনে এসেছিল এই শিশিরের বিন্দুর মত ক্ষনিকের জন্য। রোদ উঠার সাথেই মিলিয়ে চলে গেল। কিন্তু রেখে গেল তার কোমল পরশ।”
রিধিতা কিছুই না বলে শিশিরের কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রইল। ও জানে সেই নিদারুণ যন্ত্রণাময় রাতে হয়েছিল কি। বারেবার শিশিরের কাছ থেকে শুনতে শুনতে যেন চোখের সামনেই সব দেখতে পায়। সেদিন বিন্দু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ঠিক তেমন সময় একটা ট্রাক ব্রেক ফেল করে বিন্দুকে চাপা দেয়। আর সে ঘটনা স্থলেই মারা যায়। ওদিকে চমক অপমান সহ্য করতে না পেরে রুমে ঢুকের ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। শিশির যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় তখন দেখে চারিদিকে রক্ত আর রক্ত। অন্যান্যরা ততক্ষনে মেডিকেলে নিয়ে গেছে বিন্দুকে। কিন্তু কিছুতেই আর কিছুই হল না। চমক আর বিন্দুর মৃত্যুতে দু পরিবার যেন স্থির হয়ে গেছিল। চমকের আআত্মহত্যার দায়ে সুরের যাবতজীবন জেলে হয়ে যায়। আর চমক আর সুরের মেয়ে রিধিমাকে নিয়ে শিশির জার্মানি চলে যায়। রিধিমাকে ঘিরেই যেন শিশিরের পৃথিবীটা আটকে আছে। কিন্তু প্রতিদিন সকালে যেই শিশিরের বিন্দুকে কোথাও জমে থাকতে দেখে তখনই শিশিরের মনে হয়, এই তো ওর বিন্দু সচ্ছ নির্মল। মেয়েটা যেন ওর জীবনে এসেছিল ঠিক শিশিরের বিন্দুর মত ক্ষনিকের জন্য। কিন্তু তার ছাপ রেখে গেছে আজীবনের জন্য। হয়ত একেই বলে ভালবাসা।

সমাপ্ত
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here