শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব ২৭

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৭

অনেকগুলো দিন শাম্মীদের বাসায় কাটানোর পর ওরা নিজেদের বাসায় ফিরে যায়। তবে আরাফাতের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে বেলার। ওদের বাসায় বাজারসদাই করে দেওয়া বা প্রয়োজনীয় কাজগুলোও আগ্রহের সাথে করে দেয় আরাফাত। ওর মনটা আসলেই খুব ভালো। একদিন সীমা বেগম ওকে দাওয়াত করেও খাওয়ান। দীর্ঘকাল বিদেশে শাইনির চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে নাইমুদ্দীন সাহেবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

আজকাল দেশে নিজের স্ত্রী-মেয়ের কাছে নাইমুদ্দীন সাহেব ফোন করেন। বেলা কোনোদিন কথা বলে, কোনোদিন বলে না। পরে সীমা বেগমের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে নেয়। শাইনির সঙ্গে প্রথম যেদিন কয়েক সেকেন্ড ওর কথা হয়েছিল, তারপর আর কথাই হয়নি বেলার। সেদিন শাইনি সবেমাত্র থেরাপির ধকল কাটিয়ে উঠেছে, কারোর কথা না মেনে অবুঝের মতো বেলাকে ফোন করে বসে। লুকিয়ে ফোন করলেও তা দেখে ফেলে সেখানকার একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার। অতঃপর শাইনির কাছ থেকে ফোনটা তিনি কেড়ে নেন। এই খবরটা নাইমুদ্দীন সাহেব নিজে থেকে ফোন করে জানান বাসায়। সেদিন বেলার সাথে দীর্ঘক্ষণ তিনি কথা বলেন। নিজের ভুলগুলো স্বীকারও করেন। আসলে নাজনীন বেগম যে শাইনির গর্ভধারিণী মা নয় সেটা তিনি জানতেন না। নাজনীন বেগম শাইনির নামে অনেক বাজে কথা বানিয়ে বানিয়ে বলেন নাইমুদ্দীনকে। যার ফলে রাগতে বাধ্য হন শাইনির ওপর। কোনো মা তো আর এমনি এমনিই তাঁর ছেলের সম্বন্ধে মন্দ কথা বলবেন না! এসবকিছু ভেবেই বেলাকে শাইনির কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিলেন নাইমুদ্দীন। এতটুকু কথাই বেলাকে জানান নাইমুদ্দীন।

আর নাজনীন বেগমের ঘটনা শোনার পর বেলার মনে হলো, ওর মনের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে গেল। যাক, বাবা অন্তত সত্যিটা জানে। এবার সে নিশ্চিত। পুরো ঘটনাটা সীমা বেগমকে জানান নাইমুদ্দীন। পরে বেলা ওর মায়ের কাছ থেকে ঘটনাটি শোনে। ঘটনাটা ছিলো এরকম, বেলা সেদিন হাসপাতালে অজ্ঞান হওয়ার পর আলম সাহেব খুব ঘাবড়ে গেলেন। একদিকে ছেলের কন্ডিশন ভালো না, অন্যদিকে বেলার অসুস্থতা। সেই কঠিন সময়টাতে পাশে থাকার মতো কেউ ছিলো না ওনার৷ নাজনীন বেগম জিদের চোটে বেলার মুখদর্শনও কর‍তে চাননি। সেই রাতে আলম সাহেবকে দোটানায় ফেলে তিনি নিজের ভাইয়ের বাসায় ফিরে যান। একা একা আলম সাহেব খুব ভেঙ্গে পড়েন। বেলাকে এডমিট করা হয় হাসপাতালে। তখন আলম সাহেব সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে ফোন করেন নাইমুদ্দীন সাহেবকে। মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে রাতেরবেলা ছুটে আসেন নাইমুদ্দীন। আলম সাহেব ভরসা পান। বেলার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পর সময় সুযোগ বুঝে ওনি নাইমুদ্দীনের কাছে সবকিছু খুলে বলেন এবং তাঁর ভুল ভাঙান। নাজনীন বেগমের সব সত্যি তিনি বলে দেন। প্রথমে বিশ্বাস কর‍তে না চাইলেও পরবর্তীতে নাজনীন বেগমের কটু এবং উদ্ভট ব্যবহার দেখে নাইমুদ্দীন যা বোঝার বুঝে নেন৷ নাজনীন বেগমের সন্দেহজনক আচরণ তাঁকে সব সত্য বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে।

বেলার সেদিন বাবার প্রতি বড্ড অভিমান জমলেও, পরে বুঝতে পারে আসলে নাজনীন বেগম যেভাবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তার বিপরীতে ওনাকে খারাপ মানুষ ভাবাটা খুব কঠিন। অতি সহজেই তিনি তার ভালোমানুষি ব্যবহার দিয়ে অন্যকে নিজের অধীন করে নিতে পারেন। নাইমুদ্দীন সাহেবের ভুল হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আলম সাহেব নাজনীন বেগমের নামে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেন। বিনিময়ে তিনি শীলাকে নিজের কাছে রেখে দেন। অর্থলোভী মায়ের কাছে শীলাও থাকতে রাজি হয়নি। ওর মা যে শাইনির আসল মা নয়, এটা জানতে পেরে শীলা খুব কষ্ট পেয়েছিল। টাকাপয়সা, সম্পত্তি দিয়ে ও কী করবে? বাবা তো দিচ্ছিলোই সবকিছু। তবুও মায়ের এমন ছোটলোকি আচরণ ওর ষোড়শী মনটা মেনে নিতে চাইলো না। এজন্যই নাজনীন সবসময় শাইনির নামে খারাপ খারাপ কথা বলতো, ওকে তেমন মিশতে দিতে চাইতো না। নিজের মায়ের প্রতি শীলার বড্ড ক্ষোভ জন্মে। সেজন্য মায়ের কাছ থেকে সে বেলাদের বাসায় চলে আসে এবং এখানেই থাকে, যেহেতু আলম সাহেব দেশে নেই।
নাজনীন বেগম সম্পত্তি পেয়ে খুশি হলেও শীলার এহেন আচরণে স্তব্ধ হয়ে যান। যে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি এসব করলেন, সে-ই আজ ওনাকে একা রেখে চলে গেলো? ওর জন্যই সবার কাছে খারাপ হলো আর ও নিজে মাকে এতটা ঘৃণা করে? তাহলে এত টাকাপয়সা দিয়ে এখন কী করবেন ওনি? ভাইয়ের বাসায় থেকে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। এখন ফিরে যাওয়ারও আর উপায় নেই৷ কারণ আলম সাহেব স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ওনার বাড়িতে এই মহিলার আর কোনো স্থান নেই৷ বাকিটা যা করার দেশে এসে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।

বাবার সাথে সম্পর্কের সবকিছু মিটমাট হয়ে গেলে, আগের মতোই বাবার সাথে সহজ-স্বাভাবিক হয়ে পড়ে বেলা। আলম সাহেবও ফোন করে বেলার খোঁজখবর নিতো৷ শাইনির অবস্থা তখন একটু ভালোর দিকে। কিন্তু দুজনের কথা হতো না। বেলা তৃষ্ণার্ত কাকের মতো অনুরোধ করতো আলম সাহেবকে, শাইনি যেন ওর সাথে কথা বলে। কিন্তু শাইনি ইচ্ছাকৃতভাবে বেলার সাথে কথা বলতো না। দিনদিন এটা কমতে কমতে এমন একটা পর্যায়ে এলো যে, শাইনি ওর সাথে আর কথাই বলতে চায় না। তখন বেলা মনে মনে খুব কষ্ট পায়। এরপর অভিমান করে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে যে, শাইনির সাথে ও কথাই বলবে না। মরে গেলেও না৷ থাকুক নির্দয় লোকটা নিজের মতো। ওর কোনো প্রয়োজন নেই। চাপা অভিমানে বেলা ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরলেও সেটা প্রকাশ করে না সে।

কেটে গেছে আরও কিছু মাস। বছর ঘুরে আরও একটি নতুন বছরে পদার্পণ করেছে। দেশে ফিরেছেন নাইমুদ্দীন। শাইনির থেরাপি নেওয়া শেষ। তবুও কিছু চিকিৎসা বাকি। অনেকগুলো দিন নিজের পরিবার থেকে দূরে ছিলো বলে সবার আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আর শাইনির সাথে রয়ে গেছে আলম সাহেব।
প্রিয় মানুষটি যখন কাছে থাকে না, তখনকার সময়টা যে কতটা কষ্টের সহিত কাটাতে হয় তা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে বেলা। ওর দিন যায়, রাত ফুরুয় কিছুই ভালো লাগে না। সবকিছুতে শূন্যতা অনুভূত হয়।

গ্রীষ্মের এক রুক্ষ বিকেল। কাঠফাটা রোদ্দুরে ঘিরে আছে পুরো শহর। সূর্য তির্যকভাবে রোদ ফেলছিলো শহরের অলিগলিতে। চিকচিক করে এক মুঠো রোদ এসে পড়ছিলো বেলার অগোছালো ঘরের বারান্দায়। দুপুরের খাবার না খেয়ে দরজা বন্ধ করে বেশ কিছুসময় গুম মেরে বসে থাকলো বেলা। নাইমুদ্দীন ফেরার পর আলম সাহেব কয়েকবার ফোন করে ওর খোঁজ নিলেও, শাইনি একটা মুহূর্তের জন্য ওর কাছে ফোন করেনি। না ওর কোনো খোঁজ জানে। সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেলো কেন বেলা বুঝতে পারে না। যে লোকটা নিজের থেকে ওকে এক সেকেন্ডের জন্য দূরে রাখতে চাইতো না, সে এতগুলো মাস ধরে ওর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে। না দিচ্ছে নিজের খোঁজ, না নিচ্ছে বেলার খোঁজ। আচ্ছা, ওখানে কোনো সুন্দরী মেয়েকে দেখে শাইনি আবার ওকে ভুলে যায়নি তো? হতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু বেলা! ওর কথা কি শাইনির একটুও মনে নেই? এত কষ্ট কেন দিচ্ছে ওকে? সবাইকে ওর খোঁজ না দেওয়ার জন্য বলে রেখেছে। এত নির্দয়, পাষাণ কেউ হতে পারে? ওর কি কষ্ট হয় না? এসব ভেবে সারা দুপুর কান্নাকাটি করে কাটিয়েছে বেলা। অপেক্ষা জিনিসটা অনেক নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদায়ক জিনিস৷ আর পারছে না ও সহ্য করতে। ওর মুঠোফোনটা রাখা ছিল বিছানার ওপর। ভাইব্রেশন মুড অন করা অবস্থায় ফোনটা বিছানা কাঁপিয়ে বেজে ওঠলো। বেলা বিরক্ত নয়নে ফোনটা দিকে তাকালো। ইচ্ছা করলো ফোনটাকে দু-টুকরো করার। যে ফোনে শাইনি ফোন করে না সেই ফোন রেখে লাভ কী? স্ক্রিনে না তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘বেলা বউ?’

শাইনির শান্ত গলার প্রশ্ন। বেলা লাফ দিয়ে বিছানায় ওঠে বসলো। এটা সত্যিই শাইনি? কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো ও? দু-চোখ জলে ভিহে ওঠলো। রুক্ষ দুপুরের সোনালি সূর্যকে লুকিয়ে দিয়ে আকাশ শ্রাবণের সাদামেঘেদের নিয়ে উড়ে বেড়াতে লাগলো যেন।
বেলার মনের ভেতর হঠাৎ যেন প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। কি আশ্চর্য, আজকের দুপুরটা এতো সুন্দর কেন? নির্মল হাওয়ায় যেন শত শত রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। ঘোর থেকে বেরিয়ে সে জবাব দেয়, ‘ককেমন আছেন আ আপনি?’

‘কেমন আছে আমার বেলা বউ?’

বেলা অদ্ভুত কন্ঠে বললো, ‘ভালো আছি আমি। আপনি?’

শাইনি মুচকি হেসে বললো, ‘অলওয়েজ ভালো। কী করছো এখন?’

বেলা মিথ্যে বলল, ‘খাওয়াদাওয়া সারলাম। আপনি খেয়েছেন?’

শাইনি বলল, ‘সত্যি?’

বেলা কান্নাভাবটা আটকে বলল, ‘হুম। আমি ভালো আছি আর খেয়েছিও। আমি ঠিক আছি। সব ঠিক আছে।’

‘আমি এতকিছু জিজ্ঞেস করিনি। মন কোথায় থাকে তোমার? এত অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে কেন?’

বেলা অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘অন্যমনস্ক না তো!’

শাইনি কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যিই সব ঠিক আছে?’

বেলা চুপ হয়ে গেলো। এই প্রশ্নের মিথ্যে উত্তর দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আর ও তো প্রতিজ্ঞা করেছিল শাইনির সাথে কথা বলবে না৷ তাহলে বলছে কেন? ভালোবাসার মানুষের ওপর যে রাগ পুষে রাখা যায় না মুহূর্তেই বুঝে গেলো সেটা। বেলা উদাস কন্ঠে বলতে নেয়, ‘আ আসলে…মন…’

শাইনি ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘তাঁর উদাস কন্ঠটা বলে দেয়, সে দূরে থাকলেও তাঁর মন পড়ে আছে ওই একটি বেপরোয়া লোকের কাছে, যে মৃত্যুর আগেও ছাড়তে চায়না তাঁকে।’

বড্ড অগোছালো পর্ব। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন ভালো হয়নি। তাড়াহুড়ো করে লিখেই দিয়ে দিলাম। ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here