শুধু তুই ২ ❤️ পর্ব -২৩+২৪

#শুধু_তুই
—(সিজন২)
#পর্বঃ২৩
#Rifat_Amin

কম্বলের নিচে নিজের লজ্জা নিবারণ করার বৃথা চেষ্টা করতেই দরজায় কারো হাতের ঠকঠক আওয়াজ হলো। ধ্বক করে উঠলো আমার বক্ষপিঞ্জর। অবুঝ মন বৃথা ভয় দেখানোর চেষ্টা করে বললো, প্রহরভাই এসেছে। এবার কই পালাবি তুই। আমি ভয়ে চুপসে গেলাম। আবারো শব্দ হচ্ছে ‘ঠকঠক’। আমি কম্বল শরীর থেকে ছাড়িয়ে উঠে পরলাম। কাঁপাকাঁপা হাতে দরজা খুলে দিতেই ধুম করে আমার হাটু জড়িয়ে ধরলো প্রেয়সী। আমার ভয় কেটে গেলো। উনাকে বাইরে কোথাও না দেখে আশ্বস্ত হলাম। দরজাটা বন্ধ করে প্রেয়সীকে কোলে তুলে নিলাম। অতঃপর রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দিতেই প্রেয়সী বললো,

‘ ভাইয়া আমাকে দেকতে বললো তুমি একন কি কচ্চো। তাহলে আমাকে চক্কেত দিবে। এতা আবার তুমাকে জানতে মানা কচ্চে। ‘ (প্রেয়সী)

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। যতক্ষণে ওর বলা কথাটার অর্থ উদ্ধার করলাম, প্রেয়সী তখন আমার ফোনে গেমস অন করতে ব্যস্ত। আমিও ওর সাথে তাল মিলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পরলাম বিছানায়। বললাম,

‘ তোর ভাইয়াকে গিয়ে বলবি মিষ্টি আপু পড়াশোনা করতে ব্যস্ত। এত এত পড়াশোনা করছে যে, এখন কথা বলারও সময় পাচ্ছেনা। একসাথে তিনটা বই শেষ করছে। আর খুব শীঘ্রই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লাইট হয়ে যাবে। ‘ (আমি)

প্রেয়সী আমার প্রতি হা করে চেয়ে রইলো। আমার কথার মাথামুন্ডু যে কিছুই বুঝেনি। তা ভালোই বুঝতে পারলাম। অতঃপর সে ডন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফ্রি ফায়ার ইন্সটল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যা দেখে আমার চোখ কপালে।

‘ এই তুই ফ্রি ফায়ার খেলবি নাকি আমার ফোনে? ‘ (আমি)

বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলতেই প্রেয়সী ‘চ’ সুচক শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

‘ হু। আমার চব বন্দুরা কেলে। ‘ (প্রেয়সী)

বিষ্ময়ে হা করে হয়ে গেলাম আমি। এর বয়স কত? এতকিছু জানলো কেমনে! নিশ্চই ঐশীর কাজ সব। প্রেয়সীর থেকে ফোন কেরে নিয়ে বললাম,

‘ তোর বোন কইরে? ‘ (আমি)

সাথে সাথেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করলো প্রেয়সী। ওর কান্নার শব্দ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকলে হঠাৎ দরজায় নক করলো কেউ। আমি প্রেয়সীকে ফোনটা ফেরত দিয়ে কান্না থামালাম। অতঃপর দরজা খুলতেই পায়ের নিচের মাটি সড়ে গেলো আমার। সেই নির্লজ্জ মানব! হায় খোদা! কই পালাই? দরজাটা ঝট করে আবার বন্ধ করবো তার আগেই উনি ভীতরে ঢুকে কঠোরস্বরে বললেন,

‘ বাচ্চা একটা মেয়েকে এভাবে মা’র’তে লজ্জা করলো না তোর! কি দোষ করছে ও? আসলে তোর নিজের বোন না তো। তাই এমন করছিস। ‘ (প্রহর)

এমনিতে তো ঢংয়ের কান্না করে প্রেয়সী আমার মেজাজটাই বিগড়ে দিয়েছে। তার পর পেট্রোলের মতো মিক্স হলো উনার পিন্চ করা বাক্য। আবার উনি নিজের বোন না বলে খোঁটা দেয়ায় সকল লাজ লজ্জা ধুলোয় উড়িয়ে আমিও উনার মুখের উপর আঙ্গুল তুলে বললাম,

‘ দেখুন, আপনি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারেন না। প্রেয়সী আমার ফোনে গেম ইন্সটল করছিলো বলে ফোন কেরে নিয়েছিলাম। ওমনেই সে কান্না শুরু করলো। আসলে আপনি যেমন ঢং করতে পারেন। আপনার বোন হয়েছে সেম টু সেম। তবে আপনি একটা কথা ঠিক বলেছেন। আমি আপনার নিজের বোন না বলে সবসময় খোঁটা দিয়ে থাকেন। তার বেলায়? ‘ (প্রহর)

উনি আমার কথার পাল্লায় চুপসে গেলেন। শেষমেষ, উপায়ন্তর না পেয়ে নিজের আইফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেললেন। অতঃপর প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘তোর ভাইয়ের কি ফোনের অভাব? আর ভুলেও এই কিপ্টা মেয়ের ফোন ধরবি না। লাগলে আরো দশটা ফোন একসাথে চালাবি’ (প্রহর)

উনার কথায় প্রেয়সী ভুত দেখার মতো তাকিয়ে রইলো। যে ভাইয়ের কাছে এতদিন ফোন চাইতেও ভয় লাগতো। সে কি না এমন ভাবে বলছে! আশ্চর্য! যে যাই হোক। প্রেয়সী আমার ফোন রেখে উনার ফোনে গেম ইন্সটল করতে শুরু করলেন। প্রহরভাই বললেন,

‘ আমার রুমে আরো একটা ফোন আছে। যা। একসাথে দুটো ফোনে গেম খেলবি। ‘ (প্রহর)

প্রেয়সী খুশিতে বাকুমবাকুম হয়ে বিছানা থেকে নামলো। অতঃপর রুম থেকে বের হওয়ার আগে পেছনে ফিরে বললো,

‘ আমি চলে গেলে তুমরা ইটিশপিটিশ করবে না তো? ‘ (প্রেয়সী)

প্রেয়সীর কথা শুনে আমার চোখ কপালে! ইটিশপিটিশ মানে কি? আশ্চর্য! এদিকে প্রহরভাই চোখপাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ঝড়ের গতিতে রুম ত্যাগ করলো প্রেয়সী। অতঃপর আমি পরে গেলাম বিপদে। এখন কোথায় যাবো? কোনো কূল কিনারা খুঁজে না পেয়ে উনার দিকে দৃষ্টি রেখে বললাম,

‘ ইটিশপিটিশ মানে কি প্রহরভাই? আপনার স্বনামধন্য বোন এসব ওয়ার্ড কই থেকে আমদানি করলো? ‘ (আমি)

উনি পড়ার টেবিলে বসে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ আমি কোন এঙ্গেলে তোর ভাই হই একটু বলবি? বেশী ভাই ভাই করলে আমিও কিন্তু বউ বউ করবো ‘ (প্রহর)

কথাটা বলেই আমার বই উল্টাতে শুরু করলেন উনি। এখন কি পড়তে বসাবেন নাকি? হায় খোদা! আবার আগের মতো যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। আমি হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আচ্ছা। আম্মি কি বললো? মেনে নিয়েছে আমাকে? ‘ (প্রহর)

‘ তোর এতো ইন্টারেস্ট কেনো বলবি? বাই দ্য ওয়ে, তুই আমাকে ভালোটালো বাসিস না’তো? ‘ (প্রহর)

‘আসতাগফিরুল্লাহ। ইয়াক!!!! আপনাকে আমি ভালো বাসবো? ‘ (আমি)

প্রহরভাই একটু ভাব নিয়ে বললেন,

‘ এত ঢং দেখাতে হবে না। উল্টা দেখা গেলো আমার অভাবে তুই খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিস! আমি কি কম স্মার্ট নাকি। রাস্তায় গতকাল দুটো মেয়ে আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়েছে। এখন তাদের চিকিৎসা খরচ আমাকে বহন করতে হচ্ছে। (প্রহর)

‘ নাউজুবিল্লাহ। এসব ইহকালে সম্ভব নহে। আপনি প্লিজ প্রস্থান করুন’ (আমি)

‘ ঢং বাদ দিয়ে পড়তে আয়৷ আজ সারারাত পড়বি। এক রাতেই তোর এইচএসসির সিলেবাস কমপ্লিট করে দিবো’ (প্রহর)

আমি না না করতেই আমার হাত টেনে বসালেন পড়ার টেবিলে। আমি সাথে সাথেই চিৎকার করে আম্মিকে ডাকলাম। এই নির্যাতন আর সহ্য হচ্ছে না। এদিকে আম্মিকে ডাক দেয়ার সাথে সাথেই ভদ্র হয়ে গেলেন প্রহরভাই। যতক্ষণে আম্মি আসলো, তখন প্রহরভাই মনোযোগ দিয়ে ম্যাথ করছেন।

‘ কি’রে আম্মু। কি হইছে। আর বাবু তুই এখানে কি করিস!’ (আম্মি)

আমি সাথে সাথেই উচ্চস্বরে বললাম,

‘ আম্মি আমাকে বাঁচাও। তোমার ছেলে খুব খারাপ। ‘ (আমি)

‘ হ্যাঁ। এখন তো খারাপ হবোই। যখন আমার বদৌলতে তোর একটা ভালো রেজাল্ট হবে। তখন তো কেউ মনে রাখবে না । ‘ (প্রহর)

‘ আপনাকে পড়াতে হবে না। আপনি যান ‘ (আমি)

প্রহরভাই বড় আপসোস করতে করতে বললেন,

‘ এই জন্যেই কারো ভালো করতে নাই। কোথায় সাজেশন দিবো! ‘ (প্রহর)

আম্মি প্রহরভাইকে হাতের খুন্তি দেখিয়ে বললো,

‘ আমি তোর এসব কাহিনী বুঝিনা, তাইনা? তা পড়াবি যখন তাহলে ঐশী কই? ওকেও ডাকতি। রশ্নি একা কেনো পড়বে! (আম্মি)

প্রহরভাই কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আম্মির কথায় চুপসে গেলেন তিনি। লজ্জায় মনে হয় মাটির নিচে ঢুকে যাবে এমন অবস্থা! তবুও নির্লজ্জ মানুষের কি লজ্জা কমে! প্রহরভাই মাথা তুলে বললেন,

‘ যাও আব্বু আসছে মনে হয়। তোমাকেও পড়াবে। সামনে পরীক্ষা ‘ (প্রহর)

আম্মি লজ্জা আর রাগ একসাথে মিশিয়ে রাগীস্বরে বললেন,

‘ ছিহহ! বাবু। মা’ই’র’

——

আকাশে ঘনঘন মেঘ ডাকছে। বৈশাখ মাসের এই এক সমস্যা। কখন যে কালবৈশাখী শুরু হয় বোঝাই যায় না। সারা রিক্সার মধ্যে ওর বাম হাত দিয়ে প্রেমের ডানহাত জড়িয়ে ধরে আছে। এই যুগের রিক্সাগুলো বোধহয় প্রেমিক-প্রেমিকার কোমরের সাইজ হিসেবে বানানো হয়েছে। যাতে তারা নির্ভিঘ্নে প্রেম করতে পারে। পিচঢালা এই রাস্তায় মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। হালকা বাতাসে রিক্সার হুড রিক্সার গতিকে ক্রমশ বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করছে। সারা প্রেমের কাঁধে মাথা রেখে বললো,

‘ কাল কি রেডিওতে যাবে? ‘ (সারা)

প্রেম সারার হাতটাকে নিজের কোলে নিয়ে বললো,

‘ হ্যাঁ। ‘ (প্রেম)

‘ আচ্ছা প্রহরভাইকে একটু বলে দেখিও তো। আমার বাবা-মা’কে ভীষণ মনে পড়ছে। যদি ওরা মেনে নেয়। তাহলে অনেক ভালো লাগবে। ‘ (সারা)

‘ যদি মেনে না নেয়। তাহলে কি আমায় ছেড়ে যাবা? ‘ (প্রেম)

‘ ছিহ! কিসব বলো! এসব আজেবাজে চিন্তা কখনো আমার মাথায় আসে না’ (সারা)

‘ দেখিও। সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘ (প্রেম)

সারা একটা ফুচকা হাউজ দেখে রিক্সা দাঁড় করালো। অতঃপর প্রেমকে বললো,

‘ তুমি ফুচকা খাওয়াবে? ‘ (সারা)

‘ মানা করলে তো মন খারাপ করবে। তার থেকে যতখুশি খাও। ‘ (প্রেম)

প্রেম মুচকি হেসে কথা বলতেই সারা প্রেমের হাত টেনে হাতের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,

‘ আরে ওটা ঐশী না? ওর সাথে ওটা কোন ছেলে? বয়ফ্রেন্ড নাকি? ‘ (সারা)

প্রেম নিজে তাকিয়েও কিছুটা অবাক হলো। এই ছেলেটাকে সে কোথাও দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। প্রেম এসব আকাশ-পাতাল ভাবতেই সারা ফটাফট কয়েকটা পিক তুলে বললো,

‘ বাসায় গিয়ে প্রহরভাইকে দেখাবে৷ হিহিহি। ‘ (সারা)

‘ভুলেও এসব করিও না। আমি ব্যাপারটা দেখবো এখন ‘ (প্রেম)

অতঃপর ফুচকা খেতে বসলো দুজন। প্রেম ফুচকা খায় না। তাই সারা আর জোর করলো না। খাওয়া শেষ করে ঐশী, প্রেয়সী আর রশ্নির জন্য ফুচকা প্যাকেট করে নিলো সারা। অতঃপর রিক্সায় উঠে বললো,

‘ চলো, আজ আমার টাকায় তোমাকে শপিং করায় দেবো’ (সারা)

প্রেম ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘ বাব্বাহ! বউয়ের হাতে শপিং। কিন্তু টাকা পেলে কোথায়? ‘ (প্রেম)

‘ ওমা! তুমি জানো না? তোমার গাওয়া গানটা তো ৬০০কে+ ভিউ আসছে। আর প্রহরভাইয়েরটা তো আগুন। এই কয়েকদিনেই দুই মিলিয়ন ভিউ। তাই দুপুরে ব্যাংক থেকে টাকা তুলছি।’ (সারা)

প্রেম মুচকি হেসে বললো,

‘ তাহলে ওটা তো তোমার টাকা না। গানটাগুলো যেহেতু আমার আর প্রহরভাইয়ের সুতরাং এগুলা আমার আর প্রহরভাইয়ের টাকা। ‘ (প্রেম)

মহুর্তেই সারার মনটা চুপসে গেলো। অতঃপর মন খারাপ করে বললো,

‘ চ্যানেলটা তো আমার ‘ (সারা)

প্রেম হো-হা করে হেসে বললো,

‘ আচ্ছা বাবা। তোমারি সব টাকা। যাই হোক, কি কিনে দিবা? ‘ (প্রেম)

সারা আবারো প্রফুল্ল স্বরে বললো,

‘ তুমি যা চাও। তাই হবে ‘ (সারা)

প্রেম ডেভিল স্মাইল দিয়ে সারাকে লজ্জায় ফেলতে বললো,

‘ আমি তো তোমাকে চাই। কিনে দিবা? ‘ (প্রেম)

সারা ভয়ংকর লজ্জা পেয়ে প্রেমের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো,

‘ আমি তোমার জন্য এনিটাইম ফ্রি। হিহিহি।
#শুধু_তুই
—(সিজন২)
#পর্বঃ২৪
#Rifat_Amin

ঘড়িতে এখন রাত ৯ টা বেজে ২৬। প্রেম সারাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার করে বের হলো। আকাশ ক্রমাগত খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। একটু আগে আকাশে যেটুকু তারা দেখা গিয়েছিলো, সেটাও এখন অদৃশ্য। মাঝে মধ্যে আবার বিদ্যুৎের ঝলকানিতে পুরো পৃথিবী দৃশ্যমান হয়ে সেকেন্ডখানেকের মাঝেই গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই কারেন্ট মহাশয় হাওয়া হয়েছেন। কথা ছিলো খাওয়া-দাওয়ার পর একটু শপিংয়ে যাবে। আজ আর তা সম্ভব নয়। যত দ্রুত সম্ভব বাসা ফিরে যাওয়াই মঙ্গল।

রাস্তায় এখন গাড়িগুলো কমে আসছে। রিক্সাগুলোও তেমন দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিক্সা পেলো প্রেম। কিন্তু নিজের বিপদ দেখে ডাবলভাড়া চাচ্ছেন উনি। তবুও উপায় না পেয়ে উঠে পড়লো তারা।
হঠাৎ প্রেম লক্ষ্য করলো পেছনে একটা কালো গাড়ি ওদের ফলো করছে। রাস্তা ফাঁকা, অথচ ওভারটেকিং করে এগিয়ে যাচ্ছে না। এর আগেও সে এমন লক্ষ্য করতো যে কেউ ওকে ফলো করতছে। কিন্তু মনের ভ্রম বলে এড়িয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এবার দেখছি বিষয়টা দেখতেই হচ্ছে।

‘প্রেম বৃষ্টি হচ্ছে। চলো ভিজি ‘ (সারা)

হঠাৎ বৃষ্টির ফোটা শরীরে পরায় আর সারার কথায় কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে আসলো প্রেম। পেছনে ফিরে একবার সেই কালো গাড়িটাকে দেখে সারার উদ্দেশ্যে বললো,

‘এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর বাঁধাবে নির্ঘাত। মামা আপনি হুড তুলে দিয়ে একটা প্লাস্টিক দিন। আর সামান্য একটু পথ। ‘ (প্রেম)

প্রেমের কথায় মুড অফ করে রইলো সারা। একটু বৃষ্টিতে ভিজলে কি আর হতো! জ্বর না’হয় একটু আসবে। তবুও তো একটা সুন্দর মহুর্ত উপভোগ করা যেতো! প্রেম কেনো যে এসব বুঝে না। মামা রিক্সার হুড তুলে দিয়ে একটা প্লাস্টিক এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘ এই অসময়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করা বিপদ ভাইজান
ভালোই ভালোয় আপনাগো পৌঁছায় দিলে বাঁচি। ‘

প্রেম কথা বললো না। টেনশন হচ্ছে প্রচুর। এই মাহিমটা কি চায়! আর ইফতেখার উদ্দিনকে আমার সন্দেহ হয় কেনো? কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু যতক্ষণ না বাবা-মায়ের খুনিকে খুঁজে না বের করছি। ততদিন শান্তিও নেই। প্রেম ফোন বের করে প্রহরভাইকে ফোন দিলো। প্রহর তখন বেলকণিতে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া উঠা মগে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো আর রশ্নির সাথে কাটানো মহুর্তগুলো স্মরণ করছিলো। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় ফোনটা রিসিভ করলো প্রহর। প্রেমের নাম্বার দেখে বললো,

‘ কিরে কই তুই! আর সারা’ই বা কোথায়? দুজনই তো দেখি বাসা থেকে উঁধাও। ‘ (প্রহর)

প্রেম এক হাত দিয়ে ফোন আর আরেক হাত দিয়ে প্লাস্টিক ধরলো শক্ত করে। বৃষ্টির গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্লাস্টিকে ঝমঝম করে বৃষ্টির আওয়াজে ফোনে কথা বলাই কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রেম বললো,

‘ একটু ঘুরতে এসে বৃষ্টিতে ফেঁসে গেছি ভাইয়া। যে জন্য ফোন দিলাম, আমার রিক্সার পিছনে একটা কালো গাড়ি ফলো করছে। আমি কি নেমে দেখবো বিষয়টা? আমি এখন বাসা থেকে মাত্র দুমিটের দূরত্বে আছি। ‘ (প্রেম)

‘ তোকে কতবার বলি যে, গাড়ি নিয়ে বের হ। কথা তো শুনিস না। আচ্ছা যাই হোক, তোকে কিছু করতে হবে না। আমি দেখছি বিষয়টা ‘ (প্রহর)

প্রহর ফোন কেটে দিয়ে গেটম্যানকে আগে ভাগেই পুটো ফটক খুলে রাখতে বললো। অতঃপর সব গার্ডসদের নির্দেশ দিলো গাড়ি বের করতে।
এদিকে প্রেম ফোনটা পকেটে রাখতেই সারা শক্ত করে হাতটা জড়িয়ে ধরে ভয়ভয় কন্ঠে বললো,

‘ কে ফলো করছে আমাদের? ‘ (সারা)

‘ আরে তেমন কিছু না। বাদ দাও। ‘ (প্রেম)

সারার মনের অবস্থা বুঝে কথাটা বললো প্রেম। কিন্তু এখন ওর নিজেরও ভীষণ টেনশন হচ্ছে। একা থাকলে তাও একটা কথা ছিলো। কিন্তু সাথে তো সারা আছে। ওকে নিয়েই সব ভয় । হঠাৎ বজ্রপাতের আওয়াজে চমকে উঠে প্রেমের বুকে মুখ লুকালো সারা। প্রেম কথা বললো না। হৃদস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্বাভাবিক লাগছে সব। প্রেমের এত কাছে কখনো কোনো মেয়ে আসার সুযোগ পায় নি। অযথ বিয়ের পর যেনো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজের ভবঘুরে নিয়মনীতির বেড়াজাল ভেদ করে এই অদ্ভুত রমণীকে কাছে টানছে। প্রেম না ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আরো যেনো আদুরে বিড়ালের মতো প্রেমের বুকের একদম গভীরে যেতে চাইলো সারা। প্রেম আনমোনে হেসে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো গাড়িটা এখনো আছে কি না। এখনো ফলো করছে।
ঠিক তখনি, দুটো গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখে পড়লো প্রেমের। কিন্তু সারার মোটেও ভাবাবেগ হলো না। সে যেনো বিড়ালের বাচ্চার মতো ঘুমাতে প্রস্তুত। আশ্চর্য! এখানেই ঘুমিয়ে পরবে নাকি মেয়েটা। গাড়িদুটো প্রচন্ড গতিতে এসে রিক্সার সামনে দাঁড়ালো। চমকে উঠলো প্রেম, সারা। সারাকে বক্ষপিঞ্জর থেকে সড়িয়ে পেছনে ফিরলো সে। সেই কালো গাড়িটা থেমে গিয়ে এখন গাড়ি ঘুরাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। মনে হয় ধরা খাওয়ার ভয়ে এত ব্যস্ততা। ঠিক তখনি সেই গাড়িতে থাকা অপরিচিত লোকদের অবাক করে দিয়ে আরো দুটো গাড়ি পেছন থেকে ঘিরে ধরলো গাড়িটাকে। থেমে গেলো গাড়ি। এদিকে সারা ভয়ে কাঁপছে পুরো। সে কখনো ভাবেনি এত বিপদ সামনে আসবে। হঠাৎ প্রহরভাইয়ের একটা গাড়ি এসে রিক্সার সামনে দাঁড়িয়ে নেমো পড়লো ভাইয়া। তীব্র বর্ষণ চলছে। মহুর্তেই ভিজিয়ে দিলো প্রহরভাইকে। এদিকে রিক্সাওয়ালাও মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ছে। আগে যদি জানতো এত বিপদ আসবে তাহলে পাঁচগুন বেশী ভাড়ায়ও সে কখনো আসতো না। প্রহরভাই সত্যি সত্যিই রিক্সাওলাকে পাচগুন ভাড়া দিয়ে বললো,

‘ আপনি যেতে পারেন। আর প্রেম তুই সারাকে গাড়িতে উঠিয়ে দে। ড্রাইভার ওকে বাসায় পৌঁছে দিবে। ‘ (প্রহর)

প্রহরভাইয়ের কথায় আর প্রেমের ইশারায় একমুহূর্ত রিক্সায় বসে থাকলো না সারা। ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়লো। কিন্তু যখন বুঝলো শুধু ওকে একাই বাসা নিয়ে যাচ্ছে। তখন কান্নারা দলবেঁধে আগমন করলো। কোনো ভাবেই থামানো যাচ্ছে না। গাড়িটা মহুর্তেই ঘুরে গিয়ে ওকে বাসায় পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুতি নিলো।
এদিকে কয়েকসেকেন্ডের মাঝেই বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে প্রেম আর প্রহর। সেই কালো গাড়িটা একদম স্থির হয়ে আছে। সামনে দুটো গাড়ি আবার পিছনেও দুটো গাড়ি থাকায় পালাবার কোনো পথ খুঁজে পাঁচ্ছে না। প্রহরভাইয়ের গাড়িতে থাকা গার্ডসগুলো বের হয়ে ঐ কালো গাড়িটাকে ঘিরে ফেললো। অদ্ভুত ভয়ংকর এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো তখন। এ যেনো মনে হলো, ওয়েব সিরিজের ফেবারিট কোনো সিন।
..
সব মিলিয়ে দশজন গার্ডস। প্রত্যেকের পোশাক অভিন্ন। একদম হোয়াইট ড্রেস। ওদের হাতে সেফটি গান থাকায় ভেতর থেকে সেই কালপ্রিটকে বের করতে সমস্যা হলো না। এই হেডলাইটের আধো অন্ধকারে লোকটার মুখ খুব চেনাচেনা লাগলো প্রেমের। কোথায় যেনো দেখেছে।
প্রহরভাই গার্ডসগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ উনাকে গোপন রুমে নিয়ে চলো। আর গাড়িটাও। ‘ (প্রহর)

আর কোনো কথা বলতে হলো না প্রহরের। প্রেমও মোটেও অবাক হলো না। আগে থেকেই এসবের অভিজ্ঞতা নেয়া আছে দুইভাইয়ের। শুধুমাত্র গান গাইতে গিয়েই প্রহর বুঝেছিলো এই পৃথিবীতে কেউ জায়গা ছেড়ে দেয় না। বরং জায়গা করে নিতে হয়।

আকাশে এখনও বর্ষণ অব্যাহত আছে। তবে আগের মতো আকাশের ঝলকানি অথবা বজ্রপাতের কোনো আওয়াজ আসছে না। শুধু মাঝে মধ্যে একটু মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। তাই সাহস করে সাবধানে ছাদের ফটক খুলে বৃষ্টিবিলাস করতে ঢুকে পরলাম। প্রহরভাই অথবা আম্মি জানতে পারলে খবর আছে।
উফফফ! এই সময়ে যদি একটা রোমান্টিক প্রেমিক থাকতো। কতই না ভালো হতো। হঠাৎ একটা প্রেমিকের বড্ড অভাব মনে করলাম আমি। আনমোনে প্রহরভাইকে নিজের আমৃত্যু সেই প্রেমিক মনে করলাম। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মনকে শ’খানেক গালি দিয়ে বললাম ‘ উনি প্রেমিক। ছিহহ! ভাবতেও শরীর কেমন করে উঠে। দেখা গেলো একটু দুষ্টামি অথবা কোনো বারাবারি করায় ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার হু’ম’কি দিলেন। না বাবা! উনাকে দরকার নেই। একাই ভালো আছি।
আমি চোখ বন্ধ করে নিজের শরীরটাকে বৃষ্টিতে এলিয়ে দিলাম। সাথে সাথেই ভিজে গেলো শরীর। অতঃপর আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে পরিবেশটাকে উপভোগ করতে লাগলাম। ছাদে ছোট্ট একটা নিয়ন বাতি জ্বলছে। সেই অস্পষ্ট আলোয় বৃষ্টির দাপটে ছাদে সবকিছু যেন অস্পষ্ট ঠেকছে। মুখের উপর আছড়ে পড়ছে তীব্র বর্ষণ। অতঃপর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার যত সুখ দুঃখ।এই মহুর্তটাকেই জীবনের সব থেকে সুখকর অনুভূতি মনে হলো। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে কান তালা লেগে যাচ্ছে। ঠিক তখনি কোমরে কোনো পুরুষের আলতো হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম। ছোট্ট এই অনুভূতিটাকে দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই মনে হলো না। কিন্তু যখন ঘোর কেটে গেলো। চোখের সামনে আবিষ্কার করলাম সেই ভয়ংকর মানুষটাকে। যাকে দেখলেই আমার ভয় লাগে, হাসি পায়, কান্না পায়, অনুভূতিরা তালগোল পাকিয়ে হারিয়ে যায়। যার সাথে কথায় পেরে উঠা যায়না। সেই অসহ্য মানুষটাই আমার কোমরে হাত রেখে আমার চোখের দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ছিটকে সরে যেতে চাইলেও উনি ছেড়ে দিলেন না। উনার একহাতের শক্তির সাথে আমার পুরো শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি পেরে উঠলো না। বরং হাতের চাপে উনার বক্ষপিঞ্জরের একদম নিকটে আসতে বাধ্য হলাম। নিজের কঠোর লজ্জামাখা মুখ তুলে উনার দিকে তাকালাম। নিয়নবাতিতে কত স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে! দুনিয়ার সব সৌন্দর্য যেনো উনাকে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হবে কেনো? আমার হিংসা হয়। প্রচন্ড হিংসা। আমি তো কোনো অংশেই উনার সমান না। না আছে সৌন্দর্য, না আছে যোগ্যতা। আমি চিৎকার করে বললাম,

‘ ছেড়ে দিন আমায় প্রহরভাই ‘ (আমি)

ছাদে প্রচন্ড শব্দ থাকায় চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। তবুও উনি বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করলেন না। বরং আগের মতোই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি কোনোভাবেই উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না। এই প্রথম কোনো পুরুষের এত নিকটে আসতে হলো আমায়। যদিও তিনি আমার তথাকথিত স্বামী। অদ্ভুত মন অনায়াসে বলতে বাধ্য হয় উনি আমার স্বামী। অথচ নিজেই বিশ্বাস করতে পারিনা। উনি নিজের মাথাটাকে আমার কপালে রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলেন। সাথে সাথেই নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো আমার। উনি অদ্ভুত স্বরে বললেন,

‘ তোকে আমার লাগবে। ‘

চলবে?
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here