সম্পর্ক,পর্ব-১

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছে রতি। পুরো পিঠ ব্যথায় টনটন করছে। আরাফ কোমরের বেল্ট দিয়ে ভীষণ মেরেছে তাকে, তারপর অন্য একটি বেল্ট পরে আবার অফিসে চলে গেছে। রতি কাঁদছে না, আফসোস ও হচ্ছে না তার। কেননা দুই বছরের সাংসারিক জীবনে এখন এসব কমন হয়ে গিয়েছে একদম! শুধু হাঁসফাঁস করছে বুকের ভেতর টা। গুমোট বাধা কেমন এক তীব্র ক্ষোভ আর হাহাকার বারবার বুকের দেয়ালে বারি দিচ্ছে।

আহ্নি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘আবার মেরেছে, আবার? জানোয়ার একটা! আর বাসার কেউ এসে একটু ধরলোও না? ছিঃ এ বাসার সব-কয়টাই জানোয়ারের দলে…’

রতিকে ধরে ধরে বসিয়ে দিলো আহ্নি। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে শশব্যস্ত গলায় বলল, ‘পানি খাও ভাবি।’

রতি মলিন ঠোঁটে বলল, ‘আমি ঠিকাছি আহ্নি। ব্যস্ত হয়ো না।’

–‘ব্যস্ত হবো না বলছো? এই অবস্থা করেছে মেরে আর ব্যস্ত হবো না আমি? সিরিয়াসলি ভাবি! আমি তো আর জানোয়ার না… তুমি পানিটুকুন খাও কথা না বাড়িয়ে।’

বাধ্য হয়ে পানির গ্লাস হাতে তুলে নিলো রতি। থেমে থেমে পুরো গ্লাস শেষ করে আহ্নিকে দিলো। আহ্নি গ্লাসটা রেখে রতির পাশে বসলো।

–‘কোথায় মেরেছে ভাবি?’

আহ্নির চোখ গেলো বিছানার এক পাশে খুলে রেখে যাওয়া বেল্টটার দিকে। সে গর্জে উঠলো, ‘ও, বেল্ট দিয়ে মেরেছে, না?’

–‘দোষ হয়তো আমারই ছিলো আহ্নি।’

–‘এ বাসায় যতদিন ধরে আছো, কই কখনো তো তোমার কোনো দোষ পাইনি ভাবি। সবসময় তুমি নির্দোষ ছিলে তবুও সবাই তোমার উপরেই নির্যাতন করেছে ভাবি। এমনকি ভাইয়াও.. সকালে মসজিদে আরবি পড়তে গিয়েছিলাম নইলে ভাইয়াকে বুঝাতাম বউ মারার ফল কী! হুহ! আজকে কেন মারলো? কী হইছিল ভাবি?’

রতি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলার মতোন তেমন কিছু তো হয়নি! আর বলতে গেলে সম্পূর্ণ দোষ টা গিয়ে দুপুরের উপরেই পড়বে। গতকাল রাতে ঘুমাতে দেড়ি হয়েছিল রতির। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেড়িই হয়ে যায়, তাও সাতটার মধ্যেই উঠে পড়েছিল সে। উঠেই শুনলো, রতির শ্বাশুড়ি লিলি বেগম চেঁচাচ্ছেন আর রতিকে গালাগাল করে যাচ্ছেন, রতি কোন নবাব ঘরের বেটি যে তার উঠতে এত বেলা হবে? আরাফ না খেয়ে অফিস গেছে, বউ থাকতেও না খেয়ে অফিস কেন যেতে হবে ছেলেকে? হ্যাঁ?

রতি একটু অবাকই হয়। আরাফ যে আজ সকাল সকাল অফিস যাবে, রতিকে তো আগে থেকে বলেনি! যদি বলতো, তাহলে ছয়টার দিকেই উঠে পড়তো রতি, বা তারও আগে… অবশ্য বলবেই বা কেন? ইদানীং প্রয়োজনের বাইরে রতির সাথে আরাফ কোনো কথাই বলে না। রতিও বলে না, রতির বলার মতো কিছু নেই-ও, সব কথা ফুরিয়ে গেছে। রতি হাত-মুখ ধুঁয়ে রুটি বানাতে বসলো। খানিক বাদেই রক্তচক্ষু করে দুপুর এসে হাজির হলো।

আরাফরা চার ভাই-বোন। বড় ভাই তাশরিফ, তারপর আরাফ, এরপর দুপুর আর সর্বশেষ আহ্নি। এসএসসিতে পরাপর দুইবার ফেল করার পর দুপুরকে বিয়ে দেওয়া হয় মাস তিনেক আগে। হাজবেন্ড আবির, বিদেশ থাকে। ফোনে ফোনেই বিয়েটা হয়েছে। মাস দুয়েক পরে ছেলে দেশে এলে ধুমধাম করে দুপুরকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। তাই আপাতত দুপুর বাবার বাড়িতেই থাকছে।

দুপুরের হাজবেন্ড আবির লোকটি ভীষণ ভালো মনের মানুষ। এই এতটুকুন সময়েও দুপুরকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে সে। দুপুরের প্রতিটি চাওয়া সে পূরণ করে। দুপুরকে এক প্রকার জোরজবরদস্তি করেই ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে আবার। সে চায়, তার বউ শিক্ষিত হোক। অথচ দুপুর, পড়ার নাম করে কোচিং ফাঁকি দিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। আবির এসব জেনে গেলে দুপুরকে জিজ্ঞেস করে, রাগারাগি করে। তখন দুপুর কান্নাকাটি করে, ক্ষমা চায়। আবির ক্ষমা করে দিলেও ক’দিন পর আবার পূর্বের ভুল করে বসে দুপুর। গতকালকে আবির রতির ফেসবুক আইডিতে ম্যাসেজ দিয়েছিলো, ‘ভাবি, দুপুর কোথায়? ওকে অনেকক্ষণ যাবত লাইনে পাচ্ছি না।’

রতি তখন দুপুরের সব কাজ টাজ শেষ করে একটু শুয়েছে, হালকা ঢু মারতে ফেসবুকে ঢুকেছে, ওমনি আবিরের ম্যাসেজটি দেখতে পেয়ে জবাব দেয়, ‘দুপুর তো কোচিং-এ গিয়েছে ভাইয়া। ক্লাসে তো তাই বোধহয় লাইনে নেই।’

‘আপনি শিউর ভাবি দুপুর কোচিং এ?’

‘জি ভাইয়া। ব্যাগ নিয়েই তো বের হলো দেখলাম।’

কথাবার্তা এতটুকুই, এরপর আর আবির ম্যাসেজ দেয়নি। রতিও পালটা কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অথচ যখন দুপুর সকাল বেলা হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আবিরকে তুমি কী বলেছো?’

রতি বিস্মিত চোখে তাকালো।

–‘কী বিষয়ে?’

–‘আমার কোচিং যাওয়া না যাওয়া নিয়ে।’

রতির মনে পড়ায় বললো, ‘গতকাল ভাইয়া আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো। জিজ্ঞেস করেছিলো তুমি কোথায়, লাইনে নাকি ছিলে না৷ তখন তো তুমি কোচিং গিয়েছিলে আর আমি সেটাই বলেছি। কেন দুপুর? কোনো সমস্যা হয়েছে?’

দুপুর এবার রোষানলে ফেটে পড়ে বললো, ‘কে বলেছে এত পায়তারি করতে, হুঁ? বেশি চালাক হয়ে গেছো না?’

–‘এখানে চালাকির কী হলো দুপুর? আমি তো সত্যিটাই বলেছি।’

–‘ইচ্ছে করে বলেছো। যেন আমার আর আবিরের সম্পর্ক টা ভেঙে যায়,না?’

রতি হতভম্ব হয়ে দুপুরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

–‘এসব কী বলছো? আমি কেন তোমাদের সম্পর্ক ভাঙতে চাইবো?’

–‘নইলে এত পাকনামি কে করতে বলছে শুনি। বললেই পারতে আমি জানি না। দুপুর বোধহয় ঘুমোচ্ছে।’

–‘আমি তো যেটা সত্যি সেটাই বললাম, এখানে দোষের কী?’

–‘দোষ করে বলছো দোষের কী? খুব তর্ক শিখে গেছো ভাবি?’

রতির রাগ লাগলো খুব। সত্য কথা বলার পরেও এরকম আচরণ করার মানেটা কী? রতি একটু রাগী গলাতেই বললো, ‘দেখো দুপুর, আমি যেটা সত্যি সেটাই বলছি। এখানে দোষের কিছু নেই। তুমি তোমার হাজবেন্ড কে বলে দিয়ো, আমার কাছে যেন আর ম্যাসেজ দিয়ে তোমার খবর জানতে না চায়। তাহলেই হয়। এক কাজ করি, আমিই তাকে ব্লক করে দিবোনি, ব্যস।’

দুপুর হঠাৎ ক্ষীপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে রতির দু’গাল শক্ত হাতে চেপে ধরলো, ‘আমার জামাইকে তুমি ব্লক করবা, তুমি?’

–‘ছাড়ো দুপুর। আমি তোমার বড়।’

–‘বড়’র ক্ষেতা পুরি… তোর মুখ যদি আজকে না ভাঙি..’

রতির চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই রতি গুঙিয়ে উঠে দুপুরকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। এতে যেন আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠলো দুপুর। এগিয়ে গিয়ে রতির বাম গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো। রতি কিছু বুঝে উঠার আগেই রতির চুল ধরে টানা টানি, ঝাঁকানো শুরু করে দিলো। রান্নাঘরের সোজা বরাবর ঘরটা লিলি বেগম আর নাছির মাহতাবের। নাছির মাহতাব ঘুমাচ্ছেন, কিন্তু লিলি বেগম জেগেই আছেন। তিনি সব দেখছেনও অথচ একটিবারের জন্য উঠে আসলেন না, বা চেঁচিয়ে থামতে বললেন না কাউকে। পায়ের উপর পা তুলে চুপচাপ গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে চলেছেন এই দৃশ্য। যেনো টিভিতে কিছু দেখছেন!

আরাফ ভুলেই গিয়েছিল যে আজ ভোর বেলায় চায়না থেকে কয়েকজন ক্লায়েন্ট আসবে এবং তাদের সাথে মিটিং আছে। ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে হাতমুখ ধুয়েই অফিসের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিলো সে। অর্ধেক পথ গিয়ে মনে পড়লো, সে তো মিটিং এর গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটাই আনেনি। তাই পুনরায় বাসায় আসে আরাফ। রান্নাঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে আরাফ ভ্রু কুঁচকে ফেলে, রান্নাঘরে প্রবেশ করে। দুপুর আর রতিকে এরকম একটা অবস্থায় দেখে আরাফ ভীষণ অবাক হয়, দ্রুত দুপুরকে টেনে সরায়। রতি কুঁকড়ে একপাশে সরে দাঁড়ায়। আরাফ গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলে, ‘এসব কী হচ্ছে দুপুর?’

দুপুর আকস্মিক কেঁদে ফেলে। লিলি বেগমও ছেলেকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসেন।

–‘তোর বউটার এত মুখ কেন আরাফ? দুপুর আর ওর জামাইর মধ্যে উল্টাপাল্টা কথা বলিয়ে বারবার কেন ঝামেলা পাঁকাতে চায় বল তো। দুপুর এসে জিজ্ঞেস করায় দুপুরকে যাচ্ছেতাই বললো, আবার মারতেও এলো। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, নইলে তখনি এসে ঠাটিয়ে দু’গালে লাগাতাম।’

রতি বিস্ময়ে ‘হা’ হয়ে গিয়েছে। এভাবে এত মিথ্যা বলতে পারে কেউ! অবশ্য এ আর নতুন কী, লিলি বেগম সবসময়ই দুপুরের সাপোর্টার, তাতে দুপুর ভুল হোক বা ঠিক!

দুপুর মেকি কান্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভাবি আমাকে সহ্যই করতে পারে না ভাইয়া। আর আমার ভালো জায়গায় বিয়ে হইছে তো, এটা একদমই মানতে পারে না। আমার শ্বশুর বাড়ির প্রতি ভাবির লোভ। আমার তো মনে হয় আবিরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক টম্পর্ক…’

রতি চেঁচিয়ে উঠে, ‘চুপ করো দুপুর। এতো মিথ্যে বলতে তোমার গায়ে বাধছে না?’

–‘দেখছিস, তোর সামনে কীভাবে ধমকায়? তাহলে তোর পিঠ পিছনে কী করে একবার ভাব…’ বললেন লিলি বেগম। আরাফের এমনিতেই মেজাজ গরম, অফিসে দেড়ি হচ্ছে, আবার এই কাহিনী… মাথা ঠিক রাখতে না পেরে রতিকে টেনেহিঁচড়ে রুমে নিয়ে আসে আরাফ। তারপর শরীরের সমস্ত ঝাল মিটিয়ে ইচ্ছেমতো মেরে অফিসে চলে যায়।

রতি দেখেছে, আরাফ চলে যাওয়ার পর দুপুর দরজার সামনে এসেছিল। রতির দিকে তাচ্ছিল্য ভরা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেছে। রতি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিলেও দুই ফোঁটা অবাধ্য চোখের জল চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে অবলীলায় নেমে গেছে…

রতির মা নেই, বাবা থাকতেও একপ্রকার নেই বলা চলে। সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়ে ওঠা সন্তান যে কতটা অভাগী হয়, তা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। রতির বাবা আনোয়ার হোসেন দ্বিতীয় স্ত্রী এবং দ্বিতীয় ঘরের বাচ্চা নিয়েই সুখে সংসার করছেন। রতি ওই ঘরে এক কাজের লোক বৈ অন্যকিছুই ছিলো না। তবুও স্কুলের হেডমাস্টারের সহায়তায় রতি স্কুল পাশ করেছে, সরকারি কলেজে পড়েছে। ভার্সিটির এক্সামের আগে হেডমাস্টার মারা গেলেন, রতির পড়াশোনার গন্ডি ওখানেই ইতি টানলো।

রতিদের পরের এলাকায় আরাফরা থাকতো। বড়লোক বাবার ছোট ছেলে, আদরের ছেলে, চাকরি-বাকরি করছে, দেখতে সুন্দর… প্রতিটি মেয়ে এরকম একটি ছেলের বউ হওয়ার স্বপ্ন পোষণ করে। রতির সব দিকে অভাব থাকলেও রূপের অভাব ছিলো না। বিধাতা সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। সেই রূপের খাতিরেই বোধহয়, রতি কলেজ যাওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিন দেখতো, একটি ছেলে তাকে ফলো করে। ঐ ছেলেটিই আরাফ…
তবে আরাফ রতির পিছু নেওয়া অবধিই সীমাবদ্ধ থাকতো। কখনো সামনে আসতো না বা কথা বলার চেষ্টা করতো না। জ্বালাতোও না…
শুধু চোখাচোখিতে দু’জনের প্রতি দু’জনের আবেগ, অনুভূতির সবটুকু নিংড়ে নিংড়ে আদানপ্রদান করা হয়ে গিয়েছিলো।

কলেজ শেষ হলো। রতির পড়ালেখার মাত্রাও শেষ হলো। বাহিরে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেলো। আরাফকে আর দেখতে পারবে না এই ভেবে রতির যখন খুব মন খারাপ, তখন আরাফ হুট করেই তাকে চমকে দিলো। একদিন দুপুর বেলা, রতি গোসল সেড়ে এসেছে, বিছানায় বসতে গিয়ে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো দেখতে পায়। নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে কেউ রেখে গেছে। কে? আরাফ? কম্পিত হস্তে কাগজটি খুলে পড়ে রতি। দুটো বাক্য লেখা শুধু,

বিকেলে ছাদে এসো। অপেক্ষা করবো।
—আরাফ।

রতি তৎক্ষনাৎ কাগজটি কুঁচিকুঁচি করে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। সিদ্ধান্ত নেয় যত যাই হয়ে যাক, সে একদমই ছাদে যাবে না। কেউ দেখে ফেললে যন্ত্রণার শেষ থাকবে না। বাবা তো মেরেই ফেলবেন… কিন্তু বিকেল হলে রতির অবাধ্য মন আর মানে না। এই প্রথমবার পছন্দের মানুষটি তাকে ডাকলো, এই ডাক কী করে উপেক্ষা করবে রতি? এত শক্ত জোর যে মনের নেই…
তাই কাপড় আনতে যাওয়ার বাহানা করে ছাদে গেলো রতি। ধুকপুক করতে থাকা বুক নিয়ে ছাদে পা রাখলো সে। ভয় মিশ্রিত চোখে দেখতে পেলো, আরাফ দাঁড়িয়ে আছে, কালো ট্যাংকির পেছনে। রতি একবার সিড়িঘরের দিকে তাকালো। তারপর মৃদু পায়ে ট্যাংকির কাছাকাছি গিয়ে উপস্থিত হলো। গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বলল, ‘কী বলবেন? বলেন।’

আরাফ হাসলো, রতির বুক ধ্বক করে উঠলো। এই হাসির নাম নিশ্চয়ই ভুবন ভুলানো হাসি। আর ঐ যে গেঁজ দাঁতটা উঁকি দিচ্ছে.. ইশ! রতি তো মরেই যাবে গো! রতির ধুকপুকানি এবার আরো শতগুণ বেড়ে গেলো।

–‘এতক্ষণ লাগলো আসতে?’

রতি জবাব দিলো না। চোখ সরিয়ে নিলো।

–‘আরে তুমি কাঁপছো কেন? এই মেয়ে, এত ভয় পেলে চলে?’

রতি জবাব না দিয়ে পেছনে তাকালো। দেখলো দরজার দিকে, কেউ এসে পড়েনি তো! আরাফ রতির ভয়টা বুঝতে পেরে রতির হাত ধরে টান দিয়ে তাকে ট্যাংকির পেছনে লুকিয়ে নিলো। ভয়ে জমে গেলো রতি। তার হাত ঝিনঝিন করছে!

–‘আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন? প্লীজ দ্রুত বলুন। কেউ দেখে ফেললে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

–‘ভয় পেয়ো না। কেউ আসবে না। আমি সব বন্দোবস্ত করেই এসেছি।’

–‘কেন ডেকেছেন?’

আরাফ এবার রতির চোখে চোখ রাখলো। রতি দ্রুত চোখ সরিয়ে নতজানু হলো। আরাফ রতির থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ভণিতা ছাড়াই বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবে র‍তি?’

রতি ছিঁটকে দূরে সরে দাঁড়ালো, ‘এসব কী বলছেন? এটা কখনোই সম্ভব না।’

–‘কেন?’

–‘আপনার অবস্থান আর আমার অবস্থান একবার দেখেন! আপনার ফ্যামিলি ভালো পজিশনে আছে। সেখানে আমার বাবা কোনোরকমে আমাদের সংসার চালায়। আপনি এত পড়াশোনা করেছেন আর আমি মাত্র এইচএসসি পাশ… আপনার বাবা-মা কখনোই আমার মতো মেয়েকে পছন্দ করবেন না।’

একদমে কথাগুলো বলে একটু থামলো রতি, জিরিয়ে নিয়ে ফের বলল, ‘এটা তো বাস্তব তাই না? এখানে আমাদের দু’জনের আবেগ চলবে না। বুঝেছেন?’

আরাফ আবার ওর ভুবন ভুলানো হাসিটা হাসলো। বলল, ‘এত যুক্তি যে কোথা থেকে পাও!’

–‘এগুলো সঠিক যুক্তি।’

–‘শোনো, আমি তোমাকে বিয়ে করবো, তোমার পরিবার কে না। তাই তারা কোন পজিশনে আছে, আই ডোন্ট কেয়ার! আর আমার বাবা-মা তোমাকে মেনে নিবে রতি। আমি তাদের একমাত্র আদরের ছোট ছেলে। আমি যেটা বলব সেটাই হবে।’

আরাফ এগিয়ে এসে রতির হাত জোড়া মুঠোবন্দি করে নিয়ে বলে, ‘বিশ্বাস করো আমাকে। আমি তোমার সমস্ত কষ্ট-দুঃখ সব মুছে দিবো রতি। বাকি জীবনটা হবে শুধুই সুখের…’

সেদিন আরাফের ওইরকম জোরালো কথা ফেলতে না পেরে রাজি হয়ে গিয়েছিলো রতি। জীবনকে একবার সুযোগ দেওয়ার জন্য একটা রিস্ক মাথায় তুলে নিয়েছিলো সে। কম কষ্ট তো করলো না, এবার তো একটু সুখের মুখ দেখতে তারও ইচ্ছে করছে।

আরাফ রতিকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, কেননা তার বাবা-মা মেনে নেয়নি। এক মাস চট্টগ্রাম এক বন্ধুর বাসায় রতিকে নিয়ে সংসার করার পর আরাফের বাবা-মায়ের মন গলে। কয়দিন আর ছেলেকে ছেড়ে দূরে থাকবে? তাই আরাফকে বউ সমেত তাদের বাসায় আসতে বললে ওরা চলে আসে। রতির মনে আছে, এই বাসায় আসার আগে রতির এক্সাইটমেন্ট দেখে কে! রতি খুব খুব খুউউব খুশি ছিল। মায়ের অভাব এবার বোধহয় পূরণ হবে, এই ভেবে আসা রতি, আজ ঘরের বউ না হয়ে চাকরানি হয়ে গেছে! আরাফটাও দিনে দিনে বদলে গেছে! বাস্তবতার মেঘ ভালোবাসাগুলোকে আড়াল করে দিয়েছে.. এখন বাঁচতে হয় বলেই বেঁচে আছে রতি। আলাদা করে আর তেমন কোনো বাঁচার কারণ নেই।

(চলবে)
সম্পর্ক (১)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

*বানান ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here