#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ০৭
#Rifat_Amin
প্রহর ভিলার মুল ফটকের সামনে ঐশী আর আমি নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে গম্ভীরমুখে অচেনা একটা বাইকের উপর ঠেস দিয়ে আছেন প্রহর ভাই। ঐশীর ভেতরে অলরেডি কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। কেনো এত লেট করলাম বাসা ফিরতে? এই প্রশ্নে আটকে গিয়েছি দুজন। আমি মাথা নিচু করে ভয়ভয় চোখে একবার প্রহরভাইয়ের দিকে তাকালাম। অতঃপর হাতের ঘড়িটার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম সঁন্ধ্যা ৭ঃ০৯। একটু আগে সূর্য হারিয়ে গিয়ে পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এসেছে। সাথে অন্ধকার নেমে এসেছে আমাদের মতো নিষ্পাপ দুটি মানবীর পানে। প্রহরভাই বাইক থেকে নেমে একটু এগিয়ে এসে বললেন,
‘বললি না তো কোথায় ছিলি? ‘ (প্রহর)
‘ ভ-ভাইয়া একটা দরকার ছিলো, তাই এত লেট হয়েছে। সরি! আর হবে না। ‘ (ঐশী)
‘আচ্ছা ভেতরে যা। পরে এই নিয়ে কথা হবে। ‘ (প্রহর)
সাথে সাথেই আমরা দুজন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। কি বললেন উনি? এত সহজে ছেড়ে দিলেন আমাদের? এটা কি আদৌ প্রহরভাইয়ের থেকে আশা করা সম্ভব? আমরা তো ইন্না-লিল্লাহ পড়ছিলাম অলরেডি। তবে সে যাই হোক, আমরা ছাড়া পেয়েছি এটাই বড় কথা। আর কোনো কথা না বলে দুজন কেটে পড়বো, এমন সময় প্রহরভাই কঠোরস্বরে বললেন,
‘ আমি শুধু ঐশীকে যেতে বলছি। রশ্নিকে নয় ‘ (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের কন্ঠে রশ্নি নাম শোনার সাথেই সাথেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো আমার। ঐশীকে যেতে বললো অথচ আমার বেলায় এমন! আমি মনমরা হয়ে ঐশীর পানে একবার চাইলাম। দেখলাম ঐশী ঠোঁটটিপে হাসছে। আশ্চর্য! আমার দুঃখের দিনে এমন করে হাসছে কেনো ও? অতঃপর কোনো কথা না বলে গেট পার হয়ে ভেতরে চলে গেলো সে। কু’ত্তি তোর কোনো দিন বিয়ে হবে না। আমার বিপদের সময় চলে গেলি৷ অথচ আমি? আমি সেখানেই আসা’মির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রহরভাই একটু পর আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমিতো মাথা তুলবই না সিদ্ধান্ত নিলাম,
‘ কোথায় যাওয়া হয়েছিলো শুনি? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা দে। ‘ (প্রহর)
আমি চোখতুলে একবার তাকালাম। আবারো চোখ নামিয়ে ফেললাম। ঐ চোখদুটোর দিকে কি তাকানো যায়? তাঁর থেকে দু তিনটা থাপ্প’ড় খাওয়া ভালো। মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই যেনো কত কথা বলছে। অথচ আমি একটাও বুঝতে পারছি না। আমি স্বল্পস্বরে বললাম,
‘ ককলেজে একটা ইম্পর্টেন্ট ক্লাস ছিলো ভভাইয়া। আর তারপর আমরা দুজন একটু ঘোরাঘুরি করেছি! তাই লেট হলো। আর হবে না প্রমিস! ‘ (আমি)
‘ এত তোতলাতে হবে না। আমি যে ছেলেদুটোকে তোদের পিছনে লাগিয়ে দিয়েছিলাম তারা তাহলে মিথ্যা বললো আমায়! (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের এই কথা শুনে আমি পারলে মাটির নিচে ঢুকে যাই! তিনি তলে তলে এতকিছু করেছেন। হায় আল্লাহ! আমি এবার কোথায় পালাই? নিজের বোনকে ধরলো না। এখন আমার উপরেই সব রাগ ঝাঁড়বে নাকি? আমি আর কোনো কথা বললাম না৷ কিছু বলার ভাষা আছে নাকি? একটু পর দেখলাম পুরো গেট উম্মুক্ত হলো। বাড়ি থেকে প্রহরভাইয়ের সব থেকে লেটেস্ট কারটা বের করলেন কেউ। সাথে বাসা থেকে বের হলেন দুজন সাদা ইউনিফর্ম পড়া লোক। লোকদুটো কেমন জানি রোবোট প্রকৃতির৷ প্রহরভাইয়ের গার্ড নাকি? হতেও পারে, সেলিব্রিটি মানুষ বলে কথা। গাড়িটা যখন আমাদের সামনে দাঁড় হলো, তখন গাড়ির গ্লাস খুলার পর দুটো হাস্যোজ্জ্বল চোখ সামনে পড়লো আমার।
‘হেই পিচ্চু। কেমন আছো? ‘ (মিল্লাত)
গাড়িতে যাকে দেখলাম এবং তাকে দেখার সাথে সাথেই আমার মন খারাপ হাওয়া হয়ে গেলো। সাথে মনে পরে গেলো পুরোনো সব কথা। যখন প্রহরভাইয়ের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলাম। তখন এই মিল্লাত ভাই আমাকে সবসময় সাপোর্ট করতো। আর প্রহরভাইকে ধমক দিতো। কত সুন্দর যে ছিলো সেই দিনগুলো। মিল্লাতভাই হলো প্রহরভাইয়ের বেস্টফ্রেন্ড। এতদিন লাপাত্তা ছিলো। অনেকদিন পর তাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। সাথে সাথেই যেনো আমার সব জড়তা কেটে গেলো। আমি অতিউৎসাহে জবাব দিলাম,
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া। কতদিন পর যে আপনাকে দেখলাম। অনেক, অনেক, অনেক ভালোলাগছে আমার। ‘ (আমি)
মিল্লাত ভাই গাড়ি থেকে বের হলেন। প্রহরভাইয়ের সামনে গিয়ে বললেন,
‘পিচ্চু তো বড় হয়ে গেছে দোস্ত। এখন কি পিচ্চু বলা মানায়? ‘ (প্রহর)
প্রহরভাই হাসলেন। জবাব দিলেন না। আমি কপট রেগে বললাম,
‘ আমি কোথায় বড় হলাম ভাইয়া? আপনি সারাজীবন আমাকে পিচ্চু ডেকেই যাবেন। ‘ (আমি)
‘হুমমম ডাকবো’ই তো পিচ্চু। আচ্ছা, তোমাদের মাঝে আর আমি কাবাব মে হাড্ডি না হই। আজ জরুরী একটা কাজ আছে। কাল ইন শা আল্লাহ জমিয়ে আড্ডা হবে? ‘
আমি ক্ষুণ্ণ হলাম। এতদিন পর দেখা হলো। অথচ কত ব্যস্ত সবাই!
‘এক্ষুনি চলে যাবি? একটু থেকে যা। ‘ (প্রহর)
‘ না দোস্ত। প্রমিস! চিটাগংয়ের কনসার্টে আমি অবশ্যই তোর সাথে যাবো। আর কাল তো দেখা হচ্ছে’ই। বায় বায় পিচ্চু! এইযে নাও চকলেট। আনতে ভুল করিনি কিন্তু। ‘ (মিল্লাত)
আমি হাত বাঁড়িয়ে চকলেট দুটো হাতে নিলাম। চোখদুটো ভীষণ জ্বলছে। আজ কতদিন পর দেখা হলো! অথচ তিনি ভালো করেই মনে রেখেছেন, আমি যে তার চকলেটের অপেক্ষায় প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকতাম। তখন তো ক্লাস নাইনে ছিলাম আমি। বেশীকিছু বুঝতাম না। চকলেট নিতে দ্বিধাবোধ করতাম না। অথচ আজ একটু বড় হওয়ার পরও মনে হচ্ছে আমি সেই পনেরো বছরের কিশোরি। যে কি না প্রহরভাইয়ের কড়া শাষণে অতিষ্ঠ হয়ে মিল্লাতভাইকে বিচার দিতো। মিল্লাত ভাই প্রহরভাইয়ের ঠেস দেয়া বাইকটা নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। এখন বুঝলাম বাইকটা তাহলে মিল্লাতভাইয়ের ছিলো।
‘ বড় স্যার বলেছেন, আপনি কোথাও বের হলে আমরা যেনো আপনার সাথে সাথে থাকি। ‘
সাদা পোশাকধারী দুজন লোকের মধ্যে একজন কথাটি বললো। প্রহরভাই যেনো বিরক্ত হলেন। গম্ভীস্বরে বললেন,
‘ বাবাকে বলে দিও আমি ছোট বাচ্চা না। আর পারলে ম্যাডামকে একটু টিস্যু দাও তো। ‘ (প্রহর)
চমকে উঠলাম আমি। আমার চোখ দিয়ে একটু আবেগে পানি বের হয়েই গেছে নাহয়, তাই বলে এভাবে অপমান! লোকদুটো কিছুই না বুঝে বললো,
‘ জি স্যার! ‘
‘ প্লিজ তোমরা যাও তো। ডিস্টার্ব করিও না। তোমাদের দরকার হলে আমি ডেকে পাঠাবো। আপাতত বাসার ভেতরে যাও। ‘ (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের ঠান্ডা মাথার হুমকি খেয়ে লোকদুটো চুপসে গেলো৷ কোনো কথা না বলে সেখান থেকে আস্তে আস্তে কেটে পড়লো। অতঃপর প্রহরভাই গাড়ির ভেতরে বসে বললো,
‘ উঠে পড়েন ম্যাডাম। ‘ (প্রহর)
আমি অবাক হলাম না। উনি যে এমন কথা বলবেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।
‘আমি এখন কোথায় যেতে পারবো না। চেন্জ করা দরকার। অনেক বোরিং লাগছে । ‘ (আমি)
‘ উঠতে বলছি। আর কিছু শুনতে চাইনি ‘ (প্রহর)
উনার ধমকে চুপসে গেলাম। আশ্চর্য! ধমক দেয়ার কি আছে?
‘ আমি এখন উঠতে পাবো না। প্লিজ! ‘ (আমি)
উনি কথা শুনলেন না। গাড়ির ভেতর থেকে একটু আলগা হাত বাড়িয়ে হেচকা টানে ভেতরে ঢুকালেন উনি। মুহুর্তের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তারাতারি ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় মাথাটা গিয়ে উনার বুকে ধ্রুম করে লাগলো। সাথে সাথেই পুরো শরীরটা যেনো ঝিমঝিম করে উঠলো৷ চোখদুটো ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো। একটা মানুষ এত পাষাণ আর রাগি হয় কিভাবে? ভীষণ ক্লান্ত আমি। এই সময়ে কে যেতে চাইবে বাইরে? একটু রেস্ট দরকার আমার। কিন্তু তিনি বুঝলেন না। আমি ওনার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করে হাত দিয়ে চোখদুটো ঢেকে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলাম। উনি মিনিট খানেক পর টিস্যু এগিয়ে দিলেন। আমি নিলাম না। হাতের পিঠ দিয়েই চোখমুছে কঠিন স্বরে বললাম,
‘কি সমস্যা আপনার? আপনার কথায় কি সব হবে? আচ্ছা তবে তাই হোক, যা ইচ্ছে করেন। আমার যায় আসে না। এখন চাইলে আমায় মে’রে নদীতে ভাসায় দিন। ‘ (আমি)
প্রহরভাই সরু চোখে চাইলেন। পাষাণ কন্ঠে বললেন,
‘ তোকে মা’রতেই যাচ্ছি। গাড়িতে পানি, টিস্যু, কাপর আর তোর সব প্রয়োজনীয় জিনিস আছে। আমি দশ মিনিট পর এসে যেনো দেখি তুই ফ্রেস হয়ে লক্ষী মেয়ের মতো বসে আছিস এখানে। তোর সময় এখন থেকে শুরু হচ্ছে। ‘ (প্রহর)
প্রহরভাই চলে গেলেন। আমি প্রহরভাইয়ের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
—–
তুমি, ভাবনায় ডুবে থাকা
দূর আকাশের নীলিমায়।
তুমি,হৃদয়ে লুকোনো প্রেম,
মিশে থাকা গভীর মুগ্ধতায়।
তুমি এলে – মন ছুঁলে
অন্যরকম হয়ে যাই।
ইচ্ছে গুলো – জড়োসড়ো,
ভালোবাসি বলে তাই।
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি !
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি !
চিলেকোঠায় ইচ্ছে গুলো
নেইতো কোনো দাড়িকমা।
বুক পকেটে,তোমার জন্য,
রেখেছি , ভালোবাসা জমা।
শিশির রোদের লুকোচুরি,
তোমার হাসি ফোটা বকুল।
ছোঁয়া পেলে স্বপ্ন হাজার,
আনমনে হয়ে যাই ব্যাকুল।
তুমি এলে – মন ছুঁলে
অন্যরকম হয়ে যাই।
ইচ্ছে গুলো – জড়োসড়ো,
ভালোবাসি বলে তাই।
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি !
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি ! –
গিটারটা ব্রেঞ্চের সাইডে রেখে মুচকি হাসলো প্রেম৷ সারা এখনো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রেমের পানে। সে শুধু নিয়ন আলোয় প্রেমের এলোমেলো ছোট চুল আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে মত্ত রয়েছে। আর ঠোঁটের সেই হাসির ঝিলিক৷ প্রেমের গান যে ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে সেটা বুঝতেই পারেনি সারা। প্রেম সারার পাগলামো দেখে আবারো হাসলো৷ চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে বললো,
‘কোথায় হারালেন ম্যাম ‘ (প্রেম)
সারা চমকে উঠলো। সাথে সাথে প্রেমের সম্মোধনে একটু লজ্জাও পেলো যেনো। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো অনেক কাপল জড়ো হয়ে এতক্ষণ প্রেমের গান শুনছিলো। সময়টা এখন রাত আটটার কাছাকাছি। সেই সকালে বেড়িয়েছে দুজন। আর বাসায় ঢুকেনি। কিভাবে যে দিনটা কেটে গেলো! তবে সারা জানে, আজকের দিনটাই ওর জীবনের সব থেকে আনন্দের দিন। তখন একটা অচেনা মেয়ে সামনে এসে বললো,
‘ ভাইয়া আপনার কন্ঠটা যে এত সুন্দর। যা বলার মতো না। আমি আপনার গানটা ভিডিও করেছি। ফেসবুকে কি আপলোড দিতে পারি? ‘
প্রেম মুচকি হেসে বললো,
‘ না আপু৷ আপনার কাছে রাখেন সমস্যা নাই। তবে আপলোড করিয়েন না। ‘
মেয়েটা একটু অবাক হলো। তবে সারা মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমাকে ভিডিওটা নেয়ারবাই-শেয়ার করেন তো আপু। ‘ (সারা)
মেয়েটা না চাইতেও ভিডিওটা সারাকে দিয়ে দিলো। সারা প্রেমের কাছে গিয়ে বললো,
‘ এটা ইউটিউবে আপলোড দিবো। হিহিহি’ (সারা)
প্রেম বাঁধা দিতে পারলো না। সারাটাদিন সারাকে হাসিখুশি রেখেছে সে। এখন বাধা দিয়ে মুডটা খারাপ করে দেয়ার মানে হয় না। #শুধু_তুই
—-(সিজন০২)
#পর্বঃ০৮
#Rifat_Amin
‘ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে কি করবা? ‘ (প্রেম)
প্রেমের কথায় দুর্বোধ্য হাসলো সারা। চোখ ছোট ছোট করে বললো,
‘ সেটা আমার ব্যাপার। তুমি শুধু দেখে যাও। ‘ (সারা)
ঠিক তখনি তাঁদের সামনে বাইক উপস্থিত হলো ফারহান। ফারহান হলো প্রেমের বেস্টফ্রেন্ড। প্রেম যে কাজই করুক না কেনো। ফারহান তাতে সঙ্গ দেবেই। পড়াশোনা থেকে খু’নখারাবি। সবকিছুই তাদের হাতের খেলা।
‘কি’রে এসময় ডাকলি কেন? কোনো দরকার? ‘ (ফারহান)
বাইকে বসা অবস্থায় বিরক্তকন্ঠে বললো ফারহার। প্রেম ব্রেঞ্চ থেকে গিটারটা কাঁধে নিয়ে বললো,
‘সারাকে একটু বাসায় পৌঁছে দে তো। আমি গেলে নিশ্চই ঝামেলা বাঁধবে। ‘ (প্রেম)
প্রেমের কথা শুনে সারার মনটা মুহুর্তেই খারাপ হয়ে গেলো। সারাটাদিন সে বাড়ির বাইরে আছে। আরেকটু থাকলে কি হয়? বাসায় মা’ইর তো খেতে হবেই। ফারহান বাইকটা স্টার্ট করে বললো,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। উঠে পড়ো সারা। আর তুই রাত ন’টায় আমার বাসায় আসবি কিন্তু। মনে থাকে যেনো।’ (ফারহান)
সারাকে বাইকে উঠতে বলে প্রেমের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলো ফারহান। প্রেম শুষ্ক চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
‘তার আর দরকার হবে না। ইফতেখার উদ্দিনের চ্যানেলে কাজ করার সুযোগ হাতে এসে গেছে। আপাতত ওখানে একটু ভালো কাজ দিতে পারলেই হলো ‘ (প্রেম)
ফারহান অবাক হয়ে গেলো। এতদিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষায় মরিয়া হয়ে ছিলো দুজন। ফাইনালি আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। তাই বুঝি প্রেমকে এত হাসিখুশি দেখাচ্ছে! ফারহান বিষ্ময়কন্ঠে বললো,
‘ আমি সত্যি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না! সে যাই হোক, পার্টি দিবি কবে? ‘ (ফারহান)
ফারহান, প্রেমের কথায় সারা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো। প্রেম চ্যানেলে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে এটা অবশ্যই খুশির সংবাদ। কিন্ত তাই বলে পার্টি! ওকে, আমিও তাহলে সেই পার্টিতে জয়েন হবো। সারা মনমরা হয়ে প্রেমকে বললো,
‘আমাকে নিবা না পার্টিতে?’ (সারা)
প্রেম রহস্যহাসি হেসে বললো,
‘ না। মেয়েদের ওখানে এলাউ না। ‘ (প্রেম)
প্রেমের কথায় সারার মন খারাপ তীব্র হলো। এদিকে সারার মন খারাপ হয়েছে দেখে ফারহান কথা বাড়াতে চাইলো না। সারাকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘ উঠে পড়ো সারা’ (ফারহান)
সারা মুড অফ করে ফারহানের বাইকে উঠে পড়লো। প্রেম তা দেখে মুচকি হাসলো। অতঃপর বললো,
‘ সাবধানে যাস। আর রাত ন’টায় বাসায় আসিস। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। ‘ (প্রেম)
ডান বলে সেখান থেকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ফারহান, সারা। প্রেম সেই পানে তাকিয়ে রইলো ক্ষণকাল। অতঃপর একটা রিক্সা ডেকে সে’ও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো৷
আকাশটা এখন চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ। রিক্সায় বসে বিস্তীর্ণ আকাশের দিকে হা মেলে তাকিয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে, চাঁদের মোলায়েম আলোর স্রোতে গা ভাসিয়ে সে’ও হারিয়ে যাচ্ছে যোজনখানিক দূরে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব? আমরা যতই হারাতে চাই না কেনো? এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাদের ছাড়াবে না। টেনে হিঁ’চড়ে হলেও এই পৃথিবীর অভ্যন্তরে রেখে দিবে। অথচ মৃ’ত্যু যখন চোখের সামনে এসে আবির্ভাব হবে। তখন আমরা চাইলেও আর পালাতে পারবো না। প্রেম হাসলো! এত কঠিন কঠিন কথাগুলো না ভেবে চোখ বন্ধ করে বাবা-মা’য়ের কথা ভাবতে লাগলো সে। আপাতত চন্দ্রকিরণে স্নান করা যাক।
এখান থেকে বাসায় ফিরে বনানী যেতে হবে একবার। সেখানে বাবা-মায়ের কবর জেয়ারত করে আমাদের সেই পুরোনো বাড়িতে ঢুকতে হবে। যদি কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যায়! সেটা সামান্যতম উপকারে আসলেও লাভ। অনেকদিন থেকে পরিশ্রম করছি। পরিশ্রমের ফলটা আশা করি পাবো। তবে যাই হোক, রশ্নিকে এই বিষয়ে কিছু জানানো যাবে না তাহলে আজকে বাসা থেকে বেরই হতে দিবে না আমায়।
—–
প্রহরভাইয়ের ব্রান্ড নিউ কারের ভিতরে’ই বাধ্য হয়ে জামা কাপর চেন্জ করতে হলো আমায়৷ গাড়িতে সব মেয়েলি জিনিস। উনি যে কিভাবে মেয়েদের এত জিনিস এ্যারেন্জ করলেন সেটাই ভাবনার বিষয়। তবে সে যাই হোক, ফ্রেস হয়ে এখন বেশ আরাম লাগছে। গাড়ির এসিটাও অন করে দেয়া। তাই অলসতায় এখন বেশ ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমাতে পারলে বেশ হতো। আজ সারাদিন যে ধকল গেলো বাবা! কিন্তু তা কি এই খাটাস মানুষটার সামনে আদৌ সম্ভব?
সিটে হেলান দিয়ে একটু রেস্ট দিবো তার আগেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে প্রহরভাইয়ের নাম দেখে বিরক্ত হয়ে ফোনটা পিক করলাম।
‘আর কতক্ষণ লাগবে তোর? পালিয়ে গেছিস নাকি? ‘ (প্রহর)
আমি বিরক্ত হলাম। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললাম,
‘ পালিয়ে যাওয়ার কি ওয়ে রেখেছেন? পুরো গাড়ি তো লক করা। এখন অক্সিজেনের অভাবে ম’রে গেলেও বোধহয় খোঁজ নিতে আসবেন না।’ (আমি)
প্রহরভাই মুচকি হেসে উত্তর দিলেন,
‘ আমি দুমিনিটের মধ্যে আসছি। ওয়েট। তোকে ম’রতে হবে না’ (প্রহর)
উনি ফোন কাটার আগেই আমি ফোন কাটলাম। কিছুক্ষণ পর গাড়ির ভেতরে ঢুকলেন উনি। গাড়িতে ঢুকেই আমার হাতে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ নে খা। খেয়ে আমায় উদ্ধার কর। ‘ (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করা বড্ড কঠিন হয়ে গেলো। এই বিরিয়ানি সামনে থাকলে তো রাগ, মুড অফ, বিরক্তি কিছুই থাকবে না। কিন্তু কি বললেন উনি? খেয়ে উদ্ধার কর মানে? আমি ওনার থেকে চোখ সড়িয়ে বললাম,
‘ খাবো না। ‘ (আমি)
‘তোর যে খিদা লেগেছে তা ভালো করেই বুঝতে পারছি। এখন লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নে। ‘( প্রহর)
খিদার কথা মাথায় আসতেই পেটে খিদার জ্বালা অনুভব করতে লাগলাম। সেই দুপুরে খাইছি৷ আর খাওয়া হয় নি! এতক্ষণ তো মনেই ছিলো না! আর ওনার হাতে বিরিয়ানি দেখে আমার খিদা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যেতে লাগলো। না পারছি নিতে, না পারছি ফিরিয়ে দিতে। আমি মন খারাপ করে বললাম,
‘ খেয়ে আমায় উদ্ধার কর বলতে কি বুঝালেন? ‘ (আমি)
‘কিছু না। পিচ্চিদের এতকিছু ভাবতে হয় না। চুপচাপ খাবি নাকি আমি একায় খেয়ে নেবো? ‘ (প্রহর)
‘ না খাবো না ‘ (আমি)
‘ নে বলছি ‘ (প্রহর)
‘বললাম না নেবো না ‘ (আমি)
‘শেষবারের মতো বলছি নে। নাহলে কিন্তু খেতে দিবো না তো দিবো না। উল্টা মা’ইর খেয়ে আজ রাতটা কাটাতে হবে। ‘ (প্রহর)
উনার কথা শুনে আমার চোখে নোনাজলের আবির্ভাব হলো। কিন্তু আমি এই বিরিয়ানি খাবোই না। একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
‘ বললাম না খাবো না! এত ভালো মানুষী দেখানোর কি আছে? নিজে খান না ‘ (আমি)
প্রহরভাই রক্তচোখে তাকালেন। রাগে উনার শরীর হিরহির করে কাঁপছে। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে হাতের বিরিয়ানি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললেন। বিরিয়ানি ছুঁড়ে ফেয়ার সাথে সাথেই আমার দুখদুটো ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো। কান্না আটকানোর শত চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না। গাড়ির মধ্যে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করলাম। প্রহরভাইয়ের পাষান মন আর রাগ তাতে মোটেও কমলো না। উনি গাড়ির স্টার্ট করে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলেন। উনার গাড়ির গতির সাথে সাথে আমরা কান্নার গতি হু হু করে বেড়ে যেতে থাকলো। চোখদুটো খুলে দেখলাম বাইরে শা শা করে ল্যাম্পপোস্ট আর রাস্তার সাইডের ছোট-বড় গাছগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। যা দেখে আমার নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। এভাবে চলতে থাকলে নির্ঘাত এক্সি’ডেন্ট হয়ে যাবে৷ আমি সিটবেল্টও লাগাইনি৷ উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনিও লাগায়নি। উনি রোবোটের মতো গাড়ি চালিয়ে সামনের ছোটবড় গাড়িগুলোকে ক্রস করে এগিয়ে চলছেন। আমি যে সিটবেল্ট লাগাবো, তারও ওয়ে নেই। বারবার গাড়ি এপাশ হচ্ছে, নিজেকে সিটে স্থির করে বসিয়ে রাখাই যেনো কঠিন হয়ে যাবে৷ আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। হিচকি তুলতে তুলতে বললাম,
‘ আস্তে গাড়ি চালান ভাইয়া। এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো। প্লিজ ভাইয়া। গাড়ি থামান! ‘ (আমি)
আমার কথা শুনেও যেনো উনি শুনলেন না। নিজেকে স্থির রেখে গাড়ি চালিয়েই যাচ্ছেন। আমি একটু এগিয়ে এসে উনার বামহাত শক্তকরে জড়িয়ে ধরলাম। ভীষণ ভয় লাগছে। বারবার নিজেকে সিটের মধ্যে আড়ষ্ট করে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে উনার হাত ধরে বললাম৷
‘ গাড়ি থামান প্লিজ। নিজেকে কি ভাবেন আপনি? প্লিজ থামান। আমার ভয় করছে। ‘
উনি থামালেন না। বরং আরো যেনো জেদ চেপে বসলো। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় দুটো ট্রাক একজন আরেকজনকে ক্রস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ কাউকে সাইড দিচ্ছে না। প্রহরভাই যদি এখন গাড়ির গতি না কমান তাহলে আজই আমাদের শেষ দিন হবে। আমি এই ভয়ং’কর দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখতে পারবো না। তাই উনার হাতটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলাম। মনে মনে যত পারি সুরা পড়ে নিলাম। কিন্তু সেকেন্ড বিশ পর চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় উপলব্ধি করলাম গাড়িটা আর চলছে না। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমার ভাবনায় ঠিক। গাড়ি থেমে গেছে। সামনের ট্রাকদুটোও অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। আমি ওনার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম এখনো গম্ভীর আর শক্ত চাহনিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। আমি ওনার হাত ধরায় খানিকটা লজ্জা পেয়ে দূরে সড়ে বসলাম। উনি কোনো কথা না বলে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। যা বুঝলাম, উনি কথা বলবেন না। তবে ইশারায় আমাকে আদেশ করবেন! আমি গাড়ি থেমে নামলাম। এখনো মনে হচ্ছে হাইস্পিডের গাড়িতে বসে আছি। মাথা ঢুলছে, শরীর ঢুলছে। আমি গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে উনিও নেমে পড়লেন। অতঃপর সামনের একটা মিডল ক্লাস রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লেন। আমিও তার সাথে সাথে চললাম। যা বুঝলাম, এটা একটা ছোট বাজার। কিন্তু আমি এখন কোথায়? তা বুঝলাম না। প্রহরভাই মাস্ক পড়ে ভেতরে ঢুকে রেস্টুরেন্ট মালিকের সাথে দেখা করলেন,
‘ আঙ্কেল, আশা করি আমায় চিনবেন। আমি প্রহর খান। আমাদের জন্য একটা প্রাইভেট জোন এরেন্জ করে দিতে পারবেন? যেখানে আমরা ডিনারটা কম্প্লিট করতে পারবো। ‘ (প্রহর)
দোকানমালিকের বয়স ৪০+। তাই প্রহরভাইকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি। চিনতে পেরে ভীষণ অবাক হলেন। যে মানুষের ডিনার করা কথা পাঁচ তারকা হোটলে। সে কি না আমাদের মতো সাধারণ রেস্টুরেন্টে? তবে তিনি প্রহরভাইয়ের পরিস্থিতি ও আবদারটা বুঝতে পারলেন। প্রহরভাইকে বললেন,
‘ সিওর স্যার। আমাদের সিকরেট রুম আছে । ওখানে খেয়ে দেয়ে রেস্টও করতে পারবেন ‘ (মালিক)
‘ ধন্যবাদ। তবে কেউ যেনো জানতে না পারে আমি এখানে আছি। ঠিক আছে? ‘ (প্রহর)
‘ সিওর স্যার ‘ (মালিক)
চলবে?
চলবে?