#সন্ধ্যামালতী (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___________________
সন্ধ্যা আর বকুল হসপিটালে আসে। বাদলকে ইমার্জেন্সিতে রাখা হয়ছে। কোনো ডক্টরই দেখতেছে না। বকুলের মা, বোন কান্না করতেছে। বকুলের বাবা ডক্টরের কাছে ছুটতেছে কিন্তু কেউই কিছু করছে না। বাদলের যা অবস্থা তাতে এই মুহুর্তে রক্ত বন্ধ না হলে যা তা হতে পারে। সন্ধ্যা বকুলের মা’কে কোনোরকম সামলে বাদলের কাছে যায়। একটা বেডে ফেলে রাখছে নিথর শরীর। সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা হাতে বাদলের শরীর স্পর্শ করেই এক ঝটকায় দু পা পিছিয়ে যায়। শরীর শীতল, ঠান্ডা হয়ে আছে। সন্ধ্যা আবার এগোয় বাদলের কাছে। কি মনে করে মাথাটা বাদলের বুকে চেপে ধরে। কান পেতে শোনে হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ হচ্ছে কি না! ঠিক সেসময়ই সেখানে আয়াশ, রানা, আকাশ, তমাল, সাফি, লিজা আর জেরিন আসে। সবাই দেখে বাদলের বুকে সন্ধ্যার মাথা রাখার দৃশ্য। সবাই আয়াশের দিকে তাকায় । আয়াশ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে৷ জেরিন কোনোরকম সন্ধ্যাকে ডাকতেই সন্ধ্যা ঘুরে তাকায়। ছুটে আসে জেরিনের কাছে। বলে,
‘বাদল ভাইয়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। কোনো ডাক্তার হাতও লাগাচ্ছে না। এরকম হলে উনাকে বাঁচানো যাবে না আপু।’
জেরিন সন্ধ্যাকে বলে, ‘তুমি শান্ত হও। আমরা দেখতেছি।’
সন্ধ্যা জেরিনের কথা পাত্তা না দিিয়ে আয়াশের কাছে ছুটে আসে। আয়াশের শার্টের এক কোণা চেপে ধরে। চমকে উঠে আয়াশ। বাকি সবাইও অবাক চোখে তাকায়। সন্ধ্যার খেয়ালই নেই সে কি করছে! কোনো রকম বলে,
‘আপনারাা তো শহুরে ডাক্তার তাই না! বাদল ভাইকে বাঁচিয়ে দিন না শহুরে ডাক্তার।’
আয়াশ সন্ধ্যার উৎকন্ঠা দেখে কিছুক্ষণ। তারপর সন্ধ্যার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘কিছু হবে না তোমার বাদল ভাইয়ের।’
এটুকু বলেই আয়াশ বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা ফের ছুটে আসে বাদলের কাছে। লিজা আর জেরিন সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘এতো পাগলামি করো না। শান্ত হও।’
সন্ধ্যা ভাঙা গলায় বলে, ‘আমার প্রিয় সবগুলো মানুষকে আমি রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেছি। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বাদল ভাই কে আমি ওই অবস্থায় দেখতে পারবো না। বাদল ভাই আমার সব সময় পাশে ছিলো, সব বিপদ থেকে আগলে রাখতো। আমি উনার এই অবস্থা মানতে পারতেছি না।’
লিজা আর জেরিন কিছু না বলে বের হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর অনেকটা তর্কাতর্কি করেই আয়াশ বাদলকে O.T তে নেয়। সন্ধ্যা, বকুল, বকুলের পরিবার সবাই বাহিরে বসে ছিলো পুরোটা সময়। সাহেদাও এসেছে। ২ ঘন্টা পর অপারেশন শেষ হয়। আয়াশ, রানা, আকাশও অপারেশনে ছিলো। তমাল আর জেরিন রক্ত দেয়। সবাই অপারেশন থেকে বের হয়ে আসে। আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। তারপর চলে যায়। রানা হেঁসে সন্ধ্যাকে বলে,
‘সন্ধ্যা চিন্তা করো না। অপারেশন সাক্সেকফুল।’
________________
বাদলকে কেবিনে দিছে কয়েকঘন্টা হলো। সন্ধ্যা কয়েকবার রাউন্ড দিছে হসপিটাল। একবার এখানে তো একবার ওখানে। মূলত কাউকে খুঁজছে! বাদলের সেন্স একবার এসেছিলো কিন্তু মাথায় ব্যাথা হতে পারে ভেবে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়ছে। সন্ধ্যা বকুলকে থাকতে বলে নিজে বের হয়ে আসে। হসপিটাল থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে হঠাৎ করেই কেউ ডেকে উঠে,
‘সন্ধ্যা!’
সন্ধ্যা নিজের নাম শুনে পেছনে তাকায়। পেছনে আয়াশকে দেখে খানিকটা অবাকই হয়। পুরো হসপিটালে যাকে খোঁজা শেষ সে এতক্ষণে কোথা থেকে আসলো? সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই আয়াশ কাছে চলে আসে। সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘বাড়ি যাচ্ছো?’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ বলে, ‘ওকে চলো একসাথে যায়।’
তারপর দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। সন্ধ্যা কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে, ‘আপনি কি কোথাও গেছিলেন?’
‘কেনো বলো তো?’
‘আপনাকে তো হসপিটালে কোথাও দেখলাম না এখন কোথা থেকে আসলেন?’
আয়াশ কেমন ভাবে হাসে। সন্ধ্যা তাকিয়ে থাকে আয়াশের দিকে। হার্ট বিট করছে বারংবার। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এই মানুষটা আশে পাশে থাকলেই তো তার এমন হয়। কিন্তু কেন হয়? আবার এই মানুষটাকে না দেখলেই কেমন অস্থির অস্থির লাগে। কেন হয় তার সাথে এমন? সন্ধ্যার ভাবনার ছেদ পড়ে আয়াশের কথায়। আয়াশ ধীর কন্ঠে বলে,
‘ওদিকে একটা কাজ ছিলো। শেষ করতে গেছিলাম।’
‘ওহ’ বলে সন্ধ্যা চুপ হয়ে যায়। আয়াশ কিছুটা সময় পর জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি বাদল ভাইকে ভালোবাসো?’
চমকে ওঠে সন্ধ্যা। খানিকটা অবাকও হয়। সে বাদল ভাইকে ভালোবাসে মানে? বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আয়াশ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি? বলো!’
‘ভালোবাসা কি বা কাকে বলে আমার জানা নেই শহুরে ডাক্তার। তবে আমি ভালোবাসা মানে এটুকু বুঝি যে এটা এক অন্যরকম অনুভূতি যা বাদল ভাইয়ের ওপর আমার নেই।’
‘তাহলে বিয়ে কেন করছো?’
‘আপনি কেন বিয়ে করছেন?’
এমন প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তি হয় আয়াশের। সন্ধ্যা তাকে উল্টো জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারেনি। সন্ধ্যা আয়াশের উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি আপনার হবু বউকে ভালোবাসেন শহুরে ডাক্তার?’
আয়াশ চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। সে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারে না। সন্ধ্যা মুচকি হেঁসে বলে, ‘কিছু সময় ভালো না বাসলেও বিয়েতে সম্মতি দিতে হয় আর তারওপর আমরা মেয়ে। আমাদের নিজস্ব কোনো মতামত থাকতে নেই। পরিবারের খুশি আমাদের খুশি।’
‘আজ হসপিটালে এতো পাগলামি করলে কেন যদি ভালোই না বাসো!’
সন্ধ্যা শব্দ করে হেঁসে দেয়। আয়াশ সে হাসির দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয়। এ মেয়ের সৌন্দর্য যেনো আগুন তাকালেই চোখ ঝলসে যাবে। সন্ধ্যা হাসি থামিয়ে বলে,
‘একটা মানুষ যদি আপনাকে সবসময় আগলে রাখে, সব বিপদে পাশে থাকে আপনি কি তার বিপদের সময় বসে থাকবেন? আমি পারি না শহুরে ডাক্তার। বাদল ভাইয়ের ওই অবস্থা দেখে আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। মানুষটা আর বাঁচতোই না যদি না আপনারা থাকতেন! আপনাদের কাছে আমরা অনেক কৃতজ্ঞ।’
এরপর সব চুপচাপ হয়ে যায়। দুজনে নিজেদের মতো হাঁটতে থাকে কোনো কথা ছাড়াই। একজন নিজের অনুভূতিদের বুঝতে চেষ্টা করছে অন্যজন নিজ মনে কিছু ভাবছে। নিজেদের অনুভূতির সাথে লড়াই করতে করতেই একটা সময় দুজন দুদিকে যাওয়ার পথ আসে। আয়াশ নিজের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘যাও সাবধানে।’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ চলে যায়। সন্ধ্যা কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে আওড়ায়, ‘এভাবেই আপনি একদিকে আর আমি আরেকদিক শহুরে ডাক্তার। আমার অন্যরকম অনুভূতি গুলো আপনার নামে দখলদার কিন্তু এ কথা আপনিও বুঝবেন না। এ অনুভূতি যদি ভালোবাসা হয় তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি শহুরে ডাক্তার ভীষণ ভালোবাসি। যদি কয়েকদিনের পরিচয়ে একটা মানুষকে ভালোবাসা যায় তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি জানি এ ভালোবাসা তুচ্ছ আপনার কাছে। তবে আমার এ শ্রেষ্ঠ অনুভূতি আমি কারো কাছে তুচ্ছ করবো না।’
তারপর পা বাড়ায় নিজেদের বাড়ির দিকে। আয়াশ সন্ধ্যার পথ এভাবেই দু পথের মাথায় গিয়ে হয়তো শেষ হবে। একজন ভালোবাসায় ডুবতেছে আরেকজন রহস্যের জালে ডুবতেছে। এ রহস্য শেষে সে পাড়ি জমাবে তার নীড়ে পড়ে রইবে শুধু সন্ধ্যামালতীর কঠিন অনুভূতি, ভালোবাসা।
আয়াশ দ্রুত বাড়িতে এসে দেখে সবাই বসে আছে। সবাইকে দেখে তাড়া দিয়ে বলে, ‘সবাই রুমে আয়। ফাস্ট!’
সবাই খানিকটা চমকায়। তারপর দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। রানা দ্রুত কন্ঠে বলে, ‘কি হয়ছে আয়াশ?’
আয়াশ কিছু না বলে হোয়াইট বোর্ডের সামনে মার্কার নিয়ে দাঁড়ায়। একটা গোল বৃত্ত এঁকে তারমধ্যে নাম লিখে সোনিয়া আর নয়না। আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তুই ওদের নাম লিখছিস কেন?’
আয়াশ বলে, ‘গ্রামে ফার্স্ট কে মা’র্ডার হয়ছে?’
তমাল বলে, ‘চেয়ারম্যান আর মেম্বারের ছেলে।’
রানা বলে, ‘কিন্তু কেন?’
‘বলতেছি! দেখ সোনিয়া আর নয়না সুইসাইড করার পর ওই দুজনকে কেউ মা’র্ডার করে দেয়। এখানে আমাদের কাছে স্পষ্ট কেউ ওদের সুইসাইডের জন্যই প্রতিশোধ নিছে। এরপর মা’রা যায় এক্স মেম্বার উনিও মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করতো। এরপর মা’রা যায় মুন্নি যে কি না সোনিয়া, নয়না আর সন্ধ্যার ফ্রেন্ড। কিন্তু এই মৃত্যুতে সন্ধ্যা মোটেও কষ্ট পায়নি। কেন? এরপর মা’রা গেছে ফরিদ। যে কি না দিনে দুপুরে মেয়েদের ইভটিজিং করতো। দেখ ঘুরে ফিরে সন্ধ্যা!’
রানা জিজ্ঞেস করে, ‘তো?’
‘তো মানে কি? সন্ধ্যার সাথে বড় কোনো লিঙ্ক আছে এটার।’
লিজা বলে, ‘সন্ধ্যার মতো বাচ্চা মেয়ে একা কখনোই এসব পারবে না।’
‘নয়নার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিলো কিন্তু সে কে এখনো জানা যায়নি। মুন্নি জানতো শুধু। তাহলে কি মুন্নি এটাও জানতো মা’র্ডার গুলো কে করতেছে!’
লিজা বলে, ‘পসিবল। বাট সন্ধ্যা ওকে বে’ইমান কেন বললো? আর কে হতে পারে যে এসবের পেছনে আছে?’
‘হয়তো মুন্নি সন্ধ্যার কথা সবাইকে বলে দিতে চেয়েছিলো তাই হয়তো ওকে বে’ইমান বলেছে!’
তমাল বলে, ‘তবুও আমি মানতে পারছি না সন্ধ্যা এতো কিছু করতে পারে। আর নয়নার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে কাকে সন্দেহ করছিস?’
‘বাদলকে সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু ‘ও’ যেভাবে মা’র খেয়েছে তাতে নিজে নিজেকে আঘাত করা ইম্পসিবল।’
রানা বলে, ‘হুম নিজেকে কেউ এতোটা গভীর ভাবে আঘাত করতে পারবে না। কিন্তু আমার মাথায় এটা আসতেছে না কেউ বাদলকে কেনো অ্যাটাক করলো?’
লিজা বলে, সেটাই।ঘুরে ফিরে সেই শূণ্য। এখন কি করবো আমরা?’
‘নয়নার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজতে হবে। আমার বিশ্বাস সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছেই আছে।’
‘কেমনে খুঁজবো? সন্ধ্যা কখনোই আমাদের বলবে না। আর মুন্নি জানতো সে বর্তমানে ডেড।’
আয়াশ গভীর ভাবে কিছু ভেবে বলে, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।’
______________
সন্ধ্যা বাড়ি এসে দেখে সাহেদা বসে আছে। সন্ধ্যা আসতেই সে জিজ্ঞেস করে, ‘বাদল ঠিক আছে?’
‘হুম।’
বলেই সন্ধ্যা মায়ের ঘরে যায়। পুরোনো ট্রাঙ্কের মধ্যে তার কিছু দরকারি জিনিস খুঁজতে থাকে। সেসময় হাতে কিছু শীতল লাগে। সন্ধ্যা সব জিনিস উল্টে জিনিসটা বের করেই খানিকটা অবাক হয়। পুরোনো জং ধরা রাম দা। জং ধরে যাওয়ার প্রথমে সে বুঝতে পারেনি এটাতে রক্তও শুকিয়ে আছে। উল্টে পাল্টে দেখে যখন বুঝে যায় তখন ওটা ফেলে দিয়ে ‘আম্মা’ বলে চিৎকার করে উঠে। সাহেদা দৌড়ে এসে দেখে সন্ধ্যা দুকদম পিছিয়ে ভীত দৃষ্টিতে কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে নিজেই পড়ে যেতে নিলে কাঠের দরজা ধরে নিজেকে সামলায়। সন্ধ্যা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এটা কি আম্মা? তুমি….
#সন্ধ্যামালতী (১২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
সন্ধ্যা চুপচাপ পুকুর ঘাটে বসে আছে। আজ সে জীবনের এমন কিছু সত্য জানতে পেরেছে যা তার অজানা ছিলো। কিছু সত্য বোধহয় গোপন থাকায় ভালো! আনমনে পুকুরে ঢিল ছুড়ছিলো এমন সময় সেখানে আসে আয়াশ। সন্ধ্যার সেদিকে খেয়াল নেই। নিজের মতো বসে আছে সে। আয়াশ এক পলক সন্ধ্যার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। সন্ধ্যামালতীর যে মন খারাপ তা বুঝি আয়াশও টের পায়। একদম সনন্ধ্যার পাশে বসে তবে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে। সন্ধ্যা তখনো নিজ মনে ঢিল ছুড়তে ব্যস্ত। আয়াশ গলা খাঁকারি দিয়ে সন্ধ্যার আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করে। তাতেও লাভ হয় না। অবাক হয় আয়াশ। জোড়ে ডাকে ‘সন্ধ্যা’ বলে। সন্ধ্যা চমকে পাশে তাকায়। পাশে আয়াশকে দেখে অবাক হয়। আয়াশ কখন আসলো? সন্ধ্যা নিজের চোখ ডলে। মনে মনে আওড়ায়,
‘এটা কি শহুরে ডাক্তার নাকি আমার ভ্রম?’
আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কি ভাবছো? এতো মন দিয়ে তুমি সারাদিন ভাবোটা কি?’
সন্ধ্যা ধরেই নেয় আয়াশ তার ভ্রম। আয়াশ এখানে কেন আসবে? সে তো সন্ধ্যার কাছে আসার মানুষ না। তাই নিজেকে খোলা, উন্মুক্ত বইয়ের মতো করতে চায় তার শহুরে ডাক্তারের কাছে। তার মনের সব কথা উজাড় করে দিতে চায়। পুকুরে দিকে তাকিয়েই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘আচ্ছা শহুরে ডাক্তার আপনি যদি জানতে পারেন আপনার জীবনে এমন কিছু সত্য আছে যা আপনি জানেন না বা আপনি যাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন সে খুবই ঘৃণ্য। তাহলে কি করবেন?’
আয়াশ চমকে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। কি বলছে মেয়েটা? সে নিজেকে সামলে বলে, ‘তোমার মাথা বা শরীর ঠিক আছে তো সন্ধ্যা? আর ইউ ওকে?’
সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘ঠিকই আছি। আমার না ভেতরে ভীষণ পুড়ে যাচ্ছে শহুরে ডাক্তার। আমাকে একটু আপনার বুকে মাথা রাখতে দিবেন?’
সন্ধ্যা তখনো ভাবছে সে নিজের ভ্রমের সাথে কথা বলতেছে। আয়াশ তো অবাকের চরম পর্যায়ে। মেয়ে বলে কি! সন্ধ্যা ভীষণ আকুল চোখে তাকায় আয়াশের দিকে। আকুতি ভরা কন্ঠে বলে,
‘দিবেন?’
আয়াশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যার মুখের দিকে। সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে নিজের জায়গা থেকে উঠে দুপা এগিয়ে বলে, ‘আপনি আমার কল্পনাতেই সুন্দর শহুরে ডাক্তার।’
আয়াশ যেন অবাকের ওপর অবাক হয়। সন্ধ্যার কন্ঠে কিছু তো ছিলো! সেও উঠে পড়ে সন্ধ্যার সাথে। সন্ধ্যার হাত ধরে নিজের দিকে ফিরায়। সন্ধ্যা চমকে ওঠে। এতক্ষণে উপলব্ধি করে আয়াশ সত্যিই আছে। সে নিজের করা কাজে নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। সে এতো বোকা কবে হলো? কোনটা সত্যি আর কোনটা ভ্রম বুঝতে পারলো না? নাকি সে নিজেই ঘোরের মধ্যে ছিলো বলে বুঝতে পারেনি! আয়াশ হঠাৎ করেই আঁকড়ে ধরে নিজের বাহুতে। সন্ধ্যা স্তব্ধ, নির্বাক। যখন বুঝতে পারে আয়াশ তার ইচ্ছেটা পূরণ করলো তখন সে শক্ত করে আয়াশের টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে। আয়াশ নিজের কাজে অবাক হয়। সে তো চাইলেই সন্ধ্যার ইচ্ছেকে, সন্ধ্যার চাওয়াকে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারতো তাহলে সে কেনো সন্ধ্যার চাওয়ার গুরুত্ব দিলো? ভাবনার মাঝেই টের পায় সন্ধ্যার ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ। সন্ধ্যা কাঁদছে! কেন? আয়াশ সন্ধ্যাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও করে না। সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সন্ধ্যার কান্নার গতি বেড়ে যায়। শব্দ করে কেঁদে ওঠে৷ আয়াশ আদুরে স্বরে বলে,
‘কি হয়ছে সন্ধ্যা? কান্না করতেছো কেন? কেউ কিছু বলছে?’
সন্ধ্যা জবাব দেয় না। আয়াশ ফের বলে, ‘আচ্ছা শান্ত হও। কি হয়ছে আমাকে বলো!’
সন্ধ্যা থামে না। কেটে যায় বেশ অনেকক্ষণ। আয়াশ বুঝতে পারে সন্ধ্যার কিছু হয়ছে যার কারণে ‘ও’ অদ্ভুত বিহেভ করলো। একসময় সন্ধ্যা শান্ত হয়ে আসে সাথে ধরে রাখা আয়াশের টি-শার্টও আলগা করে দেয়। আয়াশকে ছেড়ে দিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়েই বেরিয়ে যায় বাগান থেকে। আয়াশ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে সেদিকে৷ হঠাৎ করেই কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে পেছনে তাকায়। রানা, আকাশ, তমাল, সাফি, জেরিন আর লিজাকে দেখে নিজেকে সামলে নেয়। রানা ঠোঁট চেপে হেঁসে হেঁসে বার বার আয়াশের দিকে ঘুরতে থাকে। আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কি? এরকম করছিস কেন?’
রানা বলে, ‘আমাদের সামনে সারাদিন ফিয়ন্সে ফিয়ন্সে করো আর এখন লুকিয়ে প্রেম করতেছো!’
আয়াশ কপালে ভাজ ফেলে বলে, ‘প্রেম করতেছি মানে? আমি কোনো প্রেম টেম করিনি। আর তোর আজাইরা প্যাচাল বন্ধ করে কাজে মন দে।’
বলেই গটগট করে চলে যেতে নেয়। তারপর আবার পেছনে ফিরে বলে, ‘বাই দ্যা ওয়ে তোরা আমার পেছনে কিভাবে আসলি? কখন আসছিস তোরা?’
আকাশ হাই তুলতে তুলতে বলে, ‘যখন সন্ধ্যা তোকে জড়িয়ে ধরতে বললো তখন আসছি কিন্ত বুঝিনি লুকিয়ে লুকিয়ে পুরো জড়িয়ে ধরাটাই দেখতে পারবো ‘
বাকি সবাই হেঁসে ওঠে। আয়াশ কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে চোখ রাঙিয়ে চলে যায়। সবাই শব্দ করে হেঁসে দেয়। লিজা বলে, ‘দোস্ত আমি তো টাস্কি খেয়ে গেছি সন্ধ্যার কথা শুনে তারপর ডাবল টাস্কি খায়ছি আমাদের হিটলারের জড়িয়ে ধরা দেখে। ওহ মাই আল্লাহ আমি তো ভাবতেই পারিনি।’
তমাল বলে, ‘দোস্ত সন্ধ্যা শিউর এই হিটলারের প্রেমের জলে ডুবতেছে কিন্তু এই হিটলারের মনের খবর বুঝি না। একবার মনে হয় আয়াশও ভালোবাসে আবার মনে হয় না বাসে না।’
রানা হেঁসে বলে, ‘আমাদের হিটলার বাবুর মনেও কিছু তো আছে। এখন বুঝতেছে না কিন্তু বুঝাইতে তো আমাদেরই হবে।’
জেরিন বলে, ‘ঠিক। সাফি যেমন ভুত ভুত করে সব জায়গায় আমাদের আয়াশ বাবুও তেমন সব জায়গায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা করবে আর তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের সবার।’
সন্ধ্যা বাড়ি এসে চোখে মুখে পানি দেয়। লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ঘোরের বশে সে কি করে বসেছে! সরাসরি আয়াশকে জড়িয়ে ধরতে বলেছে! সে বললো আর আয়াশও ধরে ফেললো! লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কবরস্থানের দিকে। কবরস্থানের সামনে আসতেই চোখ মুখ থেকে সব লজ্জা সরে গিয়ে নেমে আসে বিষণ্নতা। কবরস্থানের গেইটের সামনে এসে এক দৃষ্টিতে তাকায় একটা কবরের দিকে। চোখে মুখে ভালোবাসার জায়গায় উপচে আসে ঘৃণা। সেই ঘৃণা কান্না হয়ে বের হয়। উল্টো ঘুরে হাঁটা লাগায়। হসপিটালে এসে দম নেয়। বাদলের কেবিনে এসে দেখে বাদল তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা নিজেকে সামলে হাসিমুখে বলে,
‘এখন কেমন আছেন বাদল ভাই?’
বাদল হালকা হাসে। বলে, ‘এতক্ষণে খোঁজ নিচ্ছিস?’
‘ছিলাম তো আমি। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন বলে চলে গেছিলাম।’
বকুল বলে, ‘ভাই তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো?’
‘জানি না।’
সন্ধ্যা বলে, ‘এসব পরে আলোচনা করা যাবে৷ এখন উনি রেস্ট নিক।’
বকুলের মা সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘তোগো রেজাল কবে দিবো?’
সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘৩১ তারিখে দিবে বলছে।’
বকুলের মা বলে, ‘তাইলে তো হইয়াই গেলো। পোলাডা বেওয়ারার মতো ঘুইরা ঘুইরা এমন মাইর খাইলো!! বিয়া দিয়া দিলে তখন সংসারি হইয়া যাইবো রাইত বিরাতে বাইরেও যাইবো না।’
বকুল তাল মিলিয়ে বলে, ‘ঠিক মা। তাড়াতাড়ি ভাই আর সন্ধ্যার বিয়ের ব্যবস্থা করো তো। সন্ধ্যা আমার ভাবি হয়ে আসলে কত্ত মজা হবে!’
বাদল বলে, ‘হয়ছে এখন থামো। সন্ধ্যা আর বকুলের রেজাল্ট দিক তারপরই বিয়ের কথা তুইলো৷ এখন না।’
সন্ধ্যার মনটা আরো বিষিয়ে গেলো। বার বার আয়াশের জড়িয়ে ধরাটা মনে পড়ছিলো৷ যেনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে দৃশ্যটা। সে কি করে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে সংসার বাঁধবে? এতে তো নিজেকেও আর বাদলকেও ঠকানো হবে। নাহ একবার কথা বলতেই হবে বাদলের সাথে। বাদল সন্ধ্যাকে অন্যমনষ্ক দেখে ডাক দেয়৷ সন্ধ্যা হাসার চেষ্টা করে গল্প জুড়ে দেয়।
_________________
পরেরদিন ভোর ভোর উঠে সন্ধ্যা হাঁটতে হাঁটতে আয়াশদের থাকা বাড়িতে যায়। কাল সারাদিন সে লজ্জায় আর এখানে আসেনি। আয়াশের সামনে দাঁড়াবে কি করে সেই চিন্তাই সে ডুবে আছে। লিজা সন্ধ্যাকে দেখে ডাক দেয়। সন্ধ্যা হেঁসে এগিয়ে আসে। লিজা সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে আসে পুকুর ঘাটে। সেখানে বাকি সবাই বসে আছে। আয়াশ এক পলক সন্ধ্যার দিকে তাকায় আর বাকি সবাই তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশ ভ্রু কুঁচকে একবার সবার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। রানা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
‘আরে সন্ধ্যা! আসো আসো। আজ তোমার মন ভালো তো?’
সন্ধ্যা খানিকটা চমকায়। তারপর হেঁসে মাথা নাড়িয়ে মাথা নিচু করে নেয়। আড়চোখে একবার আয়াশের দিকে তাকায়। সাফি হেঁসে বলে, ‘মন আবার ভালো থাকবে না? আমাদের হিট….
এটুকু বলতেই পায়ে পাড়া লাগিয়ে দেয় আকাশ। সাফি চেঁচিয়ে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে সে রাগী চোখে তাকায়। বাকি সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সাফি বোকা বোকা হাসি দিয়ে মাথা চুলকে নিজের পা ডলতে থাকে। রানা বলে,
‘সন্ধ্যাকে আজ অন্যরকম লাগতেছে না?’
জেরিন মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘ঠিক ঠিক।’
আকাশ বলে, ‘সন্ধ্যা সামনে বিয়ে বলে কি এমন লজ্জা পাচ্ছো নাকি?’
সন্ধ্যা কিছু বলে না৷ লিজা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বিয়ে কবে সন্ধ্যা?’
সন্ধ্যা মাথা নিচু করেই বলে, ‘২ তারিখে।’
রানা আফসোসের স্বরে বলে, ‘ইশশ তাইলে তো সন্ধ্যার বিয়ে খাওয়া হচ্ছে না আমাদের!’
আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুহুর্তেই মনে পড়ে যায় কালকের জড়িয়ে ধরাটা। হার্ট বিটের সাথে সাথে শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে অনুভূতির দখলে। শুধু এ অনুভূতিদের বুঝে উঠতে পারে না। সন্ধ্যা হাসফাস করতে থাকে। লিজা আয়াশকে বলে,
‘দোস্ত আমরা সন্ধ্যার বিয়েটা খেয়ে যায়।’
আয়াশ ফোন স্ক্রল করতে করতে বলে, ‘বিয়ে খাওয়া যায় না। বিয়ের দাওয়াত খাওয়া যায়। তা তোরা কি ইনভাইটেশন পাইছিস?’
সন্ধ্যা চোখ তুলে তাকায়। মানুষটা এতো আজব কেন? আয়াশ ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলে, ‘৩০ তারিখ আমরা চলে যাচ্ছি। সবাই সব গুছিয়ে নে। আজ থেকে পেশেন্টর ভীড় হবে।’
সন্ধ্যা চমকে তাকায় আয়াশের দিকে। ৩০ তারিখ চলে যাবে মানে? আজ তো ২৮ তারিখ তাহলে শহুরে ডাক্তাররা আর মাত্র ২ দিন থাকবে! আর কি দেখা হবে কখনো? শহুরে ডাক্তার কি মনে রাখবে তাকে?…….
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন❤️)
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ❤️)