সখি ভালোবাসা কারে কয় পর্ব -০৫

#গল্প
#সখি ভালোবাসা কারে কয়?
পর্ব—-৫
কানিজ ফাতেমা

রাত দুইটা বাজে এবং আমি শুভ ভাইয়ের বৌ নামক সং সেজে আমার ঘরের বিছানাতে বসে আছি। মনের মধ্যে অসহ্য রাগ আর অসহায়তার চাপা ক্ষোভ আগুন হয়ে জ্বলছে শুভ ভাইয়ের নাম নিয়ে । শুধু শুভ ভাই কেনো আমার মা-বাবা, নির্ঝর ভাইয়া সবাই অপরাধী আমার চোখে। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে এই বিয়ে করতে বাধ্য করেছে তারা। কিন্তু কেনো ?
আমি কি এতোটাই বোঝা ছিলাম বাবা-মার কাছে? আর শুভ ভাই সে কেনো এটা করলো আমার সাথে ভেবে রাগে জ্বলে যাচ্ছে আমার আত্মা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি কোনোদিন এই বিয়ে মানবো না। আগামী মাসে কোনো ভাবে ভার্সিটির হলে উঠে পড়তে পারলে দরকার হলে সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের মত জীবন কাটাবো।

খাটের উপর বসেই সামনের আয়নায় চোখ পড়লো আমার। নিজেকে দেখে খুব বিরক্ত লাগলো। আম্মু যখন বড়খালুর এনে দেওয়া শাড়ি-গহনা মীরা আপুর হাতে দিয়ে আমাকে সাজিয়ে দিতে বলল আমি দৌড়ে আম্মুর কাছে গিয়ে অসহায়ের মত বললাম- আম্মু তুমি তো জানো আমার লেখাপড়া শেষ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন। তাহলে তুমি কেনে বাবাকে বললে না নিধি এখন বিয়ে করতে চায় না।
আম্মু আমার কান্না দেখে মন খারাপ করে বলল – শোন মা তোর স্বপ্নের কথা ভেবেই আমি শুভর সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছি। দেখ নিধি একদিন না একদিন তোর বিয়ে তো দিতেই হতো আমাদের । তখন হয়তো একজন অজানা মানুষের হাতে তুলে দিতাম তোকে। সে কেমন হতো কে জানতো।
কিন্তু শুভ সে আমাদের নিজেদের ছেলে, তোর স্বপ্ন তোর পছন্দ অপছন্দ সব জানে। সবচেয়ে বড় কথা তোর বড় খালু নিজে খুশি মনে তোর আর শুভর বিয়ের কথা বলেছেন। তাকে মুখের উপর না করার মত সামর্থ্য আমাদের নেই মা।

তাছাড়া তুই ঢাকা শহরে নিজের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতে পারবি। বাবার সহায় সম্পত্তি থেকে শুরু করে শুভর শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো দিক দিয়ে কমতি আছে বলতো?
এর চেয়ে ভালো সম্বন্ধ আমরা কোথায় পেতাম একবার ভেবে দেখেছিস?
কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতেই চাই না আম্মু কেন বুঝতে চাচ্ছো না তোমরা?
চুপ পাগল মেয়ে, বিয়ের সব কিছু ঠিক ঠাক। কাজিসাহেবও একটু পরেই চলে আসবে। মনের ভুলেও কারো সামনে এসব কথা বলিস না মা। মীরা ওকে একটু বোঝাও। শুভর কানে এসব কথা গেলে কী ভাববে বলোতো ?

আম্মু আরও কি যেন বলতে চাইলো এমন সময় বড়খালা আমার ঘরে এসে আম্মু ও আমাকে মন খারাপ করতে দেখে হাসিমুখে বললেন -কি নাজমা মেয়েকে কি পথে ফেলে দিচ্ছো যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে তোমার ? তোমার বড় আপা-দুলাভাই কি এতোই খারাপ? নিজের বড় আপার উপর এতোটুকু ভরসা নেই তোমার? বলে হেসে আমার কাছে এসে বলল তোকে তো আমি নিজের মেয়েই মনে করতাম আজ থেকে পাকা পোক্ত ভাবে নিয়ে নিলাম।
বড়খালার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কেঁদে ফেলতেই আম্মুও কেঁদে ফেললো। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল -আমার নিধিকে আজ তেমায় দিয়ে দিলাম বড়আপা।

এই নাজমা কি সব বলে মন খারাপ করছো বলোতো? আর নিধি তুইও হয়েছিস একদম তোর মার মত। আজকালকার মেয়েরা বিয়ের দিন কি কাঁদে? চলোতো নাজমা তুমি আমার সাথে বাইরে চল আর মীরা নিধিকে শাড়ি পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দাও। আর শোন নিধি হুট করে বিয়ে হচ্ছে বলে তেমন কিছু দিতে পারলাম না রে মা, তাই বলে একদম মন খারাপ করবি না॥
সামনে অনুষ্ঠানের সময় তুই আর আমি একসাথে শপিং করবো ঠিক আছে -বলে আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে বড়খালা আম্মুকে সাথে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আর কারো সাথে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হলো না আমার তাই চুপ চাপ মীরা আপুর কথা মত কাপড় পরে বৌ সেজে বসে রইলাম। সবাই মিলে কাজি সাহেবকে নিয়ে আসলেন । রেজিস্ট্রি করে শুভর সাথে আমার বিয়ে পড়িয়ে দিল। তারপর থেকে এতক্ষণে একবারের জন্যও কারো কোনো কথার উত্তর দেইনি আমি। সবকিছু দুঃস্বপ্নের মত লাগছে আমার কাছে।

দেখতে দেখতে রাত তিনটা বাজলো। শুভ বর সেজে আমার ঘরে ঢুকলে তাকে দেখেই মনে হলো জামার কলারটা ধরে জিজ্ঞেস করি সব জেনে শুনে আমার সাঙ্গে এটা কেনো করলো শুভ? কিন্তু মনের ভেতরের রাগটা মুখে প্রকাশ করতে না পেরে ভেতরে ভেতরে ফুসে উঠছি আমি। শুভ কিছুটা অপ্রস্তুত চেহারা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো কিচুক্ষণ। একবারের জন্যও শুভর দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না আমার। কিছু সময় দঁড়িয়ে থাকার পর খুব শান্তভাবে বলে উঠলো- খুব রাগ হচ্ছে তাই না নিধি?
আমি জানি নিধি তুমি ভীষণ রেগে আছো আমার উপর। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। নির্ঝর ভাইয়া এমন ভাবে বাবা আর খালুর সামনে চিঠিটা এনে ধরলো তখন সবার প্রশ্নের উত্তরে কী বলতাম?

শুভর কথাগুলো কানে আসতেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। প্রচন্ড রাগে দুচোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। প্রচন্ড রাগ নিয়ে শুভর দিকে তাকাতেই সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-
যখন খালু রেগে গিয়ে খালাকে বললেন -তোমার মেয়ে ঢাকা যাওয়ার আগেই এতো কিছু করে ফেলেছে, ঢাকা গেলে তো আমার মান সম্মান কিছুই রাখবে না। আর মা হয়ে কোনো খবর রাখো না?
আমার বাবাও রেগে আমাকে কথা শোনালেন।

এদিকে যখন খালু তোমাকে আর ঢাকা পাঠাবেন না বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন তখন আমার মাথায় কিছু আসছিল না বলে সবার সামনে বলেছি তোমার কোনো দোষ নেই সব আমার দোষ। তোমাকে খুব পছন্দ করি, বিয়ে করতে চাই। কথাটা বলে বাইরে চলে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার কথায় সবাই এভাবে বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে আমিও সেটা বুঝতে পারিনি। এদিকে বড় ভাইয়া ও ভাবীও যেহেতু এখানেই ছিলেন তারাই নাকি বাবাকে বলেছেন যে আজই বিয়ে পড়িয়ে রাখতে। তাই বাবা-মাও রাজি হয়ে গেছেন। এখানে আমার কি করার ছিল বলো?

এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না, রাগে রাগে বলে উঠলাম বাহ্ খুব ভালো করেছেন। আমাকে উদ্ধার করে ফেলেছেন।
নিধি তুমি কি সব সত্যিটা শোনার পরও আমার উপর রাগ করে থাকবে?
আপনি কি আশা করেন শুভ ভাইয়া?
আর আপনার মিথ্যা কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল?
আমি যেভাবেই হোক বাবাকে আমার ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করিয়ে নিতাম। কিন্তু এখন ? এখন কি করবো আমি ? আমি এভাবে আমার জীবনটাকে দেখতে চাইনি।

শুভ অসহায়ের মত বলল – আমরা দুজনে চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কি ঠিক হয়ে যাবে শুভ ভাইয়া? কোনো কিছুই আর আগের মত হবে না। কথাটা বলেই রাগে রাগে শুভ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম- আপনি এখান থেকে চলে যান শুভ ভাইয়া। আমার আপনাকে সহ্য হচ্ছে না। যতটা শক্ত হয়ে কথাগুলো বলে চলেছি মনের মধ্য তার চেয়ে জোরে ঝড় বইছে। তবুও আবারও শুভকে বলে উঠলাম আপনি যাবেন নাকি আমি এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবো?

শুভ আমার সামনে থেকে চলে গেলো।
ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় শুভর চোখদুটি ছলছল করে উঠলো। সেটা দেখেও আমার মনে বিন্দুমাত্র মায়া আসলো না তার জন্য। শুভ আমার সামনে এখন একটা অপরাধী ছাড়া কেউ না। যে সবাইকে ঠকিয়েছে, যে এক অচেনা অজানা মানুষের ভালোবাসার অনুভূতিতে নিজের নাম বসিয়ে আমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছে- যেটা আমি কোনো দিন হতে দেবো না। এতোদিন সেই চিঠি পাঠানো মানুষটা সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিল না কিন্তু এবার আমি যেভাবেই হোক সেই মানুষটাকে খুঁজে বের করবো আর শুভকে তার মিথ্যার শাস্তি দিব- কথাটা ভেবেই নিজেই নিজের চোখ দুটি মুছে মাথায় ওড়নাটা খুলে বিছানার উপর ফেলে দিলাম।

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here