শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব – ১৩+১৪

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৩||

★মি.হাসান ইজ নো মোর! উই আর সরি।

ওটি থেকে বের হওয়া ডাক্তার এর এমন কথা শুনে সালমা পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গেল। তীব্র সালমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সালমা কথা বলার মত অবস্থাতে নেই। তীব্র কে হাসপাতালে দেখে দিদার হাসান প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলো যার কারণে হাসপাতালেই ঝামেলা করে বসলো। দিদার হাসান কে সামাল দিতে কাদের শিকদার তাকে সাথে নিয়ে কোনো ভাবে বেরিয়ে গেল। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরই ঘটলো অঘটন। তাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়৷ দুজনকেই বিধ্বস্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ডাক্তার রা বুঝতে পারেন সে এক্সিডেন্ট এর সাথে সাথেই মারা গেছেন। লাইফ সাপোর্টে আছেন কাদের শিকদার। ফারহিনের সেন্স আসার আগেই নেমে এলো আরো একটি ঝড়,তুফান। মুহুর্তেই এলোমেলো করে দিলো সব। আরশ সালমার দিকে একবার তাকালো তারপর নিজেকে শক্ত করে সালমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সালমাকে চেয়ারে বসিয়ে আরশ তার সামনে মাটিতে বসে পড়লো। তীব্রের দিকে তাকিয়ে তীব্র কে ইশারা দিলো, তীব্র ও পাশে বসলো। আরশ সালমার হাত নিজের হাতের মুঠোই নিয়ে বলল-
“-মা! আমি সব বদলে দিতে পারবোনা কিন্তু আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়বেন না। আমি জানি এই মুহুর্তে এটা নিছক সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই মনে হবে না কিন্তু জন্ম যার হয়েছে মৃত্যুর সাধ তাকে গ্রহণ করতেই হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। আমি জানি আপনার জন্য এটা অনেক মুশকিল একটা সময় কিন্তু আপনাকে তারপরও শক্ত থাকতে হবে কারণ ফারহিন! ফারহিনের জন্য। আপনি একবার নিজের মনকে এটা বোঝান বাবা আর বেঁচে নেই। উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

সালমা এতক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকলেও আরশের কথায় তার মন হাজার খন্ডে পরিণত হলো। ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। ওনাকে কাঁদতে দেখে আরশ অসহায় দৃষ্টিতে তীব্রের দিকে তাকালো। তীব্র আর আরশ এটাই চেয়েছিলো এই শোক সালমা কান্নার মধ্যে দিয়ে বের করে ফেলুক, নাহলে প্রচন্ড শকে অনেক সময় মানুষ মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। কান্নাটা জরুরি তাই আরশ সালমা কে আটকালো না, থামালো না। কাঁদুক, আজকে শেষ বারের মত কেঁদে নিক মানুষটা। প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া তাকে মেনে নিতে হবে, প্রিয় মানুষকে শেষ বারের মত বিদায় ও দেওয়ার ক্ষমতা তার থাকতে হবে।

★দিদার হাসানের দাফনকাজ সমপন্ন করে ফিরে এলো আরশ আর তীব্র। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলো ড্রয়িংরুম খালি। আরশ দ্রুত পা চালিয়ে সালমার রুমে গেল। রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো সালমা দিদার হাসানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আরশ দরজায় নক করলো৷ সালমা স্তম্ভিত ফিরে পেল। দ্রুত মুখ মুছে ঘুরে দাঁড়ালো। আরশ রুমে প্রবেশ করর সালমার হাত ধরে বিছানায় বসালো। পায়ের কাছে বসে পড়লো আরশ। সালমার কোলে মাথা রেখে বলল-
“-আপনাকে আমি মায়ের মত ভাবি। আমিতো আমার মা কে দেখিনি তবে আপনাকে দেখেছি। আমি শুধু ফারহিনের হাসবেন্ড না আপনার ছেলের মত থাকতে চাই মা।

সালমা আরশের মাথায় হাত রাখলো। আরশ সেই হাত মাথার সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল-
“-আপনি আমার বাসায় চলুন মা। আমার আর ফারহিনের সাথে থাকবেন। এখানে একা আপনাকে রেখে আমি শান্তিতে থাকতে পারবো না।
“-না আরশ তা হয় না। আর এখন এসব বাদ দাও। আমি তোমাকে নিজের ছেলেই ভাবি। তোমার যখন ইচ্ছে হবে চলে এসো।
“-কিন্তু মা…
“-হাসপাতাল গিয়েছিলে?
আরশ কে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো সালমা।
“-না মা যাইনি। আপনাকে এভাবে রেখে..
“-আরশ! যে গেছে তার কথা না ভেবে যারা আছে তাদের নিয়ে ভাবো। ফারহিন, ভাইসাব সবাই হাসপাতালে পড়ে আছে তোমার ওখানে থাকা উচিত বাবা। আমি আছি এখানে তুমি যাও। ফারহিন আর ভাইসাবের খেয়াল রাখো। ডাক্তার রা এখনো কিছু জানায়নি, ভাইসাব কে সুস্থ করে তোলো।
আরশ উঠে দাঁড়ালো। সালমার মাথায় হাত দিয়ে বলল-
“-সাবধানে থাকবেন, আমি আসছি মা।
“-যাও।
আরশ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। দরজার কাছে গিয়ে সালমার দিকে ফিরে তাকালো। সালমা কাঁদছে। চোখ থেকে পানি আপনা আপনিই পড়ছে। আরশ মৃদ্যুস্বরে বলল –
“-সরি মা। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার ছিলো না।

তীব্রের বাবা মা এসেছে। তাদের কে সালমার কাছে রেখে আরশ আর তীব্র হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। হাসপাতাল পৌঁছে একবার ফারহিন কে দেখে নিলো আরশ তারপর ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানলো কাদের শিকদারের বুকের তিনটা হাড় ভেঙ্গে গেছে। মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। কাদের শিকদার আর কখনো নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারবেনা। শ্বাস চলছে নাম মাত্র! এখনো বলা যাচ্ছে না কিছুই। সব শুনে এসে করিডরেই বসে পড়লো আরশ। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে আছে সে। তীব্র পাশে গিয়ে বসতেই বলল-
“-এক মুহুর্তে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল তীব্র। কালও বাবা আমার সাথে ছিলো। আর আজ…
“-আরশ তুই ভেঙ্গে পড়িস না। ফারহিন, খালামনি ওদের কে সামাল দেবে? আঙ্কেল সুস্থ হয়ে উঠবে চিন্তা করিস না।

আরশ চুপচাপ। আরশের মলিন মুখের দিকে তীব্র তাকিয়ে রইলো। আরশের চেহারায় শোকের কোনো ছাপ নেই। তবে চিন্তার ছাপ আছে।

★মধ্যরাত! ধীর পায়ে আইসিইউর দিকে এগিয়ে গেল একটি ছায়া। পাশেই নার্স সোফায় পড়ে ঘুম। নার্সের দিকে তাকিয়ে একটুও বিরক্ত হলো না সে। একটি চেয়ার টেনে বসলো কাদের শিকদার এর পাশে। কাদের শিকদার এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ধীর গতিতে চোখ মেলে তাকালো তিনি। চোখের সামনে আরশের মুখ ভেসে উঠলো। আরশ কে দেখে তিনি যেন এক প্রশান্তির ছায়া দেখতে পেলেন। আরশ একটু এগিয়ে গিয়ে কাদের শিকদারের কপালে চুমু খেল। তারপর নিজের জায়গায় বসে শান্ত, ঠান্ডা স্বরে বলল-
“-কিছু বলব শুনবে বাবা?
চোখের পলক ঝাপটে সম্মতি দিলো কাদের শিকদার। মুখে তার অক্সিজেন মাস্ক। কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া তিনি শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন আপাতত। আরশ দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে থুতনিতে ঠেকিয়ে বলল-
“-জানো বাবা, খুব ছোট ছিলাম। তুমি আমায় একটা কাজের লোকের হাতে রেখে চলে যেতে তোমার ব্যবসা বাণিজ্যে গড়তে। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এত পরিশ্রম করতে এটাই তোমার ভাষ্য ছিলো। তুমি অফিস যাওয়ার সময় আমি প্রতিদিন কাঁদতাম বাবা। তুমি আমায় এটা এটা বুঝিয়ে চলে যেতে। তুমি জানো আমি কেন কাঁদতাম? তুমি চলে যাওয়ার পর, তোমার সেই বিশ্বস্ত কাজের লোক যার কাছে আমাকে রেখে যেতে সে আমাকে প্রচুর বকতো, মারধর করতো। সময় মত খেতেও দিত না। রুমে একা একা পড়ে থাকতাম আমি। সে আমাকে খেতে ডাকতো না। খেতে চাইলে কোনোসময় খাবার দিতো কোনোসময় দিতো না। কত বেলা যে আমি উপোস ছিলাম তা যদি তুমি জানতে। তোমাকে এসব কখনোই বলা হয়নি। আমি প্রতিদিন ভাবতাম রাতে তুমি এলে আমি বলে দেব। কিন্তু তুমি এসে রুমে চলে যেতে। আমাকে এক দেখা দেখেই চলে যেতে। কখনো কখনো সেই এক দেখাও দেখার সময় তোমার হতো না। আমি তা ভেবে কাঁদতাম। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তাম খিদে পেটেই। অনাদর, অবহেলা আমাকে এক ঘেয়ে,এক রোখা, বদমেজাজি করে তুলল। আমি ধীরে ধীরে সেই পরিবেশেই বড় হতে থাকলাম। তারপর একদিন আমার বয়স তখন ১২। তোমার এই বিশ্বস্ত কাজের লোককে আমি মেরে ফেললাম। হ্যাঁ! ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো না বাবা। গ্যাস আমিই লিক করে দিয়েছিলাম। যাতে গ্যাসের ব্লাস্টে যে মারা যায়। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম যখন তার পোড়া দেহ চোখের সামনে দেখলাম। তুমি ভাবলে ওটা এক্সিডেন্ট।

আরশের কথা শুনে শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেল কাদের শিকদারের। চোখ থেকে তার পানি পড়ছে। তিনি লক্ষ্য করলেন কথাগুলো বলার সময় আরশ নিজেও ছোট বাচ্চার মত কাঁদছিলো। একটু পর পর হেসেও দিচ্ছিলো। আরশ আবারও বলার শুরু করলো-

“-আমি মেন্টালি সুস্থ নই বাবা। কেন জানো? তোমার কারণে..
হুম, তোমার কারণে। তুমি আমাকে একটু সময় দিলে একটু আমায় ভালোবাসলে আমার দিনগুলো বাকি বাচ্চাদের মত হতো। কিন্তু আমায় মিথ্যে বুঝ দিতে তুমি যে, আমার জন্যই তুমি ছুটছো। কিন্তু তুমিতো আমার জন্য ছুটো নি বাবা। নিজের জন্য, নিজের সম্মান, নিজের ক্ষমতার জন্য ছুটেছিলে, যার কারণে বিজনেস নামমাত্র শো করে তুমি ইয়াবার মত জঘন্য একটা ব্যবসা চালিয়ে গেলে। কেন বাবা? তুমি যদি অসৎপথেই ইজিলি টাকা রোজগার করবে তাহলে কেন আমায় অত কষ্ট দিলে? কেন আমাকে ভয়ংকর হতে বাধ্য করলে? তুমি জানো আমি মাসে ৩/৪ বার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করি। তুমি কীভাবে জানবে তুমিতো জানোই না যে তোমার ছেলে পাগল। তোমার ছেলে স্বাভাবিক আচরণ করতে হলে মেডিসিন নিতে হয়। নিজেকে শান্ত রাখতে মেডিসিনের সাহায্য নিতে হয় বাবা। মাঝে মাঝে ভাবি মা থাকলে আমি হয়তো এমন হতাম না বাবা। খুব কষ্ট হয়, এত কষ্ট সহ্য হয়না। আমি মাঝে মাঝে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি যার ফল এসব…

বলেই নিজের দুহাত দেখালো আরশ। কাঁদতে কাঁদতে বলল-
‘-দেখো না বাবা, হাত দুটোতে সব দাগ। আমার কষ্ট হতো বাবা। প্রচুর কষ্ট হতো। আমি তো পারতামই না অনেক চেষ্টা করেও পারতাম না বাবা। তবু আমি তোমার সামনে নিজেকে ফিট দেখাতাম। কারণ আমি আমার এই রোগ কাউকে দেখাতে চাইনি। আমি চাইনা কেউ জানুক আমি কতটা খারাপ, কতটা ভয়ংকর, কতটা পাগল। আমার পাগলামি কতটা হতে পারে তা আমি কাউকে দেখাইনি। জানো বাবা, ফারহিনকে যেদিন দেখলাম সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারিনি। মেয়েটা আমার যত্ন করেছে এক দেখায়। ওর প্রতি আমাকে ঝুকে যেতে বাধ্য করেছে বলেই ইচ্ছে করে ওর বিয়ে আমি তীব্রের সাথে হতে দিইনি। তীব্র এসব জানেনা। তুমিই বলো, তীব্রের কাছে সব আছে বাবা মা সব। আমার কাছে তো কিছুই নেই, তুমিতো থেকেও ছিলে না তাই আমি তীব্রের কাছ থেকে ছলে বলে কৌশলে নিয়ে নিলাম আমার ফারহিন কে। ফারহিন কে আমি অনেক ভালোবাসি বাবা। ওর সামান্য মন খারাপ সহ্য হয়না। ওকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি সবাইকে মেরে ফেলতে পারি। কারণ আমার কাউকে লাগবেনা ফারহিন থাকলেই হবে। কিন্তু হুট করেই কানে এলো তোমাদের শত্রুতার রেশ ধরেই ফারহিনের উপর এই হামলা হয়েছে। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো বাবা। আমি ফারহিনকে ওই অবস্থায় কীভাবে দেখতাম? আমার তো অসহ্য লাগছিলো। আর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ফারহিনের এই অবস্থা যাদের জন্য তাদের ছাড়বো না। তাদের ক্ষমা করবোনা। আর আমি তাই করলাম। দিদার আঙ্কেল তো ভালোই ভালোই মারা গেল কিন্তু তুমি? তুমি থেকে গেলে। ভেরি ব্যাড! আমি এটা চাইনি যে তুমি থাকো। কিন্তু থেকে যেহেতু গেলে ভাবলাম তোমার জানা উচিত তোমার অংশ তোমার ছেলে কতটা ভয়ংকর। এই ভয়ংকর রুপের জন্য যে দায়ী তাকে একবার এসব না দেখালে তো অন্যায় হবে বাবা।

আরশ উঠে দাঁড়ালো। কাদের শিকদার অনবরত দু পাশে মাথা নেড়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে। আরশ হালকা হাসলো, বলল-
“-যাও বাবা, ইহকালের সময় ফুরিয়ে গেছে তোমার। আমার তোমাকে লাগবে না এমনিতেও তুমি অ-কেজোর মতই পড়ে থাকবে। তাই এত কষ্ট না করে যাও, একবারেই তোমাকে মুক্তি দিলাম। নিজেকে ক্ষমা করে দিও বাবা, তোমার বিপথে গিয়ে আমাকে এত ভয়ংকর বানানো উচিত হয়নি।

আরশ নিজের হাতেই অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিলো। হাতে গ্লাভস পড়ে নিলো। তারপর কাদের শিকদারের নাক মুখ চেপে ধরলো।কাদের শিকদার যন্ত্রণাভরা দৃষ্টিতে তার এক মাত্র ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিজের অন্তিম নিশ্বাস নিলো। তিনি শেষবারের মত দেখলো তার অতি আদরের ছেলে তাকে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিচ্ছে। আরশ যখন বুঝতে পারলো তিনি মারা গেছে তখন আরশ নিজের হাতে চোখ দুটি বন্ধ করে দিলো। কপালে চুমু দিয়ে বলল-
“-আমার ফারহিনকে কষ্ট দেওয়ার ফল ভোগ তো করতেই হতো। ভালো থেকো বাবা। এবার না আছো তোমরা আর না আছে আমার ফারহিনের কোনো শত্রু। আমি সমস্ত শত্রুতার রাস্তা বন্ধ করে দিলাম। গুড বাই।

আরশ বেরিয়ে গেল। আইসিইউ তে পড়ে রইলো কাদের শিকদারের প্রাণহীন দেহ।

চলমান……#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৪||

★আরশ! আঙ্কেল আর নেই। রাত ৩টায় ওনার ডেথ হয়েছে।

কাপা কণ্ঠে কথাটা বলে আরশের দিকে তাকালো তীব্র। চেহারাটা মলিন হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। পরপর দুজন মানুষের এভাবে আকস্মিক মৃত্যু বদলে দিয়েছে তীব্রের সাহস ও মনোবল। আরশ সম্পুর্ন একা হয়ে গেল, বাবা ছাড়া আরশের কেউ ছিলো না এখন সেও নেই। তীব্র আরশের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরশ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বলল-
“-জানি! তোর আগেই আমাকে বলেছে ডক্টর।
আরশের এমন স্বাভাবিক কথায় তীব্র চমকালো। আরশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য বলল-
“-তুই এত নরমাল?
“-ভোর রাতে ফারহিনের সেন্স ফিরেছে। আমি রি মুহুর্তে কোনো দুঃসংবাদ ফারহিন কে শোনাতে চাইছিনা। আমাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে, নাহলে ফারহিন কে সামলানো যাবে না।
“-কিন্তু আঙ্কেল…
“-আর নেই! জানি আমি। আমি এই মুহুর্তে এখান থেকে যেতে পারবোনা তীব্র, তুই বাবার লাশ নিয়ে যা দাফনকাজের ব্যবস্থা কর। আমি সুযোগ বুঝে আসবো।
আরশের কথায় তীব্র অবাক হলো। কেমন ছেলে ও? নিজের বাবার শেষ কার্যক্রম বন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছে।
“-আরশ তোর বাবা মারা গেছে। তুই শুধু মাত্র ফারহিনের জন্য ওনার সমস্ত কাজ আমার হাতে তুলে দিচ্ছিস?
“-শুধু মাত্র না। ফারহিন আমার কাছে শুধুমাত্র না। সে পুরোপুরি সুস্থ হয়নি আর এই মুহুর্তে যে গেছে তার কথা ভাবতে গিয়ে যে আছে তাকে আমি হারাতে চাইনা। ফারহিনকে তো আরো না। আমার কাছে ফারহিন অনেক ইম্পর্ট্যান্ট! অনেক।
“-আর তোর বাবা? এখানে নার্স আছে, ডক্টর আছে। ওরা ফারহিন কে একবেলা দেখতে পারবে কিন্তু তুই তোর বাবাকে আজকের পর আর দেখতে পাবিনা, এটা ভুলে যাস না।
“-আমি জানি, মারা গেলে কেউ ব্যাক আসেনা। তাই আমি চাইনা ফারহিনও কোনো দুর্ঘটনার শিকার হোক। আর তুই এত কথা বলছিস কেন? না পারলে বলে দে আমি সামলে নেব।
তীব্র বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে গেল। পরপর দুজন মানুষের মৃত্যু, তার মধ্যে আরশের বাবা যে ছাড়া আরশের কেউ নেই তার জন্যও আরশের বিন্দুমাত্র মায়া নেই? আরশ নির্দিয় জানতো তবে এতটা হবে তীব্র কল্পনাও করেনি। আরশকে কিছু না বলে তীব্র যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। যাওয়ার আগে তীব্র কে বলল-
“-তোর মত মানুষ আমি দেখিনি।
“-দেখার আশাও রাখিস না।
শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো আরশ।

★স্যুপ ভর্তি চামচ ফারহিনের মুখের সামনে ধরতেই ফারহিন বলে উঠলো-
“-বাবা আসেনি?
“-জরুরী কাজে একটু দূরে আছে, ফিরলে তবেই আসবে।
ফারহিন অবাক হলো, তার বাবার কাছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি এমন কাজ হতে পারে? ফারহিন আবারও বলল-
“-আমার চেয়ে জরুরী এমন কি কাজ যার কারণে উনি আমাকে দেখতে এলো না?
“-হবে কোনো জরুরী।
“-না আরশ! আমার বাবা এমন না। আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে, আমার আগে কিছুই না তার কাছে।
“-আমিও তো ভালোবাসি!!
ফারহিনের কথা শেষ হতেই তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল আরশ। ফারহিন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো-
“-কা..কাকে?
“-তোমাকে। আর কাকে!
“-বাবাকে একটা ফোন করবেন?
“-নেটওয়ার্কের বাহিরে আছে কল যাবেনা ওখানে।
বাটিতে থাকা স্যুপ নাড়তে নাড়তে বলল আরশ।
“-এমন কোথায় গেছে যে নেটওয়ার্কই নেই।
ফারহিনের অস্থিরতা বাড়তে দেখে আরশ বলল-
“-ফারহিন! তুমি পুরোপুরি সুস্থ হওনি। তোমাকে সুস্থ হতে হবে। এখান থেকে বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি এই সামান্য বিষয়ে উত্তেজিত হলে চলবে না।
“-কিন্তু আরশ..
“-কোনো কিন্তু না হা করো! আমি নিজের হাতে বানিয়েছি স্যুপ।
ফারহিন বাধ্য মেয়ের মত হা করলো। স্যুপ খেয়ে বলল-
“-রাধতে পারেন নাকি?
“-একটু আধটু! কেন?
“-না দেখে মনে হয় না।
“-আমাকে দেখে অনেক কিছুই মনে হয় না।
ফারহিন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেতে লাগলো।আরশ খাওয়াতে খাওয়াতে বলল-
“-এভাবে হুটহাট আর অসুস্থ হয়ে পড়বেনা, কেমন?
“-কেন?
আরশ তাকালো, বাটি রেখে একটু এগিয়ে গিয়ে ফারহিনের ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা স্যুপ মুছে বলল-
“-আমার খারাপ লাগে তাই।
ফারহিন থতমত খেল। বলল-
“-নার্স কে একটু ডেকে দেবেন?
“-কেন?
“-আমার চুলগুলো বেধে দেওয়ার জন্য অনেক বিরক্ত করছে বার বার চোখের উপর চলে আসছে।
“-নার্স লাগবেনা, এদিকে এসো আমি বেধে দিই।
ফারহিন অবাক হলো, বলল-
“-চুল ও বাধতে পারেন?
“-পারি না পারতে কতক্ষণ?
“-না থাক, অযথা টানাটানি করে আমার চুল ছেড়ার দরকার নেই আপনি নার্স কে ডেকে দিন।
“-একটা চুলও ছিড়বে না, প্রমিস।
বলেই চোখ টিপল আরশ। ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো। আরশ ফারহিন কে ঘুরিয়ে বসালো। চুল গুলো হাতের মুঠোই নিয়ে বলল-
“-বেশ লম্বা তোমার চুল।
“-সব মায়ের কেরামতি। মাথাভর্তি তেল, রাতে বেধে দেওয়া এসব মায়ের নিত্যদিনের ডিউটি ছিলো। মায়ের হাতের তেলের ম্যাসাজ পেয়ে পেয়েই এই অবস্থা।

আরশ চুপচাপ শুনছিলো। চুলে বিনুনি করতে করতে বলল-
“-ফারহিন?
“-হুম?
“-তোমার চুল অনেক সুন্দর।
“-জানি তো।
“-তবে তোমার চেয়ে না।
ফারহিন চুপ করে গেল। আরশ ফারহিন কে সোজা করে বসিয়ে সামনে এসে বসতেই ফারহিন বলল-
“-আমরা বাড়ি কবে যাবো?
“-কেন?
“-আমার হাসপাতাল পছন্দ না। এখানে থাকতে ভালো লাগছেনা।
“-পরশু।
“-পরশু কেন? কাল কেন না?
“-তুমি অসুস্থ ফারহিন, এত তাড়াতাড়ি রিলিজ দিবেনা।
“-কে বলল, আমিতো ফিট আছি৷ বাসায় রেস্টে থাকবো প্লিজ নিয়ে চলুন।
ফারহিনের করুণ অনুরোধে আরশ রাজি হয়ে গেল বলল-
“-ঠিক আছে, কথা বলে দেখি।
“-ঠিক আছে।
“-এখন ঘুমাও। তোমার একটু ঘুমানো উচিত।
“-আমার ঘুম আসবেনা।
“-আমি একটু বাসায় যাবো ফারহিন, ফ্রেশ হতে হবে। তুমি না ঘুমালে যেতে পারবোনা।
“-কিন্তু আমার যে ঘুম আসছেনা।
অসহায় মুখ করে বলল ফারহিন। আরশ বলল-
“-তাহলে নার্স কে ডেকে দিই?
“-আপনি থাকুন। নার্সের সাথে আমি কিইবা বলবো?
“-আমার সাথে কি বলবে?
“-হাসবেন্ড ওয়াইফের কত কথা থাকে।
নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলো ফারহিন। চরম লজ্জা। আরশ মুচকি হাসলো। বলল-
“-তা শুনি হাসবেন্ড ওয়াইফের সেই ‘কত কথা’ গুলো কি?
ফারহিন লজ্জা পেল। মুখ নিচু করে আছে। আরশ এক দৃষ্টিতে সেই লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা সব পরিস্থিতিতেই আরশ কে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করে।আর আরশ বার বার তার মায়ার তীরে ক্ষত বিক্ষত হয়।

★কাদের শিকদারের মুখের কাফন বেধে দিতে বলে তীব্র। আরশ এখনো আসেনি। আসরের আজান দিবে একটু পরই, এতক্ষণ রাখা ঠিক হচ্ছেনা। মসজিদের ইমাম তাড়া দিচ্ছে। তীব্র বেশ কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু আরশের ফোন বন্ধ। আর উপায় না পেয়ে নিজেই দাফন করার সিদ্ধান্ত নিলো। কাফন পরিয়ে দেওয়ার একটু আগেই তীব্র সবাইকে থামিয়ে দিলো, শেষবারের মত একবার সে দেখতে চায় বলে জানালো। মুখের কাফন সরিয়ে দিতে তীব্রের ভ্রু কুঁচকে গেল। লাশের উপর একটু ঝুকে দেখলো মুখের নিচের অংশে লাল হয়ে আছে। তীব্র ভালোভাবেই তা লক্ষ্য করলো। আইসিইউতে থাকাকালীন এই দাগ তো ছিলো না,তাহলে এখন এই দাগ কোথা থেকে এসেছে? তীব্রের ভাবনায় টান পড়লো ইমামের ডাকে। তীব্র সরে আসলো। কাফন পরিয়ে লাশ খাটিয়ায় তোলা হলো। সবাই খাটিয়ার পায়া ধরার আগেই আরশের বলিষ্ঠ হাত খাটিয়ার এক পায়া আঁকড়ে ধরে। খাটিয়ার পায়া ধরতেই তীব্র স্বস্তি ফিরে পেল। বাকিরাও খাটিয়া তুলে নিলো। আরশ পাথরের ন্যায় চুপ হয়ে আছে।

কবরস্থানে গিয়ে জানালো বাবাকে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছেই কবর দিতে চায় আরশ। এটাই তাত বাবার শেষ ইচ্ছে ছিলো বলে জানিয়েছে। তাই সবাই দিদার হাসানের পাশেই নতুন করে কবর করলো। দাফন শেষে আরশ সবাইকে চলে যেতে বলল। তীব্র থাকতে চাইলে আরশ রাজি হয়নি, কবরস্থানের বাহিরে অপেক্ষা করতে বলল সে। বাধ্য হয়ে তীব্রও সবার সাথে চলে গেল। সবাই চোখের আড়াল হতেই আরশ বসে পড়লো মাটিতে। দুজনের কবরে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বলল-
“-আমায় ভুল বুঝবেন না! আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ফারহিন আমার কাছে অনেক ভালো থাকবে। অন্তত আপনার মত, আমার জন্য কেউ তাকে আঘাত করবেনা। আপনাদের পরকালের জীবন সুখকর হোক।

উঠে দাঁড়ালো আরশ। কবরের দিকে একবারও ফিরে তাকালো না। সোজা হেটে চলে এসেছে সে৷ বিন্দুমাত্র আক্ষেপ তার নেই। নেই বাবাকে হারিয়ে ফেলার কোনো আফসোস। কারণ আরশ নিজেই চায়নি সে বেঁচে থাকুক। ফারহিনকে এত কষ্ট দেওয়ার পর অন্তত তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। সে কখনো আরশকে শান্তি দিতে পারেনি তাই আরশের শান্তি নষ্ট করার অধিকারও তার নেই।

কবরস্থান থেকে বের হতেই দেখলো তীব্র দাঁড়িয়ে। তীব্র এগিয়ে এলো। আরশকে বলল-
“-তোকে আঙ্কেলের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই, আঙ্কেল…
“-আর নেই! জানি আমি। এই এক কথা আর কত বার বলবি?
“-তোর কি মাথা খারাপ নাকি? তুই এত স্বাভাবিক কীভাবে?
আরশ তীব্রকে পুরো কথা শেষ করতে না দেওয়ায় তীব্রের মেজাজ বিগড়ে যায়,ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো তীব্র।
“-তো কি করবো? আটঘাট বেধে কাঁদতে বসে পড়ি?
“-আমি তোকে তা বলিনি!
“-ফারহিন হসপিটালে একা আমার যেতে হবে।
“-ফারহিন! ফারহিন! ফারহিন, সবসময় এই এক ফারহিন কে নিয়ে কেন পড়ে আছিস তুই? তোর বাবা মারা গেছে আরশ।
“-ওকে নিয়ে পড়ে থাকাটাই স্বাভাবিক নয় কি? আর আমার বাবা মারা গেছে জানি, কিন্তু তুই হয়তো জানিস না ফারহিন অনেক ছোট। সে যদি জানে তার বাবা মারা গেছে তাহলে সে ভেঙ্গে পড়বে। আর আমি তা চাইনা।
আরশের কথায় ধামাচাপা পড়ে গেল তীব্রের উত্তেজনা।
“-আর তোর বাবা যে মারা গেছে?
“-ফারহিনের আগে কিছু না। আমার বাবা হারানোর শোক ও না।

বলেই আরশ গাড়িতে বসে পড়লো। তীব্র আরশের যাওয়া দেখছিলো। আরশের হাবভাব তার কিছুতেই স্বাভাবিক ঠেকছে না। তীব্র এটা অন্তত বুঝেছে কাদের শিকদারের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।

চলমান……

||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here