সখি ভালোবাসা কারে কয় পর্ব -১২

#গল্প
#সখি ভালোবাসা কারে কয়? পর্ব——-১২
কানিজ ফাতেমা

আমার কথা বলার ধরন দেখে গাড়িতে থাকা সবাই একরকম চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর শোয়েব ভাইয়া পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য হেসে বলল-
“মিথিলা আসলে তুমি এতক্ষণ বক বক করে সবার মাথা ধরিয়ে দিয়েছো। তাই আমার মনে হচ্ছে এখন আমাদের সবার কিছুক্ষণ চুপ থাকা উচিত”- শোয়েব ভাইয়া কথাগুলো বলল ঠিকই কিন্তু মিথিলা আপু একদম চুপ হয়ে রয়েছে।মিথিলা আপুকে কোনো ভাবে আঘাত দিতে চাইনি আমি কিন্তু শুভর উপর রাগ করে মনের অজান্তেই রাগে রাগে কথাগুলো বলে ফেলেছি।

এদিকে শুধু মিথিলা আপু নয়, শুভও একেবারে থমথমে মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে কেমন নিজের কাছে অস্বস্থি লাগছিল তবুও গম্ভীর হয়ে সিটে বসে রইলাম।
বাসায় পৌঁছানো পর্যন্ত গাড়িতে কেউ আর কারো সাথে কোনো কথা বলল না। বাসার সামনে গাড়ি পৌঁছাতেই দেখলাম বড়খালামনি সাবরিনা ভাবী আর সুজয় ভাইয়া নিচে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
এদিকে শুভ গাড়ি থেকে নেমে গিয়েই জোরে করে জামাল ড্রাইভারকে ডেকে বলল- গাড়ি পার্ক করতে। তারপর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
আমরা গাড়ি থেকে নামতেই বড়খালামনি হাসি মুখে কাছে এগিয়ে এসে বলল- “তোমাদের এতো দেরি হলো কেনো?”

“আর বোলেন না খালা, নবীনগরে সেই কখন থেকে জ্যাম পড়ে ছিলাম।জ্যাম ছাড়লে আসার সময় দেখি সামনে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল সেই কারণে জ্যাম বেধেছিল।”- মিথিলা আপু হাসিমুখে কথাগুলে বলতেই সাবরিনা ভাবী বলল-
“ওহো তাহলে তো তামাদের অনেক কষ্টই হয়ে গেল। আমরা নবীনগর পার হয়ে আসার পরই হয়তো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”-সাবরিনা ভাবি কথাটা বলতেই মিথিলা আপু বলল –
“তাই হবে হয়তো ভাবী।”
“যাক বাবা আমরা আরামে বাসায় চলে এসেছি। সবাই গোসল সেরে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।চলো বাসায় চলো আজ বাসায় নতুন মেহমান এসেছে তাই সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খাওয়া হবে”।

আমি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবী আর মিথিলা আপুর কথা শুনছিলাম। এর মধ্য বড়খালামনি বললেন “এখানে আর কথা না বলে চলো আগে বাসায় যাই।”
“জি চলেন আম্মা।” বলে সাবরিনা ভাবী বড়খালামনির দিকে তাকিয়ে বলল – “আম্মা আমাদের নতুন বর কেথায় গেলো? নিধিকে সাথে করে যাবে না? বেকুব একটা!”
“বড়বৌমা বাদ দাও ওর কথা। বিয়ে হয়ে গেলো বুদ্ধি হলো না।”
খালামনি আর সাবরিনা ভাবী শুভকে নিয়ে কথা বলার সময় মিথিলা আপু আমার দিকে তাকালো- যেনো আমিই সব দোষ করেছি।
যাই হোক, বড়খালামনি বলল-“চলো মিথিলা শোয়েব চলো বাবা বাসায় চলো। আমার যে আজ কি ভালো লাগছে! আজ আমার ডাবল খুশির দিন।”- কথাগুলো বলতে বলতে বড়খালামনি আগে আগে বাসার দিকে চলতে লাগলো।

তারপর সাবরিনা ভাবী আমাদেরকে সাথে করে বাসার দিকে এগোতে লাগলো। সবাই একসাথে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠছি। শুধুমাত্র সুজয় ভাইয়া নিচে রয়ে গেলেন গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার আর দারোয়ানকে দিয়ে লাগেজগুলো পাঠিয়ে দিয়ে একটু বাইরে যাবেন বলে। আমাকে সাবরিনা ভাবী নতুন বৌয়ের মত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এ বাড়ির সবকিছুই আমার চেনা। তবুই এবার কেমন যেন নতুন নতুন মনে হচ্ছে।
ক’মাস আগেই ভার্সিটির ভর্তির কোচিং করবো বলে ঢাকায় এসে কদিন এখানেই উঠেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কি হলো কে জানে বাবা আম্মুকে পাঠিয়ে দিল এই বলে যে নিধিকে বাড়ি নিয়ে এসো। বাসাতে পড়াশেনা করেই অ্যাডমিশন টেস্ট দিক। বাড়ির মেয়ে এতোদিন বড়আপাদের বাসায় থাকবে এটা ভালো দেখাবে না।

সেবার বাবার সিদ্ধান্তে খুবই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমার মন খারাপ দেখে শুভ বলেছিল-“ একদম চিন্তা করো না, আমি কোচিং সেন্টারের সব শিট যোগাড় করে তোমাকে পৌঁছে দিব। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে চাইলে চোখ কান বন্ধ করে পড়তে থাকবে, এমনিতেই চান্স হয়ে যাবে । আর আমিতো আছিই যে কোনে কিছু বুঝতে না পারলে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে নিও।”
সেদিন শুভকে ফেরেশতা মনে হয়েছিল। তারপর কারণে অকারণে শুভ মানিকগঞ্জ এসেছে আমাকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। শুভই বলেছিল- “লেখাপড়া শেষ করতেই হবে নিধি । নিজেকে স্বাবলম্বী করার জন্য পড়াশোনা শেষ করাটা খুব জরুরি।”ভার্সিটির ছাত্রজীবন, হলে থাকতে কেমন লাগে সব কিছু বলে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল অথচ আজ সেই শুভই আমার স্বপ্ন ভাঙার কারণ হলো।

তিনতলায় এসেই ড্রয়িংরুমে বড়খালুকে বসে থাকতে দেখলাম।বড়খালু, মিথিলা আপু আর শোয়েব ভাইয়াকে সোফায় এসে বসতে বলল। আর সাবরিনা ভাবী আমাকে সাথে নিয়ে সোজা শুভর ঘরে চলে আসলো। রুমের ভিতরে কেউ নেই দেখে প্রথমে স্বস্তি পেলেও তক্ষুণি শুভকে ওয়াশরুম থেকে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমাকে এভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে সাবরিনা ভাবী হেসে বলল “কি এখনো কি শুভ টিচারগিরি দেখাচ্ছে নিধি? যেভবে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালে!”
“ভাবী কি যে বলো বিয়ের পর স্টুডেন্ট যে টিচারের মাথায় উঠে বসে, সেটা জানলে কখনো বিয়ে করতে রাজি হতাম না।”
শুভর কথাটা শুনে রাগে মাথাটা ঘুরে গেলো । আমাদের বাড়িতে যতক্ষণ ছিল মুখে কোনো কথা ছিল না। আর নিজেদের বাসায় এসেই মুখ দিয়ে খই ফুটছে। খই ফুটুক আর যাই হোক এক দিনের ব্যাপার। তারপর কেউ কারে কথা শুনতে এখানে আসছে না।

শুভ কাপড় পরে রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় সাবরিনা ভাবী বলল- “এখন আবার কোথায় যাচ্ছো?”
“একটু ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করে আসি ভাবী। তোমরা হুট করে বিয়ে দিয়ে দিলে ওরা তো জানলে আমার খবর করে দিবে।”
“ভাগ্য ভালো তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।না হলে এতো মিষ্টি একটা বৌ পেতে কোথায়?”
“হুম ভাবী কি পেয়েছি সেটা আমিই জানি।যার কষ্ট সেই বোঝে।”—কথাটা বলতে গিয়ে কেমন মজা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে যখন হাসলো তখন মনে হলো মুখের উপর বলে দেই
“কে পায়ে ধরে বলেছিল আমাকে বিয়ে করতে।”-আসার পর থেকে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এতো কথা বলছে যে আমার সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু বড়ভাবীর সামনে কিছু না বলে চুপচাপ বিছানাতে বসে সব শুনে হজম করে যাচ্ছি ।

শুভর কথা শুনে বড়ভাবী হেসে বলল- “থাক বাবা তোমার আর নিধির কথার মধ্যে আমি না পড়ি। আমি যাচ্ছি নিধি তুমি ফ্রেশ হও আর কিছু লাগলে আমাকে বলো। কেনো কিছু নিয়ে হেজিটেড করবে না আর শুভর কথা পাত্যা দিও না। ইন্টার্ণ করছে তো চাপে আছে তার উপর হঠাৎ বিয়ে করে হাওয়াই উড়তে ইচ্ছে করছে, তাই কি বলবে না বলবে বুঝতে পারছে না।”
হালকা হেসে সাবরিনা ভাবীর কথায় সায় দিলাম।
ভাবী চলে গেলে শুভও ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বললাম – “শোনেন এখন থেকে কাল হলে যাওয়া পর্যন্ত আমি এই ঘরে একাই থাকবো তাই আপনি আপনার লাগেজ আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অন্য ঘরে চলে যান।”
শুভ আকাশ থেকে পরার মত করে বলল- “মানে কি? এ দেখি খালার বাড়ির আবদার । আমি আমার ঘর ছেড়ে কেথাও যাচ্ছি না। তুমি তোমাদের বাসায় কি আমায় নিজের রুম ছেড়ে দিয়েছিলে?”
“দেইনি তো কি হয়েছে আপনি তে আগে থেকেই নির্ঝর ভাইয়ার রুমে থাকতেন।”
“তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই একজন বিবাহিত ছেলে অন্যের রুমে বেড শেয়ার করতে গেলে সবাই প্রশ্ন করে।”
“প্রশ্ন করলে আপনি জবাব দিবেন।দোষ করেছেন তো জবাব দিবেন না?”- বলে দরজার সামনে রেখে যাওয়া আমার দুটি লাগেজ ভিতরে নিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভকে বাইরে সরতে বললাম।
শুভও বিনা কথায় দুই পা সরে দাঁড়াতেই দম করে শুভর মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here