সখি ভালোবাসা কারে কয় পর্ব -০৬

#গল্প—-
# সখি ভালোবাসা কারে কয়?
পর্ব——৬
কানিজ ফাতেমা

পরদিন সন্ধ্যায় মিথিলা আপুর বিয়ের রিসেপশনের অনুষ্ঠানে সবাই গেলেও আমি আর শুভ বাসাতেই থেকে গেলাম।বড়চাচী খুব করে অনুরোধ করলো কিন্তু আমি কোনো হ্যাঁ বা না সূচক উত্তর না দেয়াতে অনেকটা অভিমান করেই রওনা করলেন।
এদিকে মীরা আপু আমার ঘরে এসে মজা করে বলে গেলো -নিধি শুভ ভাইয়ের সাথে একান্তে সময় কাটাতে চাস বললেই হয়। আমরা কি বুঝি না ?-বলে হেসে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় শুভর সামনে দাঁড়িয়ে বলল কি নতুন বৌয়ের রাগ কমেছে?
শোনেন শুভ ভাই রাগ না কমলে আমার থেকে পরামর্শ নিয়ে যাবেন ।নিধির রাগ কি করে ভাঙাতে হয় সেটা এ বাড়িতে আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না, ঠিক বলেছি নিধি?

আমাকে চুপচাপ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মীরা আপু কাছে এগিয়ে এসে আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল-শোন নিধি আমাদের শুভ ভাই তোর জন্য সবচেয়ে পারফেক্ট পারসন। এভাবে মন খারাপ করে আছিস কেনো? তোর তো খুশি হওয়ার কথা, না বলতেই সবাই মিলে বিয়ে দেয়ে দিল। আর আমাকে দেখ-অনার্স ফাইনাল দিব এদিকে কারো মুখে আমার বিয়ে নিয়ে কোনো কথা নেই ভাবতে পারিস আমার অবস্থা।
ধুত কাল বিয়ে হয়েছে দুজনার আর এমন ভাব করে আছিস যেনো এক যুগ আগের বিবাহিত জীবনের মান অভিমান চলছে। আর এভাবে থাকিস না তো দুজন গল্প কর নতুন করে সম্পর্কটাকে এনজয় কর- কি ঠিক আছে?

হুম, তুমি এখন যাও মীরা আপু, তোমার তৈরী হতে দেরি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে যাচ্ছি, তোরা থাক আমরা মিথিলা আপুকে নিয়ে আসি। সে ও তো অভিমান করে বসে আছে তোর বিয়ের খবর শুনে। সকালে রাগ দেখিয়ে বলল কি এমন তাড়া ছিল যে এক রাতের মধ্যে বিয়ে দিতে হবে? আর একটা দিন আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলো না সবাই। বিয়ে হতে না হতেই আমাকে পর করে দিলি সবাই। দেখিস আসলে কত কথা শোনাবে -কথাগুলো বলে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে -শুভ অপরাধীর মত দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।

সকাল থেকে এ বাড়িতে হুলুস্থুল ব্যপার চলছিল। শুভকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সকালে নাস্তার টেবিলে শুভকে ডাকা হচ্ছিল বারবার, আমি কোনো উত্তর করি নি কারণ শুভ তো ঘরে নেই।
আম্মু ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো শুভ কোথায় গেছে?
বললাম-জানি না।
জানিস না মানে? কখন বেরিয়েছে ?
বললাম তো জানি না ।
তুই জিজ্ঞেস করিসনি?
না।
কেনো?
তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলে ? তবে এখন কে কেথায় গেলো কি না গেলো তার কৈফিয়ত জানতে চাইছো কেনো?
আমার উত্তর শুনে আম্মু রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
গত রাতে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছিলাম বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে? ভেবে বিরক্তি আরও বাড়লো।

দুপুরে মীরা আপু ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো মিথিলা আপুকে নিতে যাবি না?
না আপু। তোমরা যাও।
আচ্ছা যাবি না ভালো কথা কিন্তু শুভ ভাইকে কি বলেছিস যে সারা রাত আরিচা ঘাটে গিয়ে বসে ছিল। নির্ঝর তো এক রকম গরু খোঁজা করে খুঁজে এনেছে। সারা বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির। শোন আমি যাবার আগে আবার আসবো আর এখন শুভ ভাইকে ঘরে ডেকে আনছি। আমি রেডি হ্য়ে আসতে যতক্ষণ লাগে ততক্ষণে সব রাগ মিটিয়ে ফেলে দুজন যেতে চাইলে তৈরী হয়ে নিবি। বুঝেছিস?
হুম, একরকম না পারতে উত্তর দিলাম মীরা আপুকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মীরা আপু শুভকে সাথে করে ঘরে এনে বিছানায় বসতে বলে বাইরে থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো।

শুভকে বিছানায় বসতে দেখে আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আলমিরার সামনে দাঁড়িয়ে আলমিরার উপর থেকে বাক্সটা নামাতে গিয়ে হাতে পাচ্ছি না দেখে শুভ উঠে এসে নামিয়ে দিতেই রাগ দেখিয়ে বলে উঠলাম -এতো গায়ে পড়ে আমার আর কেনো উপকার করতে আসবেন না প্লিজ।
সরি নিধি বলে শুভ একটু দূরে সরে দাঁড়ালো।
বাক্সটা নিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে থেকে চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে চেয়ারের উপর রাখার সময় শুভর মুখের দিকে চোখ গেলো আমার।ফরসা মুখটা থমথমে হয়ে আছে। মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক ছোট বাচ্চারা কোনো অপরাধ করলে যেভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বাক্সটা খুলে আলমিরা থেকে নিজের সেলোয়ার কামিজগুলো গুছিয়ে নিতে গিয়ে হঠাৎ একটা ছোটো পুরোনো আড়ংয়ের হাতের কাজ করা পার্স হাতে পেয়ে মনের অজান্তেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো।

পার্সের চেইনটা খুলতেই প্রায় আট দশটা চিঠি যেগুলো বিগত দিনগুলোতে কি একটা ভাবনা থেকে গুছিয়ে রাখতে শুরু করেছিলাম। আসলে মনে একরকমের রোমান্টিসিজম কাজ করছিল। একজন মানুষ যাকে চিনিনা জানিনা সে আমায় নিয়ে আমার জন্য চিঠির নামে কয়েক লাইন করে কবিতা লিখে পাঠায়।
মীরা আপু বলতো তোদের মত টিন এজ মেয়েদের এই এক সমস্যা সব কিছুতেই ফ্যান্টাসি খুঁজে পাস।
বোধ হয় সেটাই সত্যি এই চিঠিগুলো আমার মত একটা টিন এজ মেয়ের মনে একটা অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল। সেটা ভালেবাসা ছিল কিনা জানিনা, তবে অভ্যস্থতা তৈরী করে ফেলেছিল আমার জীবনে। সব সময় সেই জায়গা গুলেতে লক্ষ্য রাখতাম কোনো খাম পরে আছে কি না?

বিগত দিনগুলোতে এই কটা খাম সবার অলক্ষ্যে জমিয়ে রেখেছি আমি।বাকিগুলো আম্মুর হাতে পরে চুলায় ছায় হয়েছে। মাঝে মাঝেই সবগুলো খাম খুলে লেখাগুলো পড়ে দেখি। তবে খুব ভয় হতো এই ভেবে কে না কে? তবুও চিঠি আসুক মনে মনে এটাই চাইতে শুরু করেছিলাম।
এতদিন যেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে অস্বীকার করেছি।
এখন যখন মনে হচ্ছে এই অভ্যস্থতা থেকে সবাই আমাকে জোর করে বের করে আনতে চাইছে তখন কেমন জানি বিদ্রহ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জন্য সেই মানুষটা প্রকতিদিন কবিতা লিখুক চিঠি লিখুক আর আমি সারা জীবন তার অপেক্ষাই থাকি। কথাগুলো ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখদুটি ভিজে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।

হঠাৎ শুভ বলে উঠলো চিঠির মানুষটাকে খুঁজে দিলে আমার উপর থেকে রাগ কমবে তেমার?
শুভর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে রাগে রাগে চিঠি গুলে পার্সে পুরে চেইনটা বন্ধ করে বাক্সের এক কোনায় রেখে আবার গোছাতে শুরু করলাম।
সন্ধ্যার সময় সারা বাড়ি ফাঁকা সবাই রিসেপশনের অনুষ্ঠানে। বাসায় শুভ আর আমি ছাড়া শুধুমাত্র আম্মু আর বড়ফুপু রয়ে গেছেন। তাদের বাড়িতে নতুন জামাই সেই কারণে দুজন রান্নাঘরে বেজায় ব্যস্ত। সম্ভবত পিঠা বানাচ্ছে।

আমি লাগেজটা গুছিয়ে বিছিনায় চুপচাপ গিয়ে বসতেই শুভ আবারও বলল- তুমি কি চিঠির মানুষটাকে ভালোবাসো?
শুভর কথার উত্তর না দিয়ে বললাম- একটা উপকার করতে পারবেন কাল ঢাকা যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে হবে
সবাইকে বলে রাজি করাতে পারবেন?
শুভ হেসে বলল তুমি চাইলে অবশ্যই রাজি করাবো।
শুভর খুশি দেখে মনে মনে বললাম- আমি সত্যি এখান থাকে চলে যেতে চাই। গত মাসে ভর্তি হয়ে ভেবেছিলাম ক্লাস শুরু হলে হলে উঠে যাবো। কিন্তু না এবারই আপনাদের সাথে গিয়ে কোনো একটা অযুহাত দেখিয়ে হলে থাকতে শুরু করবো। তারপর যা হবার হবে।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here