#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব: ১৮ ( শেষ পর্ব)
ইরিনের পৃথিবীটা বড্ড ঘোলাটে লাগছিল । আলোর বলা কথা গুলো বিশ্বাস করতে কিছুতেই মন সাঁই দিচ্ছে না অথচ আলোর বলা শেষ কথা গুলো মাথার মধ্যে বড্ড ঘোরপাক খাচ্ছে ।
সৌমিক তবে ধোঁকা দিয়েছে আমাকে শেষ পর্যন্ত , কি করে পারলো , এতো দিনের ভালোবাসা সব মিথ্যে হয়ে গেল কিভাবে এসব ভাবতে ভাবতে ইরিনের নিশ্বাস আটকে আসতে লাগলো । ইরিন দ্রুত রহিমা খালা আর স্নিগ্ধাকে খুঁজতে লাগলো সব রুমে কিন্তু কোথাও ওদের খুঁজে পেল না ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল ।
রহিমা বেগম আর স্নিগ্ধা ছাদ থেকে নিচে আসতেই দেখতে পেল ইরিন ফ্লোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে ।
স্নিগ্ধা দৌড়ে এসে ইরিনের মুখে হাত দিয়ে বলতে লাগলো ” মামনি ওঠো , কি হয়েছে ও মামনি ওঠো ” ।
রহিমা খালা দ্রুত এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে চোখ মুখে ঝাপটা দিতে লাগলো কিন্তু কোনো ভাবান্তর না দেখে পরিচিত এক ডাক্তার কে ফোন দিল ।
দুজন মিলে কোনো রকমে ধরে বিছানায় উঠিয়ে দিলো । ইরিনের হাত পা ম্যাসাজ করতে করতে এরিই মধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো স্নিগ্ধা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দুজন লোক রুমের মধ্যে প্রবেশ করলো ।
– মামনি বাসায় লোক কোথায় ?
– ডাক্তার আঙ্কেল আপনি আসুন মামনি ঐ রুমে ।
বলেই স্নিগ্ধা ওদের বেডরুমের দিকে নিয়ে গেল ।
-স্যার আমি বাইরে অপেক্ষা করি আপনি দেখে আসুন ।
– আচ্ছা তুমি এখানে বসো আমি রোগী দেখে আসি ।
ডাক্তার ইরিনের প্রেসার দেখে বললেন খাওয়া দাওয়া হয় নি ঠিক মতো , বিপি অনেক লো , টেনশন থেকেই এমনটা হয়েছে ভয়ের কিছু নেই ।
একটা স্যালাইন দিলে দূর্বলতা টা চলে যাবে ।
– জ্ঞান কখন ফিরবে ভাই ?
– টেনশনের কিছু নেই আধা ঘন্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে ।
স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে দেখছিল সবটা ডাক্তার যেই না ইনজেকশন পুশ করতে যাবে ওমনি কান্না করে ডাক্তার কে বললো – “মামনি কে ইনজেকশন দেবে না ”
– কেন এমন বলছো বাবু কান্না করো না ইনজেকশন দিলে মামনি ঠিক হয়ে যাবে ।
কিছুতেই ইরিন কে ইনজেকশন দিতে দিচ্ছে না স্নিগ্ধা খুব করে কান্না করছে আর বলছে “মামনি ব্যাথা পাবে” ।
রহিমা বেগম কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না জোর করে ওকে ড্রয়িং রুমে আনতেই সোফায় বসে থাকা ছেলেটা স্নিগ্ধাকে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল “তুমি কান্না করছো কেন মামনি” ?
– জানো আঙ্কেল মামনি কে ইনজেকশন দিচ্ছে মামনি ব্যাথা পাবে তো আমি ব্যাথা পায় ।
– তুমি মামনি কে কতো পার্সেন্ট ভালোবাসো বলোতো ?
– হার্ন্ডেড পার্সেন্ট আঙ্কেল ।
– তবে তুমি চাও না আম্মু সুস্থ হয়ে যাক আগের মতো ?
– চাই তো ।
– তবে ডাক্তার আঙ্কেল ইনজেকশন টা দিলে মামনি আবার সুস্থ হয়ে যাবে , এখন ছোট মামনি টা আর কান্না করবে না তো ?
– ব্যাথা পাবে না তো মামনি ?
– একটুও না ।
– আচ্ছা তবে ঠিক আছে , গুড গার্ল আচ্ছা গুড গার্লটার নাম কি ?
– আমি স্নিগ্ধা ।
– চমৎকার নাম ।
– তোমার নাম কি ?
– আমার নাম আতিক , আচ্ছা গল্প শুনবে ?
– তোমার নাম টা ও সুন্দর , আঙ্কেল তুমি গল্প শোনাবে ?
– শোনাবো তো , বলেই আতিক হুম ইরিনের চিরচেনা সেই নিউরোলজিস্ট বাবু গল্প বলা শুরু করলো ।
মন দিয়ে গল্প শুনতে লাগলো স্নিগ্ধা ওদিকে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ডাক্তার ইরিনের স্যালাইন লাগিয়ে দিল ।
বের হয়ে টাকা নেওয়ার পর চলে যাবে এমন সময় স্নিগ্ধা ছুটে এসে বললো “ডাক্তার আঙ্কেল মামনি চোখ খুলেছে ” ।
– স্যার একবার কি দেখে যাবেন ?
– চলো তবে দেখেই যায় ।
বলে দুজনে আবার রুমে প্রবেশ করলো রুমে ঢুকতেই আতিক যেন বড়সড় একটা শক পেল বিছানায় ক্লান্ত দৃষ্টিতে শুয়ে আছে চিরচেনা সেই অপরিচিতা ।
আতিক কাছে আসতেই ইরিন ও যেন অবাক হলো ছয় বছর আগে বাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার যেন আবার ও পুনরাবৃত্তি ঘটে গেল ।
নিউরোলজিস্ট বাবু !
অপরিচিতা !
দু’জনেই যেন খুব শকড এভাবে আবার দেখা হবে কেউ ভাবতে পারে নি ।
কেমন আছেন অপরিচিতা ?
– নামটা মনে আছে এখনো !
– কিছু নাম না চাইলেও ভোলা যায় না ।
আতিক তুমি কি চেনো এনাকে ?
জ্বি স্যার ।
আচ্ছা আপনি শুনুন প্রেশার তো অনেক লো আপনার ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করুন নিজের যত্ম নিন আর স্যালাইন টা দেওয়া শেষ হলে কিছুটা সুস্থতাবোধ করবেন এখন আমি আসছি ।
– জ্বি আচ্ছা ।
-আতিক তুমি যাবে ?
– নিউরোলজিস্ট বাবু একটু পর যান আপনি ।
– স্যার আমি একটু পর আসছি ।
ডাক্তার চলে গেল , ইরিনের পাশে একটা টুল টেনে বসে পড়লো আতিক ।
অপরিচিতা এখনো আগের মতোই বেখেয়ালী নিজের প্রতি ?
– ইরিন হেসে বললো “না নিউরোলজিস্ট বাবু এখন আমার মেয়ে আমাকে সামলে রাখে” ।
– স্নিগ্ধা তোমার বেবি !
– হুম পিচ্চি বুড়িটার সাথে আলাপ হয়েছে ?
– ভিষণ ভালো একটা মেয়ে ঠিক যেন তোমার অবয়ব । আচ্ছা এখন আপনার কি অবস্থা এখানে কেন এতো বছর পরে ?
– ভাগ্যের টানে আবার এখানে , লেকচার হয়ে জয়েন করেছি আমাদের ডিপার্টমেন্টে আপাতত এখানেই স্থায়ী ।
– সৌমিক কেমন আছে অপরিচিতা ?
– তার খবর জানা হয় নি সবার বারন শর্তেও এতো বছর পর খোঁজ জানতে চাইছি দেখা যাক শেষ পর্যন্ত যদি একটা খোঁজ পাওয়া যায় ।
– আপনি একা একা এভাবে এতোটা দিন !
আমার মায়ের কথার জন্য আমিও লজ্জ্বিত মাফ করে দিয়েন অপরিচিতা নয়তো আপনাকে আমি কখনো হারিয়ে যেতে দিতাম না ।
– অযাথা কেন আন্টির নামে এভাবে বলছেন উনি গুরুজন আমাদের ভালো চাই সবসময় একদম এভাবে বলবেন না , আপনার কি খবর বলুন ?
– আমার আর অবস্থা বিয়ে করেছি বছর চারেক একটা ছেলে হয়েছে ।
– আলহামদুলিল্লাহ , ডাবল মিষ্টি কিন্তু পাওনা রইলো নিউরোলজিস্ট বাবু ।
– একদিন আমাদের বাসায় আসুন না
– অবশ্যই যাবো মিষ্টি খেতে হবে তো । বলেই দুজনে হেসে উঠলো ।
বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আতিক বেরিয়ে এলো । কিছু ভালো লাগা আতিকের ও কাজ করছে অনেক দিন পর ইরিন কে ফিরে পেয়ে চলতে চলতে আনমনেই বলে উঠলো-
“অপরিচিতা আপনাকে প্রেয়সী হিসেবে পায় নি ঠিকই কিন্তু একটা বন্ধু হিসাবে পেয়েছি বন্ধুত্বের বন্ধনে আমি আগলে রাখবো । প্রয়োজন নেই সব ভালোবাসা শুধু প্রেমিকা কেন্দ্রীক হোক কিছু ভালোবাসা বন্ধু কেন্দ্রীক হোক ” ।
এতো দিন পর ইরিনের বেশ ভালো লাগলো আতিক কে দেখে, ইরিন তার বন্ধুকে ভালো থাকতে দেখে অনেক খুশি হলো ।
“কিছু সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের গন্ডিতে আটকে রাখা উচিত এর বেশী এগোতে গেলে সম্পর্ক গুলো হারিয়ে যায়” ।
আতিক আর ইরিন তেমনই একটা স্বার্থহীন বন্ধুত্বের জন্ম দিয়েছে ।
ভোর হতেই ইরিন নাস্তা তৈরি করে স্নিগ্ধাকে খাইয়ে রেডি করে দিল ।
– কোথায় যাচ্ছি আমরা মামনি ?
– একটা অপরিচিত মানুষ কে খুঁজতে মাম্মাই ।
হুম ইরিনের কাছে এই সৌমিক অপরিচিত তাই সে পরিচিত সৌমিকের ভীড়ে অপরিচিত সৌমিকটা কে খুঁজতে যাচ্ছে ।
ইরিনের কেন জানি মনে হলো আলো কে একটা বার জানিয়ে দিতে ডায়াল করে আলোর নাম্বার টা বের করলো।
– ইরিন এতো সকালে তোর ফোন সব ঠিক আছে তো ??
– হুম আলো সব ঠিক আছে একটা খবর জানতে ফোন দিলাম ।
– বল না কি হয়েছে ?
– আমি শেষ বারের মতো বরিশাল যাচ্ছি সৌমিক কে খুঁজতে ।
– শেষ ডিসিশন তবে এটাই তুই যাবি ?
– হুম ।
– বাস কয়টাই ছাড়বে ?
– নয়টাই আচ্ছা আমি রাখছি এখন ।
– একটা কাজ করতে পারবি ?
– বল
– আরেকটা টিকিট বুক দিবি আমিও যাবো ।
– পাগল নাকি ভাইয়া কি বলবে ।
– আমি তোর ভালো খারাপ প্রতিটা সময়ে তোর পাশে থাকতে চাই আর রইলো বাকি তোর ভাইয়া সে একদম অন্য রকম ও নিয়ে ভাবিস না ।
ইরিন মনে মনে বেশ খুশি হলো এতোটা দিন পরেও বন্ধুত্বের এতোটা টান দেখে , মিথিকে বড্ড মিস করতে লাগলো আজ আলো আসলে একটা খোঁজ নিতে হবে ।
মিনিট ত্রিশের মধ্যেই আলো পৌঁছে গেল বাস স্ট্যান্ডে কেমন যেন মনটা একটু খারাপ বিপদের আঁচ করতে পেরেই কিছু ভালো লাগছে না কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে আজ ও ইরিন কে একা ছাড়তে ইচ্ছে হলো না ।
– কেমন আছো আন্টি ?
– ভালো স্নিগ্ধা মামনি তুমি কেমন আছো ?
– অনেক ভালো অনেক দিন পর আমরা ঘুরতে যাচ্ছি ।
– হুম মামনি ।
ইরিন শেষ পর্যন্ত যেয়েই ছাড়ছিস পারবি তো নিজেকে সামলে রাখতে ?
আজ যতোবড় সত্যি আমার সামনে আসুক না কেন আমি মেনে নেব আলো , আমার এতো দিনের জার্নিটা সহজ ছিল না আজ ও যে সহজ কিছু ঘটবে তা আমি আশা করছি না আলো ।
যেদিন শুনেছি সৌমিক বেঁচে আছে সেদিনই বুঝেছি আমার পৃথিবীর কোনো অংশে সৌমিক হয়তো ছিলই না তবু শেষ একবার তার মুখোমুখি হতে চাই তাই অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত ।
আলো ইরিনের বাহু তে হাত দিয়ে বললো “আমি আছি ইরিন তোর পাশে ” ।
বাসে উঠে পড়লো সবাই পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা লেগে গেল । সারাটা দিনে তিনজনই ভীষণ ক্লান্ত একটা হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল খাওয়া দাওয়া সেরে নিল ।
আলো তাড়াতাড়ি কর আমরা এখনই বের হবো ।
– এখনই ?
– হুম রে আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না ।
আচ্ছা ঠিক আছে ।
ঠিকানা পরিচিত থাকার কারণে আর চিনতে দেরি হলো না পৌঁছে গেলো নির্দিষ্ট ঠিকানায় ইরিন ভয়ে যেন চুপসে গেছে বুকের হৃৎপিণ্ড টা অনেক দ্রুত চলছে ।
হাত কাঁপছে ইরিনের তাই কলিং বেলে হাত দিতে পারছে না আলো কে ইশারা করলো ।
আলোর মনে ভয় করছে ইরিন পারবে তো সব মেনে নিতে এসব ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলে হাত দিল । কিছুক্ষণ পর দরজা খুললো চিরচেনা সেই মুখ ইরিন এতোটা অবাক হলো হতভম্ব হয়ে গেল ।
– মিথি !
– ইরিন তুই !
আলো মিথির দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলো না । – মিথি তুই এখানে কেন ?
মিথির মুখে কোনো কথা নেই পেছন থেকে আরেকটা চিরচেনা মুখ থেকে আওয়াজ এলো
– দরজায় কে মিথি ?
কারোর মুখে কোনো কথা নেই স্নিগ্ধা বলে উঠলো মামনি এটাই তোমার ছবিতে দেখানো সেই প্রিয় আন্টি টা তাই না ?
সবাই স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো । ততক্ষণে সৌমিক মিথির আওয়াজ না পেয়ে বেরিয়ে এলো । সবাই যেন এক বিন্দুতে থেমে গেছে , ইরিন চোখ থেকে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়লো ।
– সবাই কান্না করছো কেন ?
– ইরিন চোখ মুছে বললো কিছু না মাম্মাই।
ভেতরে আসতে বলবে না সৌমিক ?
সৌমিক পথ ছেড়ে দিল আসার জন্য ইশারা করলো , ওরা সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো কারোর মুখেই কোনো কথা নেই ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসিয়ে দিল সবাই কে ।
সৌমিক এবার নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করলো “কেমন আছো ইরিন” ?
বুকের ভেতর টা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল সবটা চাপা রাখতে গেল কিন্তু চোখটা বেইমানি করে বসলো চোখ মুছে জবাব দিলো “ভালো আছি আপনি কেমন আছেন” ?
– ভালো আছি তোমার আতিক কেমন আছে ? আর তোমাদের বাচ্চা ঐ টা ?
ইরিনের মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো সৌমিকের এমন সব কথা শুনে ।
– কি বলতে চাইছেন আপনি ? কি ইংগিত করছেন ?
– আমি তো কোনো ইংগিত করছি না তুমি যা করেছো তাই বলছি ।
ইরিন এতো অবাক হচ্ছে সৌমিকের কথায় যে কিছুই বুঝতে পারছে না অপর দিকে আলো চুপচাপ বসে আছে আর মিথি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
– আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না আর মিথি তোর পরিচয় কি এই বাড়িতে ?
– মিথি গোমড়া মুখেই বললো আমি এই বাড়ির বউ ।
এতো দিনের বিশ্বাসের সাজানো পৃথিবীটা মনে হলো কেউ যেন টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়ে গেল , ইরিনের চোখের পানি আর থামছে না আটকানোর চেষ্টা ও করছে না ।
আলো বলে উঠলো “তোকে আগেই বলেছিলাম মানুষ রূপের অমানুষ গুলোকে সহ্য করতে পারবি না সেই তো কথা না শুনে তোর সৌমিক কে খুঁজতে আসলি এরা কেউ মানুষ না দেখার সাধ মিটে গেলে চল এবার” ।
ইরিন চোখ মুছে বললো “আমার কিছু প্রশ্ন আছে সৌমিকের কাছে সেগুলো জানা হয়ে গেলে চলে যাব” ।
আচ্ছা সৌমিক এভাবে আমাকে ছেড়ে গেলে কেন বলতে পারো ?
– তোমার ব্যাপারে সবটা জানার পর ।
– আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম সেটা কি আমার অপরাধ ছিল?
– না আমি তোমাকে অনেক ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম ইরিন সেটা আমার অপরাধ ছিল ।
সেদিন যদি বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মিথি আমাকে সত্যি গুলো না বলতো তবে হয়তো তোমার পেটের বাচ্চাকে আমাদের বাচ্চা ভাবতাম ।
– এতোটা বিশ্বাস ঐ মিথির উপর ?
– কেন হবে না সবটা জানার পর যখন আমি একটা ঘরে বন্দি হয়ে গেছিলাম , ড্রাগ অ্যাডেক্টেড হয়ে পড়েছিলাম আমাকে অন্ধকার জীবন থেকে মিথি হাত ধরে টেনে বের করেছিল ।
– একটা বার আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পরে নি তোমার ?
– ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু যখন জানতে পেলাম তুমি নাকি খুব সুখেই আছো আতিক নামের ছেলেটার সাথে আমি হারিয়ে যাওয়ার পর তখন আর ইচ্ছে হয় নি তোমার খোঁজ নেওয়ার যোগাযোগ রাখার আর কোনো কথা শোনার ।
– মিথি কিভাবে পারলি রে ? আমার এতো বছরের ভালোবাসা টা এক নিমিষেই শেষ করে দিতে ?
কেন করলি আমার সাথে এমন ??
রাতুল ভাইয়ের জন্য ও কি তোর একটা বার বুক কাঁপে নি ?
মিথি চুপ করে আছে কোনো কথা নেই মুখে ।
ইরিন ও আর কি বলবে নিজের পাপের কথা নিজেই স্বীকার করেছে আমাকে ।
– মিথি কে কোনো অপবাদ দেবে না আলো অপরাধী যে তাকে বলো ।
– সেদিন ও আমাদের কথা বিশ্বাস করেন নি আজ ও যে আপনি বিশ্বাস করবেন সেই আশা করছি না । ইরিন যে আপনার মতো একটা ছেলেকে এখনো ভালোবাসতে পারে এটা আমি বুঝি না ।
– থাক আলো আর কিছু বলিস না আমার আর নিউরোলজিস্ট বাবুর নামে এতোবড় মিথ্যে কলংক লাগবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি ।
সৌমিক আমার আর কিছু বলার নেই তবে কিছু প্রমাণ করার আছে তারপরেই আমি চলে যাব জীবনে আর কখনো তোমাদের পথে আসবো না ।
– সরি ইরিন আমার কিছু জানার নেই ।
– কিন্তু আমার আছে শুধুমাত্র আমার বন্ধু র গায়ে যে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছো তা উঠাতেই আমার প্রমাণ দেওয়া দরকার আছে নয়তো আজ তোমার বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে কোনো যায় আসে না আমার ।
– মিথি জীবনে অনেক উপকার করেছিস বোন আর একটাবার না হয় কর আমার সাথে তোরা সবাই চল একবার সৌমিক শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ করো প্লিজ ।
– কেন জোর করছো ইরিন ।
– শেষ বার বলেছি তো !
মিথির মুখে কোনো কথাই নেই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে এবার । সবাই মিলে চললো বরিশালের সিটি হসপিটালে ।
সৌমিক খুব অবাক হলো “হাসপাতালে কেন” ?
– বললাম যে প্রমাণ করার আছে ।
ইরিন ঠিকানা জেনে ডি এন এ টেস্ট করানোর বিভাগে চলে গেল । গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বললো সৌমিক কে সাথে নিয়ে এটাও বললো রিপোর্ট খুব তাড়াতাড়ি চাই এর জন্য এক্সটা পেমেন্ট করতে রাজি ।
ডাক্তার বললো দেরি করে হলেও চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে ।
আমরা অপেক্ষা করতে রাজি আছি ডাক্তার ।
প্রথমে স্নিগ্ধা কে নিয়ে যাবে – মামনি আমার খুব ভয় করছে ।
– মাম্মাই তুমি মামনির সাহসী মেয়ে না ?
– হুম তো ।
– সাহসী মেয়েরা কিন্তু ভয় পেতে নেই ।
বলেই ইরিন সাথে গেল স্নিগ্ধার ।
সৌমিক দেখলো কি মিষ্টি মেয়েটা । তবে অনেক বেশি অবাক হয়ে গেল যে ইরিন কেন নিজের অপরাধ কে সবার সামনে আনতে চাইছে !
কি প্রমাণ করতে চাইছে ইরিন তবে কি .. না আর কিছু ভাবতে পারছে না সৌমিক সব কিছু এলোমেলো লাগছে । এতো বছর পরে সে সামনে এলো কিন্তু এ কোন নতুন ঝড় সাথে নিয়ে ।
কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধাকে নিয়ে ফিরে এলো ইরিন সাথে ওর নিজের পরীক্ষা করার জন্য যা যা করার দরকার করে এসেছে এবার সৌমিকের পালা ।
– সৌমিক ও এবার শেষ টা দেখতে চায় তাই চলে গেল পরীক্ষা করাতে ।
– ভালো লাগছে তো এখন মিথি ? একটু পর তোর সব কথা জেনে যাবে সৌমিক ভাই পারবি তো নিজেকে ঠিক রাখতে ? সত্য কখনো চাপা থাকে না ।
সবাই ওয়েটিং রুমে বসে আছে । স্নিগ্ধা চেয়ারের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে । বাকি চারজন ঠাঁই বসে আছে কারো চোখে ঘুম নেই ।
রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ এর দিকে রিপোর্ট এলো ।
– ডাক্তার আপনি একটু শোনান রিপোর্ট এ কি লেখা আছে ?
রিপোর্টে বাচ্চার ডি এন এ র সাথে আপনাদের দুজনের ডি এন এ হান্ড্রেট পার্সেন্ট ম্যাচ করেছে ।
সৌমিকের মাথায় যেন এবার আকাশ ভেঙ্গে পড়লো “ডাক্তার কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার ঠিক করে দেখুন ” ।
“বিশ্বাস না হলে আপনি দেখুন বা অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়ে রিপোর্ট দেখাতে পারেন আসছি আমি”
সৌমিক পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো মাথাটা যেন বনবন করে ঘুরছে ।
সৌমিক আমার বাচ্চা আর আমি কোনো টাই মিথ্যে ছিলাম না এখন আমার আফসোস হচ্ছে স্নিগ্ধা তোমার রক্ত । সম্পূর্ণ টা কেন শুধু আমার হলো না ।
ইরিন কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না , মিথি অনেক চুপ থেকেছো আর না এবারে তুমি বলো ।
ও কি বলবে সৌমিক ভাই এবার বাকিটা আমি বলি ও যে ইরিন কে হিংসে করতো তা ইরিন একা হওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছি , ইরিনের পড়া লেখা, ভার্সিটির একজন টপ বয় একজন ইরিনের স্বামী এটা আর সহ্য করতে পারে নি মিথি ইরিনের হল থেকে বের করে দেওয়ার পেছনে হাত শুধু মাত্র ওর ছিল পরে ও নিজেই স্বীকার করেছে ।
আমাদের বরিশাল আসার দিন হঠাৎ ই ওর পেট ব্যাথা শুরু হয়ে যায় তারপর আর যায় না আমাদের সাথে হল সুপারের কাছে যা নয় তাই বলেছিল সেদিন ইরিনের নামে পরে জানতে পেরেছি এক মেয়ের কাছ থেকে ।
আতিক ভাইয়ার কাছে পাঠানোর আইডিয়া টা আমার ছিল কিন্তু কে জানত সেটার সুযোগ নেবে ও আমরা ভালো ভেবেছিলাম আর ও আপনার কাছে ইরিন কে খারাপ করে বর্ণনা করেছিল। আমরা হেল্পলেস ছিলাম আর ভরসার এক মাত্র স্থান ছিল আতিক ভাইয়া কিন্তু ইরিনের ভাগ্যের ফেরে ঐ জায়গা ও ছাড়তে হয় ইরিন কে উনার মায়ের জন্য । বাড়ি তো আগেই ছেড়েছিল তার পর ঐ অবস্থায় ইরিন এই শহর ছেড়ে চলে যায় ।
তবে শুনেছি পরীক্ষা গুলো সম্পূর্ণ করেছিল যদিও আমরা আর ওর দেখা পায় নি ।
সৌমিকের চোখেও এবার পানি জমে এসেছে । এসব আগে আমাকে বলো নি কেন ইরিন ?
বলতে গিয়েছিলাম ভাইয়া আপনি শুনতে চান নি তাই আর বলিনি ।
আরো একটা স্ট্রং প্রুফ আছে আমার কাছে , আপনার সতি সাবেত্রী স্ত্রীর মুখের বয়ান।
” আলো আর না” ।
“থাম ইরিন সৌমিক ভাই খুব তার বউয়ের গর্ব করছিল শেষ টা তার জানা উচিত” বলেই আলো ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভয়েস রেকোডিং টা শোনালো সবাই কে ।
যেখানে অবলীলায় নিজের দোষ স্বীকার করেছে মিথি ।
মিথি কান্না করেই যাচ্ছে , আর ইরিন যেন পাথর হয়ে গেছে । একেই মনে হয় বলে “অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর” ।
হঠাৎ ইরিনের পায়ের কাছে এসে বসলো সৌমিক ইরিন কোনো ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো না ।
– ইরিন আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ ।
– সরে যাও সৌমিক আমি সাত বছর আগের ইরিন না আমি এখন একজন মা।
– আমি তোমাকে আর আমার মেয়েকে ফিরে পেতে চাই ।
ইরিন চেঁচিয়ে বলে উঠলো খবরদার সৌমিক আমার মেয়েকে ভুল করেও বলবে না তোমার মেয়ে , তোমার মতো এমন জঘন্য মানুষের কাছে যে আমি আর আমার মেয়ে নেই সেটাই আমাদের সৌভাগ্য ।
আমার মেয়ে কে আমি আমার আদর্শে বড় করেছি ভুল করেও তোমার মতো মানুষের ছায়া আমি আসতে দেব না ।
আর মিথি ভালো থাকবি দোয়া করি কিন্তু মনে রাখিস পরের জন্য গর্ত খুড়লে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয় , চাইলে তোকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে পারতাম কিন্তু তোর মতো নিচে নামতে আমার রুচিতে বাধে ।
ইরিন আমি ভুল বুঝেছিলাম আমাকে মাফ করে দাও ।
– তোমার কোনো গুরুত্বই নেই আমার জীবনে মাফ তো অনেক দূরের কথা ভালো থেকো ।
আর ধন্যবাদ আমাকে সিঙ্গেল মাদার বানানোর জন্য নয়তো আমি কখোনোই বুঝতে পারতাম না একটা সিঙ্গেল মাদারের দুঃখ কষ্ট গুলো, বুঝতে পারতাম না তাদের পৃথিবীটা কতোটা বিভীষিকাময় অন্ধকারে পূর্ণ । আমাদের সমাজে সিঙ্গেল মাদারের কোনো দাম নেই কিন্তু আমি গর্বিত আমি একজন সিঙ্গেল মাদার । একদিন প্রমাণ করে দিব আমি আমার সন্তান আমাদের সমাজের অভিশাপ নয় আলোক বর্তিকা ।
আসছি বলেই ইরিন বেরিয়ে এলো স্নিগ্ধা আর আলো কে নিয়ে ফিরে তাকায় নি আর জীবনের ফেলে আসা কঠিন অধ্যায়ে ।
( আমার কাঁচা হাতের লেখা গল্প আপনারা সবাই অনেক ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন অনেক ধন্যবাদ সবাইকে , আপনাদের অনুপ্রেরণাতেই শেষ করতে পেরেছি । আপনারা এভাবে পাশে থাকবেন যেন আমি লিখতে পারি আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমার লেখার শক্তি , যারা চুপি চুপি পড়েন তারাও বলে যাবেন কেমন হয়েছে । )