#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
১১
অতি পরিচিত মুখটা আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। আমি তার দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। এক পা, দু পা করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে….
কাছাকাছি যেতেই তিনি আমার থেকে দুপা পিছিয়ে গেলেন। আমি নিজ যায়গায় থেমে গেলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তিনি আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য উল্টোদিকে ফিরে হাঁটা শুরু করলেন। আমি এবার সামান্য দৌড়ে তার কাছে গেলাম। উনার পিঠে ছুইয়ে দিতেই তিনি থেমে গেলেন। আমি শক্ত গলায় বললাম
“আমার থেকে না পালিয়ে ফিরে তাকান।
উনি এবার শাড়ির আচলে মুখ গুজে আমার দিকে ফিরলেন। চোখে পানির স্রোত।
আমি কিছুটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে৷ হয়তো আমার দিকে তাকানোর মতো সাহস সে পাচ্ছেনা।
আমি এবারে বললাম
“কি হলো, তাকান আমার দিকে।
সে আমার দিকে ফিরে তাকালো। তবে চোখেমুখে প্রচন্ড লজ্জা আর অস্বস্তি রয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম
“আপনাদের বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দিয়েছেন মাত্র সাড়ে তিন মাস হলো, এর মধ্যেই আপনার এই হাল কি করে হলো? এবার তো আমি নেই, আমি নাহয় অপয়া, অলক্ষ্মী.. সেখানে আমি না থাকলে আপনার আরো ভালো থাকা উচিত ছিলো, কিন্তু এ কি?
আমার করা প্রশ্নে তিনি আবারও মাথা নিচু করলেন। এক সময় হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমি তাকিয়েই রইলাম সেদিকে। উনার কান্নায় আমার কোনো মায়া হচ্ছেনা, বরং কাহিনীটা জানার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
আমি আবারও উনাকে তাড়া দিয়ে বললাম
“কি হলো, বলছেন না যে কিছু।
এবার তিনি হুট করে মাটিতে বসে পরলেন, আমার পায়ে ঝাপটে ধরে বললেন
“আমারে মাফ করে দাও বউমা, তোমার সাথে যা অন্যায় করছি, তার ফল আল্লাহ আমারে হাতে হাতে দিয়া দিছে। এবারে যদি তুমি আমারে মাফ না করো, তাইলে আল্লাহও আমারে মাফ করবো না। মাফ করো আমারে বউমা, মাফ করো।
উনি অঝোরে কাঁদছেন। আমি তরিঘরি করে পা সরিয়ে নিলাম।। উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অসহায়ের মতো বললেন
“আমারে মাফ করবা না বউমা।
এবারে আমি হাসলাম, তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম
“যখন ঘরের বউ ছিলাম, তখন তো কোনোদিন ভুল করেও বউমা বলে ডাকেন কি। এখন তো সব শেষ, আমিতো আর ও বাড়ির বউ নয়, তবে এখন এইসব কথার কারণ কি!
সে নিচের দিকে মাথা ঝুঁকে কাঁদতে লাগলো এখনো। আমি ভ্রু বাকালাম, বললাম
“আপনার এই করুণ পরিস্থিতির কারণ কি?
উনি এবার আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চোখের পানি মুছে বললেন
“তোমারে বের করার কিছুদিন পরই আমার মৃদুলরে আমি আবারও বিয়ে করাইছি।
মৃদুল বিয়ে করে নিয়েছে কথাটা শুনতেই কলিজাটা ছ্যাৎ করে উঠলো আমার। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি। যে আমাকে এতটা ভালোবাসতো, সে আমাকে আজ ঘৃণা করে। এতটাই ঘৃণা, যে সে অন্য কাউকেও বিয়ে করে নিতে দুইবার ভাবে নি। অজান্তেই আমার চোখে দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।
উনি বলতে লাগলেন..
“বিয়ে করাইছি সে মেয়েটারেই, যার সাথে আমি মৃদুলের আগেই বিয়ে ঠিক করাই রাখছিলাম। মেয়েটার এতদিনেও বিয়া হইনাই। উনারা আমার ছেলের কাছে মেয়েটারে বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি ছিলো। আমিও আর দ্বিমত করি নাই। মৃদুলও আমার কথা চুপচাপ মেনে নেয়। বিয়ের সময় ওই মেয়ের বাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে দশ লাখ টাকা দিছে নগদ। ঘরের ফার্নিচারও দিছে, তার উপর মৃদুলের দোকানটারে আরো বড় কইরা দিছে। মাসখানেক ভালোই ছিলো সব।
হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে যাই। মৃদুলের বউ এর মতিগতিও পাল্টাইতে থাকে দিনে দিনে। তার মনে হয়, ওই বাড়িতে আমি একটা ঝামেলা। যেহেতু বিপুল পরিমাণ টাকাপয়সা আর জিনিসপত্র নিয়া আইছে, তাই ওর মুখের উপরও আমি কোনো কথা কইতে পারিনা। যদি একটা কথা শোনাই, তাইলে সে আমারে দশটা কথা শোনাইয়া দেয়।
আমি এবার মৃদু গলায় বললাম
“আপনার ছেলে কিছু বলে নি?
উনি ক্ষোভ ভরা গলায় বললেন
“ওইটা তো এখন বউ এর গোলাম হইয়া গেছে। বউ যেমনে কয়, সেমনেই বিশ্বাস করে। বউ যা কয়, তাই করে। আমার কথা শোনে না। আমি কিছু কইলে উলটা কয়, ‘টাকার বউ সে, তার কথা তো মানতেই হবে।
আমি দেখলাম উনি আবারও অঝোরে কাঁদছেন। বললাম
“এখানে কিভাবে এলেন?
“মৃদুলেই আমারে রাইখা গেছে পনেরো দিন আগে।
আমি আতঁকে উঠে বললাম
“মৃদুল রেখে গেছে?
“হু, আমার অসুখ হইছে। আমার মতো রোগী নাকি তার বউ এ টানতে পারবো না। তাই আমার সহজ সরল পুলাডারে বাধ্য করছে আমারে এখানে রাইখা যাওয়ার জন্য।
আমার বলার মতো আর কিছুই রইলো না। কি বলবো আমি, কি ই বা বলার আছে আমার?
আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে উনার হাতে একটা কাপড় তুলে দিলাম। উনি তীব্র চাহনীতে আমার দিকে তাকিয়ে কাপড়খানা হাতে নিলেন। আমি বলতে চাইছিলাম না, তাও মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো
“বলেছিলাম না আমি, দম সবারই থাকে। ফেরাউনেরও ছিলো। আপনারও ছিলো। কিন্তু আজ কোথায় সেই দম? আমি অপরাধ না করেও অপরাধী হয়েছি, মেয়েটাকে আপনি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন, স্বামীটাকেও ছিনিয়ে নিয়েছেন। আজ কি হলো? আমি কিন্তু সুখেই আছি, শান্তিতে আছি। কিন্তু আপনি সুখে নেই। আমার সুখ আপনি কেড়েছিলেন, আপনার সুখ আল্লাহ কেড়েছে।
একটা কথা জানেন তো, অন্যের জন্য গর্ত খুড়লে, সে গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়। আপনি আমার জন্য গর্ত খুড়েছিলেন, আজ আপনি নিজেই সে গর্তে হাবুডুবু খাচ্ছেন। কি লাভ হলো আপনার? যে মেয়েকে ঘরে আমার জন্য আমার উপর নির্যাতন করেছিলেন, আজ সে মেয়েই আপনাকে বাড়িছাড়া করেছে। আজ আপনার পাশে আপনার ছেলেও নেই।
উনি আচলে মুখ গুজে অসহায় গলায় বললেন
“সবই আমার কপাল।
আমি ফিরে এলাম সেখান থেকে। বুকে ব্যাথা উঠেছে, প্রচন্ড ব্যথা। এ ব্যাথায় ছারখার হয়ে যাচ্ছি আমি। মৃদুল কি করে পারলো আমাকে এতো তারাতাড়ি ভুলে গিয়ে অন্য কাউকে আপন করে নিতে? যাকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছি, সে আজ অন্য কারো। আমি হাঁটতে হাঁটতেই হাসলাম। সুখের হাসি নয়, দুঃখের হাসি। অতি দুঃখেও মানুষ হাসতে পারে কিনা আমার জানা নেই, তবে আমি হাসছি। দুঃখের মাঝেও কষ্টের হাসি হাসছি।
বাসায় ফিরে এসেই ঢুকলাম ওয়াশরুমে। শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে বসে পরলাম তার নিচেই। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখের পানিগুলো ছেড়ে দিলাম। বুকফাটা আর্তনাদ গুলো গলা চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি আর পারছিনা। ঠিক কতক্ষণ ভিজেছি আমি জানিনা। এর মাঝেই কখন যেনো আমার চোখ বুঝে এলো।
যখন আমার জ্ঞান ফিরেছ তখন আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। আমার মাথার পাশেই মা বসে আছে। কিছুটা দূরে শিহাব দাঁড়িয়ে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। আমাকে উঠতে দেখে মা বলে উঠলেন
“এই শরীর নিয়ে উঠার কি দরকার, শুয়ে থাক মা।
আমি মুচকি হেসে বললাম
“আমার শরীর একদম ঠিক আছে মা। তোমরা কখন এলে?
মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিহাব সামান্য রাগী গলায় বললো
“আমরা কখন এসেছি সেটা জেনে তোর লাভ কি। তুই এমনটা কেন করেছিস আগে সেটা বল।
আমি নরম হয়ে বললাম
“কি করেছি আমি?
“এভাবে পানির নিচে বসে থাকার মানেটা কি? আজ যদি সময়মত আমরা না আসতাম, তাহলে কি হতে পারতো তোর ধারণা আছে?
আমি মৃদু গলায় বললাম
“বেশি কিছু হলে মরে যেতাম, এরচেয়ে বেশি আর কিইবা হত। তাতে অবশ্য আমি শান্তিই পেতাম।
আমার কথায় শিহাব রেগে গেলো। মা আমাদের দুইজনকেই হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। পরম মমতায় উনার স্নেহভরা হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন
“তোর কি হয়েছিলো আজ? এভাবে ঝর্ণা ছেড়ে বসে ছিলি কেন? আমরা ভয় পেয়ে গেছিলাম অনেক। ডাক্তার আনিয়ে তারপর তোর জ্ঞান ফেরাতে হয়েছে।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। বললাম
“আমার জন্য এতো চিন্তা কেন করো মা? আর কেউ তো আমার চিন্তা করে না। আর কেউ তো আমাকে নিয়ে ভাবে না। তোমরা কেন ভাবো?
“আমি যে মা।
সেদিনই মায়ের সাথে চলে এলাম নিজ বাড়িতে। আমার সাথে শিহাবও এসেছে। যখন বাড়ি এলাম তখন ভাইয়া বাড়ি ছিলো না, তবে বাবাকে থমথমে মুখে বসে থাকতে দেখেছি। বাবা আমার দিকে তাকাচ্ছেও না, আবার কিছু বলছেও না। আমি মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বাবার দিকে হাঁটা ধরলাম। আমাকে নিজের দিকে যেতে দেখে বাবা বসা থেকে উঠে চট করে নিজের ঘরে চলে গেলো। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পরলাম।।
অনেক রাতে ভাইয়া বাড়ি ফিরলো। এসে যখন শুনলো আমি বাড়িতে ফিরে এসেছি তখন সে রেগে যায়। অনেক চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে।।ভাইয়ার চিৎকারে শিহাব বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। সে সামান্য ক্ষোভ নিয়ে ভাইয়াকে বলে
“এভাবে চিৎকার করার মানে কি?
ভাইয়া চোখ পাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠে
“তুই কার হুকুমে ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছিস?
“ওকে বাড়ি নিয়ে আসতে আমার কারো হুকুমের প্রয়োজন নেই। নিজের বাড়িতে আসতে কখনো হুকুমের প্রয়োজন পরে না।
ভাইয়া আক্রোশে বলে উঠলো
“এ বাড়ি থেকে ও নিজেই সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেছিলো। তাহলে আজ কেন এসেছে? যার জন্য চলে গেছিলো আজ সে কোথায়? ছেড়ে গেছে? আরে এটাই তো হওয়ার ছিলো। তখন আমাদের কথা শোনেনি। তাহলে আজ কেন আমাদের দ্বারে এসেছে?
চলে যেতে বল ওকে। এ বাড়িতে ওর কোনো যায়গা নেই।
এবার শিহাব রেগে গিয়ে বললো
“এ বাড়িটা তোমার একার নয় ভাইয়া, এ বাড়িতে তোমার যতটুকু পাওনা আছে, ঠিক সমপরিমাণ আমারও আছে। তোমরা যদি একান্তই ওকে রাখতে না চাও, তবে আমার যায়গায় আমি ওকে রাখবো। এতে নিশ্চয়ই তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না?
এবারে ভাইয়া আরো ক্ষেপে গেলো। সে তেড়ে এলো শিহাবকে মারতে। আমার আর সহ্য হলো না। আমি ছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম তাদের দুই ভাইয়ের মাঝখানে। ভাইয়ার পায়ে পরে বললাম
“আমি চলে যাবো ভাইয়া৷ তবুও আমার কারণে তোমরা ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্ট করো না।
ভাইয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। শিহাব আমাকে টেনে তুলে বললো
“কার পায়ে ধরছিস তুই? যে তোকে এই রাতের বেলাতেও চলে যেতে বলছে তাকে? দরকার হলে তোকে নিয়ে আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো, তবুও এই অমানুষের পায়ে ধরতে দিবো না। এর মাঝে আর তোর শশুড়বাড়ির লোকেদের মাঝে তুই কোনো পার্থক্য খুজে পাচ্ছিস আপা? ওরা তোকে ঘর ছাড়া করেছে, আর এও করতে চাইছে। তবে পার্থক্যটা কোথায়? আমি শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইলাম অবাক হয়ে। শিহাব আবারও নিজে নিজে বলতে লাগলো
“পার্থক্য শুধু এতটুকু, ওরা নিজ হাতে তোর মেয়েকে খুন করেছে, আর আমার ভাই নামের এই মানুষটা সেটা পারছেনা। কারণ এখন তো বাচ্চা আর নেই। থাকলে এটা করতেও সে একবার ভাবতো না। একটা কুকুরের সাথে মানুষ এমন করেনা, যেমনটা ওরা তোর সাথে করেছে, আর এইবার আমার ভাইয়াও সেটাই করছে।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম নিজ যায়গায়। ততক্ষণে বাবাও এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। দেখলাম ভাইয়া কিছুটা কেঁপে উঠলো। অবাক হয়ে তাকালো শিহাবের দিকে। বিস্ফোরিত গলায় বললো
“ওর মেয়েকে খুন করেছে মানে?
শিহাব চেচিয়ে উঠলো। আক্রোশে ফেটে পরছে সে। চিৎকার করে বললো
“মানে কি বুঝো না? এতটা দিনের মধ্যে একটা বারের জন্যও কি ওর কোনো খবর নিয়েছো তোমরা? ও নাহয় ভুলই করেছিলো, কিন্তু তোমরা কি করেছো? যা করেছো সবই অন্যায় করেছো। ভুল আর অন্যায় দুইটা দুই জিনিস জানো তো ভাইয়া? তুমি কিংবা বাবা, কেউই কি এতোদিনের মধ্যে ওর কোনো খোঁজ নিয়েছে? বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেটা জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেছিলে তোমরা? ততক্ষনে বাবাও চলে এসেছে ওদের মাঝে। বাবাকেও দেখে মাও এগিয়ে গেলো সেদিকে। হয়তো ভাবলো বাবাও এবার ঝামেলা শুরু করবে। তবে বাবা সেসব কিছু না করে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
“তনুর সাথে কি হয়েছে? আর ওর বাচ্চার নামে এটা কি বললো শিহাব?
আমার মাথা ঘুরছে, মাথায় ব্যথা করছে প্রচন্ড। এতো চিল্লাপাল্লা আমার আর হচ্ছে না। বার বার মনে হচ্ছে, এখানে আমি এসেছি এই পরিবারের সুখটাকে নষ্ট করার জন্য। আমার জন্যই এতো ঝামেলা, যেখানেই যাই সেখানেই অশান্তি। মনে মনে ভাবলাম, আমিই বোধহয় অপয়া। আমি চোখ বন্ধ করলাম, আবারও দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মৃদুলকে আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি, কিন্তু বৃষ্টিকে তো পারছিনা। বার বার ওর ফ্যাকাসে মুখটা আমার সামনে ভেসে আসছে। আমার মাথাটা আবারও ঘুরে উঠলো..
চলবে….#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
[দুই পর্ব একসাথে]
১২
আমি চোখ বন্ধ করলাম, আবারও দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মৃদুলকে আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি, কিন্তু বৃষ্টিকে তো পারছিনা। বার বার ওর ফ্যাকাসে মুখটা আমার সামনে ভেসে আসছে। আমার মাথাটা আবারও ঘুরে উঠলো..
আবারও মাথা ঘুরে পরে গেছিলাম আমি। তবে এবার আর জ্ঞান হারাই নি। পরে যাওয়ার সাথে সাথেই বাবা দৌড়ে আসে আমার কাছে। যে ভাই কিছুক্ষণ আগেও অনেক চোটপাট করছিলো, সেই ভাই আমাকে পাজাকোল করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আমি সবই দেখছি, কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। ঠোঁট কাঁপছিলো আমার, বড় ভাই আমাকে স্নেহভরা ধমকে বলে উঠলো
“অনেক হয়েছে, অনেক তো বলেছিলি। এবার নাহয় আর নাই বললি। মুখটাকে বন্ধ রেখে চুপচাপ শুয়ে থাক। আমি ডাক্তার ডাকছি।
আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম আমার ভাইটার দিকে। শিহাব আর ভাইয়া দুজনেই চলে গেলো বাড়ির বাইরে। গন্তব্য, ডাক্তার ডাকা। ওরা চলে যাবার পর দেখলাম মা আমার জন্য এক মগ পানিতে স্যালাইন বানাচ্ছে। আমি এক নজরে মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমন সময় ধীরপায়ে বাবা এগিয়ে এলো আমার কাছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বাবা আমার পাশে এসে বসলো। উনার শক্ত হাতখানা আমার মাথায় রাখতেই আমি শান্তি অনুভব করলাম। পরম স্নেহের আবেশে চোখ বুজলাম। বাবা তার গম্ভীর গলাটাকে যথেষ্ট নরম করার চেষ্টা করে আমাকে বললো
“মা রে.. তুই এতটা কষ্টে ছিলি এতদিন, কেন আমায় একটা বার জানালি না? বাবার সাথে অভিমান করে বসে ছিলি? আমারও অনেক অভিমান হয়েছিলো জানিস তো! অভিমান যে ঠিক কতটা খারাপ তা আজ আমি বুঝতে পারছি। শুধুমাত্র আমার অভিমানের কারণে তোর জীবনে এতো দুঃখ নেমে এলো। আমায় মাফ করে দিস রে মা।
বাবা আমার দুইহাত চেপে ধরলো, উনার চোখে পানি। আমি অনেক কষ্টে উঠে বসলাম। বাবার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে চেপে ধরলাম শক্ত করে। বাবার চোখের দিকে তাকানো মাত্র আমার চোখদুটোও ভিজে গেলো, আমি জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে। বাবাও তার স্নেহময় হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। শেষ হলো মান অভিমানের পালা।।
পরের দিন কিছুটা ভালো বোধ করলাম, গতরাতে ডক্টর এসে দেখে চেকাপ করে গেলো। আমার বাবা ভাইকে কিছু টেস্ট করার জন্যও বলে গেলো। শরীরের কন্ডিশন নাকি খুব খারাপ। অতিরক্ত চিন্তা, মানসিক চাপ.. এইসবই নাকি আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বাড়িতে এখন পূর্ণ সেবা পাচ্ছি, সবার সাথে খাচ্ছি-দাচ্ছি। মায়ের সাথে বসে সময় কাটাচ্ছি। বেশ ভালোই কাটছে দিন। আমিও নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু সেটাই হচ্ছেনা। বার বার মৃদুলের কথা মনে হয়। এতদিনের সংসার আজ অন্যের হয়ে গেছে ভাবতেই বুকে কষ্ট হয়।
মেয়েটার মায়াভরা মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে, বুকে শূন্যতা অনুভব করি তখন। বাকিসব সইতে পারলেও মেয়েটাকে হারানোর ব্যথা এখনো আমাকে তাড়া করে। সেই সাথে সেই স্বপ্নটা তো আছেই। এখন ওটা নিয়মিতই দেখি।
সেদিন মা বারান্দায় বসে সুপারি কাটছিলেন। আমি ধীরপায়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। মা আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললো
“কিছু বলবি তনু?
আমি মলিন মুখে বললাম
“একটা কথা মা..
“কি কথা?
মা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি কোনো ভনিতা না করে মাকে বললাম
“একটা স্বপ্ন।
“স্বপ্ন!! অবাক হলেন মা।
“আমার মেয়েটা যবে থেকে মারা গেছে মা, তার কিছুদিন পর থেকেই আমি মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখি। মেয়েটা আমাকে ডাকছে, আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করছে। আমিও যাই মেয়েটার দিকে, জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনা। এর আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ইদানিং প্রায় প্রতি রাতেই এই স্বপ্ন টা দেখি আমি। এর কারণ কি মা? আমার মেয়েটা কি ওখানে সুখে নেই? আমার মেয়েটার কি কবরে গিয়েও কষ্ট হচ্ছে? কেন সে এতো কান্না করে?
আমার চোখের কোনে পানি চলে এলো ততক্ষণে। মা আমার দিকে কিছুক্ষণ নিরব চোখে তাকিয়ে রইলেন। উনার চোখেমুখে সামান্য আতংক।
“মরা মানুষ ডাকন তো ভালো কথা না মা।
আমি ভ্রু বাকিয়ে বললাম
“কেন?
“তুই বুঝবিনা।
দেখলাম মা হাতে থাকা সুপারি গুলো একটা পলিতে ভরলো। সেগুলো একটা ঝাপিতে রেখে ঘরের একপাশে রেখে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
“আমি একবার মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যাচ্ছি। তুই এখানেই থাক।।
আমি বসা থেকে উঠে দাড়ালাম। প্রশ্ন করলাম
“হঠাৎ ওখানে কেন? উনার সাথে তোমার কি দরকার?
মা আমার পাশে দাড়িয়ে করুণ গলায় বললেন
“মরা মানুষ ডাকন ভালো না রে মা। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে একটা কবজ নিয়ে আসি।
আমি দ্বিমত করে বললাম
“এইসব তাবিজ কবজ আমি গায়ে লাগাবো না মা। এটা শিরক।
“আমিও জানি, কিন্তু তোর দিকটাও তো দেখা লাগবো।
“যাই বলো না কেন, আমি জেনেশুনে এই পাপ করবো না।
মা আমার হতাশ হয়ে বললো
“তাহলে একটু পড়া পানিই নিয়া আসি।
মা যেতে নিলে আমি মা’কে বাধ সেধে বললাম
“তুমি যেও না মা। বাবা কে নয়তো শিহাবকে পাঠাও।
মা তাই করলেন, শিহাবকে পাঠিয়ে দিলেন মসজিদের দিকে।
আমি বসে রইলাম বারান্দাতেই। কিছুটা সময় পর শিহাব ফিরে এলো পড়া পানি নিয়ে। মা একটা গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে এলেন আমার কাছে। আমার হাতে দিয়ে বললেন পুরোটা খাওয়ার জন্য।
তাবিজ কবজে আমি বিশ্বাসী নয়, তবে পড়া পানি এবং ঝাড়ফুঁকে আমি বিশ্বাসী। মায়ের কথা মেনে আমি পানিটুকু খেয়ে নিলাম।
এরমাঝে একদিন শিহাব চলে গেছে তার চাকরিস্থলে। আমিও নিজ বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছি। বাবা আর ভাইও এখন আমার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল। শশুরবাড়ির লোকেদের আমার উপর অত্যাচারের কথা শুনে খুব ক্ষেপে গেছিলেন তারা। এটার একটা ব্যাবস্থা নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। আমার বিশেষ অনুরোধে তারা শান্ত হয়েছেন।
তবে তাদের উপর থেকে রাগ যায়নি। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি এখনও নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারিনি। মেয়েটার জন্য গুমড়ে গুমড়ে কাঁদি, মৃদুলকে মনে পড়লে এখনো চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। সারাক্ষণ মাথায় চিন্তা ঘুরপাক করে, টেনশন ভেতর থেকে আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকি। মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে, ইদানিং বাবাকেও দেখি আমাকে নিয়ে ভাবতে।
প্রায় ছয় মাস কেটে গেলো বাড়িতে। ইদানিং আমাকে নিয়ে বাবার চিন্তাটা আরো কয়েকগুণ বেশি বেড়ে গেছে।
সেদিন আমি আর মা উঠোনে চেয়ার পেতে বসে ছিলাম। বাবা কোত্থেকে যেনো তারাহুরো করে বাড়িতে ফিরলো, এসেই মাকে ডেকে নিয়ে গেলো ভেতর ঘরে। আমার কিছুটা অবাক লাগলো। বাবাকে এভাবে বাড়িতে ঢুকতে কখনোই দেখিনি। উনার চোখমুখও যেনো কেমন দেখাচ্ছে। আমার একটু খটকা লাগলো, কি এমন কথা যে মাকে এভাবে তলব করে ভেতরে নিয়ে গেলো!! আমি কি গিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনবো?
পরক্ষণে মনে হলো বাবা মায়ের কথা এভাবে আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনাটা ঠিক হবে না। আমি আগের যায়গাতেই বসে রইলাম। অপেক্ষায় রইলাম মা ফিরে আসার। প্রায় আধঘন্টা পর মলিন মুখে মা ফিরে এলো। আমার পাশে বসতেই বাবা আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় মাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“যা বলে গেছি, সেটা যেনো মাথায় থাকে। এর আগে আমার কথা শোনেনি, এবার যেনো অন্তত আমার কথাটার মূল্য সে দেয়।
আমার মাথা দিয়ে ঢুকলো না বাবার বলা কথাগুলো।বাবা চলে গেলে আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের কপালে চিন্তার ভাজ। চোখেমুখেও চিন্তার রেশ রয়ে গেছে। আমি মাকে প্রশ্ন করলাম
“কি হয়েছে মা? বাবা কিসের কথা বলে গেলো?
মা থমথমে মুখে উত্তর দিলো
“তোর ব্যাপারেই বলে গেছে।
আমি বললাম
“সে বাবার কথার ধরণেই বুঝে গেছি বাবা আমার ব্যাপারেই কিছু বলেছে। কিন্তু কি বলেছে মা?
মা এবার আমার দিকে নিরীহ চোখে তাকালো। হতাশায় বললো
“আমার একটা কথা রাখবি মা?
“বলো মা কি কথা? রাখার মতো হলে আমি অবশ্যই রাখবো।
“তুই চাইলেই রাখতে পারবি।
“কি কথা সেটা তো বলো।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরাচ্ছেন, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দেখে বুঝাই যাচ্ছে, কথাটা বলতে তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। আমি আবারও মাকে তাড়া দিয়ে বললাম
“ও মা, বলো না কি বলতে চাও।
“তুই আবার বিয়ে কর তনু।
মায়ের কথায় আমি চমকে উঠলাম। এই ধরনের কোনো কথা মা আমায় বলবে আমি ভাবিও নি। মা আবারও বললেন
“পেছনে যা গেছে, যা তোর সাথে হয়েছে সবকিছু মন থেকে মুছে ফেল তনু। জীবনটাকে নতুন করে শুরু কর।
আমি বিস্ময়ে মাকে বললাম
“এইসব কি বলছো মা? তোমরা তো সব জানো, তারপরও এই কথাটা তুমি কি করে আমায় বলতে পারছো!!
মা আমাকে সান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন
“আগে সবটা কথা শোন মা, আমরা তোর ভালোই চাই।
“এই রকম ভালোর কোনো দরকার আমার নেই মা। আমি ডিভোর্সি, আমার একটা বাচ্চাও ছিল। এখনো আমি সে-সব কিছুই মন থেকে মুছতে পারি নি। বাচ্চাটাকে এখনো আমাকে নাড়া দেয়। আমি মুখে যতই বলি মৃদুলকে ভুলে গেছি, কিন্তু বাস্তবতা তো এটাই, আমার মনে এখনো মৃদুল রয়েই গেছে। পিছুটান আমাকে এখনো ছাড়ছে না। আমি কি করে পিছুটান নিয়ে নতুন করে কারো জীবনে প্রবেশ করবো?
মা মলিন গলায় আমাকে বললেন
“আমি সবই বুঝি রে মা, কিন্তু তোকেও তো এভাবে বানের পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারিনা। তোর বাবা উপর থেকে শক্ত মনের মানুষ, কিন্তু ভেতর থেকে একদমই নরম। তোর কষ্টটা উনি আর নিতে পারছেন না।
আমি মায়ের দিকে ভেজা দৃষ্টিতে তাকালাম। মা চোখ সরিয়ে নিলেন। আমার চোখের পানিটা হয়তো তিনি সহ্য করতে পারছেন না।। আমি মা’কে মৃদু গলায় বললাম
“আজ সকালেও যখন বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলো, তখনও সব ঠিকঠাক ছিলো। হঠাৎ করে এমন কি হলো, যার কারণে তোমরা দুজনেই আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছো?
“আসলে তোর একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আজ। ছেলেটা অনেক ভালো, ভদ্র। সরকারি চাকরি করে। পরিবারটাও অনেক ভালো। শিক্ষিত চাকরিজীবী পরিবার। ওরা চাইছে তোকে বউ করে নিয়ে যেতে।
আমি ক্ষোভ নিয়ে বললাম
“যখন শুনবে আমার আগে বিয়ে হয়েছিলো, আমার একটা মেয়ে ছিলো তখন আর তাদের এই ইচ্ছেটা থাকবেনা। বাবাকেও বলে দিও ওদেরকে জানিয়ে দিতে এইসব।
মা এবার মুচকি হেসে বললো
“উনারা সব জানেন, সবকিছু জেনে শোনেই তারা তোকে নিতে চান।
আমি অবাক হলাম মায়ের কথা শুনে। এতো ভালো একটা পরিবারের সরকারি চাকুরি ওয়ালা ছেলে কি করে সব জেনেশুনে আমাকে বিয়ে করতে চাইতে পারে? দাদা নানার বয়সী কোনো বুড়ো নয়তো?
আমি সামান্য রেগে গিয়ে মা’কে বললাম
“আমি তোমাদের কাছে এতটাই বেশি হয়ে গেছি মা, যে তোমরা টাকাওয়ালা বুড়োর কাছে আমাকে বিয়ে দিতে চাইছো?
মা এবারেও হাসলেন। মায়ের এই হাসিটা আমার গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে। আমি ঝাঝ দেখিয়ে বললাম
“হাসছো কেন এভাবে?
“অবিবাহিত ছেলে কি করে বুড়ো হতে পারে?
চলবে….
#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
১৩
মা এবারেও হাসলেন। মায়ের এই হাসিটা আমার গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে। আমি ঝাঝ দেখিয়ে বললাম
“হাসছো কেন এভাবে?
“অবিবাহিত ছেলে কি করে বুড়ো হতে পারে?
“অবিবাহিত মানে? কোনো এক অবিবাহিত সরকারি চাকুরিজীবী ছেলে ঠিক কোন লাভে আমার মতো এক ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করবে?
মা বললেন
“ছেলেটা এখনো বিয়ে করেনি। আমাদের জেলা শহরে ছেলেটার কোনো এক আত্মীয়র বাড়ি আছে। আর ছেলেটা তোর ব্যাপারে সব জেনেশুনে তবেই বিয়ের প্রস্তাব খানা পাঠিয়েছে ঘটকের মাধ্যমে। যদিও ঘটক সাহেব বাড়ি আসেন নি। বাজারে তোর বাবার সাথে দেখা করেই এইসব বলেছেন। ছেলের ব্যাপারে সব শুনে তোর বাবাও রাজি হয়ে গেছে।
আমার মনে খটকা লাগলো। এমন মানুষ আছে নাকি, যে জেনেশুনে আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? পরক্ষণেই আবার সবকিছু মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম। মাকে শক্ত গলায় বললাম
“সে যাইহোক, আমি আর বিয়ে করবো না।
“তোর বাবা কি বলে গেছেন শুনেছিস নিশ্চয়ই।
আমি দায়সারাভাবে বললাম,
“শুনেছি মা। তাও আমি এই জীবনে আর বিয়ে করবো না।
মা আমার মিহি গলায় বললেন
“শোন মা, এ দুনিয়াতে এমন কোনো মানুষ নেই যার জীবনে কোনো বাধা আসেনি। তুই তো এ দুনিয়ার মানুষের মধ্যেই আছিস। বিনা বাধায় কেউ সারাটা জীবন পাড়ি দিতে পারে না। তোর সাথে যা যা হয়েছে তা ছিলো তোর সামনের দিকে এগুতে না পারার বাধা। সেসব বাধা তো এখন মিটে গেছে, তাহলে কেন তুই সামনে এগুবি না? কতটুকুই বা বয়স হয়েছে তোর? সারাটা জীবন এখনো বাকি। একটা মেয়ের পক্ষে একা জীবন কাটানো অনেক কষ্টের রে মা।
আমি একতরফাভাবেই আবারও বললাম
“সে তুমি যাই বলো মা, আমি বিয়ে করবোনা বলেছি, করবোই না।
মা হতাশ হয়ে বললেন
“তোর বাবাকে কি বলবো?
“যা বলার আমিই বলবো মা। তোমাকে কিছুই বলা লাগবে না।
মা আর কিছু বললেন না। বিকেলের দিকে বাবা আবারও বাড়ি ফিরলেন। যেহেতু দুপুরে খায় নি, তাই বাবা আসামাত্রই আমি ভাত বেড়ে দিলাম। বাবা খাচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি বাবার সামনেই। খাওয়ার এক ফাঁকে বাবা আমায় বললেন
“তোর মা তোকে কিছু বলেছিলো তনু?
আমি নির্জীব গলায় বললাম
“হু।
“তুই কি বললি?
আমি মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম
“একবার তো বিয়ে করেছিলাম বাবা। কপালে যে সুখ সইলো না। দ্বিতীয় বার আমি একই পথে পা দিতে চাই না বাবা।।
দেখলাম বাবা খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভাবলাম রেগে যাবেন। তবে অবাক হলাম, কারণ বাবার চোখেমুখে নেই কোনো রাগ। তিনি আকুতিভরা কন্ঠে বললেন
“দেখ মা, আগের কথা আমি টানতে চাই না। তবে একটা কথা কি জানিস… আমরা বাবা মায়েরা কখনোই সন্তানের খারাপ চাই না। আর প্রতিটি বাবা মায়েরই তাদের সন্তানকে নিয়ে কোনো না কোনো স্বপ্ন থেকেই থাকে। তোকে বিয়ে দিয়ে আমি আমার স্বপ্ন পুরণ করতে চাইছি না, শুধুমাত্র তোর একাকীত্ব দূর করতে চাইছি। তোর জীবনটা সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে চাইছি।
বাবার মুখে মুখে আমি কিছু বললাম না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা আবারও বলতে শুরু করলেন
“তোকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি আর সামর্থ্য কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু তোকে সুখের সাগরে ভাসানোর ইচ্ছেটা আমার আছে। আর সেই ইচ্ছেটা থেকেই আমি চেষ্টা করছি মাত্র। তোর মনমরা মুখখান আমার দেখতে ভালো লাগেনা রে মা। আর যাদের সাথে তোর বিয়ের কথা চলছে তারাও খুব ভালো মনের মানুষ। তা নাহলে জেনেশুনে কেন তোকে বিয়ে করতে চাইবে বল?
“আমি তো সুখেই আছি বাবা। আমার আর কোনো সুখের প্রয়োজন নেই তো।
বাবা মুচকি হাসলেন। বললেন
“মা রে, তোর সন্তান আমি নয়, বরং আমার সন্তান তুই। তাই তোর মনে কি আছে না আছে সে টা আমি আর তোর মা ঠিকই বুঝি। সুখে থাকার অভিনয় করলেই যদি সুখী হওয়া যেতো, তাহলে এ দুনিয়াতে কেউ অসুখী থাকতো না রে।
আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা বললেন
“আমি চাই তুই আবারও সংসারী হো, জীবনটাকে সুন্দর করে এগিয়ে নে। যে ইচ্ছাটা আমি আগে পূরণ করতে পারিনি, এবারে সে ইচ্ছাটা পুরণ করার সুযোগ দে।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এর আগেও বাবার কথার অবাধ্য হয়েছিলাম, অমান্য করে চলে গেছিলাম এক বেইমানের সাথে। বাবাকে কষ্ট দিয়েছিলাম। সেই বাবা নিজের সকল কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে আমার সুখের কথা ভাবছে। আমি কি করে তাকে আবারও মুখের উপর না করতে পারি?
নিজের জন্য সুখ খুজতে গিয়ে তো বার বার অসুখী হয়েছি। এবার নাহয় বাবার ইচ্ছেটা পুরণ করতে আবারও নিজের সুখকে বিসর্জন দিবো। আমি একটা উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বাবার দিকে তাকালাম। ভেজা গলায় বললাম
“আমাকে কি করতে হবে বাবা?
বাবা হাসলেন। বললেন
“আমি জানতান তুই আমার অবাধ্য হবি না। কাল সুন্দর করে একটু সেজেগুজে থাকিস। ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে তোকে। যদিও দেখার কিছুই নেই, ছেলে নিজে তোকে পছন্দ করেছে। তবুও সমাজের খাতিরে আসবে।
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম
“আচ্ছা।
বুকে ব্যাথা করছে খুব। না চাইতেও বাবার কথা মানতে হয়েছে শুধু বাবার ইচ্ছেটা পুরণ করার জন্য। বিছানায় শুয়ে পরলাম আমি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে উপায় নেই, বাবা বাড়িতে। শুনতে পেলে বুঝে যাবে শুধুমাত্র তার ইচ্ছেতেই আমি এটা করেছি। নিজের কষ্ট নিজের মনে চাপা দেওয়ার পূর্ণ চেষ্টা করছি।।
সেদিন রাতে আর খেতে ইচ্ছে হলো না। মা অনেক জোরাজুরি করলো, কিন্তু খেলাম না। ভাত নিয়ে বসলেও সে ভাত আমার গড়া দিয়ে নামতো না। লাইট অফ করে শুয়ে পরলাম। চোখ দুটো বন্ধ করতেই ভেসে আসলো মৃদুলের মুখখানা। আহ, কি মায়াবি মুখ, কি মায়াবী চেহারা। এ চেহারার আড়ালে যে একটা অন্য মানুষ ছিলো তা কে জানতো!
মৃদুলের মায়ের কথাও মনে হলো। অন্যকে অত্যাচার করতে করতে আজ সে নিজেই অত্যাচারিত। আমি হাসলাম, মানুষের জীবনটা বড্ডই অদ্ভুত। আজ যে ফকির, কাল সে ধনী। আর আজ যে ধনী, কাল সে ফকির। অথচ মানুষ এই সহজ সমীকরণ টা বুঝেও বুঝে না। হঠাৎ মনে উদয় হলো, মৃদুল কি সত্যিই ভালো আছে? নাকি সবটা টাকার কাছে বিক্রি করা অভিনয়?
মাথাটা আবারও ব্যাথা করছে। আমি দুহাত দিয়ে চেপে ধরলাম মাথাটা। চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো। হাতের তালুতে সে পানিটা মুছে নিলাম। এরপর শুয়ে পরলাম আবারও। রাতের শেষভাগে ঘুম ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ। তবে এবার সেই আগের স্বপ্ন টা নয়। সেটা থেকেও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে আজকের স্বপ্নটা। আজ আমি মহাখুশি। নিজের মেয়েটাকে আজ বুকের সাথে চেপে ধরতে পেরেছি, মেয়েটার একদম কাছে যেতে পেরেছি। আজকের স্বপ্নে মেয়ে আর আমি এক হয়েছি। আজ আমি খুব খুশি, আজ মেয়েটা আর কান্না করেনি, বরং হাসিখুশি ছিলো। আমিও খুশি আজ, বাস্তবে না হোক, স্বপ্নে হলেও মেয়েটাকে কাছে পেয়েছি, ছুতে পেরেছি।
সকাল থেকেই মনটা আমার বেশ ফুরফুরে আজ। অন্যদিনের তুলনায় আজকের দিনটা অন্যরকম লাগছে, মনে খুশি খুশি লাগছে। আমার খুশি দেখে বাবা মা ও আজ খুশি। হয়তো তারা ভেবেছে, আমার বিয়ের কথা হচ্ছে, তাই আমি খুশি। তবে তারা যে কারণেই খুশি হোক না কেন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
দুপুরের আগ নাগাদ গুটিকয়েক মানুষজন এসেছে। আমার বুকটা আবারও ভার হয়ে গেছে। ঘরের এক কোনে নতুন জামা পরে চুপচাপ বসে আছি আমি। মায়ের ইচ্ছেতেই নতুন জামা পড়া। তা নাহলে আমার এইসবের কোনো ইচ্ছে ছিলো না। চাইলে ও কাদঁতে পারছিনা যে কারণে চোখদুটো লাল হয়ে আছে। বাইরে বাবা আর ভাইয়া মিলে মেহমানদারি করছে। মা রান্নায় ব্যস্ত। আমাকে বোধহয় কিছুক্ষণ পর ওদের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি ফরিয়াদ করছি, কিছুক্ষণ পর সময়টা যেনো আমার জীবনে আর না আসে। এইসব আমার কাছে একদমই ভালো লাগছেনা।
ঘন্টাখানেক বাদে আমার মা রুমে এলো। দেখলাম, উনিও ভালো একটা কাপড় পরে আছে, মুখে হাসি। আমি তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। বাবা মায়ের মুখের এ হাসিটার দিকে তাকিয়েই আমি বছরের পর বছর পার করে দিতে পারি, এটা যদি তারা একটু বুঝতো।
মা আমাকে হাসিমুখে বললেন
“শরবত রেডি আছে, তুই এগুলো নিয়ে চলে যা ওদের সামনে। আর হ্যাঁ, ওদের সামনে গিয়ে ভদ্রভাবে সালাম দিবি। নম্রভাবে কথা বলবি।
আমি সামান্য বিরক্তির স্বরে বললাম
“এতো ফর্মালিটির কি দরকার মা? ওরা তো জানেই আমি ডিভোর্সি, তাহলে কেন এতো আয়োজন?.
মা সামান্য রেগে গিয়ে বললো
“এই অপয়া শব্দটা আর একবারও যদি মুখ থেকে বের করেছিস, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বললাম।
আমার কপালে ভাজ পরলো, কিন্তু মায়ের মুখের উপর কিছু বলার আর সাহস পেলাম না।
এরমধ্যে আমার ভাইয়া চলে এলো ঘরে। সে মাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“তনু রেডি আছে তো মা?
মা নরম হয়ে বললেন
“রেডি আছে। ওকে নিয়ে যা তুই।
ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। এরপর সামান্য ধমকের গলায় বললো
“একটুও সাজলি না যে? মুখে তো বোধহয় সামান্য ক্রীমও মাখিস নি।
“ওরা তো নাকি আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে, এটা তো শুধু ফর্মালিটি । সাজগোছের কোনো প্রয়োজন মনে করছিনা ভাইয়া।
আমার কথায় সামান্য রেগে গেলো ভাইয়া। কিন্তু বাইরে মেহমান আছে তাই রাগটাকে দমন করে বললো
“আয় আমার সাথে। উনারা অপেক্ষা করছে সবাই।
আমি মায়ের মুখের দিকে একবার তাকালাম। মা আমাকে চোখে আস্বস্ত করে ভাইয়ার সাথে যাবার জন্য অনুরোধ জানালো। আমি ভাইয়ার পিছু পিছু হাঁটা ধরলাম। মাথাটা ঘুরছে আমার, পা দুটো কাপছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুণি মাথা ঘুরে পরে যাব।
বাইরে উঠোনের মাঝে একটা টেবিল সাজানো। তার চারপাশে আমার বাবা সহ বাকিরা বসে আছে। আমি ধীরপায়ে ভাইয়ার পিছু পিছু গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলাম। সবাই সালামের উত্তর দিলেন। এদের মধ্যে একজন আমাকে বসতে বললেন। সামনে থাকা চেয়ারটায় আমি বিনয়ের সাথে বসলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই শুনলাম আমার বাবা উনাদের কাছে আমার নামে গুনগান করছে। আমার হাসি পাচ্ছে এইসব গুণগান শুনে, তবে হাসা যে বারণ৷
তিন থেকে চার জন লোক হবে। আমি এখনো কারো মুখের দিকে তাকাই নি। দুই একজন আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করছে। আমার ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে। বাবার কথা মনে করে আমি ভদ্রভাবে উত্তর দিলাম। উনারা বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন আমায়। মনে হলো, কোনো সরকারি চাকরির ভাইবা এক্সাম দিচ্ছি আমি। এসবের মানে কি এটাই বুঝলাম না, যেখানে ছেলে নাকি আমায় আগে থেকেই চুজ করে রেখেছে।
যাইহোক, ভদ্রতার খাতিরে সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।
হুট করেই একজন বলে উঠলো
“নিচের দিকে তাকিয়ে আছো কেন মামনি, একটু সামনে তাকাও।
শুনলাম, কন্ঠটা বেশ মায়াবী। বোধহয় ছেলের বাবা কিংবা মামা কাকা হবে। তা নাহলে আমায় মামনি বলে ডাকতো না। সামনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিলো না আমার, আবার সেই মধুমাখা কন্ঠে মামনি ডাক শোনার পর সে ডাককে অগ্রাহ্য করতেও পারছিলাম না। অবশেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমি সামনে তাকালাম। সামনে তাকানো মাত্রই যাকে দেখতে পেলাম তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো, মাথায় যেনো বাজ পরলো বিশালাকারের। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
আমার মুখ থেকে আকস্মিক আর্তনাদের স্বরে বেরিয়ে এলো
“আপনি?
চলবে,