সন্ধ্যালয়ের প্রণয় পর্ব -১০+১১

#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| দশম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌

” একে তো করেন চু’রি এখন আবার করতে চাচ্ছেন সিনা চু’রি? আমি পারব না। নিজের হাতে খান।”

” খাবো তো? বিষক্রিয়া পরীক্ষা করতে চাইলে খাইয়ে দিতে হবে।”
” পারব না।”
” ভেবে বলছো তো? আমার সাথে যেহেতু আছো রাতের খাবার খেতেই হবে। আর এখানে অন্য কাউকে দিয়ে যদি পরীক্ষা করাতে চাও তাহলে আমি নিষেধ করব না। বুঝোই তো নামিদামি রেস্টুরেন্ট, বদনাম হলে দোষ তাদের উপর যাবেনা তোমার উপরেই আসবে। এখন ডিসিশন তোমার। কি করবে বলো।”

” অসভ্য দুর্লয়, আমি জানি আপনি আমাকে ইচ্ছে করে এখানে ফাসিয়েছেন।”

সন্ধ্যার কথায় নিলয় বাঁকা হেসে বলে,
” কুইক সন্ধ্যাবতী,সময় খুবই কম।”

গোমড়ামুখো হয়ে সন্ধ্যা এক চামচ খাবার নিলয়ের মুখের সামনে ধরে তা দেখে নিলয় ভ্রু কুঁচকায়

” আল্লাহ তোমাকে এত সুন্দর হাত দিয়েছেন জাদুঘরে সাজিয়ে রাগার জন্য? হাত দিয়ে খাওয়াও।”

আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। সন্ধ্যার মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে গেছে। অগ্নিরুপ ধারণ করেছে সে। খাবারের চামচ শব্দ করে টেবিলের উপর ফেলে হাত না ধুয়েই লোকমা বানাতে থাকে সে। নিলয় সন্ধ্যার রাগ খুব ভালো ভাবে উপভোগ করছে। এই তেজী সন্ধ্যা নিলয়ের খুব পছন্দের। নিলয়ের মুখের সামনে সন্ধ্যা হাতের লোকমা ধরায় নিলয় আবার বাঁধা প্রদান করে।

” তুমি তো আস্ত খচ্চর মিস ঐরাবতী! তোমার ওই না ধোয়া হাতে কত জীবাণু আছে জানো? এই হাতে আমাকে খাইয়ে দিতে আসছো? দেখা যাবে বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে পারব না তার আগেই আমার পেটে সমস্যা হওয়া শুরু করে দিয়েছে। হাত ধুয়ে নাও আগে।”

সন্ধ্যার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। নিলয়ের কথা শোনার পর সন্ধ্যার রাগটাও বেড়ে গেছে তাই হাতের ওই লোকমাটাই নিলয়ের মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,

” আর একটা কথা বলবেন তো সত্যি সত্যিই বি’ষ খাইয়ে মে’রে ফেলব। আমি আপনার বউ না যে আপনার সকল আবদার পূরণ করব।”

” তুমি চাইলে সেটাও হতে পারো। তাহলে আর তিন বেলা আমার নিজের হাতে খেতে হবে না। বউয়ের হাতে খেতে পারব।”

সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলার লোক নিলয়। বিষক্রিয়া পরীক্ষা করার অজুহাতে সন্ধ্যাকে খুব হেনস্থা করেছে সে। সন্ধ্যার মুখশ্রীর ভাবভঙ্গি পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে। খাওয়াতে গিয়ে সন্ধ্যার অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে।
দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ার মাঝে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেল। এর মধ্যে দুজনের একজনের ও খাবারের প্রতি ধ্যান নেই। সময়ের কথা খেয়াল হতেই নিলয় সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,

“অনেক কথা হয়েছে। আমি খাবার খেয়েছি। ম’রি’নি বেঁচে আছি সুতরাং তুমি খেতে পারো। আমাদের বাসায় ফিরতে হবে নয়তো দাদা অনেক রাগ করবে।”

নিলয়ের কথায় সন্ধ্যাবতী ভেংচি কাটে বিড়বিড় করে বলে,
” ওই আরিফ সরকারকে কে ভয় পায়?”

” সন্ধ্যা ভয় পায়। শুধু ভয় পায় না বাঘের মত ভয় পায়।”

” মোটেও না।”

নিলয়ার প্রত্যুত্তর করে না। খাবার খাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। এখন কিছু করলে দেখা যাবে নিলয়ের খোঁচানোতে, এক কথা দুই কথায় সন্ধ্যা আরও ঝগড়া শুরু করবে।
—————–

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। সন্ধ্যা পাশের সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিলয় আড়চোখে একটু পরপর সন্ধ্যাবতীকে দেখছে। কী সরল সে চাহনি! সারাদিন থাকে তেজী বাঘিনী অথচ ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষটা নিষ্পাপ। নিলয় আনমনে হেসে ফেলে। গাড়ি একপাশে দাঁড় করিয়ে সন্ধার কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। তারপর ছবির দিকে গভীর নয়নের দৃষ্টিপাত করে বলে,

” ইরাবতীর পর এই প্রথম কোন মেয়ের ছবি আমার ফোনে ঠাঁই পেয়েছে। সত্যিই তুমি খুবই ভাগ্যবতী মিস ঐরাবতী।”

গাড়ি আবারো চলতে শুরু করে। দুই ধারে উঁচু উঁচু বিল্ডিং কিন্তু নিস্তব্ধ। আকস্মাত নিলয়দের গাড়ির জানালায় কোন কিছুর আঘাতে জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে। কাঁচ ভাঙার আওয়াজে সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। সন্ধ্যাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভয় পেয়েছে। নিলয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কি হয়েছে? ডাকাত ধরেছে কি?

নিলয় উত্তর দেয় না। সামনের আয়নায় পিছনের দৃশ্য দেখতে চেষ্টা করে কিন্তু আফসোস এই অন্ধকারে কোন কিছু স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না। নিলয় গাড়ি থামায় না। স্পিড বাড়িয়ে আরো জোরে গাড়ি ছাড়ে। কিছুক্ষণ পর পেছনের জানালার আরেকটা গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সন্ধ্যা পিছনের সিটে তাকিয়ে বড়ো পাথর দেখতে পায়। ভয়ার্ত কন্ঠস্বরে বলে,
” বড়ো পাথর নিক্ষেপ করছে। দ্রুত চালান।”

” ভয় পেয়ো না সন্ধাবতী, আমি আছি তো! তোমার কিছু হবে না।”

নিলয়ের কথা শেষ হতেই গাড়িতে ধাক্কা অনুভব করে। নিলয়র আয়নায় দেখতে পায়, একটা বড়ো জিপ গাড়ি ধাক্কা দিচ্ছে নিলয়দের প্রাইভেট কারের পেছনে অংশে। নিলয় আগে থেকে স্পিড আরো বাড়িয়ে দেয়।

নিলয়দের এলাকায় পৌঁছুতেই সে অনুভব করে গাড়িতে আর অবস্থান করা ঠিক হবে না। তাই এলাকার একটা নির্জন স্থানে গাড়ি দাড় করিয়ে সন্ধ্যাকে টেনে বের করে দৌঁড়াতে থাকে। প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়ে তারা সরকার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। নিলয় হাঁটুতে হাত ভড় করে হাঁপাচ্ছে আর সন্ধ্যাবতী ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক দেখছে।

” বাড়ি চলুন এখানে থাকা সেফ না।”

নিলয় আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে যায় সরকার বাড়ির অভ্যন্তরে।

————
সরকার বাড়ি দুজন বাচ্চা মানুষের সাথে কত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এই ব্যাপারে বড়োরা কেউ জানে না। অবশ্য নিলয় এবং সন্ধ্যাবতী তাদেরকে জানাতে চায়নি। অযথা তারা চিন্তা করবে। দেখা যাবে দুজনকেই ঘরে বসিয়ে রেখেছে।

নিলয় এইমাত্র গোসল করে বের হয়েছে। মাথার চুল দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বিছানার উপর বসে সে। গভীর মনোযোগে কোন কিছু নিয়ে ভাবছে। আকস্মাত একটা ঘটনা মনে পড়ল নিলয়ের। তার কাছে মনে হল এই ঘটনাটা সন্ধ্যার সাথে শেয়ার করা উচিত। এই অবস্থায় বারান্দায় চলে যায় নিলয়। সে জানে সন্ধ্যা এসময়ে বারান্দায় বসে আছে। দূর নীলিমার তারা গুনছে বা অদূরে বিল্ডিংয়ের রং বেরঙের আলো দেখছে।

নিলয়ের ধারণা সঠিক। সন্ধ্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিলয় মুঠোফোন বের করে সন্ধ্যাকে কল দেয়
নিলয়ের ফোন আসা দেখে সন্ধ্যার ভ্রু কুঁচকে আসে। অভ্যাস মোতাবেক সেও নিলয় বারান্দার দিকে তাকায়। নিলয় হাতের ইশারায় হাই-হ্যালো বলছে এবং বলছে ফোন রিসিভ করতে।
সন্ধ্যা ফোন রিসিভ করে কানে ধরে কর্কশ স্বরে বলে,

” দিনের বেলা তো শান্তি দেন না। রাতেও কী দিবেন না? কি সমস্যা এখন জ্বালাচ্ছেন কেন?”
” প্রেম করতে।”
” কি বললেন? আরেকবার বলেন, মে’রে আলু ভর্তা বানাব।”
” সব সময় তোমার মাথায় যা ঘুরে তাই বললাম। এতসব বাজে কথা বন্ধ করে এখনই ছাদে আসো। তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে।”

” পারবনা। শুনছেন আমি ছাদে যেতে পারব না।”

” তুমি না আসলে আমি তোমার ঘরের সামনে চলে আসছি। ওয়েট,,,”

” এই না, না। বাবা দেখলে আমাকে জি’ন্দা ক’ব’র দিবে। আমি আসছি।

নিলয় বাঁকা হেসে ফোন কে’টে দেয়। এরপর ঘরে এসে একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে ছাদে চলে যায়।
———-
ছাদে ঠান্ডা বাতাস বইছে। ব্যস্ত শহর এখন ঘুমন্ত। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই। অদূরে কিছু কলকারখানার টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে তবে সেটা খুবই নিচু।

” আপনার মনে ভয় ভীতি বলতে কিছুই নেই? যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন? আমাকে কী পেয়েছেন?”
নিলয় আনমনে সন্ধ্যার কথার প্রত্যুত্তরে বলে, ” পার্টনার।”
” কি বললেন?”
সন্ধ্যা গণবিদারক চিৎকার শুনে নিলয়ের স্তম্ভিত ফিরে আসে। নিজের বলা কথা কিছুটা সংশোধন করে বলে, ” অফিসের সহকর্মী।”
সন্ধ্যা তেতে ওঠে। অফিসের সময়সীমা শেষ হয়েছে ঘণ্টা খানেক আগে। তাহলে এখন কীসের কথা।”
সন্ধ্যা মুখ খুলবে তার আগেই নিলয় বলে,
” তোমার মনে আছে! কয়েকমাস পূর্বে আমাদের অফিসের গোপন কক্ষপথে র’ক্ত পড়ে ছিল?”
সন্ধ্যার কয়েকমাস পূর্বের কথা মনে পড়ে। অফিসের গোপন কক্ষপথে র’ক্তে’র ছিটেফোঁটা থাকলেও কোন ব্যক্তির হদিস মিলেনি।
” হ্যাঁ মনে আছে।”
” আমি সেই র’ক্ত পরীক্ষা করার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম।”
” রিপোর্ট পেয়েছেন?”
” না। তবে আগামীকাল তোমাকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
সন্ধ্যা মাথা হ্যাঁ বোধক ইশারা করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনই নিশ্চুপ। সন্ধ্যা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই নিলয়ের কথায় দাঁড়িয়ে যায়,

” ভালো খেলেছো মিস ঐরাবতী। ঠান্ডা মাথায় ভয়ংকর প্ল্যান করেছিলে। তোমার চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না। ভেবেছিলে আমি গাড়িতে একা থাকব কিন্তু তা আর হলো কই! জোর করে তোমাকে গাড়িতে উঠিয়েছিলাম বলেই আজ বেঁচে গেলাম।”
#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| এগারো তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌

” সন্দেহের বশে এমন কোন কাজ করবেন না যা ভবিষ্যতে আপনার বিপদ হয়ে দাঁড়াবে, মিস্টার নীলয় নীলাভ। আপনি আমার থেকে ছয় বছরের বড়ো হতে পারেন তবে জ্ঞানের দিকে খুবই দুর্বল। সারাদিন, সন্ধ্যা, রাত আপনার সাথে ছিলাম! তবুও বলছেন, আজকের দুর্ঘটনার জন্য আমি দায়ী?”

ছমছমে পরিবেশ। সন্ধ্যার স্পষ্টকথা শহরের প্রতিটা দেয়ালে বাড়ি খেয়ে জোরে আওয়াজের প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে। নিলয়ের মুখশ্রী কাঠিন্যতায় ছেয়ে আছে।
হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে যেন ভুলবশত সন্ধ্যাবতীর গায়ে হাত না তুলে ফেলে। চোখ বন্ধ করে সে রাগ নিয়ন্ত্রণের বৃথা প্রচেষ্টা করে বলল,
” ঘরে ফিরে যাও সন্ধ্যা। নয়তো তোমায় আঘাত করতে আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না।”

সন্ধ্যা কথা শুনলো না উলটো নিলয়ের কাছে এসে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কর্কশ আওয়াজে বলল,

” নিজেকে কি ভাবেন। আরিফ সরকারের প্রিয় বলে যা ইচ্ছা তাই করবেন?”

” রাগিও না সন্ধ্যা। বলেছি চলে যেতে চলে যাও।”
” যাব না। কি করবেন শুনি?”

নিলয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। সন্ধ্যার হাত মোচড়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। সন্ধ্যার পিঠ নিলয়ের বুকে গিয়ে ঠেকেছে। নিলয়ের গরম নিশ্বাস সন্ধ্যার পিঠে পড়ছে। ঘন ঘন নিশ্বাসে জানান দিচ্ছে নিলয়ের আকাশ সমান রাগের কারণ। সন্ধ্যা ভয় পেয়ে যায়। একা ছাদে এসেছে ভেবে আফসোস করে।

” এত সাহস দেখানো ভালো না মিস ঐরাবতী। মেয়েদের গলা নামিয়ে কথা বলতে হয় নয়তো পদে পদে বিপদে পড়তে হয়। আজ যেই স্বর দিয়ে তুমি আমাকে শাসাচ্ছ আগামীকাল যদি সেই স্বরে যদি আওয়াজ না আসে তখন কী করবে।”
” মে’রে ফেলার পরিকল্পনা করছেন?”

সন্ধ্যা ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না তা নিলয়ের অজানা না। সন্ধ্যার হাত ছেড়ে দেয়। সুযোগ দেয় পলায়নের কিন্তু সন্ধ্যা! সে তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ত্যাড়া। ঠায় দাঁড়িয়ে রয় সেখানে। নিলয় এবার সন্ধ্যার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
” ভুল সংশোধন করার সুযোগ দিচ্ছি।”

নিলয় আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সন্ধ্যার জিদের সাথে মোকাবিলা করলে নিলয়েরও একই রুপ ধারণ করতে হবে যা সে এই মুহূর্তে চায় না। এদিকে নিলয় চলে যেতেই সন্ধ্যা চোখ খুলে তাকায়। রাগে সন্ধ্যার চোখ লাল টকটকে দেখাচ্ছে। সন্ধ্যা আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

” আপনাকে কখনোই ক্ষমা করব না, মিস্টার অসভ্য দুর্লয়।”
———————————-

সকালের সতেজ ঠান্ডা বাতাসে শরীর হিম হয়ে আসছে নিলয়ের। শরীরের পাতলা কাঁথা আরেকটু আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় সে। কারো নরম স্বর কানে আসায় ঘুম হালকা হয়ে আসে নিলয়ের। পিটপিট করে চোখ খুলতেই সে শুনতে পায়,
” উঠো নিলয়। আরে উঠো না! আর কত ঘুমাবে। বিয়ের পরের সকালে কেউ এত ঘুমায় নাকি?”

চোখ খুলে পুরো পৃথিবীর দেখতে চেয়েও চোখ বন্ধ করে নেয় নিলয়। স্বপ্ন নয় বাস্তবে কোন রমণীর ছায়ামূর্তি তার ঘরে অবস্থান করছে বুঝতে পেরে নিলয় তড়িৎ গতিতে বসে পড়ে। নিলয়ের সামনে সন্ধ্যা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে লাল শাড়ি, গা ভর্তি গহনা, হাত ভর্তি মেহেদী। লাজুক মুখখানা লাল হয়ে আছে লজ্জায়। নিলয়ের মন জুড়িয়ে যায়, গা ছুঁয়ে ঠান্ডা বাতাস বইয়ে যায়। চোখে শান্তি চলে আসে।

” কি গো! কোথায় হারিয়ে গেলে। নতুন বউয়ের মুখ দেখে গিফ্ট দিতে হয় জানো না! কোথায় আমার গিফ্ট?”

” গিফ্ট তো আনি নি।”

হাসিমাখা সন্ধ্যার মুখশ্রীতে নিমেষেই আঁধার নেমে এল যেন। তা দেখে নিলয়ের মুখশ্রীতেও বিষাদ নেমে আসে। নিলয় খেয়াল করে দেখল আঁধারে ঢাকা মুখশ্রী হঠাৎ বিকৃতিরূপ ধারণ করেছে ঠিক যেন ভুলভুলাইয়া সিনেমার মঞ্জুলিকা।

” গিফ্ট আনিসনি মানে কী হ্যাঁ! নতুক বউকে গিফ্ট দিবি না তো কাকে দিবি তোর ঐ এক্স ইরাবতীকে? তা আর হতে দিব না। আজই তোর ঘার মটকে খাব। আসছি, আমি আসছি।”

সন্ধ্যার রূপ পরিবর্তন দেখে নিলয় ঘাবড়ে যায়। সন্ধ্যার চাঁদের ন্যায় মুখ মিনিটেই পরিবর্তন হয়ে রা’ক্ষ’সী রূপ নেয়। নিলয় চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলে,

” আমি কোনদিনও আর এমন ভুল করব না মিস ঐরাবতী! তোমাকে বউরূপে আর দেখতে চাইব না।”

স্বপ্ন দেখা ভালো তবে দুঃস্বপ্ন দেখা ভালো না। ঘুম ভাঙতেই নিলয় শোয়া থেকে উঠে পড়ে। সারা শরীর ঘামে ভিজে জবুথবু হয়ে আছে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নেয় সে। ভোর রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। নিলয় মাথার চুল টেনে বিড়বিড় করে বলে,

” এমন রাক্ষসীকে আমি বউ হিসেবে চাই না। এই স্বপ্ন যেন সত্যি না হয়।”
——————

সকালে নাস্তা টেবিলে নিলয় গভীরমুখে করে বসে আছে। আরিফ সরকার অনেকক্ষণ যাবত নিলয়ের ভাবভঙ্গি খেয়াল করছেন। তিনি ভেবেছিলেন তার প্রিয় নাতি নিজ ইচ্ছায় তাকে আসল ঘটনা খুলে বলবে, কিন্তু তা হল না। নিলয়ের গাম্ভীর্যমাখা মুখ আরিফ সরকারের পছন্দ হল না তাই কোন সংকোচ না করে জিজ্ঞেস করে,

” কি হয়েছে নিলয়? কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করছ?”

নিলয় মলিন হাসে। দাদার কথার জবাবে বলে,

” দোয়া কর দাদা যেন খারাপ কিছু না হয়। আমি যা ভাবছি তা যেন না হয়। তাহলে আমাদের সরকার বাড়ির মান সম্মান ডুবে যাবে।”

” খারাপ কিছু মানে?”

” আমার ওপর ভরসা রাখো। খারাপ কিছু হলেও খারাপটাকে ভালো করতে আমি জানি।”

” তোমার উপর ভরসা রাখি বলেই সরকার কোম্পানির দায়িত্ব তোমার উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমার পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে তোমাদের প্রতি। তুমি এবং সন্ধ্যা আমাদের কোম্পানিকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।”

সন্ধ্যাবতীর নাম নিতেই সন্ধ্যা এসে হাজির হয়। কালো রঙের এক সেট থ্রি পিস পডরেছে সে। সাথে কালো কানের দুল হাতে কিছু কাঁচের চুড়ি।

সন্ধ্যা নিচে এসে সকলকে একসাথে দেখতে পেয়ে মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই নিলয় বাঁধা প্রদান করে,

” সন্ধ্যা দাঁড়াও। গতকাল তোমাকে বলেছিলাম না আজকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে! আমরা এখন সরাসরি সেই জায়গায় যাব।”
এরপর দাদার উদ্দেশ্যে সে বলে,

” দাদা আসছি সাবধানে থেকো। আমি গার্ডদের বলে যাচ্ছি যেন কড়া পাহারা দেয়।”

বাড়ি থেকে বের হতেই সন্ধ্যা দেখতে পায় সরকার বাড়ির বাহিরে একটি নতুন গাড়ি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। নিলয়ের দিকে তাকাতেই নিলয় বলে,

” নতুন কিনেছি। চলো যাওয়া যাক।”

তিনতলা বিশিষ্ট দালানের সামনে নিলয় গাড়ি থামায়। সন্ধ্যা গাড়ি থেকে নেমে বুঝতে পারে তারা ফরেনসিক ল্যাবে এসেছে। নিলয় গাড়ি লক করে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
” চলুন যাওয়া যাক।”

নিলয় সামনে হাঁটছে। নিলয়ের হাঁটার তালে সন্ধ্যা পেরে উঠছে না। সে নিলয়ের পিছনে এক প্রকার দৌঁড়াচ্ছে। সন্ধ্যার মনে ভয়ের সাথে কৌতূহল জন্মাচ্ছে। ধৈর্য ধারণ করতে পারছে না। তাই নিলয়কে প্রশ্ন করে,

” আমরা কেন এসেছি? সেদিনের ঘটনার রিপোর্ট নিতে? তারা কী আপনাকে খবর পাঠিয়েছে? নাকি ইচ্ছে করে এসেছেন।”

সন্ধ্যার বিচলিত হওয়া দেখে নিলয় বাঁকা হেসে উত্তর দেয়,
” আর কিছু সময় অপেক্ষা করুন মিস ঐরাবতী। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।”

সন্ধ্যাকে নিয়ে একটা ফাঁকা কেবিনে নিয়ে যায় নিলয়। চেয়ারে বসতে বলে সে আবার বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। সন্ধ্যা বসে না থেকে মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করে,

” বার বার ফোন দিচ্ছিলে কেন? তোমাকে বলেছি তো আমি ব্যস্ত আছি। ঐ অসভ্য দুর্লয় আমাকে ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে এসেছে নতুন নাটক করতে। আমি এবার এই লোকের ফাঁদে পা ফেলব না। আরেকটা কথা গতকাল যা করেছো তার শাস্তির জন্য তৈরি থাকো। যা বলেছি তা করো, কেউ যেন টের না পায়।”

সন্ধ্যা ফোন কে’টে দেয়। আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক এই কেবিনটা কীসের। সন্ধ্যা ভালো করে খেয়াল করে দেখতে পেল সন্ধ্যা বসে আছে যে স্থানে সে স্থানের ঠিক পিছনটায় একটা কাঠের সেল্ফ রয়েছে। সেখানে চলে যায় সে। কাঠের বক্সের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পরীক্ষনীয় যন্ত্র দেখতে পায়।
সন্ধ্যা ভাবতে থাকে এসব যন্ত্রের কথা। ফরেনসিকের ডাক্তাররা অপরাধীদের অপরাধ ধরে ফেলে, হাজারো মানুষ অপরাধ করে শাস্তি পায় এসব যন্ত্রেরই সাহায্যে।

সন্ধ্যা আনমনে ভেবে হঠাৎ খেয়ালে আসে, সে যদি রাব্বির সাথে নিলয়ের ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কিছু আলামত এখানে এনে দেয় তাহলে নিশ্চয়ই কিছু একটা বের করা যাবে। সন্ধ্যা ভেবে নেয় নিলয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একবার সেই গোডাউনে যাবে এবং কিছু আলামত খুঁজবে। যার দ্বারা প্রমাণ হয় যে নিলয় আসল কালপ্রিট।

কেবিনের দরজা খোলায় আওয়াজে সন্ধ্যার সেদিকে ফিরে তাকায়। নিলয় রিপোর্ট হাতে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা বিচলিত স্বরে বলে,

” ফলাফল এসেছে? কে সে মানুষ? কে ছিল? আমাদের অফিসের কেউ? নাকি বাহিরে কেউ?”

সন্ধ্যার কথা শুনে নিলয় ভিলেন মার্কা হেসে বলে,

” এত বিচলিত হচ্ছ কেন সন্ধ্যাবতী? ধরা পড়ে গিয়েছ বলে?”

” মানে কি বলতে চাইছেন?”

” আমি বলতে চাইছি এখন থেকে ঠিক বার ঘণ্টার মধ্যে তোমার বিচলিত থাকার কারণটার কথা।”
” পরিষ্কার করে বলুন কি বলতে চাইছেন।”

নীলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। টেবিলের উপর রিপোর্টটি শক্ত করে ফেলে দাঁড়িয়ে যায় সে এরপর কর্কশ আওয়াজ বলে,

” তুমি কিছুই বুঝো না? কী নিখুঁত অভিনয় করেছ তুমি। কি ভেবেছিলে ছেলে সেজে আমাকে ধোঁকা দিতে পারবে! তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছিলে সন্ধ্যা আমি অফিসের আনাচেকানাচে সি সি ক্যামেরা লাগিয়েছি। আমি কেবিনি বসে সকল খবর রাখি।”

নতুন খবর পেলে যেমন মানুষ অবাক হয় সন্ধ্যাও তেমন অবাক হয়েছে। তা দেখে নিলয় আবারো তেতে ওঠে,

” একদম ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করবে না সন্ধ্যা। আমি জানি সেদিন তুমি অফিসের গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে চেয়েছিলে। সেখানের পাহারায় নিযুক্ত লোককে মাথায় আঘাত করেছিলে ঐ কক্ষে প্রবেশ করার জন্য। তুমি খুব সাবধানে যেন সি সি ক্যামেরায় ধরা না পরো তাই সেই লোককে আড়াল করে কক্ষের সামনে আসো। সময়ের সংক্রমণে সেই কক্ষে প্রবেশ করতে পারোনি তাই চলে আসতে নিতেই কক্ষের দরজার হাতলে তোমার হাত লেগে যায় এবং কিছুটা ছিলে যায়। এই যে এই রিপোর্টে সব প্রমাণ রয়েছে। ফরেনসিক ডাক্তাররা পাহারাদারের র’ক্তে’র সাথে তোমার র’ক্তে’র স্যাম্পল পেয়েছে। তুমি এতোই চালাকি করেছ যে, এই সম্পূর্ণ কাজ করতে মাত্র সাত মিনিট সময় নিয়েছো। পূর্বের ন্যায় পাহারাদারের আড়ালে থেকে বাহিরে বের হয়ে গিয়েছ। এবং খুবই চতুরতার সাথে পোশাক পরিবর্তন করে নিজের ডেক্সে গিয়ে বসেছো। ”

” এসব মিথ্যা। আপনি ভুয়া রিপোর্ট বানিয়ে আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন। আমি সেদিন ফাইলে মগ্ন ছিলাম। আপনি নিজেই আমাকে টেনে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ”

” গলা উঁচু করবে না সন্ধ্যা। এটাই সত্য। ফরেনসিক ল্যাবে আমার কোন চাচাতো মামাতো ভাই নেই যে আমাকে সাহায্য করবে। এরপরের কাহিনী শুনবে না?”
” আমি কিছুই শুনবো না। আপনার মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী শুনে আমি কখনোই বিশ্বাস করব না।”

” ঠিক আছে। তাহলে প্রমাণ দেই।”

নিলয় ফরেনসিক রিপোর্ট সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে দেয় যার মধ্যে স্পষ্টত সন্ধ্যার নাম লিখা আছে। এছাড়াও আরেক পাতায় সি সি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও বুঝা যাচ্ছে সেখানে একজন মেয়ে ছিল। আরেক ফুটেজে জুম করে দেখানো হয়েছে সন্ধ্যা সেদিন হাতে যেই আংটি পরেছিল সেই আংটিই সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখাচ্ছে।”

সন্ধ্যার হাত থেকে রিপোর্টটি পড়ে যায়। নিলয় তা দেখে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

” এমনটা করে কি পেলে সন্ধ্যা! এত জিদ এত জিদ তোমার এবং চাচ্চুর! আমাকে দাদা কোম্পানীর দায়িত্ব দিয়েছে বলে তোমরা এই কোম্পানীর ক্ষতি করতে দ্বিতীয়বার ভাবলে না! আরে সন্ধ্যা! তোমরা কীভাবে ভুলে গেলে। এই সরকার কোম্পানীটা আরিফ সরকার বা আমার একা না তোমাদেরও। দাদা স্বপ্ন দেখে আমি আর তুমি এই কোম্পানী অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাবো। অথচ তোমরা!”

সন্ধ্যা মাথা নীচু করে রেখেছে। এখন আর কিছু বলার নেই তার।

চলবে……..
চলবে………

[ধা’ক্কা খেলেন? আশেপাশে যেই বস্তু আছে শক্ত করে ধরুন। এমন আরো ঝটকা খাবেন ভবিষ্যতে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here