#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-২৬ ( স্বীকারোক্তি)
কাল তূর ও মিহালের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী যা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে।
মিহাল ও তূর বসে আছে মিহালের রুমের বাহিরের সাইডে বাম পাশের গার্ডেনে। এখান দিয়ে মিহালের রুমে যাওয়া যায়।
তূর মিহালের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তূর বলে,
তূর: কাল আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী তাইনা?
তূরের কথায় তূরের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় এবং তূরের মাথায় ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে জবাব দেয়,
মিহাল: হুম।
তূর: কাল আমরা আবার বিয়ে করবো তাইনা?
মিহাল: হ্যাঁ, কালকে আমরা আবার বিয়ে করবো আর এবার ভালোবেসে বিয়ে করবো আমার মনের রাজ্যের “মেঘকন্যা” কে।
কথাটা বলে মিহাল অন্য হাত দিয়ে তূরের চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয়।
তূর: যতবারই আমাকে বিয়ে করো না কেনো প্রত্যেকবার ওই শর্তগুলো বহাল থাকবে।
মিহাল এবার নিজের বাহু থেকে তূরে হাত সরিয়ে তূরকে নিজের দিকে ঘুরায় আর বলে,
মিহাল: কি হইছে তোমার? নতুন করে একে অপরকে বিয়ে করার মানে কি পুরনো সব ওয়াদা ভুলে যাবো? এই সত্যি করে বলোতো তোমার কি হইছে? তুমি যখন থেকে এখানে এসেছো একদম চুপ করে আছো! অন্য সময় হলে ঠিক ছিলো কিন্তু রাত ২ টার দিকে তুমি ফোন করে বললে রুমের দরজা খুলতে আর আসার পর থেকে একদম চুপ করে থেকে এসব কথা বার্তা বলছো! কেউ কিছু বলেছে?
শেষের কথাটা মিহাল তূরের দুগালে হাত রেখে বলেছে।
তূর মিহালের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
তূর: আজকে ইনু বললো, “ডিভোর্সের ছয় মাস পরেই আবার ভালোবাসে বিয়ে তাও ভিনদেশে! দেশে গিয়েও তো বিয়েটা করা যেতো!”
আমি না ওর মুখে কয়দিন ধরেই মানে বিয়ের কথা ঠিক হবার পর থেকেই খুশি ভাবটা দেখতে পাইনি কেমন করে যেনো তাকাতো! তাই ওরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কি হয়েছে, তখন এই কথাগুলো বলল আমাকে।
মিহাল তাকিয়ে আছে তূরের দিকে একধ্যানে আর ভাবছে, “কেনো মেয়েটা এসব কথার পাল্টা জবাব সাথে সাথে দিয়ে দেয় না!”
তূর আবার বলে,
তূর: তোমাকে কিছু কথা জানানোর ছিলো। আমি না জানতাম তোমার তানজিনার সাথে ডিভোর্স বা কিছু না কিছু একটা হবে যার কারণে তোমরা আলাদা হয়ে যাবে!
মিহাল কিছু বলে না কারন সে আজ সবটা শুনতে চায় যে কিভাবে এসব জানে তূর! কেন তূর ইচ্ছা করে কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হতে চেয়েছে! কেন তূর হাসপাতালের বেডে শুয়ে তানজিনাকে ফোন দিয়ে অনুমতি চাইতে বলেছে যেখানে তূরকে নিজের কথার ওপর আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিলো।
তূর: অর্কর এক কাজিন বোন সরোয়ার্দী মেডিকেলের নার্স তাই অর্ক তাকে তানজিনার উপর নজরদারি রাখতে বলেছিল। আর তোমার দিকটা আমি রাফির থেকে জানতে পেরেছি রিজভীর মাধ্যমে। আর প্রথম থেকেই তো তানজিনা তোমার সাথে রুড বিহেভ করতো সাথে কতো অপমান করেছে। তানজিনা একজন ক্যারিয়ার সচেতন মেয়ে সেই হিসেবে ওর ডাক্তার আরিফের সাকসেসটা ভালো লাগত তাই সেও চাইতো উনার মতো হতে। তখনো তানজিনা কিন্তু ডাক্তার আরিফের উপর উইক হয়নি। ডাক্তার আরিফের কাছে অবশ্য প্রথম থেকেই তানজিনাকে ভালো লাগত। তোমাকে যে তানজিনা বিয়ে করতে চায়নি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম রিজভীর কথা শুনে। তুমি তো তানজিনার সাথে কথা বলতে চাইতে হাজার হোক সে তোমার বিয়ে করা বউ যাকে তুমি সাত বছর ধরে চেয়ে এসেছো!! আমার তখনি সন্দেহো হয় যে তানজিনা তোমাকে কি কখনো মেনে নিবে!!
এরপর তোমার সাথে আমার বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত অর্কর ঐ কাজিন বোন আমাকে খবর দিতে থাকে যে তানজিনার ব্যবহারও ডাক্তার আরিফের উপর কিছুটা উইক মনে হচ্ছে। অর্কর ঐ কাজিন বোন ওদের সাথে ক্যাম্পিংয়েও ছিলো যেহেতু সে সিনিয়র নার্স।
জানো মিহাল আমার মনে হয় কি, তুমি যে ওর প্রতি কেয়ার, ভালোবাসা দেখাতে সেটা ওর পছন্দ হতো না! কারণ ও সব সময় তোমাকে নিজের একজন প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতো। আর যে মেয়ে একদিন আমাদের বলেছিলো সে কোনো ডাক্তার কেই বিয়ে করবে কোনো ইঞ্জিনিয়ারকে না! তখন সে বলেছিলো, “মিহাল তো ইঞ্জিনিয়ার তাই ও আমার টাইপের না।”
সেই তানজিনা তোমাকে বিয়ে করে নিলো!
এরপর আমি এটাও জানতে পারি তানজিনা যে বিয়ে করেছে সেটা ওর হসপিটালের কেউই জানতো না এমনকি ও সবাইকে নিজেকে সিঙ্গেল বলে দাবি করতো।
তাই আমি ঐদিন তোমাকে সাহস করে বিয়ের কথাটা বলেছি। কারণ আমি জানি তানজিনার সাথে তোমার ডিভোর্সের পর তুমি সহজে কাউকে বিয়ে করবে না বা ভালোবাসবে না কারন তুমি ভালোবেসে বিয়ে করে একবার ঠকেছো আর দ্বিতীয়বার তা চাইবে না।
তাই তানজিনা থাকাকালীনই আমি তোমার জীবনে প্রবেশ করতে চেয়েছি যাতে তুমি কিছুটা হলেও কষ্ট কম পাও আরে নিজের জীবন খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিতে পারো।
মিহাল এতক্ষণ ধরে শান্ত হয়ে তূরের বলা সবগুলো কথা শুনলো। হ্যাঁ, তূর ঠিকই বলেছে তানজিনার সাথে ডিভোর্সের পর যদি তূর মিহালের স্ত্রী না থাকতো তাহলে মিহাল কাউকে আবার এতো দ্রুত ভালোবাসতো বা বিয়ে করতো না। হয়তো অনেক বার মানা করার পর বাবা-মার কথায় বাধ্য হয়ে একসময় বিয়ে করে নিতো কিন্তু মনে একটা দাগ ঠিক থেকে যেতো যে, “এতো ভালোবেসে ও অপমান পাবার পরেও যখন কাউকে নিজের করে পেলো তারপরেও ধরে রাখতে পারলোনা সে ঠিক উড়ে চলে গেল।” তখন হয়তো মিহাল রোবটের মত রোবটিক জীবন যাপন করত।
☆( এখন আপনারা বলুন তূর কি সেদিন বিয়েটা করে ঠিক করেছিল না ভুল করেছিল? মন্তব্যে অবশ্যই জানাবেন। )☆
মিহালের জবাব না পেয়ে তূর আবার বলা শুরু করে,
তূর: তুমি যখন তানজিনার কাছ থেকে অনুমতি চাইছিলে আমার না একটুও ভয় করছিল না! কারণ আমি জানতাম তুমি তানজিনাকে ইনডাইরেক্টলি জিজ্ঞাসা করলে তানজিনা তোমাকে তার কথার মাধ্যমেই অনুমতি দিয়ে দিবে। কারণটা জানো,
” দুনিয়াতে সকল একতরফা ভালোবাসা দুইতরফা হলেই সেটা সার্থকতা পায় একতরফাতে সার্থকতা পায়না!🙂”
যেমন দেখো তোমাকে বিয়ে করার পরেও কিন্তু আমি পাওয়া না পাওয়ার মাঝখানে ঝুলছিলাম। যখন থেকে তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করলে তখন থেকেই কিন্তু আমার ভালোবাসাটা সার্থকতার রূপ নিয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন তুমি আমাকে ঠিক ভালোবাসবে আর সেই বিশ্বাসেই আমি তোমাকে সেদিন বিয়ে করেছি।
ডাক্তার আরিফের তানজিনাকে ভালোলাগত বা ভালোবাসতো সেটা তার করা তানজিনার প্রতি কেয়ারে বোঝা যেত কারন সে অন্যান্য ইন্টার্ন ডাক্তারদের তুলনায় তানজিনাকে বেশি প্রায়োরিটি দিতো আর এখন তো তারা রিলেশনশিপে আছে।
তোমার সাথে বিয়ে হবার পর আমার বাঁচার ইচ্ছাটা বেড়ে গিয়েছিল নাহলে ডাক্তার তো আমাকে অপারেশন করার আগেই আমার পরিবারকে বলে দিয়েছিল আমি নাও বাঁচতে পারি। আসলে কি বলতো বাঁচার ইচ্ছাটা থাকাটা জরুরী।
আমার মধ্যে বাঁচার ইচ্ছাটা একটু একটু করে জমে উঠেছিলো যখন অর্কর থেকে তানজিনার ব্যাপারটা শুনলাম ও পরে রাফি আমাকে তোমার দিকটাও বললো।
সব শুনে মিহাল তূরকে নিজের সাথে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এই মেয়েটাই তো মনের ঘরে সত্যিকারের ভালোবাসার আলো নিয়ে এসেছে।
_________
শুক্রবার জুম্মার দিন। জুম্মার নামাজের পর স্থানীয় মসজিদে তূর ও মিহালের আবার বিয়ে হবে সাথে রেজিস্ট্রি পেপার শর্তগুলো সহ রেডি করা হবে।
মোহাম্মদ ওজিল যেহেতু এখানকার ছেলে তাই সে সব কিছু ব্যবস্থা করছে মসজিদে কথা বলে। ফাইজার সাথে ওজিল এখন রিলেশনশীপে আছে। নতুন বছরের ক্লাস শুরু হবার পরপরই ফাইজা ওজিলকে জানিয়ে দিয়েছে তার মনের কথা।
তূরের জন্য একটা হালকা আকাশী রংয়ের ব্রাইডাল ড্রেস ফুল স্লিভের। অবশ্য ড্রেসটা কিনে আনা হয়নি সেটা একদিনের জন্য ভাড়া করে আনা হয়েছে।
হালকী আকাশির মধ্যে ফ্লোরাল ড্রেস। ড্রেসের সাথে মিলিয়ে হোয়াইট ও ব্লু স্টোনের ফ্লোরাল ক্রাউন, ব্রেসলেট, ইয়ারিং। মাথার মধ্যে যে হালকা আকাশী রঙের ওড়না নিয়েছে সেটা সামনে এনে রেখেছে একপাশ দিয়ে আর আরেক পাশে পিঠের কিছুটা নিচ পর্যন্ত ছড়ানো চুলের একগাছি এনে রেখেছে রিং করে। সাথে হালকা মেকআপ ড্রেসের সাথে মিলিয়ে। সব মিলিয়ে তূরকে এখন “মেঘেকন্যা” মনে হচ্ছে! মিহাল নিজেই বলেছে সাদা ব্রাইডাল ড্রেস না নিয়ে হালকা আকাশী রঙের ব্রাইডাল ড্রেস নিতে।
( লম্বা চুল নিয়ে কনফিউজড থাকলে বলবো তূর নিজের চুলের অনেক যত্ন করে😷)
ওলিভা ও এলিনা তূরকে ওদের কালচারের মতো করে রেডি করেছে। তূর বাদে সব মেয়েরা হালকা আকাশী রঙের শাড়ি পড়েছে সাদা ব্লাউজ দিয়ে আর ছেলেরা সাদা রঙের স্যুট-প্যান্ট পড়েছে সাথে কালো সু ও বো টাই। মিহাল পড়েছে হালকা আকাশী রঙের স্যুট, সাদা প্যান্ট, কালো সু ও বো টাই।
দুপুর দুইটায় বিয়ে হবে।#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-২৭ ( পূর্ণতা )
ছেলেরা মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে এসে তৈরি হতে লেগে যায় যেহেতু ওদের সময় কম লাগে তৈরি হতে। আর মেয়েরা বেলা সাড়ে বারোটার সময় জোহরের নামাজ পড়ে তৈরি হতে হতে এখনও তারা তৈরিই হচ্ছে!!
দুপুর দুইটা পনেরোতে ওরা সবাই পার্শ্ববর্তী মসজিদে যায়। সেখানের ইমাম ওদের আবার বিয়ে পড়াবে। তূর হাতে বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন ধরনের ফুলের তোড়া নিয়ে মসজিদের দিকে অগ্রসর হয়। মিহাল তূরের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে চোখ ফেরাতে পারছে না। মিহালের এভাবে তাকানো দেখে ছেলেরা ও মেয়েরা উভয়ই নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে আর তূর লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। শেষে রণক মিহালের কাঁধে হাত রেখে বলে,
রণক: ভাই এমন ভাবে তাকিয়ো না নজর লেগে যাবে! সে তো তোমারই বউ তাই না।
কথাটা শুনে মিহাল নিজের চোখ নামিয়ে নেয় তা দেখে সবাই মিট মিট করে হাঁসছে।
তূর তো সেই কখন থেকে মিহালের এভাবে পলকহীন তাকিয়ে থাকায় লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছে এখনও মাথা উঠাতে পারল না। আজ তার সব দিনের তুলনায় অতিরিক্ত লজ্জা লাগছে! হয়তো আজকে নতুন করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রবেশ করবে তাই। তূরেরও খুব ইচ্ছে করছে মিহালের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সে এতদিন ভাবতো মিহালকে হয়তো নীল রঙের মধ্যে ডার্ক ব্লু রঙেই সুন্দর লাগে কিন্তু ওকে হালকা আকাশি তেও অনেক সুন্দর লাগে। মোট কথা তূরের কাছে এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো রঙে মিহালকে অসম্ভব সুন্দর লাগে!!
( বেচারি নিজেই কনফিউজড কোন রঙে মিহালকে বেশি সুন্দর লাগে🤔)
ফুলের পর্দার দুই পাশে বর ও কনেকে বসানো হয়। এরপর ইমাম সাহেব ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক ওদের আবারও বিয়ে পড়ায়। বিয়ে পড়ানোর পর ফুলের পর্দা ফাঁকা করে মিহাল তূরের কপালে নিজের অধর স্পর্শ করে।
বিয়ের কার্যক্রম সমাপ্ত এরপর ওরা বাংলোতে ফিরে আসে। বাংলোতে এসে নতুন বর-কনেকে আলাদা দুই রুমে রেখে মিহালের রুমটাকে বাসরের মতো সাজানো শুরু করে সবাই মিলে।
বাসর সাজানোর এক ফাঁকে রাফি লক্ষ্য করে ইনায়ার মুড অতটা ভালো না। অবশ্য রাফি এটা গত দুই-তিন দিন ধরেই লক্ষ্য করছে। রাফি ইনায়াকে নিয়ে নিজেদের রুমে যায় ইনায়াকে বিছানায় বসিয়ে নিজে মাটিতে বসে ওর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করে,
রাফি: কি হয়েছে ইনু তোমার? অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করছি তুমি হাসিখুশি না কেমন যেন মুখ গম্ভীর করে রাখো কারণটা কি?
মুখের ভাবগতির পরিবর্তন না করেই ইনায়া জবাব দেয়,
ইনায়া: আমার আবার কি হবে? ছাড়ো তো! যাও ওদের বাসর সাজাও গিয়ে।
রাফি বুঝতে পারে কি কারনে ইনায়ার এরকম ভাবগতি তাই রাফি বলে,
রাফি: কেন তুমি তূর ও মিহালকে মেনে নিতে পারছ না সেটা আমি বুঝতে পারছি না। তানজিনা তো নিজের জীবনের সুখেই আছে তাহলে কেনো ওদের এই আনন্দের দিনেও মুখ ভার করে আছো! ওদের খুশিতে শামিল হচ্ছো না!
ইনায়া রাফির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আর রাফিও ইনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ইনায়া: ভালোবাসা পরিবর্তনশীল তাই না? আজ একে ভালোবাসলাম তো কাল ওকে ভালবাসলাম!
রাফি অবাক চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর ইনায়া ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। রাফি তা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
রাফি: না তো ভালোবাসা পরিবর্তনশীল! না তো ভালোবাসার নিঃশেষ আছে! কিন্তু কথা একটাই,
“সঠিক মানুষকে ভালবাসতে হয়।”
ভালবাসলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, কালো-ফর্সা, ধনী-গরীব এগুলো ম্যাটার করে না। ভালবাসতে টাকা-পয়সা লাগেনা শুধু লাগে একটা সুন্দর মন যা ভালোবাসতে জানে।
সবচেয়ে নির্মম একটা কথন,
“কারো কারো জীবনে সত্যিকারের ভালবাসা প্রথমে আসে আবার কারো কারো জীবনে শত ধোঁকা ও মিথ্যা ভালোবাসার পরে সত্যিকারের ভালোবাসা শেষে আসে।
কেউ কেউ কাউকে ভালোবেসে ভুলতে না পেরে পাগল হয়ে যায় আর তাঁদের পাওয়া যায় মেন্টাল এসাইলামে বা রাস্তার ধারে ধারে, আবার কেউ কেউ অন্য কারো সত্যিকারের ভালোবাসার স্পর্শে এসে আগের মিথ্যা ভালোবাসা ভুলে যায় কারন তা পীড়াদায়ক।”🙂
তানজিনাকে মিহাল ভুলতে বাধ্য হয়েছে তূরের সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে হার মেনে। আর আমরা সবাই জানি মিহাল নিজের আত্মসম্মানে করা আঘাত সহ্য করেনা। আর যেই মেয়ে মিহালের মনে ভালোবাসার সূত্রপাত হবার পর থেকেই মিহালের আত্মসম্মানে আঘাতের উপর আঘাত দিয়েই চলেছে। এমনকি ওদের বিয়ের পরেও সিনিয়র ডাক্তারের সামনে স্বামীকে বন্ধু বলে পরিচয় দেয় আবার প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দশটা মিনিট কথা বলার জন্য সময় করে উঠতে পারে না অথচ কাজে-অকাজে সিনিয়রের পিছে পিছে ঘুরে আর নিজের স্বামীকে বলে সে ব্যস্ত আছে! এতো অবহেলা পাবার পরেও মিহাল তানজিনার সাথে কথা বলেছে শুধু জানতে, কেনো এমন করছে আর কি চায়।
সত্যি বলতে ভালোবাসায় জেদ থাকা ভালো তবে মায়া থাকতে হয় আর যা মিহালের মনে তানজিনার জন্য ছিলো না! ছিলো শুধু জেদ যা তানজিনাকে বিয়ে করে নিজের করে রেখে বুঝিয়ে দিতে যে, ‘ এতোদিন যাকে অবহেলা ও অপমান করেছ আজ তার সাথেই তোমার জীবন কাটাতে হচ্ছে!’
কিন্তু দেখো মিহাল শেষ পর্যন্ত নিজের জেদ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে আর পেরেছে কারো প্রতি মায়া, জেদ ও ভালোবাসার মিশ্রনে এক পূর্ণাঙ্গ অনুভূতিতে ভালোবাসা জাগ্রত করতে।
—-
ইনায়া সবটা শুনলো খুব মনোযোগ দিয়ে এবং বুঝলো কিন্তু মনে একটা খচখচানি থেকে যায় তার কারন তানজিনার বিয়ের খবর ও ডিভোর্সের কথা জানাজানি হলে আর সেটা নিয়ে যদি কোনো সমস্যা পরে হয় তো তানজিনা কি করবে তা ইনায়া নিজেও ভাবতে পারছে না।
এরপর ইনায়া হাসিমুখে রাফির সাথে যায় ও বাকি কাজে হাসিমুখে হাত লাগায়।
_________
তূরকে লাল বেনারসি লাল ব্লাউজের সাথে পরিয়ে সাথে লাল লিপস্টিক,কাজল,মাশকারা, সোনালী ঝুমকো, ডায়মন্ডের ছোট নোসপিন, স্বর্ণের দুটি চিকন চুড়ি, স্বর্ণের প্লেইন আংটি, স্বর্ণের চেইন, চুলে মাঝ সিঁথি করে খোপা সাথে বিভিন্ন রকম ফুলের গাজরা।
মিহালের মা তূরকে সুস্থ হবার পর স্বর্ণের নোসপিন, আংটি ও দুটি চিকন চুড়ি দিয়েছিলো আর তূর সেগুলো সাথে করে নিয়ে এসেছিলে এই ভেবে যদি মিহাল তাকে কোনদিন স্ত্রীর অধিকার দেয় তখন থেকে পরবে।
______
সাজানো শেষে হরেক রকম ফুলে সজ্জিত বিছানায় তূরকে বসিয়ে দিয়ে আসে। রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে মিহাল রুমে আসে আর তূর তো সেই নয়টা থেকে বসে থেকে থেকে এখন বিছানা থেকে নেমে রুমের মধ্যে একটু হাঁটছিল।
দরজা খোলার শব্দে তূর অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় যেখানে ছিল। পুরো রুম ছোট বড় কিছু ক্যান্ডেল ও দুইটা ল্যাম্প দিয়ে আলোকিত।
মিহাল দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাড়িয়ে থেকে বেডের পাশে দাঁড়ানো তূরকে দেখলো, কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। লাল বেনারসি পরিহিত তূরকে ল্যাম্প ও ক্যান্ডেলের আলোয় কোন অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না। মিহালের তো এখন তূরকে এমন আবছা আলোয় দেখে মন ভরছে না তাই আগের সুইচ বোর্ডে রুমের লাইট অন করে।
এতক্ষণ রুমে হলুদাভ নিকষ কালো আলোয় পরিপূর্ন থাকায় তূরের চোখে সাদা আলো পরায় চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসে। মিহাল এরিমধ্যে তূরের কাছে এসে পরে। চোখ হাত দিয়ে আড়াল করে সাদা আলো সয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে তূর আর মিহাল এসে তূরের চোখের উপর থেকে তূরের হাত সরিয়ে দিলে পিটপিট করে চোখ খুলে তূর।
মিহাল তূরকে মন ভরে দেখে একেবারে অপলক তাকিয়ে আছে। মিহালের কাছে আজকে তূরকে পাক্কা বউ বউ লাগছে। ওদের মাঝে দূরত্ব এখন শুধু এক হাত। তূরতো মিহালের এমন চাহনি দেখে লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে। তূর ভাবে, লোকটা এমন কেনো? শুধু আমাকে লজ্জা দেওয়ার ধান্দায় আমার দিকে একপলকে তাকিয়ে থাকে! আগেতো ফিরেও দেখতো না😒। শেষের টুকু ভেবে তূরের মন খারাপ হয়ে যায় তাই তূর মাথা নিচু করে অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মিহাল তূরের হঠাৎ এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াতে বুঝতে পারেনা কি হয়েছে তাই তূরের থুতনিতে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরায় আর বলে,
মিহাল: কি হলো, হঠাৎ করে মুখ ঘুরিয়ে নিলে যে?
তূর: কিছুনা!
মিহাল: কিছুতো হয়েছে! বলো, লজ্জা লাগছে তোমার?
তূর মাথা আবার নিচু করে ডানেবামে নাড়িয়ে না জানায়।
মিহাল: আজ থেকে আমরা পূর্ণাঙ্গরূপে স্বামী-স্ত্রী তাই তোমার মনে যা আসবে আমাকে বলে দিবে। “ভালোবাসি তোমায়!” জানি কথাটা তোমাকে আগেও বলেছি তবে তুমি বিস্বাস করেছো কি না তা জানি না।
তূর হকচকিয়ে যায় মিহালের কথায়। তাড়াতাড়ি করে বলে,
তূর: তুমি ভূল বুঝছো। আমি বিস্বাস করি তুমি আমায় ভালোবাসো, শুধু কখনে ছেড়ে যেও না প্লিজ! আমি নিতে পারবো না সেটা।
কথাটা বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসে তূরের আর মিহাল তা দেখে চোখ থেকে তা গড়িয়ে পরার আগে দুই চোখের ওয়াটারলাইন থেকে মিহাল নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুছে নেয় এরপর তূরের কপালে নিজের অধর স্পর্শ করায় খুব সময় নিয়ে। তূর এসময়টায় আঁখি যুগল নমিত রেখে লাজুক হাসে।
রুমের লাইট বন্ধ করে আবার আগের মতো করে নেয়। তূরকে বিছানায় বসিয়ে মিহাল পূর্ব পাশের জানালার গ্লাস লাগিয়ে পর্দা টেনে দেয় সামান্য ফাঁকা রাখে যাতে বাহিরের আলো প্রবেশ করতে পারে। এরপর নিজে এসে তূরের পাশে বসে আর বলে,
মিহাল: তোমার জন্য এই উপহার টা এনেছি।
হাতের মধ্যে একটা রিং বক্স নিয়ে বলে। এরপর এটাকে খুলে বের করে একটা ছোট ডায়মন্ড পাথরের রিং।
রিংটা তূরের অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দেয় আর তূরের হাতে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে।
কিছুক্ষন ওরা রুমের দক্ষিণ দিকের দরজা যেটা দিয়ে গার্ডেনের বাম পাশে যাওয়া যায় সেটা খুলে একে অপরের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখে এরপর মিহাল তূরকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দরজাটা যেয়ে লাগিয়ে দিয়ে নিজে তূরের পাশে একদম কাছাকাছি এসে বসে বলে,
মিহাল: আজ সম্পূর্ণরূপে তোমাকে চাই আমার করে, অনুমতি দিবে?
তূর কিছু না বলে মাথা নিচুু করে লাজুক মুখে আঙ্গুল দিয়ে বিছানা সাদা চাদরটার উপর বিছানো ফুলের পাঁপড়ি গুলো খুঁটছে।
মিহাল: কি হলো বলো?
কথাটা বলে মিহাল আবারো তূরের থুতনিতে হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে নিজের বরাবর করে। তূর নিজের আঁখি জোড়া মুদন করে রেখেছে তা দেখে মিহাল চোখের উপর ফু দেয় আর তূর সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে মিহালের বুকে মুখ লুকায়। একে অপরকে ভালোবাসার আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় দুজনে। পূর্ণতা পায় ওদের ভালোবাসার স্পর্শ।
চলবে,