শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২৬
অভিমানে গলা ধরে আসল রুমাইসার। বলার মত কোন জবাব ওর কাছে নেই। ইহান ঝড়ের বেগে সবকিছু নিয়ে বাইরে চলে গেল। ইহান এর যাওয়ার পর রুমাইসা বিছানার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। দৃষ্টি উপরের দিকে চলা ফ্যান টার দিকে।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে ঠিক ই কিন্তু কোথাও যেন কষ্ট অনুভব হচ্ছে না।কারন ওর মনে হচ্ছে শুধু ও ই না, ইহান ও অনেক বড় ধোঁকা খেয়েছে রুহির কাছে। কিছুক্ষন ভেবেই ও তাড়াতাড়ি ফোন টা হাতে নিল। আজ কিছু প্রমান এর পালা। দ্রুত ফেসবুক আইডিতে লগ ইন করে একভাবে রুহির আইডিটা খুঁজে পেল।কিন্তু আশা ভঙ্গ হল আইডিতে লক লাগানো।
৩০ মিনিটের তিক্ত প্রহর কাটার পর রুহি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করল। সাথে সাথে রুহির দিক থেকে মেসেজ আসল। কিন্তু এখন মেসেজ বড় কথা না। রুমাইসা তাড়াতাড়ি ওর প্রোফাইল চেক করল। কিছুটা নিচে নামতেই কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়ে গেল। এখন শুধু বলার অপেক্ষা।
রুমাইসা রুম থেকে বের হবে এমন সময় মেয়ে উঠে গেল ঘুম থেকে। রুমাইসার ভেতর টা ছটফট করছে কখন বলবে কিন্তু এদিকে ইহিতা কেও ছাড়তে পারছে না। বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়েই বসল ও। মাথায় প্রচন্ড ভাবে ব্যাপার গুলো খেলছিল। রুহি ওর মামাতো বোন। দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দরী কিন্তু সে কি আসলেই এমন করেছে নাকি রুমাইসার ভুল হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে রুমাইসা রাত ৯ টায় ই ঘুমিয়ে গেল।
ঘুমের মাঝে হঠাৎ কানের কাছে রুমাইসা ফিসফিস আওয়াজ শুনছিল। “রুমাইসা, রুমাইসা “। কেউ ওর নাম ধরেই ডাকছিল। ভয়ে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠল। তাকিয়ে দেখল ফ্লোরের উপর হাটু গেড়ে বসে আছে ইহান। রুমাইসা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
ইহান এর মুখ টা একদম গম্ভীর আর বিমর্ষ হয়ে আছে। রুমাইসা সদ্য মাত্র ঘুম ভাঙা, তাই মাথায় কিছু ঢুকছে না কি হচ্ছে। ও একটু দ্বিধা মনে জিজ্ঞেস করল ” কি ব্যাপার! হঠাৎ এভাবে ডাকছেন কেন? ”
ইহান মাটির দিকে চেয়ে বলল “আমায় দুটো থাপ্পড় মারো রুমাইসা। ”
রুমাইসা একটু চেঁচিয়েই বলল ‘মানে কি ইহান!’
‘থাপ্পড় মারো আমাকে তুমি। আমি তোমাকে তখন মেরেছি, এখন তুমিও আমায় মারো। দ্বিগুন হিসাবে মারবে কিন্তু। ‘
রুমাইসা বিষ্মিত হয়ে বলল ‘কি আজেবাজে বকছেন আপনি! মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে রাতের বেলায়! ‘
ইহান বিমর্ষ হয়ে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়ল। রুমাইসা বিছানা থেকে নেমে ওর পাশ যেয়ে বসল। অনেক সময় দুজনের কোন কথা নেই। ইহান রুমাইসার দিকে করুন চোখে চেয়ে বলল “দেও না থাপ্পড় দুটো, আমি তোমাকে দিয়েছি না! ‘
রুমাইসা প্রচন্ড মাত্রায় বিরক্ত হল। একটু রেগেই বলল ” আপনার মাথা গেছে নাকি! এই রাতের বেলা আমার ঘুম টা ভাঙিয়েছেন আপনি এসব আউল ফাউল কথা বলতে! ‘
ইহান বাচ্চাদের মত মুখ টা করে বলল ‘থাপ্পড় মারলে ঘুম ভালো হবে। আর তুমি কেন নিজের উপর অত্যাচার সহ্য করবে? আমি রাগের মাথায় কত কি বলে ফেলছি, এটা আমার উচিত হয় নি।এখন শাস্তি দেও, তবেই শিক্ষা হবে। ‘
রুমাইসা রাগ টা কে দমন করে বলল ‘সেটা সেই তখনি ই যদি দিতাম তবে আপনার শিক্ষা হত। এখন দিলে গায়ে লাগবে না। ‘
ইহান অবাক হয়ে বলল ‘কেন লাগবে না!! ‘
‘অপরাধ কররা পর সাথে সাথে শাস্তি দিলে সেটা সব সময় মনে থাকে। তবে অনেক পড়ে অপরাধী যদি শাস্তি টা নিজেই চায়, তবে সেখানে শিক্ষা হয় না বরং এক রকম, যা করতে বলেছি তাই করেছে, এমন টা ভাবা হয়।’
ইহান আবার বসে রইল মুখ ভার করে। রুমাইসার কাচা ঘুম টা ভাঙায় একটু বিরক্ত লাগছে। তবে থাপ্পড় এর কথা মনে করেও রাগ লাগছে। এরি মাঝে ইহান হুট করে বলে বসল ‘রুমাইসা ডায়েরি টা হয়ত পড়েছ ই। আমি চাই নি আমার অতীত তোমার সামনে এভাবে আসুক। সম্পর্ক টা স্বাভাবিক থাকলে আমি বহু আগেই সব টা বলে দিতাম। আমি এই অতীত টা কে খুব ঘৃণা করি রুমাইসা। তাছাড়া, তুমি জানো কিনা জানি না, গত কয়দিন ধরে আমি ঘুমাই না, খাই না ঠিক মত, সিগারেট এর উপর থাকি। কারন সেদিন আমার অতীত স্বশরীরে আমার কাছে এসে দাড়িয়েছে তার বর্তমান নিয়ে। আমি তাকে ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে আবার আমার অতীত মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে সে নিজেই প্রশ্ন করেছে আমি কি তাকে ভালোবাসি? সহসা জবাব দিতে পারি নি। তবে এই একটা প্রশ্ন দিন কে দিন আমার মন, আমার মস্তিষ্ক কে খেয়ে যাচ্ছে। আমি তো আসলেই কোন দিন কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাই নি। ভাইয়াকে নিচু করতে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। তোমার সবকিছু ই জানতাম আমি অনেক আগে থেকে। ভাই যে অভিনয় করেছে সেটাও জানতাম আমি। ভেবেছিলাম তোমাকে সত্যি টা বলব। কিন্তু কেন যেন তোমার সাথে দেখা হয় নি, বেবি হুওয়ার পর খুঁজে পাই নি। কথায় আছে না, মন থেকে কিছু চাইলে সেটা রব তাকে আমাদের সামনে আনবেই। সেটাই হয়েছে। তোমাকে বিয়ে করার ডিসিশন নিতে অনেক সময় লাগিয়েছি। দিন রাত ভেবেছি কাজ টা কি ঠিক হবে! কিন্তু মনে হল, ভাই কে নিচু দেখানোর পাশাপাশি হয়ত তোমার আর ইহিতার লাইফ টা একটা গতি পাবে। তোমাদের অধিকার পাবে। আর তুমি যে সব জানার পর আমার সাথে কোন সম্পর্কে লিপ্ত হবে না সেটাও জানা ছিল। তাই এতকিছু করেছি। কিন্তু ওইদিন রাতের বিয়েটা সম্পূর্ণ আকষ্মিক ছিল। আমি তোমাকে আরো পড়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতাম অন্য ভাবে, কিন্তু সিচুয়েশন যেন আনার পক্ষেই ছিল বারবার। কিন্তু রুমাইসা তোমার জীবন টা আমরা দুই ভাই মিলে বিষিয়ে তুলেছি।ভাই এখনো তোমাকে ডিস্টার্ব করে। আমি কিছু বলি না কেন জানো? কারন আমি চাই তুমি নিজের জবাব টা নিজেই দিবে। আমার উপর ডিপেন্ড থাকো চাই না।তারপর তোমার মেয়েটাও আমার কারনে…. যাকে অধিকার দিতে লাইফে এনেছিলাম সে কোথায় যেন দূরে চলে গেছে আমার জন্য। তারপর ইমতির দায়িত্ব ঠুকে দিলান আমরা জোর করে। এ বাসায় তোমার জায়গা যে কি আমি এখনো জানি না। তুমি সারাদিন নিজের সবটা দিয়ে দায়িত্ব পালন কর। অথচ তোমার আসল জায়গা টা কোথায় থাকা উচিত ছিল। আমি তবুও বলি না এটা ভেবে যে তুমি প্রতিবাদ করবে। শুনো রুমাইসা, যত সেক্রিফাইজ করবে, তত সবাই তোমার উপর চেপে বসবে,আশা তোমার কাছেই বেশি থাকবে। সেক্রিফাইজ কর, বাট লিমিট রাখো। নিজের জায়গা টা কে কেন দুর্বল অবস্থায় রাখো। বাইরের মানুষ কেন তোমাকে ব্যবহার এর সুযোগ পাবে। আজ আমি একটা থাপ্পড় দিলাম। কাল আমি হয়ত তোমার নিশ্চুপ উত্তর দেখে নিজের মনে সাহস পাব। তোমাকে আরো একবার আঘাত করার সুযোগ পাব। তুমি কেন আমায় সে সুযোগ টা দিবে? প্রতিবাদ সম্পর্ক কে নষ্ট করে না। এট লিস্ট সে জায়গায় নষ্ট হবে না কোন দিন, যেখানে সামনের মানুষ টা আসলে প্রতিবাদ দিয়ে নিজের ভুল টা বুঝে। যে নিজের ভুল মানবে না , সে সামান্য কারনেও সম্পর্ক ভাঙবে আর তার সাথে সম্পর্ক রাখতে নিজের,আত্মসম্মান টা কেও বিসর্জন দিবে তুমি। ”
ইহান এবার থামল। রুমাইসা মনোযোগ দিয়ে সব কিছু শুনছিল। ইহান থেমে যাওয়ায় রুমাইসা বলল “থেমে গেলেন কেন? আরো বলুন না! “,
ইহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ‘দেখ রুমাইসা,যত শুনবে ভালো লাগবে। তবে কারো দেখানো রাস্তা আর শেখানো উপদেশ থেকে ভালো হয় নিজে দেখে শিখো। তোমার উপর যে এত বড় ঝড় গেল, এতকিছু হল, কই তোমার জায়গা টা কি শক্ত হয়েছে? আমার মা তোমার উপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিত হয়েছে। হ্যা সব বাড়ির বউয়ের দায়িত্ব আছে। কিন্তু তাই বলে কি নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে দায়িত্ব পালন! বিয়ের দুই রাত যে ঘরে থাকতে পারো নি, খেয়েছ কিনা, ঘুমিয়েছ কিনা, কেউ কি জিজ্ঞেস করেছে তোমাকে? ”
রুমাইসার দিকে উত্তরের আশায় তাকাল ইহান। রুমাইসা মুখ টা কালো করে বলল ‘নাহ।’
‘তবুও তোমার মুখে একটু ও কথা ফুটে নি আর নিজের অধিকার নিজের আদায় করা সম্ভব হয় নি।রুমাইসা তুমি এ বাড়ির বউ, আর আমার স্ত্রী। তার মানে এখানে আমার যতটুকু অধিকার আছে ঠিক ততটুকু তোমার।নিজের অধিকার আদায় করতে না পারলে আমি তোমার অধিকার তুলে দিতে পারব না।সাহিল বরাবরই স্বার্থপর । তুমি জানো কিনা জানি না, রুহি কে যখন বিয়ে করতে চাই, তখন সাহিল নিজে বাবাকে বুঝালো আমি আবেগে পড়ে এসব করছি। আমাকে এসব থেকে বিরত রাখা উচিত, ভুলেও এসবে যেতে দেওয়া উচিত না। আরো অনেক কিছু। আমাকে যে সময় উঠে দাড়াতে সাহায্য করার কথা সেখানে ও আমার পাশেই ছিল না।”
কথা শেষ করার আগেই রুমাইসা বলল “ভুল কিছু করে নি উনি। ”
ইহান বিষ্মিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল “ভুল করেনি বলতে কি বুঝাতে চাও তুমি? ”
রুমাইসা ঠোঁট কামড়ে বসে রইল। বুঝতে পারছে না বলা টা কি ঠিক হবে। “বলছ না কেন কিছু? ”
“রুহি আপুর হাজবেন্ড কে কখনো দেখেছেন? ”
ইহান মাথা ঝাকিয়ে না বলল। রুমাইসা পুনরায় প্রশ্ন করল “কেন? ”
ইহান অন্যদিকে চেয়ে বলল “নিজের ভালোবাসাত মানুষ টা কার সাথে ভালো আছে সেটা কি আমি দেখতে যাব ফিরে আবার। ”
রুমাইসা ও ইহানের মত সামনের দিকে চেয়ে বলল “সেটাই আপনার বড় ভুল ছিল। ”
ইহান অবাক হয়ে বলল “মানে? ”
“মানে হচ্ছে রুহি আপনাকে ঠকিয়েছে। জাবির আর রবিন একি ব্যক্তি। বিশ্বাস না হলে দাড়ান প্রমান দেখাচ্ছি। ” এই বলে রুমাইসা মোবাইল থেকে রুহির আইডিতে গিয়ে ছবি দেখাল জাবির আর রুহির। ইহান যেন এটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। এর সাথেই হাতে নাতে ধরা পড়েছিল রুহি। আর এর সাথেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে! মানে এটা প্রেমের বিয়ে ছিল, আর ইহান শুধু মাত্র টাইম পাস ছিল! ইহানের পায়ের নিচের মাটি টা যেন সরে গেল। ও যেন দুনিয়াতেই নেই। এত বড় ধোকা দিল রুহি ওকে! যেই রুহির জন্য ও কত কি করেছে সেই রুহি ই কিনা শেষ পর্যন্ত ওর পেছনে এত বড় কাহিনি করল! বুক ফেটে কান্না আসছে ওর। এত বড় বোকা কিভাবে হল ইহান! কেন সেদিন ই সম্পর্ক টা ভেঙে দেয় নি ও!
রুমাইসা চেয়ে রইল ইহানের দিকে। ইহানের মুখের এমন পরিবর্তন ও আগে দেখি নি।ইহান কে ও চিনে অনেকদিন। আজ মনে হয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট টাই পেয়েছে। রুমাইসা কি সত্যি বলে ভুল করল! কি করবে বুঝতে পারছে না ও। আসতে করে ও ইহানের হাত টাকে নিজের হাতের মুঠো তে বন্দি করল। ইহান খুব জোরেই যেন হাতে চাপ দিচ্ছে। ইহান রুমাইসা দুজনেই ব্যথা পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কারো হাত সরিয়ে নিচ্ছে না। ইহানের চোখ দু’টো লাল হয়ে গেল মুহুর্তের মাঝে। সত্যি টা সহ্য করা কতটা কঠিন সেটা রুমাইসা জানে। ভাগ্যের কি খেলা, ইহান ও একি ধোকার স্বীকার প্রিয় মানুষের কাছে। জীবন বড্ড আজব লীলাখেলা। কোন নিয়তির টানে আবার দুজন মানুষ একি সম্পর্কে বাধা পড়ল আবার দুজনেই প্রথম দুজনকে সত্যির মুখোমুখি করাল।
শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২৭
ইহান বহু বছর পরে হলেও সত্যি টা জানার সুযোগ পেয়েছে। কথায় আছে না, সত্যি কোন দিন চেপে থাকে না। ঠিক সেটা রুহির বেলায় ও হল। ওর সত্যিটা অবশেষ এ ইহান জানতে পারল। রুমাইসা ভেবেছিল ইহান অনেক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ইহান নিজে থেকেই বলল, ‘রুমাইসা যদি আমি এখনো ও কে পাগলের মত ভালোবাসতাম তবে হয়ত ভেঙে পড়তাম, ঠিক তখনের মত যখন ও ধরা পড়েছিল। কিন্তু না, ওর জন্য আমার অনুভূতি টা মিশে গিয়েছিল অনেকটাই। তাই আজ ওর সত্যিটা জানার পর বুকের উপর থেকে একটা বড় বোঝা নেমে গেল।’
রুমাইসা কৌতুহল চোখে প্রশ্ন করল ‘বোঝা! কিসের বোঝা? ‘
‘রুহি এসে আমাকে সেদিন মনে করিয়ে গেছে, আমি একদিন এটাই ভাবতাম ও ছাড়া কাউকে লাইফে জায়গা দিব না। বাট ও সেটা মনে করিয়ে দেওয়ায় ভেতরে বড্ড অনুশোচনা কাজ করছিল।আজ ফাইনালি মুক্তি পেলাম। ‘
রুমাইসা এবার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল ‘লাইফে কি আসলেই জায়গা দিয়েছেন! ‘
ইহান প্রশ্ন শুনে একদম লজ্জা পেয়ে গেল সাথে খানিকটা দ্বিধায়।প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল ‘চল খাবে, তুমি খাও নি কিছু। ‘
রুমাইসা মিটিমিটি হাসতে লাগল অন্যদিকে চেয়ে। ইহান ওর দিকে তাকাতেই লজ্জার আড়ষ্টভাব কাটিয়ে বলল ‘কি ব্যাপার , হাসছো কেন! ‘
‘কিছু না চলেন খেয়ে আসি। ক্ষুধা লেগেছে। ‘
ইহান ভাবলো থাক এটা নিয়ে আর কথা না আগানোই ভালো। পরে আবার কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে।
রান্নাঘরে যেয়ে রুমাইসা হাসতে হাসতে শেষ । পুরুষ মানুষ বুঝি এত লজ্জা পায় মনের কথা বলতে, ইহান কে না দেখলে জানত ই না। তবে ওর খুব ভালো লাগছে। জীবনে অনেক কিছু হারিয়েই ইহানের মত মানুষ টা কে সাথে পেয়েছে। স্বামী না হোক একজন বন্ধু হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে ওর পাশে। ইহান এতগুলো সময় প্রতিটা পদে পদে ও কে জীবনের শিক্ষা গুলো দিয়েছে। বকা দিয়ে হলেও প্রতিটা কথার মর্মার্থ বুঝিয়েছে। লোকটা যেন জাদু ই জানে। কথা বলার সময় কেমন যেন সম্মোহিত করে নিজের কাছে।
দিন যত যাচ্ছে ইহান আর রুমাইসার সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। প্রতিটা সময় দুজন দুজনকে বন্ধুর মত সাহায্য করে যাচ্ছে। সময় গুলো বেশ কাটছিল দুজনের। প্রতিদিন ই অফিস থেকে এসে ইমতি, রুমাইসা আর ইহান এর ভালোই সময় কাটত। ইহিতার কমতি আসতে আসতে ইমতি ই পূরণ করে দিচ্ছিল। হুট করে একদিন খবর হল বায়ারদের থেকে কন্টাক্ট নিতে ইহান কে ৪ দিনের জন্য থাইল্যান্ড যেতে হবে। সাহিল ভুলেও যাবে না, ওর কাজে মন নেই। নিজের মত মদ খেয়ে পড়ে থাকে ঘরে। কেউ ধার কাছেও যায় না ওর। বাধ্য হয়ে ইহান কেই যেতে হবে। রুমাইসার মন টা খারাপ হয়ে গেল এটা শুনে। ব্যাগ গুছাতে গুছাতে রুমাইসা মুখ ভার করে রইল। ইহান বিছানায় বসে রুমাইসার দিকে চেয়ে আছে। এমন অনুভূতি আজ প্রথমবার এর মত চোখে দেখছে। ভালোই লাগছে আবার খারাপ ও লাগছে। সম্পূর্ণ এক মিশ্র অনুভূতি । কেউ ওর জন্য এখন কেয়ার করে হয়ত। ওর থাকা না থাকায় বুঝি কারো যায় আসে। ইহান ইমতির সাথে সাথে খেলতে খেলতে বলল “পাপা তোমার রুমু আম্মু কে বল, মুখ কালো করলে ভূতের মত লাগে দেখতে। ”
রুমাইসা বিন্দুমাত্র কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না এই কথায়। ইহান আবার বলল, “সুযোগ পেলে হয়ত বউ বাচ্চা সাথেই নিতাম। কিন্তু কি আর করা, বউ না করেছে ভোটার আইডি না পাসপোর্ট ।একদম অকর্মার ঢেকি আমার বউ।”
রুমাইসা নাক ফুলাচ্ছে শুধু এসব শুনে। ইহান একে তো দূরে যাচ্ছে তার উপর আবার খোচা দিচ্ছে। খুব জোরে জোরে জিনিসপত্র ব্যাগে রাখছে আর রাগ ঝাড়ছে। ইহান ইমতি কে উদ্দেশ্য করে বলছে, “আজ যেভাবে জিনিসপত্র রাখছে, সেখানে যেয়ে একটা জিনিস আস্ত পাব নাকি কে জানে। ভাগ্য ভালো এমন রাগ আমার উপর উঠায় নি। তাহলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম।”
রুমাইসা এবার ইহানের সামনে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়ালো। ইহান ইমতি কে কোল থেকে নামিয়ে শুইয়ে দিল। এবার বিছানা ছেড়ে যেই রুমাইসার সামনে দাড়ালো, রুমাইসা কলার ধরে বলল ‘সমস্যা কি আপনার হ্যা? একে তো চলে যাচ্ছেন আবার খোচা দিচ্ছেন একের পর এক?”
ইহান কপালে ভাজ ফেলে বলল, ” বাবাহ ভয় পেয়েছি রে। ছেড়ে দেন খালাম্মা। আমার ভুল হয়েছে, নেক্সট টাইম আপনাকে খোচা দিব না। এই যে আপনার এক কান আর আমার এক কান ধরলাম। ”
রুমাইসা আরো ক্ষেপে গেল। ইহান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। মন টা আজ অনেক খারাপ। ইহান ওর অনেক দিনের অভ্যাস। হুট করে চলে যাবে কয়দিনের জন্য একদম ওর ভালো লাগছে না। মন টা খারাপ করে হাসনাহেনা গাছের কলি গুলো দেখছিল। আচমকা ইহান পেছন থেকে রুমাইসা কে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। রুমাইসার সারা গায়ে যেন কাটা দিতে লাগল। হাত টা পেটের কাছে নিতেই রুমাইসা সরিয়ে দিতে চাইল হাত দুটো। কিন্তু ইহান জোর করে ওর হাতের উপর নিজের হাত রেখে দিল। রুমাইসা অভিমানে চুপ করে রইল। কেন এত অভিমান হচ্ছে তাও জানে না। তবুও বারবার ভাবছে, কিন্তু মনে হচ্ছে এই অভিমান টাই স্বাভাবিক।
‘রাগ করে আছো আমার উপর অনেক? ‘
রুমাইসা শব্দ করল না। চুপচাপ ঠায় দাড়িয়ে রইল। পায়ের নখ ফ্লোরে ঘষছিল বারবার। ইহান একটা পা দিয়ে রুমাইসার পা ঘষায় বাধা দিল। রুমাইসা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে চাইল।ইহান হুট করে কপালে আলতো করে চুমু একে দিল রুমাইসার। রুমাইসা যেন প্রচন্ড মাত্রায় শকড হয়ে গেল। এতদিনে এমন কোন ব্যবহার ইহান দেখায় নি। আজ কি তবে ওর পক্ষ থেকে দেওয়া অধিকার এর জোরে এমন কিছু করল। কিন্তু খারাপ তো লাগছে না, স্বামী হিসাবে ইহান তো বেশি কিছু করে নি এখনো। তবুও কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ওর। ইহান কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেকে বন্ধন মুক্ত করল রুমাইসা। ইহান এর মাথা নিচু হয়ে গেল লজ্জায়। ও আসলেই অধিকার টা বেশি রকম দেখিয়ে ফেলেছে। অথচ রুমাইসা ও কে এখনো গায়ে হাত দেওয়ার অনুমতি দেয় নি। তবুও ও বারবার জড়িয়ে ধরেছে। সেই জন্য ই সাহস করে একটু আদর করতে চেয়েছিল। তাতেই হয়ত রুমাইসা খারাপ ভাবল। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে ইহানের।
ছোট্ট করে একটা সরি বলে ইহান তাড়াতাড়ি রুম থেকে চলে গেল।রুমাইসা ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কি হয়ে গেল নিজেও জানে না। ইহান আর ওর সম্পর্ক টা কে স্বাভাবিক করতে চাইলেও রুমাইসা পারছে না। ইহানের কাছে গেলে বড্ড অস্বস্তি হয়। তাছাড়া একটু আগের ঘটনাটায় রুমাইসার মনে হলে ও বারংবার ইহান কে নিজের সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ দিয়েছে, তাই কাছে এসেছে এত। কিন্তু তাতে ক্ষতি কি! এই কথাটাও মনের মাঝে উকি মারল রুমাইসার।
ইহান আর দুই ঘন্টা পর ই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রুমাইসার কেন যেন খারাপ লাগছিল বারবার । কিন্তু কিছু করার ছিল না ওর। ইহান ও কে যাওয়ার সময় কেবল আসছি বলে চলে গেছে। বারান্দা থেকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল রুমাইসা গাড়ির দিকে, যতক্ষন না সেটা মিলিয়ে যায় দূরে। যত দূরে যাচ্ছিক গাড়িটা রুমাইসার ভেতর টা তত ই মোচড় দিচ্ছিল। মনে হচ্ছে প্রিয় জিনিসটা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। মেয়ের কান্নায় ভেতরে ফিরে আসল।
একটা দিন যেন তেন ভাবে রুমাইসার কেটে গেল। ইহানের দিকে থেকে কোন ফোন আসে নি।বাবাকে জিজ্ঞেস করে রুমাইসা জানল ইহান অনেক সময় আগেই পৌঁছে গেছে। রুমাইসার ভেতরটা স্বস্তি পেল সাথে তীব্র খারাপ লাগা ভর করল। ওকে কি একবারো বলার প্রয়োজন মনে করল না। উত্তর টা মনের গভীর থেকে ই ফিরে আসল। অধিকার টা ও ই নিয়ে নিয়েছে।
রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে খুব মিস করছিল ইহান কে। ইমতি আর রুমাইসা শুয়ে আছে অথচ তবুও খালি খালি সবকিছু। একটা দীর্ঘশ্বাস আর চাপা কান্না বুকের ভেতর থেকে বের হল।
সকাল বেলা রুমাইসার ঘুম ভাঙল চেচামেচি তে। রুমাইসা চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল সকাল ১০ টার বেশি বাজে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাইরে বের হল। বের হতেই রান্নাঘর থেকে শ্বাশুড়ির গলা শুনল। গত কয়েক মাসে এমন গলা শুনে নি ও। রান্নাঘরের কাছে যেতেই শুনল, “বাড়ির বউ তো ঘুমাবেই। জামাই নাই এখন কাজ ও নাই তাই ঘুমাবে। তুই কি বসে থাকবি। তোকে কি আমি মাসে এমনে এমনেই টাকা দেই নাকি হ্যা। সকালে উঠে কাজ করবি তা না, খেয়ে খেয়ে শরীরে তেল জমেছে তাই না।”
মিলি একটু প্রতিবাদ করে বলল ‘ভাবী তো ডেইলি সব করে আমি বাবুরে রাখি। আজকা আমার শরীর ডা ভালা না। তাই একটু দেরীতে উঠসি আর কি।’
নাসিমা বেগম চেচিয়ে বলল, ‘হ্যা সব ঘুমায় থাক। আমার মেয়েটা আজ কয়দিন শ্বশুর বাড়ি। আমার মেয়ে থাকলে মেয়ে ই সকালে নাশতা বানায় খাওয়াইত। কথায় আছে না, যত ই আপন ভাবো, পর পর ই থাকব। আমার সংসার আমারি দেখতে হইব আর কি।কার আশায় ফালায় রাখুম। জামাই দেখাইতে কাম করত। এখন আবার নবাবজাদী হইসে।আমার আর কি, আমার জিনিস কষ্ট হইলেও দেখতে হবে।’
রুমাইসার প্রচন্ড রাগ উঠে গেল। এর আগে ঠিক এসব৷ বলেই ওর মেয়েকে মারল। আজ আবার নিজের আসল রূপে চলে এসেছে। রাগ দমন করতে না পেরেই রুমাইসা বলল, ‘হ্যা আম্মা কথা সত্যি বলেছেন, পর পর ই হয়, আপন আর হয় না। আবার কিছু মানুষ অভিনয় করে নিজের পাপ ঢাকতে বসে ঠিক ই, কিন্তু সময় মত আসল রূপ দেখিয়ে দেয়।’
নাসিমা বেগম এটা শুনে হতবাক হয়ে গেল। রুমাইসার মুখে এসব কথা শুনে ওনার কান কে বিশ্বাস ই করতে পারছে না একদম।রাগ টা ওনার মাথায় চড়ে গেল। রুমাইসা ভেতরে ঢুকে মিলির কাছে মেয়েকে দিয়ে বলল, ‘ও কে নিয়ে বাইরে নিয়ে যান।আবার কোন রাগে মেয়েকে চুলায় ফেলে দিবে কে জানে।একটা হারিয়েছি, এটাও যাবে।’
মিলি ইমতি কে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেল। নাসিমা বেগম চেচিয়ে বলল, ‘তুমি আমায় খোটা দিচ্ছ? ‘
‘আম্মা আপনাকে খোটা কেন দিব। আপনি যা বললেন সেই কথাই আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম।’
‘মানে? ‘ নাসিমা বেগমের কন্ঠে কৌতুহল।
‘আমি একদিন লেট করেছি আর মিলিও করেছে তাতেই আপনার মাথা খারাপ।কথা তো কম শুনালেন না।আমার জামাই জানে আমি কেমন। অভিনয় জিনিস টা আমার মাঝে নেই আমার স্বামী জানে। তবে আপনার ছেলে আমাকে বারবার বলেছিল, আমার মা কে আমি চিনি। এইসব ভং কেবল দুই দিনের, তারপর আসল রুপ দেখবা।আমি শুনি নি। ভেবেছি রাগে এমন করছে। কথা কিন্তু ভুল বলে নি সে। আজ লেট করলাম আর তাতেই আপনি আমাকে যাচ্ছেতাই শুনাচ্ছেন। কই ইহান থাকতে দেরী হলে তো শুনাতেন না। ‘
নাসিমা বেগম কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে রইল। রুমাইসা আবার বলল, ‘আম্মা আপনি আমাকে মেয়ে ভাবেন কিনা আমি জানি না। বাট আমি আপনাকে মায়ের মত ই দেখি। আই ফেরেশতা না। ভুল আমারো হয়। তাই বলে এসব বলবেন কেন।যেমন চলছিল তা কি খারাপ চলছিল? আমি আপনার সংসারের দায়িত্ব চাই নি, বরং আপনি দিয়েছেন। নিতে চাইলে আমি ঘর থেকে চাবি এনে দেই। ‘
নাসিমা বেগম উত্তর দেওয়ার আগেই বাইরে থেকে চেচামেচির আওয়াজ আসল। রুমাইসা শ্বাশুড়ির দিকে চাইলো আর শ্বাশুড়ি রুমাইসার দিকে। দুজনেই দ্রুত হেটে বাইরে যেয়ে দেখল সাহিল মদের বোতল থেকে মদ ইমতির গায়ে ঢালছে। ইমতি কান্না করছে অনেক। মিলি কে এক চড় মেরে, ধাক্কা দিয়ে সাহিল ফেলে দিয়েছে। আর বাচ্চা টা কে নিজের কোলে নিয়ে নিয়েছে।
সাহিল চেচিয়ে ইমতিকে বলল, ‘তোর কারনে সব গেছে আমার। তোকে মেরে ফেলব। ‘
রুমাইসা আর নাসিমা বেগম বাধা দিতে আসল। অভি রুমাইসার দিকে চেয়ে খুব বাজে ভাষায় গালি দিয়ে বলল, “এটাকে মারলে আজকে তোকে নিয়ে রুমে যাব। ইহান টা গিয়েছে সাথে এটাকে ও পাঠাবো আমি। তারপর তুই সারাদিন সুখ দিবি আমাকে। ‘
নাসিমা বেগম বারবার বাধা দিচ্ছিল সাহিল কে। সাহিল কথা তো শুনছিল ই না, উল্টা নাসিমা বেগম কে বলল “তুই আমার সব নষ্ট করেছিস।তোকে আগে আগুনে পুড়িয়ে মারব। ‘
নাসিমা বেগম ভয়ে আঁতকে উঠল ছেলের কথা শুনে। রুমাইসা সাহিলের কাছ থেকে মেয়েকে কেড়ে নিতে চাইছে, আর সাহিলা দুই হাত দিয়ে ধরে আছে। সারা বাড়ি ইমতির কান্নার আওয়াজে ভারি হয়ে উঠল। সাহিলের নখের দাগ বসে গেল ইমতির পেটে। রুমাইসা উপায় না পেয়ে রান্নাঘর থেকে ঝাড়ু এনে সাহিল কে মারতে লাগল। সাহিল মার প্রতিহিত করতে যাবে, তখন রুমাইসা চেচিয়ে বলল, ” মিলি ইমতি কে কোলে নেও। আমি দেখছি ও কে।”
মিলি এক সুযোগে ইমতি কে নিয়ে এক রুমে ঢুকে বসে রইল। মেয়েটা এখনো কান্না করছে। সাহিল ঝাড়ু টা টেনে ধরে ফেলে দিল রুমাইসার হাত থেকে। উল্টো রুমাইসার চুলের মুঠি ধরে বলল “খুন তেজ তোর, আজ তোর তেজ ভাঙব।”
নাসিমা বেগমের মুখটা রক্তশূণ্য হয়ে গেল এ কথা শুনে।
(