সন্ধ্যামালতী পর্ব -০৯+১০

#সন্ধ্যামালতী (০৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

চারিদিকে স্নিগ্ধ, শীতল পরিবেশ। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দে চারিদিকে মুখরিত হয়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে এখনো ভিজে চলেছে দুটি মানব-মানবী। একজন তার ভালোবাসার মানুষে মগ্ন আরেকজন স্নিগ্ধ মুখ দেখতে ব্যস্ত। একে অপরের এতো কাছে হওয়া সত্বেও দুজনের মাঝে অনেক দূরত্ব। সন্ধ্যা অনেকটা সময় পর কাঁপা কাঁপা হাতে আয়াশের গালে হাত রাখে। কিছুটা চমকে ওঠে আয়াশ। আয়াশের থেকে সন্ধ্যা অনেকটা ছোট আর হাইটেও কম তাই পা উচু করে রেখেছে। আয়াশ নিজেকে সামলে বলে,

‘এই মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেছো কেন? ঠান্ডা লেগে গেলে কি করবে?’

সন্ধ্যার কি হলো কে জানে! আয়াশের গলা জড়িয়ে একদম কাছে দাঁড়ালো। আয়াশ ভড়কে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। আয়াশ কিছু বলার আগেই সন্ধ্যা চোখ পিটপিট করে তাকায়। কয়েক বার চোখের পলক ফেলে ধীর কন্ঠে বলে,

‘শহুরে ডাক্তার! আ-আমি আপনাকে…

এটুকু বলে সন্ধ্যা লুটিয়ে পড়ে আয়াশের বুকে। আয়াশ শক্ত করে ধরে। বৃষ্টির শব্দে সন্ধ্যার কথা স্পষ্ট কানে যায়নি আয়াশের। সন্ধ্যা জ্ঞান হারিয়েছে বুঝতে পেরে কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সন্ধ্যাকে আয়াশের কোলে দেখে বাকি সবাই ভয় পেয়ে যায়। সাহেদাও ভয় পায়। বাড়িতে ঢুকে কাউকে কিছু না বলেই আগে একটা রুমে নিয়ে যায় সন্ধ্যাকে। পেছন পেছন সবাই আসে। সাহেদা দ্রুত মেয়ের কাছে এগিয়ে এসে বলে,

‘হায় আল্লাহ গো। সন্ধ্যার কি অয়ছে? বাজান অয় জ্ঞান হারায়ছে ক্যা?’

আয়াশ শান্ত কন্ঠে বলে, ‘তেমন কিছু হয়নি আন্টি। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজার ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। ওর তো আবার স্বভাব এটা।’

শেষের টুকু আস্তে করে বলাায় সাহেদা শুনতে পায়নি। লিজা বলে, ‘তোরা এতক্ষণ কি করছিলি? সেই কখন পাঠিয়েছি তোকে! তোর আর সন্ধ্যার পাত্তাই নাই।’

আয়াশ জবাব দেয় না। রুম থেকে বের হতে হতে বলে, ‘ওর কাপড়টা চেঞ্জ করুন। এমনিনেই অনেকক্ষণ ভিজেছে আরো ভেজা কাপড়ে থাকলে জ্বর চলে আসবে।’

তারপর নিজের রুমে চলে যায়। রুম থেকে সব ছেলেরা বের হয়ে গেলে লিজা তার ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস এগিয়ে দেয় সাহেদার কাছে। হেঁসে বলে,

‘ওকে শাড়িতেই বেশি সুন্দর লাগে আন্টি। আমার ব্যাগে ছিলো শাড়িটা। ওকে এটাই পড়িয়ে দিন।’

সাহেদা মাথা নাড়ায়। লিজা আর জেরিন মিলে সাহায্য করে সন্ধ্যার কাপড় পাল্টাতে। তারপর তাপমাত্রা চেইক করে নিজেরা রুম থেকে বের হয়। বাহিরে সবাই আছে। আয়াশও চেঞ্জ করে কফি হাতে বসেছে। বৃষ্টি কমার বদলে বেড়েই চলেছে। লিজা আর জেরিন এসে রানার পাশে বসে। রানাকে চিমটি কাটতেই রানা লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। রানা হাত ডলতে ডলতে বলে,

‘তোরা এই ডা’ইনির মতো নখ গুলো কাটতে পারিস না? ইশশশ আমার হাতের চামড়া উঠে গেছে।’

লিজা ভেংচি কেটে বলে, ‘তোর গায়ের চামড়া এমন তেমন না। গ’ন্ডারের চামড়ার মতো শক্ত। আমাদের এই ছোট খাটো নখে তোর মতো গ’ন্ডারের চামড়া উঠবে তো দুর আমাদের নখই ভেঙে যাবে।’

রানা ভেংচি কাটে। পাশ থেকে আকাশ আয়াশকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোরা এতক্ষণ বৃষ্টিতে কি করছিলি দোস্ত? প্রেম?’

আয়াশ কপালে ভাজ ফেলে তাকায় আকাশের দিকে। রানা হেঁসে বলে, ‘প্রেম করছিলো নাকি সন্ধ্যার থেকে প্রুফ খুজতেছিলো আল্লাহ মালুম।’

সবাই হেঁসে দেয়। জেরিন বলে, ‘কথা তো একদম ঠিক। আমাদের হিটলার বাবুর তো ফিয়ন্সে আছে তার চোখে তো এতো ভালো মেয়ে পড়বে না।’

লিজা আর জেরিন হাইফাই করে। বাকি সবাই হাসতে থাকে। আয়াশ একটা ধমক দিয়ে বলে, ‘তোদের মজা শেষ? এবার যা।’

সাফি ভেংচি কেটে বলে, ‘কেন যাবো আমরা? আমরা এখানেই বসে থাকবো।’

তমাল হঠাৎ করে লাফ দিয়ে উঠে বলে, ‘সাফি ওই দেখ ভুত ভুত।’

সাফি ভুতের কথা শুনে ‘ভুত ভুত’ করে লাফিয়ে উঠে। এক লাফে আকাশের কোলে আর আকাশ টুল থেকে ধপ করে নিচে পড়ে। সবার হাসির দমক বেড়ে যায়। রানা তো রানাই হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি শুরু করছে। আকাশ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

‘অলওয়েজ ভুতে ভয় পাবি তুই আর সাফার করবো আমি। আল্লাহ আমার কোমর বোধহয় শেষ।’

তমাল টেনে তুলে আকাশকে। সাফি কাচুমাচু করে বলে, ‘আমার কি দোষ? তমাল কেন বললো ভুত ভুত।’

লিজা হাসতে হাসতে বলে, ‘তুই কবে বড় হবি দোস্ত? ভুত বলতে কিছু হয় না৷ ওগুলো তো ছোট বেলার রুপকথার গল্পেই মানায়।’

জেরিন আফসোসের সুরে বলে, ‘ছোটবেলাটা অনেক মিস করি রে। সেই ঝাঁপাঝাপি, লাফালাফি, রাতে দাদীর কোলে বসে ভুতের গল্প তার ভয়ে আম্মুর আঁচল ধরে থাকা। কি মজা না?’

সবাই সায় দেয়। তারপর মেতে উঠে আড্ডায়। আয়াশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বৃষ্টির দিকে। ভেসে উঠে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ মুখ।

বৃষ্টি কমে এসেছে সাথে বেড়ে গেছে সন্ধ্যার গায়ের তাপমাত্রা। সাহেদা সন্ধ্যার কাছেই ছিলো হঠাৎ করে মেয়েকে গোঙরাতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি কপাল, গলা চেইক করে দেখে গা গরম। একটু না অনেক বেশি গরম। দ্রুত ডাক দেয় সবাইকে। লিজা আর জেরিন সন্ধ্যাকে এভাবে গোঙরাতে দেখে নিজেরাই ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত তাপমাত্রা চেইক করে দেখে ১০৩° জ্বর। হঠাৎ করে জ্বর চলে এসেছে। আয়াশ দ্রুত নিজেদের মতো প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে। সাহেদা মেয়ের হাত ডলতেছে লিজা আর জেরিন নিজেদের মতো চেষ্টা করছে। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। সবাই টেনশন করতেছে। সাহেদা একবার সবার দিকে নজর বুলায়। মনে মনে আওড়ায়, ‘পোলা মাইয়া গুলান এতো ভালা ক্যান?’ অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য কত কি করছে! সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। যেন অসুস্থ একটা ৩-৪ দিনের পরিচিত মেয়ে না তাদেরই কেউ। চোখ ভরে আসে সাহেদার। মনে মনে অনেক দোয়া দেয়। জেরিন জলপট্টি দিচ্ছিলো রানা ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘কি রে জ্বর কমেছে!’

জেরিন দুদিকে মাথা নাড়ায়। আয়াশ বলে, ‘সবাই বাহিরে চল। জেরিন!’

জেরিন ইশারায় বুঝায় ‘ঠিক আছে’। সবাই বাহিরে চলে আসে। জেরিন আর সাহেদা মিলে সন্ধ্যার গা মুছিয়ে দেয়। আয়াশের চোখ মুখ লাল দেখে রানা এগিয়ে আসে। বলে, ‘তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?’

আয়াশ মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘তেমন না। বৃষ্টিতে ভেজার ফলে চোখ মুখ লাল দেখাচ্ছে। ঠান্ডা লাগার পূর্বাভাস।’

‘রেস্ট নে গিয়ে। আমরা দেখতেছি সন্ধ্যাকে।’

আয়াশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় রানার দিকে। বলে, ‘ঠিক আছি আমি।’

রানা বোঝে আয়াশ রেস্ট নিবে না। নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসে রানা। লিজা ইশারায় জিজ্ঞেস করে, ‘কি?’ রানা দুদিকে মাথা নাড়ায়। একটু পরই জেরিন ডাকে। সবাই আবার রুমে ঢোকে। আয়াশ সাহেদাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আন্টি অনেকটাা সময় পাড় হয়ে গেছে বৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থায় সন্ধ্যাকে নিয়ে যাওয়ার দরকার নাই। আপনারা বরং আজ থেকে যান।’

সাহেদা বলে, ‘সন্ধ্যার দাদাই যে বাড়িতে বাজান। তোমরা এট্টু আমার মাইয়াডারে রাখবা? হের এই অবস্থায় নিমু কেমনে কও?’

আকাশ বলে, ‘আন্টি সন্ধ্যা থাকুক সমস্যা নাই।’

তমাল পাশ থেকে বলে, ‘আন্টি ওর হঠাৎ এতো জ্বর হইলো কেমনে? বৃষ্টির জন্য?’

সাহেদাা মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘হ বাজান৷ ছুডুবেলা থেইকায় অয় বৃষ্টিতো ভিজতো পারে না। জ্বর আইসা যায়।’

আয়াশ সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বকা দেয়। জ্বর আসলে বৃষ্টিতে কেন ভিজতে হবে?

বৃষ্টি থেমে গেলে সাহেদা নিজের বাড়ির দিকে যায়। বৃদ্ধ শ্বশুর বাড়িতে একা উপায় নেই যেতে হবে। আয়াশ আর লিজা থেকে গেছে বাকি সবাই খাচ্ছে। লিজা আয়াশের পাশে বসে। বলে,

‘তুইও খেয়ে আয়। আমি সন্ধ্যার কাছে আছি।’

আয়াশ গম্ভীর গলায় বলে, ‘তোর ক্ষুধা লাগলে তুই যা। আমি আছি এখানে।’

লিজা হাসে৷ বলে, ‘তুই যে এই পিচ্চি মেয়ের ওপর দুর্বল এটা বুঝিস?’

আয়াশ কপালে ভাজ ফেলে তাকায় লিজার দিকে। শান্ত কন্ঠে বলে, ‘তুই ভুল। আয়াশ ইরফান এতো সহজে কারো ওপর দুর্বল হয় না। তাছাড়া আমি কমিটেড।”

লিজা আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে যেতে যেতে দাত কিড়মিড় করে বলে, ‘তোর ওই ন্যাকা ফিয়ন্সের কথা শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি খেতে যাচ্ছি তুই বসে থাক।’

বলেই চলে যায়। আয়াশ নিঃশব্দে হাসে। এরা একদম সহ্য করতে পারে না আয়াশের ফিয়ন্সেকে। তারপর গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা তখনো জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করতেছে, গোঙরাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারে আয়াশ। মুখটা এগিয়ে নিয়ে যায় সন্ধ্যার দিকে। মুখে ফু দেয়। কেঁপে উঠে সন্ধ্যা। আয়াশ ফের ঠোঁট কামড়ে হাসে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যার মুখের দিকে। সে সময় ছুটে আসে বাদল আর বকুল। আয়াশ নিজেকে সামলে ঠিক করে বসে৷ বাদল সন্ধ্যার কপালে হাত দিয়ে জ্বরের পরিমাণ দেখে ঘাবড়ে যায়। আয়াশকে বসে থাাকতে দেখে বলে,

‘ওর জ্বর একটুও কমেনি?’

আয়াশ দুদিকে মাথা নাড়ায়। বাদল ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘কমছে না কেন? ঠিক হয়ে যাবে তো?’

আয়াশ গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘ঠিক হবে। কিন্তু আপনি কে?’

বকুল পাশ থেকে বলে, ‘আমার ভাই।’

আয়াশ নড়েচড়ে বসে। বলে,’ সন্ধ্যার যার সাথে বিয়ে!’

বকুল মাথা নাড়ায়। আয়াশ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। শুধু স্বাভাবিক ভাবে বলে, ‘চিন্তার কারণ নেই। ওষুধ দেওয়া হয়ছে বার বার জলপট্টি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

তারপর নিজে বের হয়ে যায়। বাদল দ্রুত পাশে থাকা জলপট্টি দিতে থাকে সন্ধ্যাকে। বকুলও পাশে বসে। পেছনে তাকিয়ে আরো একবার আয়াশের যাওয়ার দিকে তাকায়। লোকটা একা এখানে কি করছিলো?

বিকালের দিকে জ্বর কমে আসে সন্ধ্যার। এতক্ষণ পাশে সবাই বসে ছিলো৷ বাদল আর বকুলও যায়নি। সন্ধ্যা চোখ পিটপিট করে তাকাতেই চোখের সামনে আয়াশের মুখ ভেসে ওঠে। আয়াশ সামনে ছিলো বলে প্রথমে তার মুখই দেখে। অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলে ঠোঁট এলিয়ে দেয়। বাদল দ্রুত কন্ঠে ডাকে সন্ধ্যাকে৷ সন্ধ্যা পাশে তাকাতেই খানিকটা চমকায়। অনেক কষ্টে বলে,

‘ব-বাদল ভাই! আপনি!’

‘ঠিক আছিস এখন? সেই সকাল থেকে তোর ধুম জ্বর। সবাই তো ভয়ই পেয়ে গেছি৷ জানিস বৃষ্টিতে ভিজলে তোর জ্বর হয় তাহলে ভিজলি কেন?’

সন্ধ্যা উত্তর না দিয়ে একবার আয়াশের দিকে আরেকবার বাদলের দিকে তাকায়। বাদলের উৎকন্ঠা দেখে সে আয়াশের দিকে তাকায়। একজনের প্রতি তার নাম না জানা অনুভূতি আর আরেকজন তার হবু স্বামী। যার সাথে আর কয়েকটা দিন পরই পবিত্র বন্ধন গড়ে উঠবে। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। মাথায় চাপ দিতে তার ইচ্ছে করলো না। আয়াশের প্রতি তার অনুভূতি তো কেউ জানে না! আর জানবেও না। সে বাদল ভাইয়ের সাথে সুখী হবে। লিজা পাশ থেকে বলে,

‘তুমি তো আমাদের জানই কেড়ে নিচ্ছিলে!’

সন্ধ্যা হাসে৷ বাদল কৃতজ্ঞতার কন্ঠে বলে, ‘আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। আপনারা সন্ধ্যার জন্য অনেক কিছু করছেন। অপরিচিত মানুষের জন্য কেউ এতোটা করে না।’

রানাা হেঁসে বলে, ‘ইটস ওকে ভাই। প্রথমত আমরা ডক্টর আর তাছাড়াও আমরা মানুষ। এতোটুকু করতেই পারি। ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই।’

বাদল হাসে। আর কিছুক্ষণ বসে বাদল সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘একা হাঁটতে পারবি?’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। পাশ থেকে আয়াশ বলে, ‘ওর এই শরীর নিয়ে হাঁটা কষ্টের হবে আপনি ওকে কোলে নিন নয়তো কোনো গাড়ি ডাকুন।’

বাদল বলে, ‘সন্ধ্যা যা চিকন তাতে ওকে কোলে করেই নিতে পারবো৷ নো প্রবলেম।’

আয়াশ কিছু না বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা সেদিকে তাকায়। এখন কি সে বাদল ভাইয়ের কোলে উঠবে নাকি? আজব! এই গোমড়া শহুরে ডাক্তারের কি কাজ নেই নাকি যে সে বাদল ভাইকে এসব বলে গেলো! বাকি সবাইও হতাশ হয়। আয়াশ জেলাস ফিল না করে বাদলকে উপদেশ দিয়ে গেলো যেনো সে সন্ধ্যাকে কোলে করে নিয়ে যায়…..
#সন্ধ্যামালতী (১০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

সন্ধ্যার জ্বর ছেড়েছে দুইদিন পর। এই দুদিন সন্ধ্যা আয়াশদের ওখানে আর যায়নি তবে আয়াশরা সবাই এসে দেখে গেছে। বাদল আর বকুলও দুই বেলা করে নিয়ম করে দেখে গেছে। অনেক সময় বকুল থেকেই গেছে সন্ধ্যার কাছে। যতটা সময় সন্ধ্যা বাড়িতে থাকতো ততোটা সময় ছটফট করতো। বকুল জিজ্ঞেস করলেই বলতো, ‘ভালো লাগছে না’। বকুলও আর কিছু জিজ্ঞেস করতো না। সন্ধ্যা সুস্থ হতেই টইটই করে পুরো গ্রাম ঘুরে ফেলেছে। বকুল কাজ করছে বাড়িতে তাই আর বিরক্ত করে নি। একা একাই অনেকটা পথ হেঁটে আবার ঘুরে আয়াশদের ওখানে যায়। সবাই ব্যস্ত কাজে। তাই সন্ধ্যা কাউকে কিছু না বলেই পুকুর ঘাটে চলে আসে। বকুল গাছে উঠে বকুল ফুল পাড়তে থাকে। সেসময় সেখানে আসে সাফি। বকুল গাছে কাউকে নড়াচড়া করতে দেখে ‘ভুত ভুত’ বলে চিৎকার করে উঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় সন্ধ্যা গাছ থেকে পড়ে যেতে নিলে কোনো রকমে একটা ডাল ধরে নেয়। ততক্ষণে সাফি দৌড়। সন্ধ্যা নিচে নেমে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কি হলো তার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তার দু মিনিট বাদেই সবাই হাজির। সন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিজা বলে,

‘আরে সন্ধ্যা কখন আসলে? তোমার জ্বর ভালো হয়ে গেছে।’

সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘একটু আগে আসছি আপু। তোমরা কাজ করছিলে তাই বিরক্ত না করে এখানে চলে আসছি।’

জেরিন একবার সাফির দিকে আরেকবার সন্ধ্যার দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘তুমি তো এখানেই ছিলে কোন ভুত টুত দেখছো?’

সন্ধ্যা বলে, ‘কিসের ভুত? আমি বকুল গাছে উঠে বকুল ফুল পাড়তেছিলাম সে সময় উনি আসলো আর চেঁচিয়ে উঠলো। আমি তো উনার চিৎকারে গাছ থেকেই পড়েই যাচ্ছিলাম।’

রানা সাফির পেছনে এক লা’থি দিয়ে বলে, ‘হা’রা’ম’জা’দা দেখ ভুত। কইলাম দিন দুপুরে ভুত নাই উনি ভুতের ভয়ে প্যান্টে হিসু করে দিচ্ছে!’

আকাশ আর তমাল শব্দ করে হেঁসে দেয়। সাফি নরম গলায় বলে, ‘আরেহ আমি ওকে দেখে ভাবছি ভুত।’

সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘আপনি এতো ভুতে ভয় পান কেন? মানে ভুত টুত কখনো দেখছেন নাকি?’

জেরিন হাসতে হাসতে বলে, ‘আরেহ ব’ল’দের দাদি বলছিলো গ্রামে ভুত থাকে তারপর থেকে ভয় পায়।’

আয়াশ বলে, ‘তুমি তো আস্ত একটা ভুত’ই। তোমাকে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।’

সন্ধ্যা হা করে তাকায় আয়াশের দিকে। তাকে দেখতে কি ভুতের মতো লাগে নাকি? আজব কথা। সন্ধ্যা কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘আমারে দেখতে কি ভুতের মতো লাগে আপনার?’

আয়াশ পাত্তাই দেয় সন্ধ্যার রাগ৷ বলে, ‘তা নয় তো কি? দিন দুপুরে যদি গাছে উঠে বসে মানুষকে ভয় দেখাও তাহলে তো মানুষ ভয় পাবেই৷ তাছাড়া তোমার জ্বর ভালো হয়েছে মাত্র আর এখনি কি গাছে উঠে আবার হাত পা ভেঙে কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকার সুযোগ খুঁজতেছো?’

সন্ধ্যা কিছু বলতে যাবে তার আগে জেরিন বলে, ‘থাম থাম। সন্ধ্যা মোটেও দেখতে ভুতের মতো না। সাফির চোখ ভুতের মতো তাই ‘ও’ সারাদিন ‘ভুত ভুত’ করে।’

সাফি সাথে সাথেই নিজের চোখে হাতে দেয়। রানার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দোস্ত আমার চোখ ভুতের মতো?’

রানা কাঁদো কাঁদো ফেইস নিয়ে তাকায়। বলে, ‘লা’থিটা কোথায় খাবি ভাই? সামনে নাকি পেছনে?’

সাফি রানার থেকে দুই হাত দুরে গিয়ে দাঁড়ায়। বাকি সবাই হাসতে থাকে। সন্ধ্যা লিজাকে বলে,

‘তোমাদের কি কাজ শেষ?’

‘হুম। পেশেন্টই তো নাই৷ বুঝলাম না কিছু এতো কম পেশেন্ট!’

‘গ্রামের লোকজন রা ডাক্তারি উপায়ের থেকে অন্যান্য গাছালি পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করে।’

‘হুম তাও ঠিক।’

‘আচ্ছা আসো৷ বসে গল্প করি।’

তারপর সবাই শান বাঁধানো পাথরে বসে। আয়াশ ফোন নিয়ে এক কোণায় বসে গেইম খেলতে থাকে। বাকিরা আড্ডা দেওয়া শুরু করে। সন্ধ্যা বার কয়েক আড় চোখে আয়াশের দিকে তাকিয়েছিলো তারপর নিজের মতো আড্ডা দেয়। কথার এক পর্যায়ে জেরিন বলে,

‘আচ্ছা সন্ধ্যা বকুল বাদে তোমার আর কোনো ফ্রেন্ড নাই?’

এই সময় জেরিন এমন প্রশ্ন করতে পারে তা কারোরই মাথায় ছিলো না। আয়াশ ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার চোখে মুখে মলিনতা আর চাপা রাগ ফুটে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ছিলো। মা’রা গেছে।’

জেরিন ‘সরি’ বলে। সন্ধ্যা বলে, ‘ইটস ওকে আপু।’

লিজা আমতা আমতা করে বলে, ‘তোমার ফ্রেন্ডরা কিভাবে মা’রা গেছে সন্ধ্যা?’

সন্ধ্যা কিছুটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর মলিন হেঁসে বলে, ‘আত্মহত্যা।’

আয়াশ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন? কি এমন কারণে এতো বড় একটা কাজ করলো তোমার ফ্রেন্ড?’

সন্ধ্যা আয়াশের দিকে তাকায় না। এই মানুষটার দিকে তাকালেই সে নিজেকে সামলাতে পারে না। কয়েকদিনের পরিচয়ের একটা মানুষ তার এতো আপন কিভাবে হলো? নিজের ভাবনাকে দুরে ঠেলে তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে,

‘সেদিন বলেছিলেন না এর আগে গ্রামে ফরিদ কাকার মতো আরো কাউকে মে’রে ফেলা হয়ছে! হুম। চেয়ারম্যান কাকা আর মেম্বার কাকার ছেলেরে মে’রে ফেলছে। ওই চেয়ারম্যান কাকার ছেলে আর মেম্বার কাকার ছেলের জন্য আমার সইয়েরা আত্মহত্যার মতো পাপকে বেছে নিয়েছে।’

কথাগুলো তো সবাই জানতো। তবুও সবাই দুঃখ প্রকাশ করে। সন্ধ্যা রহস্যময় এক হাসি বলে, ‘আরেকজন ছিলো ওকেও কেউ মে’রে ফেলছে। ওই যে আপনারা আসার পরেরদিন যে মেয়েটাকে মে’রে ফেলা হয়ছে ‘ও’ আমাদের সই ছিলো।’

লিজা বলে, ‘ওকে কেউ কেন মা’রলো?’

সন্ধ্যা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস নেয়। বলে, ‘জানি না।’

আয়াশ বলে, ‘তোমার ফ্রেন্ড মা’রা গেলো আর তুমি তার বিষয়ে একটু কষ্টও পাচ্ছো না!’

সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘বেই’মানদের জন্য কষ্ট পেতে নেয়।’

কথাাটা যেনো মুহুর্তেই পরিবেশকে অশান্ত করে তুললো। কিসের বে’ইমানির কথাা বলছে সন্ধ্যা? লিজা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিসের বে’ইমানি সন্ধ্যা?’

সন্ধ্যা হাসে। বকুল ফুল নাড়াচাড়া করতে করতে গুণগুণ করে গান ধরে। আয়াশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। এই সন্ধ্যা ভীষণ রহস্যময়। যতটা এর সৌন্দর্যের গভীরতা ততটাই রহস্যেরও গভীরতা। কিছু তো আছে যা জানে সন্ধ্যা আর নয়তো এসবের সাথে জড়িত। কিছুক্ষণ চুপ থাকে সবাই। সন্ধ্যা গান গাওয়া অফ করে সবার দিকে তাকায়। বলে,

‘কি হলো? সবাই চুপচাপ হয়ে গেলে কেন?’

লিজা আর জেরিন শুকনো ঢোক গিলে। বাকি সবাই নিজেদের গুছিয়ে নেয়। বলে, ‘তোমার গান শুনছিলাম।’

সন্ধ্যা হাসে। এক পলক আয়াশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে উঠে আসে আয়াশের সামনে। আয়াশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকায় তার দিকে। সন্ধ্যা হেঁসে বলে,

‘ফুল নিবেন শহুরে ডাক্তার?’

আয়াশ কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা সব ফুল আয়াশকে দিয়ে বলে, ‘এখন তবে যায়। পরে আসবো আবার।’

লিজা মাথা নাড়াতেই সন্ধ্যা চলে যায় হেলে দুলে। লিজা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘আ’ম কনফিউজড ইয়ার। কোন সন্ধ্যা সত্যি? এই স্নিগ্ধ রুপের সন্ধ্যাকে দেখলে কখনোই মনে হয় না ‘ও’ কোনো মা’র্ডার করতে পারে আবার সন্ধ্যার রহস্যময় কথা শুনলে অটোমেটিক মাথায় চলে আসে ‘ও’ নিশ্চয় এর সাথে জড়িত।’

রানা বলে, ‘হয়তো সন্ধ্যা কিছু জানে তবে আমার মনে হয় না সন্ধ্যা মাস্টারমাইন্ড!’

আকাশ বলে, ‘হ্যাঁ আমারও মনে হয় না। আর যদি ‘ও’ এসব করে থাকে তাহলে বলবো ভালো কাজ করছে। যাদের মা’র্ডার করছে তারা এমনিতেও বেঁচে থাকার যোগ্যতা রাখে না।’

জেরিন সায় দেয়। আয়াশ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘কিন্তু মুন্নি কি করছে? অবশ্যই মুন্নিকে মা’রার পেছনে বড় সড় কোনো কারণ আছে নয়তো সন্ধ্যা ওকে বে’ইমান বলতো না। কিছু তো আছে।’

সন্ধ্যা রাস্তায় এসে হেলে দুলে হাঁটতে থাকে। কি মনে করে আবার উল্টো ফিরে কবরস্থানের দিকে হাঁটা দেয়। কবরস্থানের সামনে শুনশান। সন্ধ্যা এসে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকায়। বৃষ্টির কারণে কবরের মাটি সরে গেছে তবুও নতুন দুইটি কবর জ্বলজ্বল করছে। সেই দুইটি কবরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে সন্ধ্যা। তারপর পুরোনো কবর গুলোর দিকেও তাকায়। নিজের প্রিয় তিনটি কবরের দিকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। সে সময় কেউ কাধে হাত রাখে। চমকে তাকায় সন্ধ্যা। সামনে বাদলকে দেখে খানিকটা হাসে। বাদল ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘তুই এসময় এখানে কি করছিস? কাকার কবর দেখতে এসেছিস?’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। বাদল সন্ধ্যার হাত ধরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘তুই মাত্র জ্বর থেকে উঠেছিস এখনই এমন উড়নচণ্ডীর মতো পুরো এলাকা রাউন্ড দিচ্ছিস কেনো?’

সন্ধ্যা খিলখিল করে হেঁসে বলে, ‘সন্ধ্যামালতীর কাজই তো এটা বাদল ভাই।’

সন্ধ্যার দিকে নিষ্পলক তাকায় বাদল। মেয়েটার হাসিতেও কি ভীষন রকমের মায়া! বাদল চোখ সরিয়ে নেয়। সন্ধ্যা কিছু একটা ভেবে বলে, ‘বাদল ভাই চলেন তো মুন্নির বাড়ি যায়।’

বাদল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ওখানে কেন যাবি?’

‘চলেন দেখে আসি ওর বাড়ির কি অবস্থা!’

বাদল আর না করে না। পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে থাকে। দুর থেকে একজন দেখে এ দৃশ্য। কার পাশে কাকে দেখে তার রাগ হচ্ছে তার জানা নেই। সন্ধ্যার পাশে বাদলকে দেখে তার রাগ হয় নাকি বাদলের পাশে সন্ধ্যাকে দেখে রাগ হয় জানা নেই।

________________

সকালের আলো ফুটতেই সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। কেবল বিছানা ছেড়ে উঠেছে সে সময় ছুটে আসে বকুল। চোখ মুখ ফুলে আছে, বিধ্বস্ত চেহারা। সন্ধ্যা দ্রুত এগিয়ে আসে বকুলের কাছে। বকুল সন্ধ্যাকে জাপটে ধরে। শব্দ করে কেঁদে উঠে। সন্ধ্যা ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘কাঁদছিস কেন? তোর এই অবস্থা কেমনে হলো?’

কান্নার দমকে বকুল কথায় বলতে পারতেছে না। অনেক কষ্টে সন্ধ্যা বকুলকে শান্ত করে। বকুল ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘ব-বাদল ভাইকে কারা যেনো অনেক মে’রে বাড়ির সামনে ফেলে গেছে।’

সন্ধ্যা চমকে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘বাদল ভাই ঠিক আছে তো বকুল?’

বকুলের কান্নার দমক বেড়ে যায় কোনো রকমে বলে, ‘ভাইয়ের মাথা ফেটে গেছে। সবাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে সন্ধ্যা।’

সন্ধ্যা আর কোনো কথা না বলে বকুলের হাত ধরে ছুট লাগায়। তার মাথায় আসতেছে না এমন কাজ কে করতে পারে! তবে কি এবার শিকার বাদল ভাই? কথাটা মাথায় আসতেই গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় সন্ধ্যার। ছুটতে থাকে হাসপাতালের দিকে….

চলবে..

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ❤️)
চলবে..

(আসসালামু আলাইকুম৷ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ❣️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here