শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব – ১৭+১৮

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৭||

★টেস্ট কিট হাতে দাঁড়িয়ে আরশ। থরথর করে কাঁপছে সে। এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে তার। হৃদস্পন্দন যেন বাতাসের গতিতে বেড়ে গেল। কাঁপছে তার ভোকাল কর্ড। স্বরনালী অসাড় হয়ে আসছে। চোখ ভর্তি জ্বল টলমল করছে। আরশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহিনের দিকে তাকালো। ফারহিন হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াতেই আরশ নিজের মুখ এক হাতে চেপে ধরল। আরশ দ্রুত ফারহিন কে বেডে বসালো। অস্থির কন্ঠে বলল-
“-বসো এখানে। এসব…
“- আপনার বাচ্চা খুব শীগ্রই আসবে।
আরশ হেসে দিলো। পেটে হাত বুলিয়ে দিতেই আরশের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আরশের চোখে পানি দেখে ফারহিন ভড়কে গেল। দুহাতে আরশের মুখ ধরে বলল-
“-আপনি কাঁদছেন কেন? খুশি হোন নি?
“-অনেক হয়েছি। আমি আমার খুশি বলে প্রকাশ করতে পারবো না। তুমি এমন একটা উপহার দেবে কল্পনাও করিনি৷
“-তাহলে কাঁদছেন কেন?
আরশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মৃদুস্বরে ডাকলো।
“-ফারহিন?
“-হুম?
“-আমি আমার বাবুকে কখনো একা রেখে কোথাও যাবোনা। আমার বাবুকে আমি সর্বোচ্চ সময় দেব। আমি কখনো ওকে আমার মত একা করে দেব না। আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড হবো, ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ হবো। ও হাত বাড়ালেই আমাকে ওর কাছে পাবে। আমি কখনো ওকে বা দিয়ে নিজের কথা ভাববো না। আমি বেস্ট বাবা হবো। তুমি দেখো, ও আমাকে ছাড়া কিছু বুঝবেই না। ও তোমার কাছে কম আমার কাছে বেশি থাকবে।

আরশের চোখে পানি টলমল করছে। ঠোঁটের কোণে হাসি। ফারহিন আরশের মাথায় হাত রাখলো। মৃদুস্বরে বলল-
“-বাবার কথা মনে পড়ছে?
আরশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
“-আমার বাবুর খেয়াল রেখো, ওর কোনো কমতি হতে দিও না বউ।
“-আপনি তো আছেনই! আপনি থাকতে আমার এত চিন্তা নেই।
কথাটা বলেই ফারহিন মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চুমু দিলো আরশের কপালে। আরশ ফারহিনের বুকে মাথায় রেখে বলল-
“-আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো?
“-আমি কেন আপনাকে ভুল বুঝবো?
“-তুমি বলেছিলে আমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি আসবেনা, কোনো থার্ড পার্সন এসে যদি তোমাকে কিছু বলে তাহলে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে না তো?
“-আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা আরশ। আপনার আর আমার মাঝে ভালোবাসা ছাড়া কেউই আসবেনা, কেউ না।
“-ফারহিন?
“-হুম?
“-আমি যা করেছি শুধু তোমার জন্য করেছি। তোমাকে ভালো রাখতে তোমাকে কাছে পেতে করেছি।আমি সব সময় তোমার মাঝে নিজেকে দেখতে চেয়েছি, আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে কখনো এত তীব্রভাবে চাইনি। তুমি আমার কাছে গোটা একটা পৃথিবী। তুমি যদি কখনো দূরে চলে যাও আমি বাঁচবো না ফারহিন। আমি সত্যিই তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। তোমার আগে আমার কাছে কিছু না, আমি নিজেও না।
“-আপনি চিন্তা করবেন না, কেউ কখনো আমাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। পৃথিবীর বুকে এমন কেউ নেই যে ফারহিনকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। আপনি আমার আবেগ না আরশ, আপনি আমার ভালোবাসা।

★হাতে থাকা কাঁচের গ্লাস মাটিতে পড়ে ঝংকার তুলল। ভেঙে টুকরোতে পরিণত হলো। সালমা ধপ করেই বসে পড়লো বেডে। কানে ধরে রাখা ফোন কাঁপছে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো অস্থির এক কণ্ঠস্বর-
“-খালামনি তুমি ঠিক আছো?
তীব্রের ডাকে ধ্যান ভাঙলো সালমার।
“-হ..হ্যাঁ ঠিক আছি।
“-খালামনি আমি যা বলেছি তুমি শুনেছো তো? ওই আরশের কাছ থেকে দূরে থাকো। তুমি বেরিয়ে আসো প্লিজ।
“-কিন্তু ফারহিন..
“-ফারহিন কে পরে বুঝানো যাবে। আপাতত তুমি চলে এসো। আরশ খুবই ভয়ংকর খালামনি। আমি চাইনা তোমারও কিছু হোক।
“-আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তীব্র। আরশ কীভাবে…
“-আরশ এর আগেও খুনের মত জঘন্য কাজ করেছে খালামনি। ওর কাছে এসব কিছুই না। ও আজ যেই ফারহিনের জন্য এত কিছু করেছে, নিজের বাবাকে মেরে ফেলেছে, সেই ও নিজেই ফারহিনকে আঘাত করতে দুবার ভাববে না যদি ফারহিন ওর কাছ থেকে সরে আসতে চায়। ফারহিনের জন্য ও অনেক বিপদজনক। ফারহিনের মাথার উপরে আজ ছায়া নেই তা শুধু ওর জন্য। আঙ্কেল কেও আরশই মেরেছে।ওইদিন ওই এক্সিডেন্ট আরশই করিয়েছে। কারণ আঙ্কেলদের শত্রু ফারহিনকে আঘাত করেছিলো তাই।

সালমা চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা জল। সালমা ফোন কেটে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে আরশের রুমের সামনে গেল। দরজা খোলা ছিলো। পর্দা সরাতেই সালমা দেখলো আরশের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ফারহিন। আরশ হেলান দিয়ে বসে আছে, সেই অবস্থাতেই ঘুম। আরশের এক হাত ফারহিনের মাথায় যা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না এতক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো সে। সালমার ঠোঁটের কোণে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। সালমা এতদিনে একবারও আরশকে দেখেনি ফারহিনকে অবহেলা করতে। আরশের কাছে ফারহিন সুখে আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর আরশ সবসময় ফারহিনকে সময় দিয়েছে। ফারহিন বাবার শোক কাটিয়ে উঠেছে খুব অল্প সময়ে। ফারহিনের যত্নের বিন্দুমাত্র ক্রুটি রাখে নি। অফিস যাওয়ার আগে নিজে সব কাজ করে যেত। ফারহিনের জন্য আরশ নিজের হাতে রান্না করে। মাঝে মাঝে ফারহিনকে অফিসেও নিয়ে যেত। কখনো কখনো হাফ টাইমে ফেরত চলে আসতো অফিস থেকে। ফারহিন কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ফারহিনের মন ভালো করার জন্য আরশ সব করেছে। সালমা সরে এলো। হাটতে হাটতে ছাদে গেল। ফিরে গেল নিজের অতীত এ। যেখানে দুঃখ, আঘাতের সাথে সাথে ছিলো কোনো এক বিপদজনক লোকের ভয়াবহ ভালোবাসা।

**ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর এক মাত্র মেয়ে ছিল সালমা বিনতে সোলায়মান। বাবার খুব আদরের ছিল। মেয়ের সমস্ত আবদার সবার আগেই ছিলো যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত কাজ ফেলে মেয়েকে সময় দেওয়া ছিলো তার কাছে প্রধান ও মুখ্য কাজ। মেয়েকে প্রতিদিন স্কুল থেকে নিয়ে আসতো নিজেই। সোলায়মান সাহেব ছিলেন অত্যন্ত সৎ,ও নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। গরীবের বন্ধু ছিলেন তিনি। তার সৎ কর্মের ফলাফল হিসেবে তিনি নিজেই সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করলেন খুব শীগ্রই। যার দরুন তার নাম ছড়িয়ে পড়ল শহরের কোণায় কোণায়। কোনো এক সম্মেলনে যাওয়ার কারণে একদিন তিনি তার মেয়ের স্কুলে আসতে পারেন নি। সেদিনই ঘটলো অঘটন। সালমার উপর নজর পড়লো এলাকারই একজন নাম করা দুর্নীতিবাজের। সালমা ভয় পেত স্কুলে আসা যাওয়া করতে। বাবাকে সবটা বলার পর বাবা একদিন তার লোকদের বলে তাকে হাজির করালো। সালমার এখনো মনে আছে প্রথম সাক্ষাতে দিদার হাসান আর তার বাবার মাঝে বেশ তর্কাতর্কি হয়েছিলো। যার কারনে লোকসম্মুখে চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলো যে, বেঁচে থাকতে তিনি তার মেয়ে এই ছেলের হাতে দেবে না। আর সেদিন দিদার হাসান প্রতুত্তরে বলেছিলো, ‘আপনার মেয়ে আমার ঘরেই আসবে। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আপনার মেয়ের অবস্থান বদলে দেব। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।’
ব্যস! এক সপ্তাহের মধ্যেই সালমা কে তুলে নিয়ে দুজনেই গায়েব হয়ে গেল। পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে ও নিজের মেয়েকে পায়নি সোলায়মান সাহেব। বছর দুইয়েক পর সালমা ফিরে এসেছিলো। নিজের মেয়েকে পেয়ে সোলায়মান যতটা খুশি হয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি আঘাত পেয়েছিলেন নিজের মেয়ের মুখে দিদার হাসানের সুনাম শুনে। সালমা বলেছিলো, ‘ আমি ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি বাবা। তুমি বিশ্বাস করো সে তোমার মত না হলেও সে আমাকে কখনো কোনো অনাদর, অবহেলা করে নি।’ মেয়ের কথা শুনে সোলায়মান স্ট্রোক করেছিলেন। মৃত্যুর কোলে তিনি ঢলে পড়েছিলেন। নিজের বাবাকে হারিয়ে সালমা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিলো। তখন ফারহিন গর্ভে ছিলো। স্বামীর সাথে আর কখনো তার বনিবনা হয়নি। কারণ সে কখনো তার কাজ থেকে সরে আসেনি। দিন দিন আরো তলিয়ে গেল অবৈধ কালো ব্যবসার অতল গহীনে।
অতীত বিচরণ করতে গিয়ে সালমা প্রচন্ড তিক্ততার মুখোমুখি হলো। সালমা চোখের পানি মুছে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো। রুমে যাওয়ার আগে ফারহিন আর আরশের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পর্দা সরাতেই দেখলো ফারহিন আরশের বক্ষস্থলে। সালমার চোখ, মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সালমা মৃদু হেসে বলল-
“-আমি কখনো স্বামীর ভালোবাসা পাইনি ফারহিন। তোমার বাবা আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে বার বার। যার জন্য আমি সব হারিয়েছিলাম দিনশেষে আমি তাকেও পাইনি। আমার জীবনটা একটুও পরিবর্তন হয়নি ২০ বছরে। স্বামী স্ত্রী নামক সম্পর্কে দুজনে বাধা ছিলাম অথচ আমার প্রতি তার কোনো দায় ছিলো না। অথচ আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম শুধু মাত্র তার জন্য। তুমি অনেক ভাগ্যবতী ফারহিন। আরশ যা করেছে তোমার জন্য করেছে। যে চলে গেছে তার চলে যাওয়া নিয়ে আমি তোমাদের জীবনে কোনো অশান্তির সৃষ্টি করবো না। কারো না কারো হাতে তার পতন হতোই। তবে আমি ভাবিনি সেটা আরশ হবে। আরশ তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আরশের মত কেউ কখনো তোমাকে আগলে রাখতে পারবেনা। তোমার উপর আঘাত যে করেছে তাদের আরশ ছেড়ে দেয়নি। আর যাদের জন্য এই ঘটনা ঘটেছে তাদেরও সে ছেড়ে দেয়নি। হোক অপরাধ। এবার আমি এই অপরাধের সঙ্গই দেব। আরশকে কখনো কেউ তোমার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবেনা। আরশের ভালোবাসার শক্তি অনেক, অনেক মজবুত। আমি যা আমার জীবনে পাইনি তা তোমার জীবনে আসুক ফারহিন। আমি কাউকে তার বাধা হতে দেব না।

বলেই মৃদু হাসলেন সালমা। অতঃপর নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলেন।
#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৮||

★শাড়ির কুঁচিগুলো ভাজ করে গুজে দিয়ে সোজা হতেই আয়নার দিকে চোখ পড়লো ফারহিনের। পেটের দিকটায় অজান্তেই হাত চলে গেল। দ্রুত আঁচল ভাজ করে পেটে হাত রাখলো। পেটে হাত দুটো উপরনিচ করে রেখে সমানে বুলিয়ে যাচ্ছে। এপাশ ওপাশ ফিরে নিজেকে বার বার দেখছে। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। পেট বড় হয়েছে কি না তা দেখতেই ব্যস্ত সে।
টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো আরশ। ওয়াশরুমের দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহিনের দিকে। আরশ চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো তাকে। তার রঙঢঙ দেখে হেসে দিলো আরশ। হাতের টাওয়েল ডিভানে রেখে এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। ফারহিনের পেছনে দাঁড়িয়ে পেটের উপর হাত রাখলো। শাড়ির নিচে পেটের উপর আরশের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই ফারহিন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। আরশ এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করলো-
“-কি দেখছিলে?
“-পেট! বড় হয়েছে কি না…
আরশ উচ্চস্বরে হেসে দিলো। আরশকে হাসতে দেখে ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো।
“-হাসলেন কেন?
“-একদিনে পেট বড় হয় নাকি? পেট বড় হয় বাবু বড় হলে। বাবু তো এখনো ছোট..
“-ওহ্। অনেক সময় লাগবে তাই না?
“-তাতো লাগবে।
কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে ঘাড়ে হাত রাখতেই ফারহিন সরে যেতে চাইলো। আরশ সরতে দিলো না। ফারহিন বলল-
“-প্লিজ ধরবেন না কেমন সুড়সুড়ি লাগে।
“-এত দিনেও সুড়সুড়ি ভাঙলো না? এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়..
ভ্রু কুঁচকে বলল আরশ। আরশের কথা শুনে ফারহিন অবাক হলো, বলল-
“-কেন?
“-তোমার সুড়সুড়ি দূর করার উপায় আছে।
“-যেমন?
“-আমি যদি সারাদিন তোমার সাথে থাকি তো….
“-সরুন।
বলেই আরশ কে ধাক্কা দিলো। আরশ বিছানায় বসে পড়লো। ফারহিন চলে যাওয়ার আগেই ফারহিনের হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো আরশ। ফারহিন বিছানায় শুয়ে পড়লো। আরশ তার দিকে ঝুকে বলল-
“-এত দৌড়াদৌড়ি করবেনা।
“-কেন?
“-বাবু আছে যে।
“-আচ্ছা।
“-ফারহিন..
“-জি..
“-বাবু আসাতে একটা জিনিস ভালো হলো।
“-কি?
“-এইযে আমার আর তোমার পিছু ছুটতে হবে না তুমি ইজিলি আমায় ধরা দিয়ে দেবে।
ফারহিনের ঠোঁটে আঙুল ঘষে বলল আরশ। ফারহিন উঠতে চাইলো। আরশ উঠতে দিলো না।

আরশ আর ফারহিনকে নাস্তা খেতে ডাকতে এসে থেমে গেল সালমা। ভেতর থেকে হাসির শব্দ আসছে। দুজনেই হাসছে উচ্চস্বরে। সালমা হাসলো। দরজায় নক না করেই ফিরে এলো। নিচে নামতেই দেখলো তীব্র এসেছে। তীব্র কে দেখে সালমা দ্রুত এগিয়ে এলো।
“-তুমি এখানে?
“-তোমাকে নিতে এসেছি খালামনি..
“-আমি কোথাও যাবো না তীব্র। ফারহিনের সাথে থাকাটা দরকার।
“-ফারহিনকে সহ নিয়ে চলো, ওখানে গেলে সবটা বলো।
“-কি বলবো তীব্র? কি বলার কথা বলছো তুমি?
“-কালকে রাতেই তো বললাম তোমাকে।
“-এসব নিয়ে আর আলোচনা করো না তীব্র। আমি এখান থেকে যাবোনা। কয়েকদিন থাকবো..
“-কিন্তু খালামনি ফারহিন…
“-প্রেগন্যান্ট!
অবাক হলো তীব্র। একটু পিছিয়ে গেল সে। বলল-
“-কিহ?
“-হ্যাঁ! ফারহিন প্রেগন্যান্ট। আর আমি চাইনা ও এসব জানুক, বা কোনো প্রকার দুশ্চিন্তায় ভুগুক।
“-এসব কিভাবে..
“-হওয়াটাই স্বাভাবিক তীব্র।
“-কিন্তু…
তীব্র কিছু বলার আগেই ফারহিনের আওয়াজ কানে এলো। উপরে তাকাতেই দেখলো আরশ ফারহিনকে কোলে করে নিচে নেমে আসছে। ফারহিনের চেহারায় হাসি লেপ্টে আছে। দুজনেই কথা বলতে বলতে নেমে আসছে।
“-মা দেখলে কি ভাববে?
“-কিছু ভাববে না। এই অবস্থায় সিড়ি বেয়ে ওঠা নামার দরকার নেই। আমি আছি না?
“-তাই বলে এখন থেকে?
“-ছোট থেকেই যত্ন করতে হয়।
বলেই আরশ সামনে তাকাতেই দেখলো তীব্র। ফারহিনকে নামিয়ে দিলো। ফারহিন কে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে সালমা কে সালাম দিলো-
“-আসসালামু আলাইকুম, গুড মর্নিং মা।
“-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। গুড মর্নিং..
“-তুই কখন এলি?
“-মাত্র এসেছে। তোমরা কথা বলো আমি নাস্তা রেডি করছি।
বলেই সালমা চলে গেল। আরশ সালমা যাওয়ার পর তীব্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। দু হাত পকেটে রেখে বলল-
“-এখানে হঠাৎ কি মনে করে?
“-কেন ভয় হচ্ছে নাকি?
আরশ হাসলো, তাচ্ছিল্যের হাসি।
“-এসেছিস ভালো হয়েছে। নাস্তা খেয়ে যা, মিষ্টি মুখ করে যা। তারপর বিদেয় হ। উল্টো পাল্টা কিছু মাথায় ও আনিস না।
“-আনলে কি করবি? আমাকেও মেরে ফেলবি নাকি?
তীব্রের কথায় আরশ ভ্রু কুঁচকালো। তীব্রকে উপর থেকে নিচ একবার দেখলো তারপর বলল-
“-এখন অবধি এমন কিছুই ভাবিনি, কিন্তু যদি উল্টো পাল্টা কিছু করেছিস তাহলে সত্যি সত্যিই করে বসবো যা তুই ভাবছিস তা।
“-হুমকি দিচ্ছিস?
এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল তীব্র। আরশ হাসলো। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল-
“-হুমকি দিই না আমি, অভ্যস্ত নই।
“-ফারহিন কে আটকানোর আর কোনো পথ পেলি না? শেষে কিনা বাচ্চা?
“-হুশ! আমার বাচ্চাকে নিয়ে একটা কথাও নয়। এসেছিস ভালোই ভালোই নাস্তা করে নে।
“-এই বাড়িতে পানিও খাবোনা। আর নাস্তা..
“-তাহলে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না। গেট আউট!!
“-ফারহিনকে একদিন সব জানিয়ে দেব। যেই ভালোবাসা তোকে দিয়েছিলাম তা আমি আবার নিয়ে নেব। তুই তোর শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকিস। আমার ফারহিনকে খুব শীগ্রই নিয়ে যাবো।
আরশ তীব্রের কলার ধরে বসলো-
“-আর একবার যদি ‘আমার ফারহিন’ এই শব্দ উচ্চারণ করেছিস তাহলে তোর জীভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলব। ও শুধু আমার। তোর কখনো হবেনা আর না ছিলো, না আছে।
“-মিথ্যে ভালোবাসার পট্টি বেঁধে আর কত দিন? একদিন না একদিন সে জানবে, আর তোকে ছেড়ে চলে যাবে। ঘৃণা ছাড়া কিছু পাবিনা। কারণ আমার ফারহিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করবেনা।
আরশ ছেড়ে দিলো তীব্রের কলার। তীব্র বেরিয়ে গেল। আরশ সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। মনে মনে আওড়ালো-
“-ফারহিন সত্যিই ছেড়ে চলে যাবে না তো?
পরক্ষণেই নিজের মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিলো।
“-কখনো না, ও আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেনা। ও আমাকে ভালোবাসে শুধু আমাকে। ও আমাকে ঘৃণা করতে পারেনা। অন্যের কথা ধরে কখনো না।

★ফারহানার সাথে বেরিয়ে গেল ফারহিন। আরশ এত করে বলার পরও আরশ কে সাথে নিয়ে গেল না। প্রায় দু ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও ফারহিন ফিরে এলো না। ড্রয়িংরুমে অনবরত পায়চারি করছে আরশ। বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। ঘড়ির ঘন্টা বেজে উঠতেই ত্রস্তনয়নে তাকালো আরশ। রাত ৯টা বাজছে। আরশ অস্থির হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এত রাত হয়ে গেল অথচ ফারহিন বাহিরে.! কেঁপে উঠলো হৃদয়। আরশ দরজার দিকে আরো একবার তাকালো। সালমা অনেক্ষণ যাবত আরশের অস্থিরতা লক্ষ্য করছে। আরশের বেচয়েন ভাব দেখে এগিয়ে গিয়ে আরশের পাশে দাঁড়ালো। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আরশের দিকে এগিয়ে দিলো। আরশ পানি খেয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিতেই সালমা আরশের হাত ধরে নিলো। আরশ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সালমা ইশারায় ডেকে সোফায় বসিয়ে দিলো। আরশের মাথায় হাত রেখে বলল-
“-ঠিক আছো?
“-মা ফারহিন…
“-এসে যাবে। তুমি এত অস্থির না হয়ে একটু বোসো। সে এসে যাবে!
আরশ চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পর সালমার দিকে তাকালো। আরশের চোখ লাল হয়ে এসেছে। চোখে পানি চিক চিক করছে। আরশ কাঁপা কন্ঠে বলল-
“-মা?
“-বলো?
“-ফারহিন আমাকে ভুল বুঝবে না তো? আমায় কখনো ছেড়ে চলে যাবে না তো?
“-তুমি এমন কিছু করেছো যা জানলে ফারহিন চলে যাবে বা ভুল বুঝবে?
আরশ ত্রস্তনয়নে তাকালো। অসহায় চাহনি তার। সালমা আবারও বলল-
“-পৃথিবীতে সবাই সব দিক দিয়ে সম্পুর্ণ হয়না আরশ। আর সত্য-মিথ্যের এই দুনিয়ায় সত্য খুব বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। সত্য সামনে আসলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে এই পরিস্থিতি সামলানোর একটা ছোট্ট উপায় আছে। যদি আমরা নিজেই নিজের ভুল স্বীকার করি। আমরা যদি নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারি তা স্বীকার করি তাহলে সামনের ব্যাক্তি আমাদের শাস্তি কিছুটা কমিয়ে দিবে এই ভেবে যে, অন্তত যাইহোক সে তার ভুলটা বুঝেছে।
“-আম..আমি ভুল করিনি মা।
“-আরশ! ভুল আমরা করিনা। আমরা প্রত্যেকেই ভাবি এই কাজটা সঠিক। কিন্তু অপরের চোখে তা সঠিক না ও হতে পারে। তোমার চোখে যা ঠিক অন্যের চোখে ও তা ঠিক হবে এমনটা নয় আব্বু। তুমি বুঝেছো আমি কি বলেছি? তোমার করা ভুল ফারহিন অন্যের মুখ থেকে শুনে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে তুমি নিজেই তা স্বীকার করে তাকে করা আঘাতে প্রলেপ লাগাও। আজ না হয় কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।

আরশ ধীর গতিতে মাটিতে বসে পড়লো। সালমার কোলে মাথা রেখে বলল-
“-সে আমায় ভুল বুঝবেনা তো সবটা জানার পর? আমার কাউকে লাগবেনা, কিন্তু আমি তাকে না পেলে চলতে পারবোনা মা। তাকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে সে। আমি তাকে এক মুহুর্তের জন্যও আলাদা করতে পারব না। সেখানে তাকে ছাড়া থাকবো এটা ভাবতেও আর কলিজা ছিড়ে রক্তক্ষরণ হয়।
“-কিচ্ছু হবে না আমি আছি। তোমার ফারহিন কোথাও যাবেনা তোমাকে ছেড়ে।

চলমান….
চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here