#শেষ_কান্না
#পর্ব_৩
#লেখা_Bobita_Ray
রায়হান মায়ের মুখে পুরো ঘটনা শুনে ঘরের এক কোণে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িলে রইল।রাকিব খুব ভদ্র, শান্তশিষ্ঠ,একটি ছেলে আর খুব মেধাবীও।সেই ছেলে ভাবির সাথে নোংড়ামী করবে কেন? তা ভেবেই পেল না রায়হান। অন্যদিকে অরুর কথাও তো ফেলে দেওয়া যায় না। মেয়েটা তো আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলবে না।এখন কার কথা বিশ্বাস করবে রায়হান? মায়ের কথা,না অরুর কথা??ফুলমতি চেঁচিয়ে বলল,
-“তোর বউয়ের ছলচাতুরি তুই না বুঝলে কী হইবো আমি ঠিকই বুঝছি। তোগো দুইজনরে আলাদা ঘরে শুইবার দিসি না। তাই কৌশলে নিজের দেওরের নামে বদনাম কইরা তোরে ঘরে নিবার চায়।এই ছেমড়িরে তো আমার প্রথম থেক্কায় পছন্দ না।ওর সিনায় সিনায় শয়তানি বুদ্ধি।ঢাকাইলা মাইয়া তো বার ভাতার ধইরা খাওয়ার অভ্যাস।
রায়হান করুণ দৃষ্টিতে অরুর দিকে এক পলক তাকাল।অপমানে,লজ্জায়, মেয়েটার মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“মা তুমি থামবে?
-“এহনে আমারে থামতে কস ক্যাঁ। তুই আমার পেটের ছাওয়াল হইয়া এই বেজন্মার পক্ষ নেস।খুঁজ নিয়ে দেখেকগা এই ছেমড়ির বাপ মায়ের ঠিক আছে না কী!রায়হানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।রাগে হাত মুঠো করে চিৎকার করে বলল,
-“কী চাইছ বলতো মা তুমি?ঘরের ভিতর শুধু শুধু অশান্তি করছ কেন?ওকে যা খুশি বলো এর ভিতরে ওর বাবা মাকে টানছ কেন?
ফুলমতি হঠাৎ সশব্দে কেঁদে দিল মুখে আঁচল গুঁজে রায়হানের পা ধরার ভঙ্গী করে বলল,
-“মাফ চাই বাজান মাফ চাই।তুর বউরে আর কিছুই কমু না। আমি বুঝবার পারনাই পোলা আমার দু’দিনেই বিয়া কইরা পর হইয়া যাইবো।বুঝলে তোর বউরে কিচ্ছু কইতাম না।যে পোলার লেইগা জায়গা,জমি বেঁইচ্ছা পড়ালেহা করুণের লেইগা ঢাহা পাঠাইছি সেই পোলা এখন আমারে কয় আমি নাকী সংসারে অশান্তি করি।আজ তোর বাপ বাঁইচ্চা থাকলে আমারে এত অপমান করবার পারতি না।বলেই হাউমাউ করে কাঁদলে লাগল ফুলমতি।রায়হান কী করবে, কী বলবে ভেবে পেল না। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল অরুর উপর। মা’কে এসব কথা না বলে রায়হানকে বললেও পারত মেয়েটা ।রায়হান অরুর একহাত চেপে ধরে সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল,
-“এখন তোর শান্তি হয়েছে?আমাদের মা ছেলের সম্পর্ক খারাপ করে।তুই তো এটাই মনে মনে চেয়েছিলি।তুই যখন থেকে আমার জীবনে এসেছিস তখন থেকে সুখ কী জিনিস আমি ভুলে গেছি।আমার গোছানো লাইভটা বরবাদ করে দিয়েছিস তুই?তোর মুখ দেখলেও অভিশাপ লাগে।বলেই অরুর হাত ছেড়ে চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বলল,
-“এতক্ষণ তোর সাথে ভালো ব্যবহার করেছি, তোকে সহ্য করছি কেন জানিস!ভেবেছিলাম তোর বড়লোক বাপ তোর সাথে কিছু টাকাকড়িও দিবে যৌতুক হিসেবে।কিন্তু যৌতুক তো দূরের কথা ভদ্রলোক তোকে বিদায় করেই হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।
অরু অবাক হয়ে রায়হানের চোখে চোখ রাখল।রায়হানের চোখ রাগে লাল হয়ে গেছে, কপালের রগ জেগে ওঠেছে,হাত কাঁপছে।অরু অস্ফুট স্বরে বলল,
-“আহ্ রায়হান…ছাড় ব্যাথা পাচ্ছি।
-“একদম চুপ!
-“তুমি না আমায় ভালোবাস রায়হান?এই তোমার ভালোবাসা?
রায়হান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
-“ঘরে অভাব,মনে অশান্তি আর কাছে টাকা না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।
অরু ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল,
-“এরকম তো কথা ছিল না রায়হান!ভুলে গেছ সেসব সুখময় দিনের কথা।যে তুমি আমার জন্য কতো পাগলামি করতে,আমি না খেলে তুমিও খেতে না, সারারাত জেগে ফোন কানে চেপে কতশত স্বপ্ন বুনতাম দুজনে, আমার জ্বর হলে তুমি সারারাত ছটফট করতে। মাঝরাতে ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধুমাত্র আমাকে দূর থেকে এক পলক দেখার জন্য।আর আজ সময়ের সাথে সাথে কতো বদলে গেছ তুমি?
রায়হান অরুর চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গীতে বলল,
-“তোমার নাটক বন্ধ করো।এখন যাও মায়ের সাথে কিছু কথা আছে।
অরু চোখের জল মুছতে মুছতে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।রায়হান মায়ের দু’হাত ধরে বলল,
-“আমার ভুল হয়ে গেছে মা। মাফ করে দাও। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কথাগুলো বলতে চাইনি! মাথা গরম করে কী বলতে কী বলেছি সেসব মনে রেখে কষ্ট পেও না মা।
ফুলমতি চোখের জল মুছে রায়হানের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-“তুই হইলি আমার সাত রাজার মানিক ।তোর কথায় কী আমি মন খারাপ করবার পারি?আয় বাজান বুকে আয়?রায়হানকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিল ফুলমতি।একদিকে মা ছেলের মধুর মিলন দৃশ্য। অপরদিকে একটি নীরহ,অসহায় মেয়ে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বুকে একরাশ কষ্ট চেপে বাঁলিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে। মা হয়ে না হোক শাশুড়ি হয়েই একটু আদর,ভালোবাসা দিলে কী এমন ক্ষতি হতো?অরু কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করে তাড়াহুড়ো করে চোখের জল মুছে নিল সামনে তাকিয়ে দেখল রথী অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।অরু স্মিত হেসে বলল,
-“রথী।
রথী অরুকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কেঁদে দিল।অরু রথীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“এই পাগলি কাঁদছ কেন?
-”সরি ভাবি মায়ের কথায় কিছু মনে করো না।আসলে মা তো! তাই সন্তানের দোষ চোখ পড়ে না।আমি সব শুনেছি ভাবি।আমার খুব খারাপ লাগছে।কষ্টে আমার পেট জ্বলছে।অরু এত কষ্টের মাঝেও ফিক করে হেসে দিল।বলল,
-“বোকা মেয়ে কষ্টে মানুষের বুক জ্বলে। পেট জ্বলে না কী?
-“আমি কালো তো তাই আমার অনুভূতি ভিন্ন।সবার বুক জ্বললে কী হবে আমার পেট জ্বলে।
-“হুম বুঝলাম। আমি খুব ভাগ্য করে পাগলি একটা ননদ পেয়েছি।
রথী ফিসফিস করে বলল,
-“ভাবি আমি জানি রাকিব ভাইয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে?
অরুর বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠল। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
-“তোমার সাথে কিছু করেছে কী?
-“ছিঃ ছিঃ এসব কী বলো।এসব শোনাও পাপ।
অরু অবাক হয়ে বলল,
-“তাহলে?
-“আমার এক বান্ধুবীকে ক্লাস সিক্সে থাকতে একদিন টিফিন পিরিয়ডে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।মেয়েটাকে আমার ঘরে বসতে বলে আমি আম্মার ঘরে কী দরকারে যেন গিয়েছি এসে দেখি রাকিব ভাই আমার বান্ধুবীকে জাপটায় ধরে এলোপাথাড়ি চুমু খাচ্ছে। আমি আচমকা ওদের দুজনকে জড়াজড়ি করতে দেখে ভয়ে তো এক চিৎকার দিয়েছি।মেয়েটাও ভীষণ ভয় পেয়েছিল আর খুব কাঁদছিল।সেই থেকে ও আর আমাদের বাড়ি আসেনা।ধীরে ধীরে আমার সাথে বন্ধুত্বও নষ্ট হয়ে গেল।
-“ওমা সেকী! তোমার আম্মাকে বলোনি?
রথী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
-“বলেছিলাম ভাবি বিনিময়ে আম্মা আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বলেছে, -“চুপ কর বেহায়া ম্যাইয়া।এই কতা দুই কান হইলে তোরে আমি জ্যান্ত কবর দিমু।পোলাগো এই বয়সে একটু আধটু দোষ থাকেই। ব্যাপার না।তুই ঠিক হইয়া চলিস।
অরুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।বলল,
-“কী আজব আমাদের সমাজের নিয়ম তাই না!নিজের ছেলে ভুল করলে,অন্যায় করলে কোনো মেয়ের সাথে নোংড়ামী করলে কোনো দোষ নেই।অথচ যে মেয়েটার সাথে এসব অন্যায় হবে,সেসব মেয়েদের প্রতিনিয়ত অপবাদ সহ্য করতে হবে।এ সমাজ মেয়েটাকে ছেড়ে কথা বলবে না। আচ্ছা রথী আজ পর্যন্ত কী শুনেছ পুরুষ মানুষের স্পর্শ ছাড়া একটা মেয়ে নিজে নিজে নষ্ট হয়,পতিতা হয় বা প্রেগন্যান্ট হয়? আমাদের সরকার নারী পুরুষের সমান অধিকার ঠিকই দিয়েছে।কিন্তু নারী পুরুষ সমান দোষে দোষী এই অধিকার দেয়নি।ভুল করবে দুজন, অন্যায় করবে দুজন অথচ শাস্তি,অপবাদ,লাঞ্ছনা,সহ্য করতে হবে শুধু মাত্র নারীকে। রথী মেয়েদের একটা দূর্বল পয়েন্ট আজ তোমাকে বলি,কখনো কোনো ছেলের মিষ্টি কথায় ভুলবে না। সেসব ছেলেরা সুযোগ সন্ধানী।মেয়েদের মন খুব নরম অল্পতেই গলে যায়, ভেঙ্গে যায় বরংবার।আমরা আজকাল টেলিভিশনে, ফেসবুকে,কিংবা আশেপাশে প্রতিনিয়তই এসব ঘটনা শুনে থাকি ক্ষণিকের জন্য হয়তো সর্তক হই। তবুও দিনশেষে নিজের সবচে মূল্যবাণ সম্পদটা বয়ফ্রেন্ড নামক পশুদের কাছে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে বিলিয়ে দেই।নিজেরাই নিজেদের সস্তা বানিয়ে ফেলি।
রথী অরুর হাত চেপে ধরে শান্তনার দৃষ্টিতে বলল,
-“মন খারাপ করো না ভাবি।এই যে,আমি কালো দেখে লোকে আমাকে কতকিছু বলে,স্কুলের মেয়েরা মিশতে চায় না।আমাকে দেখে নাক ছিটকায় এসব দেখে ক্ষণিকের জন্য মন খারাপ হলেও পরে নিজেই নিজেকে বুঝ দেই আমি আমার আল্লাহ্ কাছে অনেক সুন্দরী।গুটা দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমার আল্লাহ্ আমাকে ফিরাবে না। প্রেমালাপ তো দূরের কথা এই যে কোনো ছেলে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না এতে আমি মনে মনে সবচে খুশি হই।হয়তো লোক লজ্জার ভয়ে নিয়ম মেনে পর্দা করতে পারি না।কিন্তু শুধু মাত্র গায়ের রং কালো বলে শতশত লোভাতুর দৃষ্টির হাত থেকে অদৃশ্য ভাবে প্রতিনিয়ত আমার আল্লাহ্ আমাকে রক্ষা করছে।এই সৌভাগ্যই বা কয় জনের হয়?
অরু রথীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“বোনরে তোর সাথে আগে কেন আমার দেখা হলো না।তোর মত চমৎকার মেয়ে আর দুটো হয় না।যে তোর মূল্য বুঝবে সে তোকে মাথায় করে রাখবে!
রথী বিনিময়ে মিষ্টি করে একটু হাসল।তারপর অরুর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-“আজ থেকে আমরা দুজন আমার ঘরে ঘুমাব কেমন?
অরু মাথা নেড়ে বলল,
-“আচ্ছা।
কই গো নবাবজাদীরা ফুসুরফাসুর করা হইলে আসেন।রান্ধাবাড়া করা লাগব তো।
অরু করুণ দৃষ্টিতে তাকাল রথীর দিকে রথী ভরসা দিয়ে বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না ভাবি আমি তোমাকে কীভাবে রান্না করতে হবে শিখিয়ে দিব।
তারপর গলার স্বর উঁচু করে মাকে উদ্দেশ্যে করে বলল রথী,মা তুমি চিন্তা করো না সময় মতো খাবার পাবে।
রথী অরুর হাত ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেল।চুলায় ভাতের জন্য গরম পানি বসিয়ে একটা বোলে চাল নিয়ে রথী বলল,
-”ভাবি পানি দিয়ে ভালো করে চালগুলা ধুয়ে হাঁড়িতে আস্তে আস্তে ছেড়ে দাও।
অরু মৃদু হেসে বলল,
-“আমি ভাত রান্না করতে পারি বুনু।
রথী খুশি হয়ে বলল,
-“আর কী কী পার ভাবি?
-“ভাত,ডাল, ডিমভাঁজি,আলুভাঁজি,মাছের ভর্তা, মাছের ঝোল,সরষে ইলিশ,মাংসের তরকারি,বিরিয়ানি,পোলাও,মোটামুটি বাঙালী আইটেম পারি।
-“ওরে আল্লাহ্ বলেকী আমি তো ভাবছি তুমি বড়লোক বাড়ির মেয়ে কোনোদিন পানিটুকু ভরে খাওনি।
-“হুর,কী যে বলো।রান্না শিখেছি শখের বশে।আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমি রান্না করতে ভীষণ ভালোবাসি। তাছাড়া রান্নায় গরীব, বড়লোক আছে না কী?রান্না শিখা বা পারা হলো মেয়েদের গর্ভ।
রথী বড় একটা দম নিয়ে বলল,
-“যাক বাঁচালে ভাবি তোমাকে প্রথম থেকে শিখাতে গেলে আমার অবস্থা বেহাল হয়ে যেত।
অরু রথীর গাল টেনে দিয়ে বলল,
-“ওরে পাকনীরে।
অরু,রথী দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে দিল। ওরা হয়তো জানে না দূর থেকে এই মধুর দৃশ্য দেখছে একজোড়া চোখ। অপলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুর দিকে।রায়হান তখন অরুকে রাগের মাথায় কতোগুলো কটু কথা শুনিয়ে দিলেও এখন খুব আফসোস হচ্ছে, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।শুধু শুধু মেয়েটাকে না বকলেও হতো।কিন্তু রাগের বশে মাথা একদম ঠিক থাকেনা এটাই তো বড় সমস্যা।রায়হান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
-“যে করেই হোক একান্তে অরুর কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে।বড্ড অভিমানী যে পাগলিটা!
চলবে