শিশিরের বিন্দু
৭ম পর্ব
বিন্দু চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো একরাশ অভিমান নিয়ে। এই মানুষটাই একদিন সবার সামনে তাকে বিনা অপরাধে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বিন্দু তাড়াতাড়ি চোখের পানি আটকালো। আড্ডায় আড্ডায় খাওয়া শেষে করে আবির __নিনা, বিপ্লব __ তুলি, শিশির ওদের হোটেলে ফিরে গেল। বিন্দু রয়ে গেল কারণ ওর কাজ এখনও শেষ হয় নি। হোটেলে ফিরেই নিনা আর তুলিকে রুমে পাঠিয়ে আবির আর বিপ্লব এলো শিশিরের রুমে। শিশিরের রুমে ঢুকেই দেখলো শিশির ব্যালকুনিতে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবির পিছন থেকে এসে শিশিরের ঘাড়ে হাত দিতেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ও। ভেতরে এসে বসতেই বিপ্লব বলল,
___” কি রে বিন্দুকে দেখে খুব খারাপ লেগেছে “।
___ ” প্রচন্ড অনুশোচনা হচ্ছে রে দোস্ত। মেয়েটাকে এভাবে ফেলে না রেখে গেলেও পারতাম “।
শিশির অবনত মস্তকে বলল। আবির পাশ ঘেঁসে বসতে বসতে বলল,
___ ” আজকে তো কথা বলতে পারতি ওর সাথে তাই না “।
___ ” কোন মুখে কথা বলব বল, এত বড় একটা অপরাধ করে কি আবারও তার সাথে কি ভাবে কথা বলব আমি? আমি যে শুধু ওর জন্যই ফিরে এসেছি “।
___ ” এই কথাটা বিন্দুকে বলতে হবে তোর ওকে বুঝা যে তুই ভুল করেছিস। এটা তোকে পুড়িয়েছে বারেবার।”
আবির শিশিরের চোখে চোখ রেখে বলল। শিশির কিছু না বলে মাথা ঝাকালো। টুকটাক কথাবার্তার পরে ওরা যার যার রুমে চলে গেল। সারারাত জার্ণি করে এসেছে ওরা তাই একটা ঘুমের দরকার ওদের। শিশির সিগারেট ধরিয়ে আবার এসে বসল বেলকুনিতে। দুপুর হয়ে আসছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু দেখতে শয়ে হয়ে লোক আসছে। কত কিসিমের লোক যে আসছে আর শিশির বসে বসে দেখছে। যারা পর্যটন করপোরেশনের মোটেলে থাকে তাদের সেতুতে যেতে টাকা লাগে না। কিন্তু অন্যদের দশটাকা করে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। কাপ্তাই হ্রদের উপরে ঝুলন্ত বিজ্রটা বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কিন্তু মজার কথা হল শিশির এখনও পর্যন্ত যায় ওখানে। হঠাৎ শিশির দেখলো বিন্দু আসছে সাথে ওই ম্যানেজারটা। শিশির মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক বিন্দুর সাথে কথা বলবে। যেই ভাবা সেই কাজ, শিশির তাড়াতাড়ি দরজার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। বিন্দু আজকে প্রচুর টায়ার্ড সারারাত জার্ণি করে এসেছে কিন্তু একটুও রেষ্ট না করে টানা কাজ করেছে এতক্ষন। ম্যানেজারকে বলল,
___ ” সজীব শোনেন আমার যে গেস্টরা আছেন তাদের এক্সট্রা কেয়ার নেবেন। দুপুরে কে কি খাবে সেটার খেয়াল রাখাবেন। ”
___ ” জী ম্যাম অবশ্যই “।
___ ” আর হ্যাঁ আজকে আর কোন কাজ করব না। যে কাজ আছে মোটামুটি একদিনেই শেষ হয়ে যাবে। আমি আছি এই সপ্তাহটা। যদি প্রয়োজন পড়ে তো নক দেবেন।”
___ ” জি ম্যাম “।
এ কথা বলেই ম্যানেজার চলে গেল। বিন্দুর অবাক লাগে এই ছেলেটাকে দেখে জি ম্যাম ছাড়া আর কিছুই আসে না মুখ দিয়ে, আজব কাহিনী। শিশির যখন দেখলো লিফট চার তলায় উঠে এলো ও সাথে সাথে দরজা খুলে এক পাশে দাঁড়ালো। বিন্দু ব্যাগ থেকে চাবি খুঁজতে খুঁজতে আসছিল তাই আর খেয়াল করে নি যে সামনে শিশির দাঁড়ানো। হুট করে একদম বিন্দুর সামনে এসে দাঁড়াতেই ও শিশিরের বুকের সাথে ধাক্কা খেল। শিশির তাড়াতাড়ি করে ওকে ধরে ফেলল যাতে ও পড়ে না যায়। বিন্দু নিজেকে সামলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তখনও শিশির বিন্দুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু বরাবর শিশিরের চোখের দিকে তাকালো। যে কোন মূহুর্তে ওই মেঘ বর্ষণে রুপ নিতে পারে। শিশির কোমল স্বরে বলে উঠলো,
___ ” কেমন আছো বিন্দু “?
___ ” এই কথাটা তিনবছর আগে বললে হয়ত উওর দিতাম কিন্তু এখন উওর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না “।
চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলা কথাগুলো হয়ত বুকে একটু বেশিই বেঁধে। শিশির মাথা নিচু করে রইল।আসলে ওর যে বলার কিছুই নেই বিন্দুকে। শিশির মরিয়া হয়ে বলল,
___ ” বিন্দু প্লীজ কিছু কথা শুনবে, প্লীজ……? ”
___ ” এটা আমার ওয়ার্কিং প্লেস। কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা। আর আমার এখন কথা বলা বা শোনার মুড কোনটাই নেই জাষ্ট লিভ মি “।
কথা গুলো বলে বিন্দু নিজেই শিশিরের হাত সরিয়ে চলল রুমের দিকে। পিছন ফিরলে হয়ত দেখতো শিশিরের চোখ বেয়ে শিশিরের বিন্দুর মত পানি টপটপ করে পড়ছে। রুমে ঢুকেই বিন্দু বিছানার উপরে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বারেবার মনে হচ্ছিল ওই মানুষটার বুকে একটু খানি মাথা দিয়ে কাঁদতে পারলে হয়ত শান্তি লাগত। প্রথম প্রেম ছিল ওর। কোন দোষে ওরে এত বড় শাস্তি দিয়েছিল শিশির। চোখ মুছে উঠে বসল বিন্দু, ও শাস্তি দেবে শিশিরকে। কঠিন শাস্তি।
বিন্দু চেঞ্জ করে না খেয়েই পর্দা টেনে রুম অন্ধকার করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো নিমেষেই। হঠাৎ বিন্দুর খেয়াল হল দরজায় কে যেন নক করছে। বেশ জোরে সোরেই বিন্দু চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলেই দেখলো নিনা আর তুলি দাঁড়ানো। একটু দূরে আবির বিপ্লব আর শিশির দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নিনা বিন্দুকে দেখেই মুখে হাত দিয়ে ফেলল। তুলিও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আর বাকি তিনজন কথা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ঘুরে গেল। বিন্দু বুঝল না হঠাৎ এমন করার কারণটা কি? হঠাৎ বিন্দুর চোখ পড়ল ওর নিজের দিকে। স্লিভলেস টিশার্ট আর শর্টস পরে ঘুমিয়েছিল ওটা পরেই চলে এসেছে সবার সামনে। দরজা খোলা রেখেই ও ছুটলো রুমের ভেতরে। নিনা আর তুলি মুখ চেপে হাসতে হাসতে রুমে ঢুকলো। একটু পরে বিন্দু একবারে গোসল করে ফিরোজা কালারের একটা কামিজ আর সাদা পাজামা ওড়না পরে বের হল ওয়াশরুম থেকে। ততক্ষনে শিশির আবির আর বিপ্লবও এসেছে রুমের মধ্যে। সদ্য গোসল করা মেয়েদের নাকি এমনিতেই অপরুপা লাগে আর বিন্দুকে তো অসাধারণ লাগতেছে। খোলা বড় চুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তেছে। ভেজা ভ্রু ভেজা ঠোঁট শিশির যেন চোখই ফেরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে বিন্দুকে ওর এক্ষুনি চাই। বিন্দু চুলে টাওয়াল জড়িয়ে বসল বিছানায় তুলি আর নিনার পাশে। আবির বলল বিন্দুকে,
___ ” ম্যাম কালকে সারাদিন ঘুরবো ফ্রি থাকবেন “।
___ ” ভাইয়া যাকে বলে জবরদস্তি ট্রিট দেওয়া আপনারা তাই দিচ্ছেন আমাকে। ”
বিন্দু হাসতে হাসতে বলল। তখন নিনা ঠোঁট উল্টয়ে বিন্দুকে বলল,
___ ” সে তুমি যাই ভাব না কেন যেতে তো হবেই। আচ্ছা তা যাব কই আমরা “।
___ ” রাঙামাটিতে সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দির আছে। ওখানে কালকে সারাদিন ঘুরতে পারি। কালকে আদিবাসীদের অনেক বড় উৎসব চিবর দান আছে শুনেছি। ”
___ ” তাহলে কালকে সারাদিন ওখানে ঘুরবো আমরা “।
নিনা আনন্দের সাথে বলল। ওমনি আবির বলে উঠলো,
___ ” আচ্ছা চিবর মানে তো কাপড় প্রদান তাই না “।
বিন্দু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। তখন আবির বলল,
___ ” কাপড়ের সাথে বউ দান করার কোন ওয়ে নাই৷”
আবিরের কথা শুনে ঘরের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। একথা শুনে নিনা রেগেমেগে বলল,
___ ” কি তুমি আমারে দান করতে চাও “।
আবির তাড়াতাড়ি ঢোক গিলে বলল,
___ ” জান আমি কখন বললাম যে তোমারে দান করব। পাগল নাকি তুমি? ও তো বিপ্লব জিজ্ঞেস করতেছিল আমার কাছে। তাই জানার জন্য বিন্দুরে জিজ্ঞেস করলাম আর কি! ”
এবার আবিরের কথা শুনে তুলি চোখ গরম করে বিপ্লবের দিকে তাকালো। বিপ্লব এবার মেজাজ গরম করে বলল,
___ ” হারামী নিজে মরবে মরবেই আবার আমারেও সাথে করে নিয়ে মরবে।”
এমন দুষ্ট মিষ্ট খুনসুটি গুলো বিন্দু হাসতে হাসতে দেখছিল আর শিশির দেখছিল অপলক নয়নে বিন্দুকে। মেয়েটা হাসলে যে এত এত সুন্দর লাগে সেটা তো কখনও জানত না শিশির।
সবার গল্প শেষে ওরা চলল খেতে। যাওয়ার আগেই বিন্দু ফোন দিয়ে বলার কারণে যেয়ে বসতেই খাবার এসে পড়ল। রুপচাঁদা ফ্রাই, কালাভূনা,ডাল,কোরাল মাছ আর ডিম সাথে শ্বেত শুভ্র সাদা ভাত। খাওয়া শেষে সবাই চলল মোটেলের অপজিটে আর্মিদের গিফট শপে। সবাই গেলেও বিন্দু ফোন নিয়ে বসলো শান বাদাঁনো এক গাছের নিচে। তারা ভরা আকাশ আর শীতের মধ্যে বেশ ভালই লাগছে ওর। শপের ভিতর থেকে সবার হাসির শব্দ আসছে। ওর ভালই লাগছে এদের সান্নিধ্য। কিন্তু শিশিরকে যখনই দেখে মনে হয় কেউ যেন বুকের খুব নরম জায়গায় ছুরির খোঁচা দিচ্ছে। বিন্দু ফোনে মনোযোগ দিল। এমন সময় টের পেল ওদের শূন্য উঠে যাচ্ছে। পাশ ফিরে দেখলো শিশির ওকে আড়কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। পেছন থেকে আবির নিনা, তুলি বিপ্লব সবাই হৈহৈ করে উঠলো। বিন্দু চোখ বড় বড় করে বলল,
___ ” এটা কি ধরনের কাজ কারবার। ”
___ ” পাগল ধরনের কাজ কারবার।”
শিশির নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল। বিন্দু দাঁতে দাঁত পিষে বলল……..
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর
শিশিরের বিন্দু
৮ম পর্ব
বিন্দু দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
___ ” ফাজলামির একটা লিমিট আছে “।
___ ” কোলে নেওয়াটা কি ফাজলামি?? ”
শিশির হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল। বিন্দু এবার শিশিরের মুখের দিকে তাকালো। এতদম শিশিরের চোখের দিকে তাকালো। শিশির এবার বিন্দুকে আরো কাছে নিয়ে এসে হাঁটতে লাগল। বিন্দু চোখ ফিরিয়ে নিল কেন জানি না। ওই চোখের দিকে তাকালে হয়ত আবারো প্রেমে পড়ে যাবে। শিশির ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
___ ” কেমন আছো বিন্দু “।
এবার বিন্দুর অভিমানের জল চোখ থেকে নিচে গড়ালো। টপটপ করে পানি পড়তে লাগল চোখ দিয়ে। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল,
___ ” তিন বছর আগে এই কথাটা ভাবলে হয়ত আমাকে ছেড়ে যেতেন না “।
শিশির কিছু না বলে বিন্দুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছু সময় পরে একটু দম নিয়ে আবার বিন্দু দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” আজকের রাতটুকু আমাকে দেবে আমি কিছু কথা বলব তোমার সাথে।”
বিন্দু মুখ ঘুরিয়ে বলল,
___ ” না একদম না। আমার কাছে কোন সময় নেই আপনার জন্য।”
___ ” বিন্দু আমি জোর করে সময় আদায় করে নিতে পারি। কিন্তু সেটা চাচ্ছি না। প্লীজ একটু সময় দেও। ”
বিন্দু কিছু না বলে মুখ নিচু করে রইল। হোটেলের সামনে এসে শিশির বিন্দুকে নামিয়ে দিল। পেছনে দেখলো সবাই হেঁটে হেঁটে হাসাহাসি করতে করতে আসছে। বিন্দুকে নামিয়ে দিতেই ও হনহন করে ভেতরে হেঁটে চলে গেল একবারো পিছু ফিরে তাকালো না। পিছন থেকে আবির এসে শিশিরের পেটে গুঁতো দিয়ে বলল,
____ ” কি রে হিরো কেমন লাগল হিরোইনরে কোলে নিয়ে। ”
শিশির কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইল। কারন ওর মনে মধ্যে ঘুরছে বিন্দুকে সব বুঝিয়ে বলার পরে বিন্দু বুঝবে তো ওর সিচুয়েশনটা। বিপ্লব তখন আবিরের প্রশ্নের উওর দিল ঠেস মেরে,
___ ” এত দিন পরে এত কাছাকাছি দুইজনে তারপরও তুই জিজ্ঞেস করিস কেমন লাগে? ”
___ ” আসলেই আমার মাথায় বুদ্ধি কম রে “।
আবির মাথায় টোঁকা দিয়ে বলল। শিশির গম্ভীর স্বরে বলল,
___ ” অনেক রাত হয়েছে যার যার রুমে যেয়ে শুয়ে পড়।”
___ ” আসছি ঘুরতে তাও তুই এত তাড়াতাড়ি ঘুম পড়ায়ে দেওয়ার প্লান করতাছত “।
আবির মুখ ঝুলিয়ে বলল। বিপ্লব শিশিরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে চুপ রইল। সবাই লিফটে উঠে যার যার রুমে চলে গেল। শিশির ওর রুমে বসে একের পরে এক সিগারেট ধরাতেই লাগল। মনে হচ্ছে এই ধোঁয়ার সাথে যেন মিশে যাচ্ছে সব না বলা কষ্ট গুলো। এলোমেলো লাগছে শিশিরকে বারে বার। এমন করে কতক্ষন যে ছিল সেটা শিশির জানে না। ঘোর ভাঙল দরজার শব্দে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় রাত বারোটার কাছাকাছি। এতক্ষন হয়ে গেছে ওর তো যাওয়ার কথা বিন্দুর কাছে। ইসস মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত। কেমন যে লাগছে। কিন্তু এত রাতে কে এলো। শিশির তাড়াতাড়ি যেয়ে দরজা খুলেই হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। এলোমেলো কাপড় চোপড় মাথায় চুলগুলোও এলোমেলো প্রচন্ড উত্তরা বাতাসে উড়ছে চুল গুলো। এই শীতের মাঝে পাতলা একটা টিশার্ট আর শর্টস পরে দাঁড়ানো ওর দরজার সামনে বিন্দু। শিশির যেন ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। শিশির বিন্দুকে টেনে রুমের ভেতরে এনে দরজা লাগিয়ে দিল। লাইটের আলোতে দেখলো বিন্দুর চোখ জোড়া টকটকে লাল। প্রচুর কেঁদেছে হয়ত। বিন্দু হঠাৎ শিশিরের বুকে মাথা দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বারেবারে বলতে লাগল,
___ ” আমাকে কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন? আমার কি দোষ ছিল বলতে পারে? আমি তো আপনাকে কিছুই করি নি তাহলে আমাকে এত এত কঠিন শাস্তি কেন দিয়ে গেলেন আপনি? ”
বিন্দুর প্রতিটি কথা যেন শিশিরের বুকে বিঁধতে লাগল ছুরির মত। বিন্দুর চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে শিশিরের বুক। বিন্দু কেঁদেই যাচ্ছে অঝোরে। শিশিরের কি হল সেটা শিশির নিজেও জানে না, হঠাৎই বিন্দুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বিন্দু যেন তখনও বেহুঁশের মত কেঁদেই যাচ্ছে। শিশিরের অনুশোচনা আগেও হয়েছে কিন্তু এবারে মত খারাপ যেন আর কখনও লাগে নি। নিজের খাম খেয়ালীতে এত এত কষ্ট দিয়েছে নিজের ফ্যামিলি আর এই মেয়েটাকে এর মাফ যেন নেই। বিন্দু তখনও বিড়বিড় করেই যাচ্ছে, কেন শিশির এমন করল। হঠাৎ শিশির খেয়াল করল, বিন্দুর হাত পা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। এই শীতে কিছুই পাতলা পাতলা জামাকাপড় পরে আছে ও।শিশির বিন্দুকে টেনে বিছানায় নিয়ে গেল। বিন্দুর পুরো শরীর কম্বলে মুড়িয়ে দিয়ে চুপ করে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। একটু ধাতস্ত হতেই বিন্দু তাড়াক করে উঠে বসল। শিশিরের কাছে থেকে দূরে সরে যেতে চাইলে শিশির ওর হাত চেপে ধরল। বিন্দুর চোখে চোখ রেখে গভীর স্বরে বলল,
___ ” জানো বিন্দু ওই দিন কেন পালিয়ে গিয়ে ছিলাম কাপুরুষের মত “?
বিন্দু এবার ছুড়াছুড়ি থামিয়ে বড়বড় পানি ভরা চোখে তাকালো শিশিরের দিকে। শিশির বলতে লাগল,
___ ” হুট করে বিয়ে ঠিক করেছিস সবাই। জিনিসটা আমি মানতে পারি নাই। তারপর তোমার সাথে দেখা হল একটু কথা হল। কিন্তু গায়ে হলুদের দিন যে কি হল সেটা আমি নিজেও জানি না। ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি। সংসার সামলানো, অন্য মেয়ের দ্বায়িত্ব নেওয়া সব মিলিয়ে আমি পারছিলাম না বিন্দু।”
শিশির বলেই চলল,
___ ” তাই ডেনমার্কের চাকরির অফার পাওয়া নিজের ক্যারিয়ার সব ভেবে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু একবারও তখন তোমার কথা,মনে আসে নি। কিন্তু জানো বিন্দু বিদেশ যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে তোমার কথা মনে আসা শুরু হল৷ নিজের মধ্যে অনুশোচনা আরম্ভ হল। নিজেকে কোন ভাবেই ক্ষমা করার উপায় আমার কাছে নেই। যতটুকু না তুমি কষ্ট পেয়েছ তার চেয়ে বেশি শাস্তি পেয়েছি আমি আমার অপকর্মের।”
শিশিরের গলা এবার ধরে এলো। বিন্দু আগ্রহ আর চোখের পানি নিয়ে শিশিরের কথা শুনেই যাচ্ছে। শিশির বিন্দু হাত শক্ত করে চেপে ওর বুকে ধরে বলল,
___ ” বিন্দু তোমার তো আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ফ্যামিলি পাশে ছিল। কিন্তু জানো গত তিনবছর আমার আব্বু আমার সাথে কথা বলে না। বোনটা আর মা কথা বলে অপরিচিত মানুষের মত। আর তুমি…..?
চমকের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখো সবার আগে প্রশ্ন করতাম তুমি কেমন আছো? বিন্দু আমি আমার কৃতকর্মের ফল পাচ্ছি পারো না আমাকে একটু ক্ষমা করতে “।
শিশির বিন্দুর হাত কপালে লাগিয়ে টপটপ করে পানি ফেলতে লাগল। বিন্দুর মনে হচ্ছিল এ পৃথিবীতে একজনই অসহায় আছে আর সেটা হল ও। শিশিরকে ক্ষমা করা উচিত না কি করা উচিত সেটা ও মিলাতেই পারছে না। উপরওয়ালা এ কেমন সংকটে ফেলেছে ওকে।
শিশির তাড়াতাড়ি বিন্দুর হাত ছেড়ে চোখ মুছে নিল। পৃথিবীতে বিরল একটা জিনিস হল ছেলেদের চোখের পানি। যদি কোন ছেলে কোন মেয়ের সামনে কাঁদে তো বুঝতে হবে ওই মেয়েটাই ওই ছেলেটার পৃথিবী। হঠাৎ কনার বলা এই কথা গুলো মনে পড়ল বিন্দুর। আসলেই কি তাই হয়? বিন্দু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় রাত দুটো বাজতে চলল। শিশির তখন ও দিক তাকিয়ে চোখ মুছে বলল,
___ ” কফি খাবে বিন্দু “।
বিন্দু মাথা ঝুলিয়ে হ্যাঁ বলল। প্রচুর শীত লাগছিল ও। শিশির গেল কফি বানাতে তখন বিন্দু কম্বলটা কান পর্যন্ত টেনে দিয়ে বালিশের সাথে ঢেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। শিশির দুই মগে কফি এনে দেখলো বিন্দু কান পর্যন্ত কম্বল টেনে দিয়ে শুয়ে আছে আস্তে আস্তে ডাক দিল কিন্তু কোন সাড়া নেই। কম্বল একটু খানি সরিয়ে দেখে বিন্দু ঘুমিয়ে পড়েছে। শিশির আর কিছু না বলে লাইট অফ করে বেড সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে কফির মগ হাতে বই নিয়ে বসল। বিন্দুর শরীরে ভাল করে কম্বল টেনে দিল ও। পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে আসলো শিশিরের সেটা ও নিজেও জানে না। প্রচন্ড শীতে একটু উষ্ণতার জন্য ঘুমের মধ্যে ও নিজেই কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। এ যেন না চাইতেও দুজনের কাছাকাছি আসা।
পরের দিন সকালে নিনা আর তুলি রেডি হয়ে আটটার দিকে গেল বিন্দুর রুমে ওকে ডাকতে। অনেকক্ষন ডাকাডকির পরেও দরজা খুললনা যখন বিন্দু। ওরা আবার গেল নিজেদের রুমে। পরে আবির বিপ্লবকে সাথে নিয়ে চারজনে এলো শিশিরের রুমের সামনে। তিনবার নক করার পরে শিশির আলুথালু বেশে এসে দরজা খুলে দিল। চোখ ঢলতে ঢলতে শিশির দেখলো সামনে চারজন দাঁড়ানো। কিন্তু তখনও শিশিরের খেয়াল নেই যে বিন্দু অঘোরে ওর খাটের উপরে ঘুম। শিশিরকে এই অবস্থায় দেখে আবির বিরক্ত হয়ে বলল,
____ ” সালা এখনও তুই ঘুমাচ্ছি? ”
___ ” আচ্ছা তোরা বয় আমি রেডি হচ্ছি দশমিনিট।”.
শিশির একথা বলেই টাওয়াল কাঁধে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওরা সোফায় বসতেই নিনার চোখ পড়লো খাটের দিকে। কম্বলের তলা থেকে কার যেন পায়ের আঙুল বের হয়ে আছে। ও আবিরের হাত ধরে ঝাঁকা দিল। আবির বিরক্ত হয়ে তাকাতেই, নিনা ইশারা দিয়ে খাটের উপরে দেখালো। আবির যেন জমে গেল। আরো ভয় লাগতে লাগল ওর যদি নিনা আর তুলি বিন্দুকে বলে দেয় তখন কি হবে। আবির এবার বিপ্লবকে দেখালো কাহিনীটা। তাড়াতাড়ি দুই বন্ধু নিনা আর তুলিকে চাবি দিয়ে ওদের রুমে পাঠিয়ে দিল। আবির মাথায় হাত দিয়ে বল্লল,
___ ” বিপ্লবরে সব শেষ রে সব শেষ “।
___ ” যদি বিন্দুর কানে এসব যায় তখন কি হবে রে আবির? ”
বিপ্লবও খুবই চিন্তিত হয়ে বলল। ঠিক এমন সময়………
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর