#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#একাদশ_পর্ব ( রহস্য-১)
৩০.
পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে প্রাচী। নাকের ডগা, আর চোখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। একটু আগেই ঘরের দরজা বন্ধ করে নিরবে অজানা গুমোট অনুভূতি গুলো কান্নার মাঝে প্রকাশ করেছে সে। পরনে ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়ি। রাগে ক্ষোভে এখনো পাত্রের দিকে মাথা তুলে তাকায় নি প্রাচী।
– “আমরা তো অনেক কথাই বললাম, এবার না হয় ছেলে মেয়ে দুজনকে আলাদা করে কথা বলতে দেয়া যাক।”
– “হ্যাঁ, অবশ্যই। চলুন ওদিকটায় যাওয়া যাক।”
আনোয়ার সাহেবের কথায় মাঝবয়সী ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী সহ সকলেই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতেই চারপাশে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সামনাসামনি দুজন মুখোমুখি হয়ে বসে থাকলেও কারো মুখে কোনো কথা নেই।
– “কি করব? এভাবে মাথা নিচু করে বসে থাকলে তো হবে না। কিছু একটা করতে হবে নাহলে এই লোকটার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। কি করলে বিয়েটা ভেঙে যাবে? কিছু একটা কর প্রাচী।
লোকটাকে সরাসরি না করে দিব? না আমি বিয়েটা করতে পারব না।”
মাথা নিচু করে নিজের সাথেই মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে প্রাচী।
– “মিস প্রাচী?”
রুক্ষ কন্ঠস্বর, তবুও পরিচিত। সামনে থাকা ব্যক্তিটির কন্ঠ শুনে তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী। চেনা পরিচিত মুখ দেখতেই আরেক দফা অবাক হয় সে।
– “রাইয়্যান স্যার, আপনি!!”
খানিকটা অবিশ্বাস্য সুরেই বলে উঠে প্রাচী।
প্রাচীর থমথমে অবাক মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসে রাইয়্যান।
– “হ্যাঁ, আমি। কেন অবাক হয়েছো?”
রাইয়্যানের প্রশ্নে থতমত খেয়ে বসে প্রাচী। তবুও মুখটাকে বেশ গম্ভীর করে শান্ত গলায় বলে ওঠে,
– “এসব কি রাইয়্যান স্যার? আমি আপনার কাছ থেকে অন্তত এসব এক্সপেক্ট করি নি।”
– “কাম ডাউন, মিস প্রাচী। ইটস এ নরমাল ম্যাটার। আর রইল এসব করার কারণ সেটা হলো আই ফল ইন লাভ উইথ ইউ মিস প্রাচী। আর সেটা হুট করেই না, ভার্সিটির প্রথম ক্লাসে দেখার পর থেকেই। আ’ম ম্যাডলি লাভ উইথ ইউ প্রাচী। আর সেটার জন্যই আমি আজকে এখানে এসেছি।”
রাইয়্যানের বলা কথায় পুরো থ বনে যায় প্রাচী। কি বলছে এসব রাইয়্যান? অতি আশ্চর্যতার কারণে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে।
– “হোয়াট!! কি বলছেন এসব আপনি? আর ইউ ফাইন মিস্টার রাইয়্যান?”
– “লিসেন প্রাচী। ডোন্ট বি হাইপার!
আগে আমার পুরো কথা তো শুনো। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি আর সারাজীবনের জন্য ভালোবাসতে চাই, নিজের করে পেতে চাই। আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ মিস মেহরিশ আয়াত প্রাচী।”
রাইয়্যানের বলা শেষ কথাটি শুনে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। রাগে ক্ষোভে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় সে। কিন্তু চোখ বন্ধ করার পরক্ষণেই অন্ধকারে থাকা সেই চোখ দুটো ভেসে উঠে।
– “মেহু পাখি, তুমি শুধু আমার!”
কল্পনার জগতে কথাটি কানে ভেসে আসতেই ঝট করে চোখ মেলে তাকায় প্রাচী। না তার পক্ষে রাইয়্যানকে বিয়ে করা সম্ভব না। রাইয়্যানের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রুমে কড়া নাড়েন আনোয়ার সাহেব।
ফজলুল সাহেব, রুবি বেগম, আনোয়ার সাহেব, জেবা বেগম সকলেই হেসে হেসে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করেন।
– “ভাইসাহেব, আজ তো অনেক হলো। বাচ্চারাও নিশ্চয়ই তাদের মাঝে কথা বলে নিয়েছে। আর আমরাও আশা করি ফলাফল ভালোই হবে। আজ উঠি তাহলে সবাই। আমি রাইয়্যানের সাথে কথা বলে সবটা জানিয়ে দিব।”
সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রুম থেকে ধীরে ধীরে প্রস্থান করে রাইয়্যান ও তার পরিবার। এদিকে এই বিষয় নিয়ে চিন্তায় চোখ মুখ শুকিয়ে এসেছে ইতোমধ্যে প্রাচীর। তাহলে কি সবকিছুই তার হাতছাড়া হয়ে গেল?
৩১.
পুরো খাট জুড়ে ছোট বড় চিরকুট দিয়ে ভরপুর। তার থেকে ঠিক কিছুটা দূরেই দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচী।
– “এতদিন এসব করার কি মানে ছিল? কি দরকার ছিল এসব চিরকুট লিখার, আমাকে এসবের প্রতি দুর্বল করার; যেখানে বর্তমানে আপনার কোনো অস্তিত্বই নেই।
আর যদি অস্তিত্ব থাকতো তাহলে এভাবে আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন না, নিজেকে প্রকাশ করতেন আমার সামনে। আমি চাই না আর এসব লুকোচুরি। এসব লুকোচুরি খেলা বাদ দিয়ে সামনে আসুন আমার। আমিও দেখতে চাই কে আপনি; কি আপনার পরিচয় যাকে ঘিরে এত রহস্য!”
বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে প্রলাপ বকে প্রাচী।
– “কি মনে করেছো, এসব হুট করেই হয়েছে? নো মিস প্রাচী। ইউ আর টোটালি রং! এসব তোমার কাছে হুট করে মনে হলেও আসল রহস্য তোমার অজানাই। এই খেলার সামান্য মাত্র একটা গুটি তুমি, যাকে কাজে লাগিয়ে আমি আমার বানানো প্ল্যান এক্সিকিউট করব আর সেটা তুমি টেরও পাবে না।
ভালোবাসা? বিয়ে করা? সেটাতো জাস্ট একটা গেইম। এই রাইয়্যান আহমেদের কাছে ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না, না কিছু আছে আর না কখনো হবে!
আর বাদবাকি রইলো তোমার হিডেন লাভার, ওর সাইকো লাভার হোয়াটেভার সেও আমাকে আটকাতে পারবে না। বি রেডি মিস প্রাচী ফর ইউর স্যাক্রিফাইস।”
ক্লাবের এক কর্ণারে বসে ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে উঠে রাইয়্যান। সামনেই ফোনের স্ক্রিনে প্রাচীর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভেসে রয়েছে। কি এমন রহস্য; যাকে ঘিরে এতকিছু?
পরদিন সকালে,,
যথারীতি সময়ে সকালের নাস্তার টেবিলে এসে বসতেই জেবা বেগম বলে উঠেন,
– “যাক তাহলে এসেছিস, এই নে ঝটপট নাস্তা খেয়ে নে।”
মিনিট পাঁচেক বাদে রুম থেকে আনোয়ার সাহেব ও বের হন। মুখে যথেষ্ট হাসি হাসি ভাব। এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতেই তিনি বলে উঠেন,
– “শুনছো নাকি জেবা, একটু আগেই রাইয়্যানের বাবার সাথে কথা হয়েছে ফোনে। তাদের নাকি প্রাচীকে পছন্দ হয়েছে। আর রাইয়্যানের সাথে কথা বলে এটাও জানিয়েছে যে তারা খুব দ্রুতই বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে চায়।”
– “আলহামদুলিল্লাহ্। এ তো দেখছি বেশ ভালো খবরই পাওয়া গেল সকাল সকালই।”
সবে মাত্র এক লোকমা খাবার মুখে তুলেছিল প্রাচী। কিন্তু বাবার কথা শুনে সেটাও যেন গলায় আটকে গিয়েছে।
– “কিন্তু বাবা, এটা একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? সবে তো রাইয়্যান দেখে গিয়েছে প্রাচীকে; এর মাঝেই এত তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাপারটা কি আদৌ ঠিক হবে?”
আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে শঙ্কাজনক কন্ঠে বলে উঠে ইশরাক।
– “হ্যাঁ, বাবা ভাইয়া তো,,”
প্রাচীর কথাকে ইশারায় থামিয়ে দেয় জেবা বেগম।
– “আমি জানি বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে, তবে এমন ভালো ছেলে হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে? দেখতে ভালো, ইস্টাবলিশড্, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের প্রাচীকে ভালো রাখবে।
আর আমিও চাই বিয়েটা খুব শীঘ্রই হয়ে যাক। আশা করি আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ উপনীত হবে না।”
নিজের বাবার এমন পরিবর্তনশীল আচরণ ঠিক মেনে নিতে পারছে না প্রাচী। কেন যেন মন সায় দিচ্ছে না এই বিয়েটা করতে। অন্যদিকে আনোয়ার সাহেবের কথায় ইশরাক ও আর কথা বাড়ায় না। অপেক্ষা এখন শুধু সময়ের।
– “মা, আমি আসছি।”
– “কিন্তু পুরোটা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
– “খিদে নেই। আকাশ আর হৃদিতা ওয়েট করছে আমার জন্য।”
বলেই ব্যাগ নিয়ে উঠে দ্রুত পায়ে বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করে প্রাচী।
৩২.
– “আচ্ছা বাবা, তুমি আমাল সাথে সবসময় থাকো না কেন?”
ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। পিহুর করা প্রশ্নে থেমে যায় সে। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরাতেই খেয়াল করে পিহুও তার করা প্রশ্নের উত্তর পেতে উৎসুক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
– “হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন পিহু মামনি?”
– “সবাল বাবা, মাই তো একসাথে থাকে। কই তুমি তো আমাল সাথে সবসময় থাকো না। আর মা কোথায় বাবা?”
পিহুর প্রশ্নের কি উত্তর দিবে তা খুঁজে পায় না সমুদ্র। কি করে বোঝাবে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে তাকে ছুটে চলতে হবে সেই সুদূর অতীতে।
– “বলেছি তো পিহু মামনি, আর কয়েকটা দিন। আর কয়েকটা দিন পার হলেই বাবা তোমার সাথেই থাকবে। আর তোমার মা ও থাকবে। বলেছিলাম না তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। সেই সারপ্রাইজ টা তুমি খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে পিহু মামনি।
মিস অর্পিতা?”
সমুদ্রের ডাকে কিচেন থেকে ছুটে আসে অর্পিতা। সমুদ্র চোখের ইশারা দিতেই অর্পিতা এসে পিহুকে কোলে তুলে নিয়ে চলে যায়।
ল্যাপটপ স্ক্রিনে ভেসে থাকা ইমেইল ফাইল ওপেন করতেই ঠোঁটের কোণে হাসির চিহ্ন ফুটে ওঠে সমুদ্রের।
– “গেইম ইজ অন।”
কফিশপের কর্ণারের দিকে থাকা সিটে বসে রয়েছে আকাশ, হৃদিতা আর প্রাচী। আকাশ আর হৃদিতা দুজনের দৃষ্টিই বর্তমানে প্রাচীর দিকে স্থির।
– “এসবের মাঝে এতকিছু হয়ে গেল অথচ তুই আমাদের জানানোর প্রয়োজন ও মনে করিস নি?”
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে উঠে হৃদিতা। অন্যদিকে প্রাচীর দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির।
– “তোর সাথে এত কিছু হয়েছে আর তুই একটাবারও বলিস নি। আর রইল রাইয়্যান স্যারের কথা, ব্যাটা যে এত পরিমাণ লুচু হবে তা কে জানতো!”
– “কেন বলিনি সেটার কারণ তোদের একটু আগেই বলেছি।”
– “তো এখন কি করতে চাস তুই? তুই কি সত্যিই রাইয়্যান স্যারকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস?”
আকাশের করা প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় প্রাচী।
– “যেমনটা চলছে তেমনটাই চলতে দে। এই বিয়েতেই সেই অজানা আগন্তুকের পরিচয় পাওয়া যাবে। সে নিজে থেকেই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে এন্ড ইটস্ মাই প্রমিজ। আর তার জন্য যদি আমাকে মিস্টার রাইয়্যানের সাথে বিয়েও করতে হয় তাতেও আমি রাজি।
বি রেডি মিস্টার ইনভিজিবল, ব্যস অনেক হয়েছে গেইম। এবার আপনাকে আমার সামনে আসতেই হবে।”
খানিকটা দৃঢ়তার সাথে বলে উঠে প্রাচী। আসলেই কি তাই? তবে কি এবার আসলেই বেরিয়ে আসবে মিস্টার ইনভিজিবলের পরিচয়?…………..
#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বাদশ_পর্ব
৩৩.
হোসেন বাড়ি পুনরায় বিয়ে নামক শব্দে মুখরিত। চারপাশে ব্যস্ততা একপ্রকার চেপে বসেছে যেন। আনোয়ার সাহেবের মুখে প্রাণোচ্ছ্বল হাসি। বড় ছেলের পর একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
বাড়ির সবার মুখ হাসি হাসি থাকলেও হাসি নেই শুধু ইশরাকের মুখশ্রীতে; বরং হাসির পরিবর্তে একরাশ আশংকার ছাপ স্পষ্ট। তার মতে সবটা এত তাড়াহুড়ো না করে হলেও পারত। অন্যদিকে বিয়ে বাড়ির সব ঝামেলা, আমেজ থেকে দূরে সরে নিজের রুমে বসে বসে কম্পিউটার স্ক্রিনে হরর, থ্রিলার মুভি “Halloween Kills” দেখে চলেছে প্রাচী; যেন এই বিয়ে নিয়ে তার মাঝে কোনো ভাবান্তর ই নেই।
– “প্রাচী, এই প্রাচী আর কত রুমের মধ্যে বসে থাকবি? দরজা খোল!”
দরজার ওপাশ থেকে জেবা বেগমের দৃঢ় কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই একপলক দরজার দিকে তাকিয়ে মুভি পজ করে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী।
– “কি হয়েছে মা?”
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রাচী।
– “আর কত এভাবে রুমের মধ্যে পড়ে থাকবি? এখন ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে। একটু পর সবাই বের হবে।”
মায়ের কথায় আপনাআপনি ভ্রু কুঁচকে আসে প্রাচীর।
– “বের হবে মানে? কোথাও যাব নাকি সবাই?”
– “হ্যাঁ, বিয়ের কনে তো এমনি এমনিই বিয়েতে উপস্থিত হবে না। বিয়ের ড্রেসের জন্য একটু আগেই রাইয়্যান ফোন করেছিল। সবাই মিলে শপিং এ যেতে হবে। রাইয়্যান ও আসবে সেখানে। এখন দ্রুত রেডি হয়ে নাও।”
রাইয়্যানের কথা শুনতেই চোখ মুখ কুঁচকে নেয় প্রাচী যেন রাইয়্যানের উপস্থিতি তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। তবুও জোরপূর্বক হেসে বলে উঠে,
– “ঠিক আছে, আমি আসছি রেডি হয়ে।”
মেয়ের কথা শুনে জেবা বেগম ও স্মিত হেসে সেখান থেকে দ্রুত পায়ে চলে আসেন।
চুলগুলো একপাশে বেনি করা, মুখে তেমন একটা মেকআপের আবরণ নেই। পরিপাটি হয়ে নিচে আসতেই খেয়াল করে সবাই খোশগল্প করায় ব্যস্ত। কর্ণারের দিকে চোখ যেতেই খানিকটা বিস্মিত হয় প্রাচী। সমুদ্র এখানে কি করছে? তাহলে কি তার বিয়ের খবরটা সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে? গম্ভীর হয়ে ভাবতে ভাবতেই নিচে নেমে আসে প্রাচী।
– “ঐ তো প্রাচীও এসে পড়েছে। এবার না হয় চলা যাক, বাইরে ড্রাইভার ওয়েট করছে; আর ওদিকে রাইয়্যানের ফ্যামিলিও এসে পড়বে।”
আনোয়ার সাহেবের কথায় সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
পেছনের গাড়িতে ফিহা, প্রাচী আর সমুদ্র বসেছে। ফ্রন্ট সিটে থাকা লুকিং গ্লাসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সমুদ্র। তার বিপরীত পাশে বসে থাকা প্রাচীর দিকে তার দৃষ্টি স্থির।
জানালার গ্লাস ভেদ করে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রাচীর।
– “বিয়ে? বিয়ে করার খুব শখ তাই না প্রাচী? নে এবার বোঝ। ঐ ব্যাটা বদ লোকের জন্য কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে। বিশেষ করে ঐ ব্যাটা রাইয়্যানের এসব ন্যাকামি। তার উপর এই কনকনে শীতের ঠান্ডা হাওয়া। একবার আপনার আসল পরিচয়টা পেয়ে নেই মিস্টার ইনভিজিবল; এর থেকে দ্বিগুণ নাকানিচোবানি না খাইয়েছি তাহলে আমিও প্রাচী না।
এখন শুধু আমার বানানো প্ল্যান সাকসেসফুল হলেই হয়।”
ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বিড়বিড় করতেই প্রাচীর চোখ পড়ে লুকিং গ্লাসের দিকে। সে কি? সমুদ্র তার দিকে সরু দৃষ্টিতে একইভাবে তাকিয়ে রয়েছে। লজ্জায় দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে। সমুদ্র কি ভাবছে ভেবেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে প্রাচীর।
৩৪.
শপিং মলের বিয়ের কনে ও বরের ড্রেস, অর্নামেন্টস এরিয়ায় চলে যেতেই রাইয়্যান সহ তার পুরো পরিবারকে দেখতে পায় প্রাচী। আনোয়ার সাহেব এগিয়ে গিয়ে ফজলুল সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময় করেন।
সবাই মিলে ভেতরের দিকে গেলেও সমুদ্র একটা ফোনকলের জন্য বাইরেই ওয়েট করে। এদিকে প্রাচী যতই রাইয়্যানের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে ততই রাইয়্যান তার সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করে।
– “ইউ লুক সো গর্জিয়াস মিস প্রাচী।”
খানিকটা ফিসফিস করে প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে রাইয়্যান।
– “গর্জিয়াস? কেন মিস্টার রাইয়্যান? আমি কি আপনার সামনে বউ সেজে বসে আছি নাকি?”
তড়িৎ গতিতে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে প্রাচী। এতে সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাইয়্যান। গলা খাঁকারি দিয়ে আর কিছু না বলেই হাঁটা শুরু করে সামনের দিকে।
– “চোখ না চুলা! ফাপরবাজির ও একটা লিমিট থাকে। কাম ডাউন প্রাচী। সবার সামনে হাইপার হলে চলবে না। আর কয়েকটা দিন ই তো। সহ্য করে নে। ব্যাটা আস্ত একটা ফাপরবাজ।”
রাইয়্যানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের সাথেই আনমনে প্রলাপ বকে প্রাচী।
ভারী কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটা লাল রঙের লেহেঙ্গা সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রাচীর। কিন্তু কোনোটাই তার পছন্দ হয়নি। প্রাচীর এহেন কান্ডে দোকানদাররাও বেশ বিরক্ত যা তাদের মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
– “আচ্ছা সমুদ্র কোথায়? ওকে তো দেখতে পারছি না। এক কাজ করি, সমুদ্রকে ডেকে নিয়ে আসি। আফটার অল সমুদ্রের পছন্দ সবসময়ই বেস্ট হয়।”
ইশরাকের প্রস্তাবে উপস্থিত সবাই সায় দিলেও রাইয়্যানের তা কেন জানি খুব একটা পছন্দ হয় নি। তবে বড়দের কথার
অমান্য করতে না পারায় সবটা চুপচাপ মুখ বুজে সহ্য করে নেয় সে।
ইশরাক সমুদ্রকে নিয়ে একপ্রকার জোর করেই প্রাচীর পাশে বসিয়ে দেয়। আড়চোখে প্রাচীর দিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দেয় সমুদ্র।
পছন্দ অনুযায়ী ইশারা দিতেই দোকানদার কালো রঙের একটা বিয়ের ড্রেস নিয়ে আসে। অসাধারণ কারুকাজ আর সাথে কালো স্টোনের সংমিশ্রণে লেহেঙ্গাটির সৌন্দর্য যেন আরো ফুটে উঠেছে। প্রাচীও অবিশ্বাস্য চোখে একবার লেহেঙ্গার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সমুদ্রের দিকে। আসলেই ছেলেটার পছন্দ আছে বলতে হবে। গত একঘন্টা যাবৎ যা সে পছন্দ করতে পারে নি তা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সমাধান করে দেয়াতে সবাই সমুদ্রের প্রশংসায় ব্যস্ত।
বিয়ের কেনাকাটা শেষ করতে করতে বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা। চারপাশে ব্যস্ত ঢাকা নগরীর কোলাহল ও আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। রেস্টুরেন্টের এক কর্ণারে বসে এতক্ষণ এগুলোই দেখছিল প্রাচী। হঠাৎ কেউ তার মুখোমুখি হয়ে বসতেই নড়েচড়ে বসে সে। মাথা তুলে তাকাতেই রাইয়্যানের চেহারা চোখে পড়ে তার। সাথে সাথেই মুখশ্রী থেকে হাসির রেখা উবে যায় প্রাচীর।
– “হেই মিস, সরি উডবি মিসেস প্রাচী এভাবে এখানে একা একা বসে আছো কেন?
আমার তো বিলিভ ই হচ্ছে না আর মাত্র দু’দিন পরেই আমি তোমাকে নিজের করে পাব সারাজীবনের জন্য। আ’ম রিয়্যালি হ্যাপি ফর দ্যাট। আই লাভ ইউ সো মাচ, প্রাচী।”
টেবিলের উপর রাখা প্রাচীর হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে উঠে রাইয়্যান।
– “শখ কত বিয়ের? আর এমন ভাবে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করছে যেন ভালোবাসা উতলে উতলে পড়ছে আমার জন্য। আর কত নাটক করতে হবে কে জানে? জাস্ট বিরক্ত লাগছে এসব। যত্তসব ন্যাকামি!”
মাথা নতজানু করে বিড়বিড় করে প্রাচী।
– “কিছু বললে?”
চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে ওঠে রাইয়্যান।
– “নো, মিস্টার রাইয়্যান। আমি বলছিলাম যে আমিও প্রচুর খুশি আপনার যতো এমন একজন লাইফ পার্টনার পেতে চলেছি।”
বলেই জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে প্রাচী।
৩৫.
ঘড়িতে রাত ১১:০০ টা ছুঁই ছুঁই। সারাদিনের ধকলে শরীরে ক্লান্তি জুড়ে বসেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়ানোতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। এমনিতেই আগামীকাল হলুদের অনুষ্ঠান রয়েছে। তার উপর ক্লান্ত শরীরে ঘুমে চোখ আপনাআপনিই বুজে আসছে বারবার।
ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে প্রাচী। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন; কিন্তু ফোনের ভাইব্রেশনের মতো তীক্ষ্ণ বিরক্তিকর শব্দ কানে এসে পৌঁছাতেই ঘুম ঘুম চোখেই হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে ফোন তুলে নেয় প্রাচী। আননোন নাম্বার থেকে টানা ১৩ বার মিসড কল এসেছে অথচ সে এতটাই গভীর ঘুমে ছিল টেরই পায়নি। রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই ফোনের অপরপাশে থাকা ব্যক্তিটির ঘোর লাগানো আগ্রাসী কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “মেহু পাখি?”
নিমিষেই চোখে লেগে থাকা ঘুমের রেশ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যায়। এ তো চেনা কন্ঠ। তবে কি মিস্টার ইনভিজিবল আর কেউ নয় বরং ……
ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে প্রাচীর।
পরনে কাঁচা হলুদ আর ডার্ক পিংক কালারের লেহেঙ্গা, কাঁচা ফুলের অর্নামেন্টস্, চুলগুলো কার্ল করে বেনি করা, মুখে মেকআপের আবরণ, সবমিলিয়ে পুতুলের চেয়ে কম লাগছে না প্রাচীকে। বিয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে গায়ে হলুদ। আর আজকে সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই হোসেন বাড়ি মেহমানে পরিপূর্ণ। প্রাচীর মুখেও স্নিগ্ধ হাসি।
সন্ধ্যে নেমেছে। বাড়ির ছাদে সুন্দর করে রঙ বেরঙের কাঁচা ফুল, মরিচবাতি দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে। চারপাশের করা ডেকোরেশন ও যথেষ্ট পরিমাণে নজরকাড়া। আনোয়ার সাহেব ও জেবা বেগমের মাঝে মেহমান নিয়ে রয়েছে বেশ ব্যস্ততা।
রুমের মধ্যে আয়নার সামনে বসে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। তখনই রুমে প্রবেশ করে ফিহা। মুচকি হেসে এগিয়ে যেতেই আদুরে গলায় প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
– “আজ আমার ননদিনীর থেকে চোখ ফেরানোই মুশকিল। না জানি বিয়ের দিন রাইয়্যানের কি অবস্থা হবে। বেচারা তোমাকে দেখে দেখেই দিন পার করে দিবে।”
ফিহার কথার প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসে প্রাচী। আসলেই জীবন অদ্ভুত সুন্দর। কখন কোথা থেকে কোন মোড়ে চলে যায় তা বোঝা অত্যন্ত কঠিন।………..
#চলবে 🍂
#চলবে 🍂