#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| বারো তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
” আমি নির্দোষ। তার প্রমাণ খুব শীঘ্রই আপনি পেয়ে যাবেন মিস্টার নিলয় লীলাভ। তার আগে আপনি দোষী সেটার প্রমাণ আমি করব।”
” পুরো দুনিয়ায় এমন কোন মানুষ পাবে না যার মাধ্যমে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে।”
সন্ধ্যা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
” দেখা যাবে।”
নিলয় পায়চারি করছে। সন্ধ্যার অপরাধের ক্ষমা নেই। আবার পুলিশ ঝামেলা হলে সরকার বাড়ির ক্ষতি। আরিফ সরকার তো হৃদ যন্ত্রণায় ম’রে যাবে।
নিলয় সন্ধ্যার পানে তাকিয়ে উপলব্ধি করে সন্ধ্যার মুখের ভাবগতি। সন্ধ্যার মুখশ্রীতে অনুশোচনার কোন চিহ্নের ছিটে ফোঁটা নাই। নিলয় হতাশ হয়ে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
” তোমার মনে একটুও অনুশোচনা হচ্ছে না!”
” দোষ করলে তো অনুশোচনা হবে! আপনি কেন আমার পিছু পড়ে আছেন। আসল কালপ্রিটকে অনুসন্ধান করুন, কাজে আসবে।”
” সন্ধ্যাবতী! আসল নকল জানি না। প্রমাণ আমার হাতেই আছে। তবুও তোমার কথা বিবেচনা করে আমি নিজে তদন্ত করব। তোমার উপর সর্বদা আমার নজর থাকবে। আমি নিলয় নীলাভ সরকার বাড়ির কোন ক্ষতি হতে দিব না।”
———–
সন্ধ্যালয়ের আগমন ঘটেছে। ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। দোকানীদের দোকানে কেনা বেচা বেড়েছে। গাড়িতে দুজন মানব মানবী আরোহণ করে অজানা গন্তব্যস্থলে এগিয়ে যাচ্ছে। দুজনই নিশ্চুপ। নিলয় আড়চোখে কয়েকবার সন্ধ্যার দিকে তাকাচ্ছে। সন্ধ্যার মুখশ্রী একদম নিষ্পাপ। নিলয়ের বিশ্বাস হচ্ছে না যে সন্ধ্যাই আসল কালপ্রিট। নিলয়ের আজকের যাত্রা অজানা পথে। নিলয় মূলত সন্ধ্যার ভাবগতি পর্যবেক্ষণ করছে এত সময় নিয়ে। নিলয় ভাবছে, সন্ধ্যা সেদিন একাই অফিসে কাজ করছিল। কাজের মধ্যে এতটাই ডুবে ছিল যে নিলয়ের উপস্থিত সেদিন টের পায়নি। এছাড়াও সন্ধ্যাকে অফিসের গোপন কক্ষপথে নিয়ে যাওয়ার সময় হাজারটা প্রশ্ন করেছিল এবং র’ক্ত দেখে প্রচুর ভয় পেয়েছিল।
নিলয়ের ভাবনায় সন্ধ্যার ছোটবেলার একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়। নিলয় তখন দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে চলে যায়। নিলয় চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর নাকি সন্ধ্যা বাগানে জুয়েনা নামক একজন কাজের মহিলার সাথে খেলছিল। জুয়েনা ছিল কিশোরী বয়সী, বাড়ির বাহিরে বের হলেই পৃথিবী অন্যরকম মনে হতো। সেদিন বিকেলে সন্ধ্যার সাথে খেলছিল সে। পাশের বাড়ির দারোয়ানের নজর ছিল তার প্রতি। সবসময় বিরক্ত করতো। নিলয়ের বাবা অর্নব দারোয়ানকে অনেকবার সাবধান করেছিল যেন জুয়েনাকে জ্বালাতন না করে। দারোয়ান শুনেনি সেদিন, মনে হয়তো ক্ষো’ভ পোষণ করে রেখেছিল। সন্ধ্যার সাথে খেলা অবস্থায় সে আইসক্রিমের বায়না ধরে এতে জুয়েনার গেইটের বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সন্ধ্যাকে গেইটের কাছে দাঁড় করিয়ে সে বাহিরে যায়। আইসক্রিম আনার জন্য রাস্তা পাড় হতেই সেই দারোয়ান জুয়েনাকে জোর করে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায়। হাতের ধস্তাধস্তিতে জুয়েনা অনেক আহত হয়। এদিকে সন্ধ্যা জুনেয়ার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে চিৎকার করে অর্নব এবং নীরবকে ডাকতে থাকে। এতে আশেপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকে। দারোয়ান ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পেরে জুয়েনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে একটা গাড়িতে উঠে পালিয়ে যায়। এদিকে জুয়েনার মাথা রাস্তায় পড়ে থাকা ইঁটের সাথে লেগে ফে’টে যায়। র’ক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পিচ ঢালা রাস্তার রং পরিবর্তন হয়ে লাল রং হয়ে গেছে। জুয়েনার সাথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা সন্ধ্যার চোখের সামনে হয়েছে। র’ক্ত দেখে সন্ধ্যা ভয় পেয়ে যায় এবং রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সেই ঘটনার পর থেকে সন্ধ্যার র’ক্তে ফোবিয়া।
এই ঘটনা নিলয়ের মা নিলয়কে জানিয়েছিল। ঝাপটা বাতাসে নিলয় ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে। সন্ধ্যার পাসে তাকিয়ে দেখে সে বাহিরে দেখতে ব্যস্ত। আকস্মাত সন্ধ্যা চিল্লিয়ে উঠে,
” গাড়ি থামান।”
“কেন? পালিয়ে যাবে?”
নিলয়ের কথায় সন্ধ্যা বিরক্ত হয়। একে তো সন্ধ্যার রাগ লাগছে তার উপর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সন্ধ্যা দাঁতে দাঁত চেপে প্রতুত্তুরে বলে,
” আপনি তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অসভ্য দুর্লয়। না খেয়ে দিনে দিনে বয়স কমাচ্ছেন।”
” বেশী বলছো মিস ঐরাবতী।”
” আরে রাখেন বেশি কম। গাড়ি থামান চা খাবো।”
নিলয় কথা বাড়াতে চাচ্ছে না। গাড়ি একটা চায়ের টংয়ের পাশে দাঁড় করায়।
সন্ধ্যা এই নিয়ে তিন কাপ চা পান করে ফেলেছে। নিলয় এতে খুবই বিরক্ত। নিলয় খুব করে জানে সন্ধ্যা অপ্রকাশ্যে আর যাই করুক না কেন নিলয়কে শায়েস্তা করতে ঠিকই পারে। এই যে বর্তমানে নিলয়ের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। সন্ধ্যা খুব ধীরে ধীরে চায়ে ফু দিয়ে চা পান করছে। এমন ভাবে চা পান করছে যেন শেষ হয়ে যাবে। চতুর্থবার মত চায়ের অর্ডার দিতে নিলে নিলয় ক্ষেপে যায়।
” চা পান করতে করতে কী আজ রাত পার করে ফেলবে? এত ক্ষুধা লেগেছে বললেই তো হতো। রেস্টুরেন্টে তোমাকে পেট নয়, গলা ভর্তি করিয়ে খাইয়ে নিয়ে আসতাম।”
” খোটা দিচ্ছেন? আপনি কি ভেবেছেন আপনি একাই কোটিপতি? শুনুন মিস্টার অসভ্য দুর্লয়, আমার ব্যাগে এখনো টাকা আছে। আমার টাকা, আমার পেট, আমার গলা, আমার মুখ মুখ দিয়ে খাব তাতে আপনার কী?”
” বেশি বকবক না করে গাড়িতে ওঠো। দাদা ফোন করেছে। শীঘ্রই বাসায় যেতে বলেছে। মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
নিলয়ের মায়ের কথা শুনে সন্ধ্যা অর্ডার ক্যানসেল করে দেয়। নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দোকানিকে দিতে নিলেই নিলয় বাঁধা দেয়।
” আমাকে কি অকর্মঠ মনে কর? আমি কর্মজীবী মানুষ। কর্ম করে উপার্জন করি। আমার সামনে একজন মেয়ে বিল পরিশোধ করবে সেটা মানতে পারব না। যাও গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি চায়ের দাম দিয়ে আসছি।”
নিলয়ের কথা শুনে সন্ধ্যা দাঁত কেলিয়ে হাসে। ভুলে যায় অতীতের সব কথা। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে বলে,
” ইশ আমার টাকাটা বেঁচে গেল।”
সন্ধ্যার কথা শুনে নিলয় হাসে। মাথার চুলকে দোকানিকে টাকা পরিশোধ করে গাড়িতে এসে বসে।
——————-
সরকার বাড়ি আজ নিস্তব্ধ। আশেপাশে প্রতিটা বিল্ডিংয়ে আলো দেখা যাচ্ছে একমাত্র সরকার বাড়ি ছাড়া। এখন নিস্তব্ধ অন্ধকার পল্লী মনে হচ্ছে। মানুষদের আনাগোনা নেই। নিশ্বাসের আওয়াজ নেই। সন্ধ্যা ঘাবড়ে গিয়ে নিলয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়।
” ব্যাপারটা কী বলুন তো? বড়ো মার খারাপ কিছু হয়নি তো?”
” সবসময় উলটা পালটা না ভাবলে হয় না! মিস ঐরাবতী?”
” আমি কী করেছি। এমন অন্ধকারে ভয় পাচ্ছি তো!”
নিলয় সন্ধ্যার হাত আলতো করে ধরে ভিতরে প্রবেশ করে। একজন মানুষের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া, অহংকার, রাগের বাহিরেও আরেকটা দিক আছে সেটা হচ্ছে কোমল হৃদয়। নিলয়কে বর্তমানে একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক মনে হচ্ছে সন্ধ্যার কাছে যে খুব যত্নে সন্ধ্যার খেয়াল রাখছে। দেয়াল হাতড়ে নিলয় সুইচে চাপ দেয় সাথে সাথেই নীলিমা বেলুন ফুটিয়ে চিল্লিয়ে বলে, ” শুভ জন্মদিন ভাইয়া।”
নিলয় হাতের বন্ধনীতে দৃষ্টিপাত করে। এখন সময় বারোটা দশ মিনিট। নিলয় আশাপাশ ভালোভাবে তাকায়। জমজমাট আয়োজন না করা হলেও ঘরোয়াভাবে আয়োজনের কমতি নেই। পাশের রান্নাঘর থেকে পায়েসের মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে, সন্ধ্যার প্রিয় কালা ভুনারও ঘ্রাণ আসছে। এদিকে সন্ধ্যা আশেপাশে সূক্ষ্ম দৃষ্টি স্থাপন করে দেখতে পায় তার বাবা-মা এক কোণায় বসে আছে। নীরব সরকারের মুখ গুমরে রেখেছে এদিকে সন্ধ্যার মা স্বামীর ভয়ে চুপসে আছে। সন্ধ্যা জানে তার মার এখন ইচ্ছে করছে বড়ো মার সাথে গল্প করতে।
আরিফ সরকারের কথায় সন্ধ্যা বাবা-মার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
” বয়স তো অনেক হয়েছে। বিয়ে করবে কবে নিলয়?”
জন্মদিনের আনন্দের সময় মুরুব্বিদের ঠাট্টা মশকরা হয়েই থাকে। নিলয় দাদার কথায় ভীষণ লজ্জা পায়। নীলিমা ভাইয়ের হাত ধরে সোফায় নিয়ে বসায়। নিলয়ের মা ছেলের মুখে মিষ্টি তুলে দেন। কেক কাটার পর্ব আগামীকাল হবে। আরিফ সরকার সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
” আগামীকাল আমার নাতির জন্মদিন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। পরিবারের সকলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে। আমার যেন কাউকে ডাকতে না হয়। এখন সবাই একসাথে রাতের খাবার খাবো। বড়ো বউ, সুমি? টেবিলে খাবার দাও।”
মেজ ছেলেকে ইঙ্গিত করে বলা কথাটা পরিবারের সকলে বুঝতে পারেন। আরিফ সরকারের কথা অমান্য করার সাধ্য কারোর নেই। সুমি স্বামীকে উপেক্ষা করে নিলয়ের মায়ের কাছে আসেন। দীর্ঘ বছর পর বড়ো বোনকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।
নীরব সরকারের কাছে এমন আদিখ্যেতা ভালো লাগছে না। সে অচল নয়তো একাই চলে যেত নিজ গৃহে। এদিকে সে সুমিকেও হাতের নাগালে পাচ্ছে না যে কিছু বলবে। অবশেষে সন্ধ্যাকে ডেকে বলে,
” সন্ধ্যা আমাকে উপরে নিয়ে চলো। এখানে আর ভালো লাগছে না। আর তুমিও আমার সাথে উপরে চলো। তোমার মায়ের ক্লাস আমি পরে নে।ব আমার আদেশ অমান্য করা বের করব।”
সন্ধ্যা বাবাকে হুইলচেয়ারে ধরে। উদ্দেশ্য নিজেদের বাড়ির দিকে। পথিমধ্যে আরিফ সরকার এসে পথ আটকায়। হুইল চেয়ারের সামনে সামনে এসে দাড়িয়ে বলে,
” তোমার সাহস তো কম নয়, আমার কথা অমান্য করো? আমার সাথে কথা বলছো না ঠিক আছে। তাই বলে তোমাদেরকে এত আদর সোহাগ করে যেই ভাবী বড়ো করেছে তার কথাও অমান্য করবে? সে এত কষ্ট করে তোমাদের জন্য রান্না করছে সেটা প্রত্যাখ্যান করে চলে যাবে? যাও খাবার টেবিলে গিয়ে বসো।”
বাবা মেয়ে দুজনেই আরিফ সরকারের সামনে মাথা নত করে ফেলে। নীরব সরকার মেয়েকে ইশারা দেন খাবার টেবিলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যা তাই করে বাবাকে নিয়ে এগিয়ে যায় খাবার টেবিলের কাছে। আজ নীরব সরকারের মুখের বুলি শেষ হয়ে গেছে।
অনেকদিন পর পুরো পরিবার একসাথে খাবার খাচ্ছে। আরিফ সরকারের চোখ শীতল হয়ে আসে। নিলয়ের মা সকলের উপস্থিতিতে নিজের স্বামীকে খুব মনে করেন। আজ যদি তার স্বামী এখানে থাকতো তাহলে কত সুখে থাকতো তারা ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করেন।
—————
আজকে অফিসে কাজের চাপ বেশি। সন্ধ্যাবতী সকাল থেকে দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছে না। নতুন প্রজেক্টে হাতে আসার পর আজ প্রথম সকাল। নিলয় সহ কয়েকজন গিয়েছে নতুন ফ্যাক্টরিতে। আর এখানে সমস্ত অফিসের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে সন্ধ্যার হাতে। কিছুক্ষণ পরপরই এক এক করে ফাইলের সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে তাকে। এমনিতেও সন্ধ্যা সকাল থেকে না খাওয়া তারমধ্যে এত কাজ করতে করতে বেহাল দশা তার।
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সন্ধ্যা। শরীরকে একটু জিরিয়ে নিতে চাইছে সে। ক্ষুধার্ত পেটে ইতিমধ্যে গুরগুর ডাক ডাকছে। নাকের সামনে নুডলসের ঘ্রাণ আসায় সন্ধ্যা চোখ খুলে তাকায়। আকাশ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গরম নুডলসের বাটি।
” খাইয়া নে জানু। তোর জন্য কত কষ্ট করে রান্না করে নিয়া আসছি।”
সন্ধ্যা খাবার হাতে নেয়। চামচে দুই তিন ফু দিয়ে খাফার মুখে পুরে নেয়। নুন,মরিচ, সস, মসলায় খাপে খাপ। আকাশকে কিছু না বলে গাপুস গুপুস করে খেয়ে নেয় সে। আকাশ তৃপ্তি হাসে পাশে তাকিয়ে কাউকে হাতের ইশারায় সব ঠিক আছে জানায়।
কেউ একজন আকাশের ইশারা পেয়ে সন্তুষ্টি হয় এবং চলে যায় নিজ কাজে।
” হ্যাঁ রে, আক্কাইস্সা। এত ভালো রান্না কবে শিখলি রে? তোর বউয়ের তো আর কষ্টই হবে না। যা মজা হয়েছে না?”
” আরে কি যে বলিস সন্ধ্যা! আমি তো অল রাউন্ডার।ঘরের কাজ বা অফিসের কাজ আমি এক তুড়িতে করে ফেলতে পারি।”
সন্ধ্যা হাসে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে,
” তবে যাই বলিস, তোর নুডলস রান্নায় আমি বড়ো মায়ের স্পেশাল মসলার স্বাদ পেয়েছি। তুইও কী রাজশাহী থেকে স্পেশাল মসলা কিনে এনেছিস নাকি?”
সন্ধ্যার কথা শুনে আকাশ শুকনো কাশে। তুতলে উত্তর দেয়,
” আরে হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ মসলা খুব কষ্টে পেয়েছি দোস্ত! আচ্ছা আমি এখন যাই। তুই কাজ কর।”
আকাশ কোনরকম নিজের জীবন বাজি রেখে চলে যায়। সন্ধ্যা এতকিছু না ভেবে কাজে মন দেয়।
দুপুরে বিরতির সময় সন্ধ্যা সকলের চোখের আড়ালে অফিস থেকে বের হয়ে আসে। নিলয় অনুপস্থিত এই সুযোগে সন্ধ্যা নিজর কার্যসিদ্ধি সম্পূর্ণ করতে চাইছে। নিলয় সন্ধ্যাকে নিয়ে আসা সেই গোডাউনে সে সময় নিয়ে পৌছায়। গোডাউনের সামনে দুইজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে আছে তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা অসম্ভব। সন্ধ্যা অপেক্ষা করছে যেন কোন চমৎকার হয়। সন্ধ্যার দোয়া যেন কবুল হয়ে যায়। দুজনের মধ্যে একজন প্রাকৃতিক প্রয়োজনে দূরে চলে যায়। একজনকে সামলানো এতটা কষ্টের হবেনা সন্ধ্যার জন্য। বুদ্ধি খাটিয়ে একজনকে দূরে নিতে হবে। সে একটি ইটের টুকরা গোডাউন থেকে কিছু দূরে নিক্ষেপ করে। তৎক্ষণাৎ থেকে যাওয়া পাহাদার কে কে বলে আওয়াজের উৎসের দিকে চলে যায়। সন্ধ্যা এই সুযোগে গোডাউনের ভেতর প্রবেশ করে।নিলয়ের সাথে আসার সময় যেভাবে তারা এক এক ধাপ পেরিয়ে প্রবেশ করেছিল ঠিক সেভাবেই সে প্রবেশ করে।
পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে সন্ধ্যা কোন কিছুই খুঁজে পায় না যার দ্বারা নিরয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে
সন্ধ্যা হতাশ হয়ে যায় গোডাউন থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে একটি মোটা রডের দিকে নজর পড়ে। যেখানে শুকনো র’ক্ত লেগে আছে। সন্ধ্যা খুব দক্ষতার সহিত হাতে কাপড় প্যাচিয়ে লোহার রড হাতে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার সামনে আসতেই সন্ধ্যা লক্ষ্য করে দুজন পাহারাদার একে অপরে আলোচনা করছে। সন্ধ্যা সুযোগ বুঝে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।
কাকতালীয়ভাবে নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে সন্ধ্যা সেখানে প্রবেশ এবং বের হতে পেরেছে তা সন্ধ্যার অজানা। সে শুধু এতটুকু জানে, যেভাবেই হোক রাব্বির খু’নে’র শা’স্তি নিলয়কে পেতেই হবে। সন্ধ্যা নিজে শা’স্তি দিবে।
চলবে……..
[আসসালামু আলাইকুম। গল্পটা যারা পড়বেন কষ্ট করে রেসপন্স করবেন।]#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| তেরো তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
প্রদোষকালের অগ্রভাগে দূর আকাশের নিলীমায় লাল আভা সরে গিয়েছে। ধরণীতে অন্ধকারের আগমন ঘটেছে। পুরো আকাশ গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। প্রকৃতির গুমোট রূপে হাজির যখন তখন পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি ঝড়ঝড় করে ঝড়ে পড়বে।
বাহিরের পরিবেশের গুমোট রূপেও আজ সরকার বাড়ির অন্দরমহলে ঝলমলে করে তুলেছে। নানান সাজ সজ্জায় সজ্জিত সরকার বাড়ির অন্দর মহল। বিশিষ্ট ব্যাক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ আজ উপস্থিত হয়েছেন সরকার বাড়িতে।
নিলয় পূর্বের মত কোন ত্রুটি রাখতে চায়নি অনুষ্ঠানে তারজন্য এবারের অনুষ্ঠান বাগানে না করে সরকার বাড়ির অন্দরমহলে আয়োজন করেছে। আরিফ সরকার তার রাজকীয় চেয়ারে বসে সবকিছু পর্যালোচনা করছেন। আজ সরকার বাড়ির বঁধূরা অনুষ্ঠানে শামিল হয়েছেন। নিলয়ের মা এবং সন্ধ্যার মা আজ কয়েক বছর পর মন খুলে গপিস করছে। ফারুক সরকারের বউ বাবার বাড়ি। নিলয় মা-চাচীর খোশ গল্প দেখে হাসে। চোখ বারবার ঘুরিয়ে সন্ধ্যাকে খোঁজ করে সে।
” সন্ধ্যা আপু, দরজা খুলো। আমি নীলিমা।”
ল্যাপটপের স্ক্রিনে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু দেখছে সন্ধ্যা। নিচের জমকালো অনুষ্ঠানের দিকে মন নেই তার। নিলয়কে দোষী প্রমাণ করতে এবং নিজ হাতে ধ্বংস করতে তার এত ব্যস্ততা। নীলিমার ডাকে সে ভয় পেয়ে যায়। ল্যাপটপের কাজ আংশিক রেখেই উঠে পড়ে সে। দরজা খুলতেই নীলিমার হাস্যজ্বল মুখশ্রী সে দেখতে পায়। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সে তাকায় তা দেখে নীলিমা মুখ ফুলিয়ে বলে,
” আমি বড়ো আপুর আদর পাওয়ার জন্য দিবারাত্রি ছটফট করছি। একটু আদর দিবে আপুনি?”
সন্ধ্যার চোখ ভরে আসে জলে। দুই হাত বাড়িয়ে দেয় নীলিমার দিকে। এই মেয়েকে সন্ধ্যাবতী খুব ভালোবাসে। দূর থেকে শুধু নীলিমাকে বড়ো হতে দেখেছে সন্ধ্যা। সে দেখেছে ছোট বোনের ছটফটে ভাব। ছোট বেলা সন্ধ্যার কাছাকাছি থাকতে চাইতো সদা। সন্ধ্যা এড়িয়ে চলতো। আজ বুকের পাথর সরিয়ে ছোট বোনকে আলিঙ্গন করে নিল সন্ধ্যা।
” মিস ইউ বেবি ডল লিলিপুট!”
নীলিমার সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয় তার চোখেও পানি। হাতের শপিং ব্যাগ সন্ধ্যাকে দেখিয়ে সে বলে,
” আমাকে সাজিয়ে দাও আপুনি। আম্মু ছাড়া আমার চুল বাঁধা হয় না।”
নীলিমার বাচ্চামো দেখে সন্ধ্যার মন ভালো হয়ে যায়। নীলিমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় সে। গোলাপী গাউনে সন্ধ্যাকে পরী দেখাচ্ছে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে সন্ধ্যা নীলিমার কটালে চুমু এঁকে বলে, ” মাশাআল্লাহ আমার লিলিপুটকে সত্যি সত্যিই বেবি ডল লাগছে।”
বড়ো আপুর মুখের তারিফ শুনে নীলিমার ঠোঁটের হাসি আরো প্রশস্ত হয়। সে সন্ধ্যাকে ছেড়ে সারা ঘর ঘুরঘুর করে দেখছে। ল্যাপটপের সামনে যেতেই নীলিমা দাঁড়িয়ে যায়। ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিলয়ের নাম দেখে সন্ধ্যাকে প্রশ্ন করে সে,
” ভাইয়ার সাথে ঝগড়া লেগেছো নাকি? লাল কালি দিয়ে ভাইয়ার নামের উপর ক্রস চিহ্ন দিয়েছ যে?”
” তোমার ভাইয়ের সাথে কঠিন হিসাবনিকাশ বাকী আছে। সেই কাজই করছি।”
নীলিমার মাথায় কিছুই ঢুকেনি। সে সন্ধ্যার সামনে এসে বলে,
” তুমি ভাইয়াকে আমার মত ভালোবাসতে পারো না? ভাইয়া তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”
” ভালোবাসা যে কেড়ে নেয় সে কী আদৌও ভালোবাসতে পারে? একজন মানুষের মনে ভালোবাসা থাকলে সে কখনো অপরজনের ভালোবাসাকে দূরে সড়াতে পারে না।”
সন্ধ্যাকে তৈরী হতে না দেখে নীলিমা অবাক হয়ে যায়। সন্ধ্যার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে,
” আপু তুমি তৈরি হবে না?”
” আমি সেখানে যাব না। তুমি চলে যাও লিলিপুট।”
” আমি তোমাকে ছাড়া এক পা এগোবো না। এই আমি বিছানার উপর বসলাম। তুমি এখনই তৈরি হয়ে আমার সাথে নিচে যাবে।”
নীলিমার জিদের কাছে সন্ধ্যা হার মানে। নীলিমার সাথে ম্যাচিং করে শাড়ি পড়ে নেয় সে। হালকা একটু সেজে কানের বড় পাথরের ঝুমকো পরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দুই বোন।
নিলয় বারবার হাতের বন্ধনীতে তাকাচ্ছে। কাঙ্খিত একজন মানুষের অপেক্ষা করছে সে। সরকার বাড়ির প্রধান ফটকে এই নিয়ে বিশ বারের মতো নজর দিয়েছে সে। কাঙ্খিত মানুষের কোন আভাস নেই। সে মানুষটা না আসলে যে নিলয় অনুষ্ঠান শুরু করতে পারবে না।
” স্যার কিছু কথা ছিল।”
আকাশের ডাকে নিলয়ের স্তম্ভিত ফিরে আসে।
” বলো আকাশ, কি বলবে?”
” আপনি আমাকে যেই কাজটা দিয়েছেন সেই কাজ শেষ করেছি। এফাইলে আপনার দেওয়া কাজের এ টু জেড সবকিছু পাবেন। সবচেয়ে আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে, কয়েকমাস পূর্বে যে মারা গেছে সে আমাদের অফিসের কেউ না। যাকে সন্দেহ করেছিলাম সে গ্রামে চলে গিয়েছিল আপনাদের বাসার অনুষ্ঠানের পর পরই।”
নিলয় চিন্তায় পড়ে যায়। রহস্যের সমাধান যে কবে,কীভাবে হবে সেটাই ভাবছে সে। আকাশের সাথে আলোচনার মধ্যে নিলয়ের সিঁড়ির দিকে নজর যায়। নিলয়ের পুরো দুনিয়া সেখানেই থমকে যায়, চোখ জোড়া স্থির হয়ে যায়। গোলাপি রঙে গোলাপি পরী সেজে সন্ধ্যা নিচে নামছে। কানের বড়ো ঝুমকা সন্ধ্যার হাসির তালে দুলছে। নিলয় চোখ বন্ধ করে নেয়। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ঠিক করে নেয়। নিলয় ভাবে সে আর সেদিকে তাকাবে না কিন্তু অবাধ্য চোখ জোড়া সেদিকেই চলে যায়। সন্ধ্যা কাছাকাছি আসতে নীলিমা ঘুরে বলে,
“আমাকে কেমন লাগছে ভাইয়া?”
নীলিমার প্রশ্নের উত্তরে নিলয় আনমনে উত্তর দেয়,
” অপূর্ব।”
নীলিমা ভাইয়ের চাহনি অনুসরণ করে। সন্ধ্যার দিকে তার স্থির চাহনি। মুচকি হেসে সে বলে,
“অপূর্ব আমাকে লাগছে। নাকি সন্ধ্যা আপুকে লাগছে?”
নীলিমার পাকা কথা পাশ থেকে রেহানা শুনে ফেলে। নীলিমার কান শক্ত করে ধরে বলে,
“ওরে পাকা মেয়ে! এত পাকা পাকা কথা শিখেছিস কবে থেকে? আর এদিকে আয় দেখি, তোর মাথার চুলগুলো ঠিক করে দেই।
সন্ধ্যাকে দেখে আকাশের ইচ্ছে করছে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। সন্ধ্যাকে এতটাই প্রিটি লাগছে যে আকাশের ইচ্ছে করছে সন্ধ্যাকে বসিয়ে তাকিয়ে থাকতে। মনের অনুভূতি গোপন রাখলেও মুখের কথা আটকে রাখতে পারে না আকাশ। নিলয়ের সামনেই বলে,
” দোস্ত তোরে যা লাগছে না! বিশ্বাস কর দোস্ত, তোরে যদি আমি জানের জিগার দোস্ত না বানাতাম তাহলে একটা চান্স নিতাম এবং আজকে তোকে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম।”
নিলয় আকাশের কথা শুনে ভ্রু কুচকায় সন্ধ্যা তা দেখে দাঁতের দাঁতে চেপে বলে,
” মুখে লাগাম দে আক্কাইস্সা। তোর যেন জন্য যেন আমার বাঁশ খেতে না হয়।”
আকাশ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে দাঁড়িয়ে রয় তা দেখে নিলয় আকাশের উদ্দেশ্য বলে,
” আপনার মা-বাবার নাম্বার দেন তো মিস্টার আকাশ। তাদেরকে বলি তাদের ছেলের অতি শীঘ্রই বিবাহের ব্যবস্থা করতে। কেননা তাদের ছেলের নজর আজকাল বড্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আর মুখের কথা নাই বললাম। মুখ তো যেখানে সেখানে অনবরত চলছে। দিন দিন নাম্বার দিন।”
আকাশ শুকনো ঢোক গিলে। সন্ধ্যা নাক মুছে বিড়বিড় করে বলে,
” ফেঁসেছে ফেঁসেছে আক্কাইস্সা ফেঁসেছে।”
আকাশ নিলয়ের দিকে বোকা হাসি ছুঁড়ে বলে,
” দুঃখিত স্যার আর কোনদিনও মেয়েদের দিকে তাকাবো না। সরি সরি মেয়েদের সাথে কথাই বলব না। আর সন্ধ্যার সাথে তো আরো আগে না। তবুও আমার বাবা মার নাম্বার চাইবেন না। আমি বাবা মাকে খুব ভয় পাই। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না। আর আমার ভালবাসার মানুষ আছে তাকে আমি খুব ভালোবাসি বিয়ে করলে তো তাকেই করব। সন্ধ্যা আমার জানের জিগার দোস্ত। এমনি মজা করলাম আর কি।”
আকাশ বরাবরের মতো সন্ধাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে চলে যায় অন্য প্রান্তে। নিলয় সন্ধ্যা দুজনেই নীরব। আকাশ সন্ধ্যার সামনাসামনি দাঁড়ায়। সন্ধ্যার ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে। সন্ধ্যার একদম কাছাকাছি এসে বলে,
“ভালোবাসা অঙ্গীকার বলতে পারো। তুমি যদি কাউকে ভালবাসো আর প্রতিশ্রুতি নাও তার কাছে থাকার। দেখবে মায়া কাটাতে পারবেনা। সে চিরদিনের মত চলে গেলে মৃত লাশ হয়ে যাবে। ভালোবাসাকে এতটা সস্তা মনে করো না সন্ধ্যাবতী। ভালোবাসার মানুষটি খাঁটি হলে সে তোমাকে মন থেকে ভালবাসবে। ফেলে চলে যাবে না।”
” আমাকে এসব বলার কারণ কি জানতে পারি মিস্টার অসভ্য দুর্লয়?”
” প্রয়োজনীয় তাই বললাম।”
” ভালোবাসা তো আপনি কেড়ে নিয়েছেন। প্রতিহিংসার সৃষ্টি করেছেন মনে। প্রতিশোধ নিতে বাধ্য করেছেন। আপনার জন্য এমনকি পৃথিবীর কোন পুরুষের জন্য মনে কখনো অনুভূতি তৈরি হবে না। আপনি কি জানেন মিস্টার নিলয় নীলাভ! আপনি শুধুমাত্র ঘৃণার পাত্র!”
সন্ধ্যার কর্কশ কথা শুনে নিলয়ের মাথা গরম হয়ে যায়। সকলের আড়ালে সন্ধ্যবতীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় সরকার বাড়ির বাহিরে। সন্ধাকে একদম নিজের কাছে টেনে এনে বলে,
” এত ঘৃণা! কার জন্য এত ঘৃণা করছো যে কিনা তোমাকে ভালোবাসেনি। তোমাকে বোকা পেয়ে শুধুমাত্র ব্যবহার করেছে যে! এমন কিছু করিও না সন্ধ্যাবতী যার কারণে পরবর্তীতে আফসোস করবে। মনে রেখো আমি তোমার চেয়ে বড় এবং আমি যা করি ভেবেচিন্তে করি।”
সন্ধ্যা নিজেকে নিলয়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলে,
” তাই বলে আপনি তাকে মে’রে ফেলবেন? এত বুঝেন আপনি? কেন করলেন এমন, কেন আমার ভালোবাসাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। আপনার কাছে তো সব আছে। আমার কাছে তো শুধু এই ভালোবাসাটাই ছিল তাকেও কেড়ে নিয়েছেন। আমার হাসির কারণ কি আপনার সহ্য হয় না? তাকে আপনি আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। কেন, কেন?”
” শান্ত হও সন্ধ্যা। আমি কাউকে হ’ত্যা করিনি। সেই ঘটনা কেবলমাত্র দুর্ঘটনা ছিল। তাকে আটক রেখে আমি তোমার নিকট শুধু প্রমাণ করতে চাইছিলাম যে সে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”
সন্ধ্যা থামে না ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। এতদিনের জমানো সকল দুঃখ আজ কান্নার মাধ্যমে ধুয়ে মুছে দিচ্ছে সে।
সরকার বাড়িতে প্রধান ফটকে একটি গাড়ি প্রবেশ করায় নিলয় এবং সন্ধ্যা দুজনে সেদিকে তাকায়। নিলয় সন্ধ্যার কাছাকাছি এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
” তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না সন্ধ্যাবতী। আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন তোমার চোখে মুখে আমার জন্য ঘৃণা নয় বরং অন্য কিছু দেখব। এবার চলো আমার সাথে, প্রধান অতিথি এসেছে। আপ্যায়ন করতে হবে এবং সেখানে আমাদের দুজনেরই উপস্থিত থাকতে হবে। ”
—————
অনুষ্ঠান জমজমাটভাবে আয়োজন করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানের পরিচিত মুখদের মধ্যে একটি মাত্র অপরিচিত মুখ রয়েছে সে হচ্ছে রাফসান। নিলয়ের জন্মদিনের প্রধান অতিথি রাফসান। যার আগমনে নিলয় খুব খুশি হয়েছে।
সন্ধ্যার রাফসানকে দেখামাত্রই আবারো ভাবনায় ডুবে যায়। লোকটার চোখ দুটো সন্ধ্যার খুব চেনা। হাঁটার ধরণ তার পরিচিত। ফুল দিয়ে স্বাগতম জানার সময় রাফসানের হাতের সাথে সন্ধ্যার হাত স্পর্শ করে। সন্ধ্যা রাফসানের দিকে তাকালে দেখতে পায় রাফসান বাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বর্তমানে রাফসানকে সন্ধ্যার কাছে উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে।
কেক কা’টা’র মুহূর্তে নিলয়ের মা সন্ধ্যাকে নিলয়ের পাশে দাঁড় করায়। দূর থেকে মন ভরে দুজনকে দেখে নেয়। বলা তো যায় না কখন আবার এমন সুযোগ আসবে।
নিলয়ের সকল ব্যস্ততা রাফসানকে ঘিরে। তাকে যদি কোন ভাবে খুশি করা যায় তাহলে তাদের প্রজেক্টটা আরো ভালো আগাবে।
কেক কা’টা হলে নিলয় আরিফ সরকারের মুখে তুলে দেয়। এরপর তার মাকে খাওয়ায় এরপর নীলিমাকে। এরপর কেক হাত চলে যায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার মনোযোগ অদূরে বসা রাফসানের দিকে। এখানে কে কি করছে না করছে তার দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সন্ধ্যার মুখের সামনে কেক ধরায় সন্ধ্যা নিলয়েরর মুখের দিকে ফিরে তাকায়। দরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটায় সে খুবই বিরক্ত।
” কি! খেতে বলছি। আমাকে দেখতে বলিনি। আমি জানি আমি অনেক সুদর্শন এবং তোমার চোখে বুড়া লোক।”
সন্ধ্যা ভেংচি কে’টে অল্প একটু কেক মুখে নেয়। নিলয় বাঁকা হাসে। সন্ধ্যা চলে যেতে নিলেই হাত আটকে ধরে এরপর সন্ধ্যা খাওয়া অংশ থেকে কেক মুখে ঢুকিয়ে বলে,
” কেক অনেক মিষ্টি, তাই না মিস ঐরাবতী?”
” আপনি ইচ্ছে করে এমনটা করেছেন তাই না! আমি আপনাকে,,,,,
” এই মেয়ে চুপ। সবসময় শরীরে এত কারেন্ট থাকে কেন। হ্যাঁ! যখন তখন শুধু আমার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে।”
সন্ধ্যা কিছু বলতে নেবে তার আগেই আরিফ সরকারের কথা কানে ভেসে আসে। নিলয় সন্ধ্যার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে দাদার কাছে চলে যায়। টেবিলের পর থেকে এক টুকরো কেক দাদার মুখে কেক ঢুকিয়ে বলে,
” দাদা দোয়া করে দাও।”
আরিফ আজাদের মন আজ ভীষণ খুশি। নিলয়ের কথার প্রত্যুত্তরে বলে,
” কি দোয়া করব। যেন সন্ধ্যার মত বউ পাও!”
নিলয় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় আড়চোখে আরিফ আজাদের মুখের ভাবভঙ্গি বুঝে নেয়।
” বুড়ো হয়েছ এখনো তোমার দুষ্টুমি যায় নাই, তাই না! আমি বিয়ে করছি না। মেয়ে মানুষ প্রতারক হয়। তারা ছেলেদের মন ভাঙতে জানে, ভালোবাসতে জানে না।”
” আচ্ছা! তাহলে আমার নাতনিকে এত যত্ন করে কেক খাইয়ে সেই অংশ আবার মুখে নিলে বিষয়টা কেমন না!”
নিলয় বুঝতে পারছে আরিফ সরকার আজ তাকে ইচ্ছা মতো ধুলাবে। তাই মুঠোফোনে কল আসার বাহানা করে কাজ সামনে থেকে কে’টে পড়ে সে।
নিলয় আশেপাশে তাকিয়ে সন্ধ্যাকে খুঁজছে। কিন্তু সন্ধ্যার কোন খবর নেই। অবশেষে সন্ধ্যাকে খুঁজে পায় নীলিমার সাথে। দুই বোন মিলে সেলফি তুলছে। নিলয়ের একটু হিংসে হলো যেন দুই বোনের উপর। নিলয়কে একটু সাথে নিলে কি হয় তাদের? নিলয় গায়ের ব্লেজার ঠিক করে একটু ভাব নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে দুই বোনের ঠিক পিছনটা গিয়ে দাঁড়ায়।
” এখানে কি হচ্ছে শুনি?”
সন্ধ্যা নিলয়কে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকায়। সন্ধ্যা যেখানে যাচ্ছে নিলয় ঠিক সেখানেই চলে আসে। ব্যাপারটা তার মোটেও পছন্দ না। তাই সে নিলয়েরকে খোঁচা দিয়ে বলে,
” আপনাকে বলা যাবে না। এখানে এসেছেন কেন? আপনার যত অতিথি আছে তাদের সমাদর করুন। যান এখান থেকে।”
” আজকাল আপনার মুখ একটু বেশি চলে মিস ঐরাবতী। আপনি ভুলে যান যে আমি আপনার,,,,,,
নিলয়ের পুরো কথা শেষ হতে দিল না সন্ধ্যা তার আগেই বলে,
” হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি আমার বস লাগেন। আপনি আমার গুরুজন হন। আপনি আমার বয়সে খুবই বড়ো। আপনি অনেক বুদ্ধিমান, আপনি হেন আপনি তেন। ভাই! এবারে মাফ করুন। বাড়িতে অন্ততপক্ষে মন ভরে শ্বাস নিতে দেন।”
নিলয় ভ্রু কুঁচকায়। সন্ধ্যার মুখের চঞ্চলতা দেখে মনে মনে খুশি হয়।
“আমি তো বস বলতে চাইনি। বলতে চেয়েছিলাম আজকে আমার জন্মদিন। সো যেখানে পরিবারের সবাই থাকবে সেখানে আমিও থাকব।”
দুজনের কথা কাটাকাটিতে নীলিমা বাচ্চাটা খুবই বিরক্ত।
” তোমরা দুজন সারাক্ষণ কি ঝগড়াই করে যাবে! আসো সেলফি তুলি।”
নীলিমা সামনে সন্ধ্যা আর নিলয় তার থেকে একটু দূরে। দুজনে এখনো ঝগড়া করছে। আঙ্গুল তুলে। এর মাঝেই ক্লিক। সুন্দর একটি ঝগড়াটে ছবি উঠে পড়েছে নীলিমার ফোনে।
নীলিমা কোমড়ে হাত দিয়ে দুজনের সামনে দাঁড়ায়।
” দিলে তো ছবিটা নষ্ট করে? তোমরা সারাদিন এত ঝগড়া করো কেন। একটা কাজ কর, তোমরা ঝগড়া না করে দুষ্টু মিষ্টি আলাপ করো। দেখবে তোমাদের মাঝখানে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।”
সন্ধ্যা নিলয়ের পাশ থেকে নীলিমার কাছে দাঁড়ায়। নিলয়ের দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বলে
” দুষ্টু মিষ্টি কথা! আর সেটা তোমার এই ডাম্বল মার্কা ভাইয়ের সাথে? অসম্ভব। তোমার ভাই হচ্ছে আস্ত একটা অসভ্য, রা’ক্ষ’স। এর সাথে কখনো মিষ্টি কথা বলা যায় না। তেতো কথা এর জন্য ঠিক আছে।”
সন্ধ্যা নিলয়কে ফেলে আবারো চলে যায়। সেখান থেক যাওয়ার আগে আঙ্গুল তুলে বলে যায়,
” আমার একদম আমার পিছু নিবেন না। নয়তো নাকে এমন একটা ঘুসি দিব যেন নিজের নাম ভুলে যান।”
নিলয় আজ মন খুলে হাসছে। সন্ধ্যার পাগলামি দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছে। এদিকে নীলিমা দুজনের কান্ড দেখে মাথায় হাত দিয়ে চলে যায় মায়ের কাছে আজকের ঘটনা বলার জন্য।
আজ সন্ধাকে একটু না, একটু বেশি জ্বালাতে ইচ্ছে করছে নিলয়ের। তাইতো সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যার পেছনে ছুটে।
—————–
আসমান গাঢ় অন্ধকার। এলোমেলো বাতাস বইছে। সন্ধ্যা ছাদে চলে আসে। দু হাত মেলে রয়েছে। এতে বাতাস সন্ধ্যার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফোনের ম্যাসেজের টিংটং আওয়াজে সন্ধ্যার সতেজ মন নষ্ট হয়ে যায়। মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে ম্যাসেজ অপশনে ক্লিক করে ম্যাসেজ দেখে সন্ধ্যার শরীর কাঁপতে থাকে। ফোন হাত থেকে ফেলে দেয় সে। মাথার কেশব টেনে বলে,
” এ হতে পারে না। সে কীভাবে আসবে! সে তো ম’রে গেছে, আমারই চোখের সামনে।”
চলবে……….